শিশু

স্তন পান করানোর সময় গলা ব্যথা-প্রতিকারসমূহ এবং অবলম্বনকারী সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনাগুলি

একজন স্তনদানকারী মায়ের অসুস্থ এবং অবসন্ন হয়ে ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক,কিন্তু যখন তিনি অসুস্থ থাকেন,তখন তার সন্তানকে স্তন পান করিয়ে চলা উচিত কিনা এই দূরকল্পনা হয়ত তিনি করতে পারেন।স্তনদানকারী মায়েরা মধ্যে সংক্রমণগুলি সহজেই বাসা বাঁধতে পারে এবং তারা চিকিৎসাজনিত ব্যাধিগুলির প্রতিও অত্যন্ত ঝুঁকি প্রবণ হয়ে পড়তে পারেন।গলা ব্যথা হল এক ধরনের সংক্রমণ যেটি ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার কারণে হতে পারে,এবং একজন স্তনদনকারী মায়ের স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে।এই সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য আপনার গ্রহণ করা ওষুধগুলি আপনার দুধের মধ্যেও হয়ত প্রবেশ করতে পারে এবং স্তন পান করানোর সময় সেটি আপনার সন্তানের মধ্যেও স্থানান্তরিত হতে পারে।সুতরাং তখন আপনার কি করা উচিত?পড়ুন,কারণ আমরা এখানে আলোচনা করেছি স্তন পান করানোর সময় হয়ে থাকা গলা ব্যথার জন্য বিভিন্ন প্রতিকার,অবলম্বিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনা এবং এর সাথে সম্পর্কিত আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

গলা ব্যথা বা গলদাহের কারণগুলি কি?

আপনার গলার মধ্যে যদি যন্ত্রণা,অস্বস্তি অথবা চিঁড়ে যাওয়ার মত কিছু অনুভব করেন এবং সেটি যদি খাবার গেলার সময় অবস্থাটিকে আরও খারাপ করে তোলে,এর অর্থ হতে পারে আপনার হয়ত গলদাহ রয়েছে।এখানে এমন কিছু দেওয়া হল যেগুলি হয়ত এই অবস্থাটির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

  • কিছু বিশেষ ধরনের জ্বলন,গলায় শুষ্কতাবোধ,গলার মাংসপেশীর টান ধরা,অ্যালার্জি,GERD ইত্যাদি প্রকট হয়ে ওঠার কারণে এটির প্রকোপ আরও বেড়ে উঠতে পারে।
  • স্ট্রেপটোকক্কাস পয়জিনেসের মত ব্যাকটেরিয়ার কারণে এটি হয়ত আরও ছড়িয়ে যেতে পারে।একটি গলদাহ আবার মাঝেমধ্যে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণেরও একটি লক্ষণ হতে পারে,যেমন ডিপথেরিয়া অথবা হুপিং কাশি।
  • এটি সাধারণ সর্দিকাশি অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জার মত ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণেও হতে পারে।
  • এটি আবার অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণ যেমন চিকেন পক্স, মনোনোক্লিসিস ইত্যাদির লক্ষণগুলির মধ্যেও একটি হতে পারে।

গলদাহের লক্ষণগুলি কি?

যদি আপনার মধ্যে নিম্নে উল্লিখিত উপসর্গগুলির মধ্যে কিছু অথবা সবগুলিই প্রদর্শিত হয়ে থাকে,এর অর্থ হতে পারে আপনি হয়ত গলদাহে ভুগছেনঃ

  • গেলার সময় ব্যথা অনুভূত হওয়া
  • বর্ধিত টন্সিল
  • তীব্র মাথা যন্ত্রণা
  • জ্বর
  • দেহ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
  • সাধারণ ব্যথাবেদনা
  • একটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে কণ্ঠ্যস্বর
  • নাক থেকে জল ঝরা
  • হাঁচি হতে থাকা

গলদাহ নির্ণয় করার উপায়

গলা ব্যথার লক্ষণগুলি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে এবং আপনার গলা, চোয়াল, নাক এবং কানের শারীরিক পরীক্ষা করে আপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে বলতে সক্ষম হবেন যে আপনার গলার ব্যথা আছে কিনা।তবে, কখনও কখনও আপনার অবস্থার সঠিক কারণটি নির্ধারণের জন্য, আপনার ডাক্তারবাবু আশা করতে পারেন যে আপনি অ্যালার্জি পরীক্ষা এবং গলার সোয়াব পরীক্ষাগুলি করানো গ্রহণ করবেন।এছাড়াও আবার তিনি আপনার রক্তের সংখ্যাও পরীক্ষা করতে পারেন।

স্তন পান করানোর সময় গলদাহের চিকিৎসা কীভাবে করা যেতে পারে

স্তন পান করানোর সময় গলদাহের জন্য কি গ্রহণ করা যেতে পারে তা নিয়ে চিন্তিত?বেশ,এর চিকিৎসা পদ্ধতিটি বৃহদাকারে নির্ভর করতে পারে আপনার অবস্থাটির তীব্রতার উপর।তবে সাধারণত যে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি আপনার ডাক্তারবাবু নির্ধারিত করে থাকতে পারেন সেগুলি নিম্নরূপঃ

  • প্যারাসিটামল এবং আইবুপ্রুফেন হল এমন ধরণের কিছু ওষুধ যেগুলি বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় গলা ব্যথার জন্য গ্রহণ করা নিরাপদ।এটি ছাড়াও যদি আবার আপনার জ্বর এবং সারা দেহে যন্ত্রণা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও আপনার ডাক্তারবাবু আপনার জন্য হয়ত এই ওষুধগুলিকে নির্ধারিত করতে পারেন।আপনার গলা ব্যথা থেকে উপশম পেতে আপনার ডাক্তারবাবু আপনার গলার জন্য একটি স্প্রে নির্ধারণ করতে পারেন এবং তার সাথে আপনাকে কাশির সিরাপ খাওয়ারও পরামর্শ দিতে পারেন।
  • ডিকনজেস্ট্যান্টগুলিকে ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলি আপনার স্তন দুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।
  • স্তন পান করানোর সময়,আপনি কখনওসখনও অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধগুলিকে গ্রহণ করতে পারেন,যদি আপনার ডাক্তারবাবু এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

এগুলি হল সেই ব্যবস্থাপনা যেগুলি আপনি গ্রহণ করতে পারেন স্তন পান করানোর সময় গলা ব্যথা নিরাময়ের জন্য।তবে এটি পরামর্শ দেওয়া হয় যে,কোনওরকম ওষুধ গ্রহণের পূর্বে আপনি অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেবেন।

স্তন পান করানোর সময় গলা ব্যথার জন্য ঘরোয়া প্রতিকারগুলি

যদি ওভার দ্য কাউন্টার অথবা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধগুলি আপনার ক্ষেত্রে কাজ না করে,তবে সেক্ষেত্রে আপনি কিছু ঘরোয়া প্রতিকার অবলম্বন করতে পারেন।এখানে গলা ব্যথার জন্য বেশ কিছু ঘরোয়া প্রতিকার উল্লিখিত হলঃ

1.ক্যামোমাইল চা

ক্যামোমাইল চা পান আপনাকে গলা ব্যথা থেকে স্বস্তি দিতে পারে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।এই সুগন্ধি চা গলায় অস্বস্তি এবং যন্ত্রণা হ্রাসে ভাল ভাবে কাজ করে।

2.যষ্ঠিমধুর মূল বা মুলাঠি

এটি গলদাহ নিরাময়ের জন্য প্রাচীন একটি প্রতিকার।ময়লা এবং জীবাণুগুলি থেকে মুক্তি পেতে মূলগুলিকে যথাযথভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন,এরপর ধীরে ধীরে সেগুলিকে চূর্ণ করুন।এবার সেটিকে চিবোতে থাকুন,এর ফলে মূলের রসটি বেরিয়ে যখন আপনার গলায় পৌঁছোবে আপনি অনুভব করতে পারবেন যে আপনার ব্যথা অনেকটা লাঘব হয়েছে।

3.গরম স্যুপ এবং অন্যান্য তরল

গরম তরল পান করার ফলে তা আপনার গলার ব্যথা এবং অস্বস্তির নিরাময় করতে পারে।আপনার গলার জ্বলন ও অস্বস্তি দূর করতে গরম গরম স্যুপ এবং অন্যান্য তরলগুলি পান করুন।

4.অ্যাপেল সীডার ভিনিগার

জলের সহিত অ্যাপেল সীডার ভিনিগার মিশ্রিত করে সেটি দ্বারা গার্গেল করলে তা গলা ব্যথার উপসর্গগুলিকে দূর করতে সাহায্য করতে পারে।

Related Post

5. শ্বাসের মাধ্যমে বাষ্প গ্রহণ

অবরুদ্ধ নাক এবং গলার শুষ্কতা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনি শ্বাসের দ্বারা বাষ্প গ্রহণের চেষ্টা করতে পারেন।

6.গলার জন্য আরামদায়ক লজেন্স

আপনার গলার শুষ্কতাকে আদ্র করতে আপনি গলার উপযোগী এই আরামদায়ক লজেন্সগুলিকে ব্যবহার করতে পারেন।এছাড়াও আবার আপনি আদা চা অথবা ব্ল্যাক টি পান করতে পারেন অথবা আবার আপনার গলাটিকে পিচ্ছিল করে তোলার জন্য আপনি বরফের টুকরোর উপর চাটতেও পারেন।

7.লবণ জলে গার্গেল

আপনার গলা ব্যথা এবং অস্বস্তি কমানোর অন্যতম একটি কার্যকর উপায় হল দিনে 4-5 বার করে লবণ জলে গার্গেল করা।

8.এলেম বৃক্ষের(ইউরোপ মহাদেশে জন্মায়) ছাল

ফুটন্ত জলের মধ্যে কিছুটা এলেম বৃক্ষের ছাল ঢেলে নিয়ে আপনি এর একটি ক্কাথ বা পাচন প্রস্তুত করতে পারেন।এবার দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার এই চায়ে চুমুক দিন আপনার গলা ব্যথা এবং অস্বস্তি কমাতে।

9.মধু এবং লেবু জল

এক গ্লাস ইষৎ উষ্ণ জলের সাথে বড় এক চামচ মধু যোগ করুন এবং এর মধ্যে একটি লেবুর রসকে নিংড়ে নিন।ভাল ভাবে নাড়িয়ে নিন এবং আপনার অস্বস্তি দূর করতে উষ্ণ অবস্থায় পান করুন।

স্তন পান করানোর সময় হয়ে থাকা গলা ব্যথায় জন্য যে সতর্কতাগুলি অবলম্বন করবেন

একজন স্তন পান করানো মা হওয়ার কারণে,আপনার খাওয়া এবং পানের বিষয়ে আপনার একটু অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।এখানে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থার উল্লেখ করা হল যেগুলি আপনার মনে রাখা উচিতঃ

  • আপনার খাদ্য তালিকায় ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবারগুলি অন্তর্ভূক্ত করুন।
  • যতটা সম্ভব বারে বারে উষ্ণ জলে চুমুক দিন।
  • দিনে 3-4 বার লবণ জলে গার্গেল করুন।
  • ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনি উষ্ণ হলুদদুধ পান করতে পারেন।
  • আপনার অনাক্রম্যতার উন্নতি সাধনে আপনি কাঁচা রসুন খেতে পারেন।
  • জীবাণু থেকে মুক্তি পেতে প্রায়শই হাত ধুয়ে নিন।
  • আপনার সন্তানের কাছে হাঁচবেন না।
  • আপনার সন্তানের কাছাকাছি হাঁচা বা কাশার সময় আপনার মুখ ঢেকে তা করুন।

স্তন পান করানো মায়েদের ভাল বোধ করার জন্য অতিরিক্ত পরামর্শ

অসুস্থ হয়ে পড়াটা সাধারণ ভাবে কোনও ভাল অনুভূতি নয়,আর স্তন পান করানো মায়েদের জন্য এটি আরও বেশি অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে।কিন্তু আপনি যদি নিম্নে বর্ণিত পরামর্শগুলির কিছু অনুসরণ করেন তবে আপনি শীঘ্রই আরও ভাল অনুভব করতে পারেনঃ

  • দ্রুত মুক্তিলাভ নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
  • আপনার বাড়িতে যথাযথ বায়ু চলাচল নিশ্চিত করুন এবং চেষ্টা করুন কোনও রকম ধূলা এবং ধোঁয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে।
  • শীঘ্র ভাল অনুভূতি পাওয়ার জন্য কাঁচা রসুন এবং রসুনের পরিপূরকগুলি খান।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল পানের দ্বারা হাইড্রেট থাকুন।
  • গরম জলে স্নান করুন এবং প্রশ্বাসের মাধ্যমে উষ্ণ বাষ্প গ্রহণ করুন।
  • যতটা সম্ভব গৃহ মধ্যস্থ শুকনো বাতাস এড়িয়ে চলুন।আপনার ঘরটি খুব বেশি ঠাণ্ডা কিম্বা খুব বেশি গরম থাকবে না সে ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করুন।
  • দ্রুত পুনরুদ্ধারের জন্য আপনি জিঙ্কের পরিপূরকগুলিকে গ্রহণ করতে পারেন।
  • এমন জায়গাগুলিতে যাওয়া থেকে সংযত থাকুন যেখান থেকে আপনার মধ্যে অ্যালার্জেন,দূষণ অথবা ধূলাবালি প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
  • আপনি যদি ঠাণ্ডা অঞ্চলে যান তবে নিজেকে ভালভাবে ঢাকা দিয়ে নিন।
  • আপনি যদি দুচাকার বাহনে বা মটর বাইকে যাত্রা করেন,আপনার কানগুলিকে ঢেকে নিন।

কখন একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন

গলদাহ এমন কোনও গুরুতর অবস্থা নয় যে আপনার তৎক্ষণাৎ কোনও চিকিৎসাগত সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন।তবে,আপনি যদি নিম্নে বর্ণিত কোনও একটি উপসর্গ আপনার মধ্যে লক্ষ্য করে থাকেন,তবে সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারের সাথে দেখা করার প্রয়োজন হতে পারে।

  • এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যদি আপনার মধ্যে গলদাহের উপসর্গগুলি বজায় থাকে।
  • আপনার যদি 4 ডিগ্রী বা তার বেশি তাপে উচ্চ মাত্রায় জ্বর হয়ে থাকে।
  • যদি আপনার জ্বর না কমে এমনকি ওষুধ খাওয়ার পরেও।
  • আপনি যদি অ্যান্টি থাইরয়েড ওষুধগুলি খান।

গলা ব্যথার চিকিৎসা সহজে ঘরেতেই করা যায়;তবে,উপরে উল্লিখিত কোনও একটি শর্তও আপনার মধ্যে প্রদর্শিত হয়ে থাকলে,আপনার অবিলম্বে ডাক্তারি সহায়তা নেওয়া উচিত।

এছাড়াও,আপনি যদি গলদাহের জন্য ওষুধ গ্রহণের পর আপনার মধ্যে দুধ সরবরাহে কোনও রকম পরিবর্তন লক্ষ্য করেন,সেটি আপনার ডাক্তারবাবুর নজরে নিয়ে আসুন।যদি এই ব্যাপারের জন্য ওষুধটিই মূল অভিযুক্তকারী হয়ে থাকে তবে আপনাকে সেটির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে বলা হতে পারে।

আমরা আশা রাখি এই নিবন্ধটি আপনাকে আপনার গলদাহ এবং তার উপসর্গগুলির সাথে মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।

Share
Published by
দেবশ্রী ব্যানার্জী