স্তন পান করানো হল একটি অত্যন্ত জরুরী প্রাকৃতিক এবং সহজাত অভ্যাস তবে এটি আবার মা এবং সন্তান উভয়ের জন্যই একটি শিক্ষণীয় প্রক্রিয়া।স্তন পান করানো আপনার সন্তানকে অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা প্রদানের পাশাপাশি আপনার এবং আপনার সন্তানের মধ্যে একটি বিশেষ বন্ধন গড়ে তুলতে সহায়তা করে এবং তা ছাড়াও আবার এটি শিশুর পর্যাপ্ত শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করে।
নবজাতকদের জন্য স্তন দুধ নিশ্চিত ভাবে একটি সর্বশ্রেষ্ট স্বাস্থ্যকর খাদ্য।আপনার সন্তানের খাওয়ার জন্য এটি হল সবচেয়ে সেরা এবং সুরক্ষিত খাদ্য।শিশুদের প্রথম 6 মাস বিশেষভাবে স্তন পান করানোর জন্য কেন সুপারিশ করা হয়ে থাকে তার কয়েকটি কারণ এখানে উল্লেখ করা হলঃ
স্তন পান করানো শুরু করার পূর্বে আপনার এবং আপনার সন্তানের উভয়ের জন্যই একটা স্বস্তিদায়ক বা আরামদায়ক অবস্থানে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।আর সেটি বেছে নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি অবস্থান রয়েছে এবং আপনার নার্স বা স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারী এক্ষেত্রে আপনার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত হতে পারে এমন একটি অবস্থান বাছাই করতে আপনাকে অবশ্যই সহায়তা করবেন।একটি আরামদায়ক অবস্থান বলতে বোঝায় যেখানে আপনি কিছু সময়ের জন্য কোনওরকম অস্বস্তি ছাড়াই থাকতে পারেন এবং আপনি স্তন পান করানোর সময় শিশুর সাথে আবার চোখের যোগাযোগও করতে সক্ষম হন।
এখানে শিশুদের স্তন পান করানোর অত্যন্ত সাধারণ কয়েকটি অবস্থানের উল্লেখ করা হলঃ
স্তন পান করানোর সাথে সাথে বাচ্চার দিকে নজর রাখা এবং সে যে যথাসম্ভব অ্যারিওলার কলাটিকে চোষণ করছে তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
বাচ্চাকে কীভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো যায় সে সম্পর্কে একটি ভাল বোঝাপড়া কাজটিকে আরও সহজ করে তোলে।
বাচ্চাটিকে আপনার কাছাকাছি এমনভাবে ধরুন যাতে সে আপনার স্তনের মুখোমুখি থাকে।আপনার স্তনবৃন্তটিকে তার উপরের ঠোঁটে স্পর্শ করান এবং যেই মুহূর্তেই সে তার মুখটিকে খুলবে তৎক্ষণাৎ তাকে আপনার স্তনের উপর টেনে নিন।আপনার স্তনবৃন্তের চারপাশের গাঢ় অ্যারিওলার অঞ্চলটির বেশিরভাগ জায়গাটি জুড়েই যাতে শিশুটির মুখটি আবৃত থাকে সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করুন।
একবার খাওয়ানো শুরু করলে সেটি মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক না হয়ে ওঠাকে নিশ্চিত করুন।খাওয়ানোর পরে হয়ে থাকা যেকোনও কোমলতার দিকে মনোযোগ দিন।যদি শিশুটি সঠিকভাবে চোষণ করে তবে সেক্ষেত্রে স্তনবৃন্তের চারপাশের গাঢ় অ্যারিওলার অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশটিই শিশুটির মুখের ভিতরে থাকবে এবং আপনার স্তনবৃন্তে চোষণ করার অনুভূতি অনুভূত হবে।
শিশু স্তনবৃন্ত চোষণ করার সময় যদি আপনার ব্যথা লাগে তবে শিশুটির মুখ এবং আপনার স্তন বৃন্তের মাঝে একটি আঙ্গুলের দ্বারা বাঁধার সৃষ্টি করে শিশুটিকে স্তনবৃন্ত থেকে অসংলগ্ন করার মাধ্যমে খাওয়ানোর প্রক্রিয়াটিতে একটা সাময়িক বিরতি আনুন।
আরামদায়ক এবং যথাযথভাবে অবস্থান করা হয়ে গেলে আপনি পুনরায় খাওয়ানো শুরু করতে পারেন।
আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী যেটি আপনার সুবিধা হয় সেটি খুঁজে বের করার জন্য আপনি স্তন পান করনোর বিভিন্ন অবস্থানগুলি প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারেন।এখানে তারই কয়েকটি দেওয়া হল যেগুলি আপনি বিবেচনা করতে পারেনঃ
এটি স্তন পান করানোর খুব সাধারণ একটি অবস্থান যা ভালভাবে ঘাড়ের নিয়ন্ত্রণ করতে পারা শিশুদের পক্ষে আরামদায়ক।
স্তন পান করানোর বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে অর্ধশায়িত অবস্থায় বাচ্চাকে ধরে রেখে খাওয়ানোটি হল এমন একটি অবস্থান যেখানে মা তার শিশুর সাথে আড় হয়ে বা হেলান দিয়ে অর্ধ শায়িত অবস্থায় তার স্তনের দিকে মুখোমুখি করে তার ধড়ের উপরে শিশুটিকে ধরে রাখেন।কৌশলটি শিখতে এবং স্তনের উপর চোষণ করতে শিশুটি কিছুটা সময় নিতে পারে।
এটিকে ক্রসওভার হোল্ডও বলা হয়ে থাকে, যেখানে মা তার একটি হাত দিয়ে তার বাচ্চাটিকে ধরে থাকতে পারেন।
এই কৌশলটি প্রয়োগের চেষ্টা করার পরামর্শ দেওয়া হয় সেই সকল মায়েদের যারা সিজারিয়ান পদ্ধতির দ্বারা সন্তান প্রসব করেছেন অথবা যারা বৃহৎ স্তনের অধিকারিণী হয়ে থাকেন।এছাড়াও আবার এই প্রক্রিয়ায় অকাল প্রসবিত শিশুদেরও খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
যমজ সন্তানের মায়েরা তাদের সন্তানদের হয় পৃথকভাবে অথবা একই সময়ে একইসাথে তাদের সন্তানদের খাওয়াতে পারেন।পরবর্তী ক্ষেত্রে,আপনার সন্তানদের প্রতিটি স্তন থেকে চোষণ করার জন্য আপনি এই অবস্থানটি চয়ন করতে পারেন।
নবজাতকে খাওয়ানোর সময় এই অবস্থানটি মাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়।এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা দক্ষতার প্রয়োজন আছে কিন্তু একবার শিখে গিয়ে অনুশীলন করা শুরু করলেই সাধারণত বেশিরভাগ মায়েদের কাছেই এটি বেশ পছন্দের একটি অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়।এটি আবার সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করে থাকা মায়েদের জন্যও উপযুক্ত।
বিভিন্ন অধ্যয়ন এবং আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাগুলি শিশুদের অন্তত প্রথম ছয় মাসের জন্য কোনওরকম জল, খাদ্য সম্পূরক, ফলের রস, দুধ অথবা খাবার সরবরাহ না করে টানা একভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়।আর স্তন পান করানোর ক্ষেত্রে এর বর্ধিত সময়কাল হিসেবে বারো মাস পর্যন্ত সময়সীমাকে নিরাপদ হিসেবে সুপারিশ করা হয়ে থাকে।
জন্মের পরেই প্রথম খাওয়ানোতে সাধারণত দুধের পরিবর্তে কোলোস্ট্রাম(মায়ের বুকের প্রহম হলদেটে দুধ)থাকে,যা হল অ্যান্টিবডি দ্বারা সমৃদ্ধ একটি হলদেটে জলীয় তরল বিশেষ যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।কয়েক দিনের মধ্যেই নিয়মিত খাওয়ানোর জন্য এটি দুধে পরিণত হয়ে যায়।একটি সাধারণ চিন্তা যেটি থেকে থাকে তা হল শিশুটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলো কিনা।আপনি যদি তাকে তার চাহিদা অনুযায়ী খাইয়ে থাকেন এবং সে যদি সময় মত তার প্রস্রাব ত্যাগ করে থাকে ও প্রতিদিন প্রায় 7-8 বার মল ত্যাগ করে এবং সেটি যদি হলুদ বর্ণের এবং আধা শক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে,তবে নিশ্চিত হন যে ভালভাবেই তার খাওয়া সম্পাদিত হয়েছে।
তবে আপনার বাচ্চার মধ্যে যদি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা যায়,সেক্ষেত্রে আপনার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করা উচিতঃ
নবজাতককে স্তন পান করানোর কোনও নির্দিষ্ট সময় সংখ্যা নেই,তবে সাধারণত একটি স্বাস্থ্যকর বাচ্চাকে দিনে 8 অথবা তার বেশি বার খাওয়ানো হয়ে থাকে। আপনার বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী তাকে খাওয়ানোর অনুশীলন করানোই সবচেয়ে ভাল।অতিরিক্ত খাওয়ানো ক্ষতিকারক হতে পারে যা এড়ানো উচিত।
একটি ক্ষুধার্ত শিশু সাধারণত অস্থির হয়ে উঠবে,অতিরিক্ত মাত্রায় কাঁদবে এবং তার আঙ্গুল অথবা বুড়ো আঙ্গুল চুষতে থাকবে কিম্বা তার চোখ–নাক–মুখ ঘষতে থাকবে।এই লক্ষণগুলি হল আসলে নবজাত শিশুকে স্তন পান করানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস যা কখন আপনার শিশুকে খাওয়ানোর প্রয়োজন আছে তা বুঝতে আপনাকে সহায়তা করতে পারে।
স্তনপান করনো একটি সিজারিয়ান পদ্ধতির দ্বারা সাধারণত প্রভাবিত হয় না।যদিও শল্যচিকিৎসার শারীরিক চাপ এবং এর জন্য পরিচালিত ওষুধগুলি আপনার সন্তানের স্তন পান করার ক্ষেত্রে কিছুটা বিঘ্ন ঘটাতে পারে,তবে সন্তানের জন্ম দেওয়ার কয়েক ঘন্টা অর্থাৎ মোটামুটি 6-12 ঘন্টা পর থেকেই আপনাকে বার বার যতটা সম্ভব ঘন ঘন স্তন পান করানোর জন্যই পরামর্শ দেওয়া হয়।আর একবার সেটি শুরু করে দিলেই দুধের সরবরাহ হওয়া নিশ্চিত করবে এবং স্তন পান করানোর ক্ষেত্রে আর কোনও সমস্যার সৃষ্টি হওয়া উচিত নয়।এর জন্য আপনার সন্তানকে ঠিকঠাক অবস্থানে আনার জন্য আপনি আপনার সঙ্গীর সহায়তা নিতে পারেন।এবং আপনার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আপনি দোলনার মত করে ধরে রাখার কৌশল,পাশে খাওয়ানোর কৌশল অথবা ফুটবলের মত ধরে রাখার অবস্থানকে বেছে নিতে পারেন।
একজন .স্তন পান করানো মায়ের একটি সুষম ডায়েট ব্যতীত আর বিশেষ তেমন কিছুই প্রয়োজন হয় না যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হলঃ
যে কোনও পরিস্থিতিতেই একজন স্তন পান করানো মায়ের ধূমপান এবং মাদক দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা উচিত।
এর জন্য নার্সিং ব্রা কেনার পরামর্শ দেওয়া হয় যেহেতু এগুলি আপনার স্তনকে ভালভানে সমর্থন করে।বার বার খাওয়ানোর জন্য চেন এবং হুকের সাথে এই ব্রাগুলি প্রকৃতই আরামদায়ক।সম্পূর্ণ রূপে খোলা যায় এমন বেষ্টনীর সাথে মানানসই হয়ে বসে এমন ধরনের ব্রা ব্যবহার করাই আপনি নিশ্চিত করুন।যদি কোনও ক্ষেত্রে স্তন অপ্রতুলভাবে উদ্ভাসিত হয় বা প্যাডগুলি স্তনের উপর চাপ প্রয়োগ করে তবে এটি দুগ্ধ নালীকাগুলিকে অবরুদ্ধ করে দিতে পারে যার ফলে ম্যাসটাইটিস (স্তনের কলার প্রদাহ) সৃষ্টি হতে পারে।
অক্সিটোসিনের প্রতিক্রিয়ার কারণে আপনার স্তনগুলি থেকে দুধ লিক করতে পারে,নিজেকে শুষ্ক এবং আরামদায়ক রাখার জন্য ভ্রমণ করার সময় পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এমন ব্রা এর প্যাড পরিধান করুন। পারে।রাত্রে পরিধানের জন্য হালকা ব্রাগুলিও আবার উপলভ্য।অতিরিক্ত দুধের প্রয়োজন হওয়ার ক্ষেত্রে স্তন পাম্প করা সহায়ক হতে পারে।
নিম্নলিখিত পরিস্থিতিগুলির ক্ষেত্রে স্তন পান করানো জটিল হয়ে উঠতে পারে।
একজন নতুন মায়ের জন্য বুকের দুধ পান করানো হল একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প।অনুশীলন,সচেতনতা এবং ধৈর্যের সাথে আপনার বাচ্চাকে খাওয়ানো একটি ঝামেলা মুক্ত উপায়ে সম্পন্ন করা যেতে পারে।একবার আপনি এটি প্রয়োগ করা শুরু করলে উপলব্ধি করতে পারবেন যে,বুকের দুধ হল এমন একটি শ্রেষ্ঠ জিনিস যা বাচ্চার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার কারণে একজন মা তার নবজাত শিশুটির মুখে এটিকে উপহারস্বরূপ তুলে দিতে পারেন।