In this Article
হিমোগ্লোবিন হল লোহিত রক্তকণিকায় পাওয়া যায় এমন একটি প্রোটিন যা শরীরের অন্যান্য বাকি অংশগুলিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।গর্ভাবস্থায় একজন গর্ভবতী মহিলার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সর্বত্তম হওয়া উচিত তার সারা দেহে যথাযথ অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য।রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা সরাসরি সঞ্চালিত হিমোগ্লোবিন মাত্রার সাথে সমানুপাতিক হয়ে থাকে।
আপনি যদি গর্ভবতী হয়ে থাকেন, ভ্রূণের বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে আপনার হৃদপিণ্ডটিকে অবশ্যই অনেক বেশি কাজ করতে হবে।গর্ভাবস্থায়, আপনার দেহে রক্তের পরিমাণ 30%-50% বৃদ্ধি পাবে।আমরা নিশ্চিত যে আপনার দেহে রক্তের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে এবং গর্ভাবস্থায় আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্থিতিশীল থাকার ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করার জন্য আপনি অবশ্যই স্বাস্থ্যকর আহার গ্রহণ করছেন।তবে গর্ভাবস্থার পরবর্তী পর্যায়গুলিতে সেগুলি গ্রহণ করা আপনার পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতে পারে যার পরিণতিতে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে।গর্ভাবস্থায় কীভাবে আপনি আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারেন তা জানতে হলে পড়ুন।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রার উন্নতি ঘটানোর শ্রেষ্ঠ উপায়গুলি
গর্ভাবস্থায় আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি কম থাকে, আপনার ডাক্তারবাবু হয়ত সেটি বাড়ানোর জন্য আপনাকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ওষুধ এবং ইঞ্জেকশন দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন।কিন্তু আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি খুব কম না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনয়ন এবং নিয়মিত ব্যায়ামাদি অনুশীলনের দ্বারাই আপনি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারেন।এখানে দেওয়া হল আপনার দেহে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে আপনি যেগুলি করতে পারেন।
স্বাস্থ্যকর আহার গ্রহণ করুন
আপনার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে, আপনার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করুন ভিটামিন B, ভিটামিন C, আয়রণ, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি সমৃদ্ধ খাদ্যগুলি। এখানে এমন কিছু খাদ্যের একটি তালিকা দেওয়া হল যেগুলি আপনার খাওয়া উচিত গর্ভাবস্থায় আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য।
-
সবুজ শাক–সবজি
সবুজ শাক–সবজি, বিশেষত সবুজ শাকপাতা যেগুলি আয়রণ উপাদানে সমৃদ্ধ–একজন গর্ভবতী মহিলার ডায়েটে অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি কম হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবারগুলি থেকে আপনি উপকার পেতে পারেন।আয়রণ হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা আবার লোহিত রক্ত কণিকা গঠোণে সহায়তা করে।গর্ভাবস্থাকালে আপনি খেতে পারেন এমন কিছু আয়রণ সমৃদ্ধ খাদ্য এবং ভেষজের মধ্যে রয়েছে পালং শাক, পাতা কপি এবং ব্রকোলি, আর এছাড়াও রয়েছে ধনে, পুদিনা এবং মৌরি।আয়রণ ছাড়াও সবুজ শাক–সবজিগুলি আবার অন্যান্য ভিটামিন এবং পুষ্টিতে ভরপুর যেগুলি গর্ভাবস্থার জন্য অপরিহার্য।সুতরাং এগুলিকে আপনার ডায়েটের একটি অংশ করে তুলুন।
-
ড্রাই ফ্রুট এবং বাদাম
খেজুর এবং ডুমুরগুলিতে উচ্চ মাত্রায় আয়রণ থাকায় তা আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করতে পারেন।গর্ভকালে আপনি নিয়িমিত সেবন করতে পারেন এমন কিছু ড্রাই ফ্রুট এবং বাদামগুলি হল আখরোট, কিশমিশ এবং আমণ্ড বাদাম কারণ এগুলিও গর্ভাবস্থায় আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।
-
ডাল
ডাল হল আয়রণ এবং প্রোটিনে ভরপুর।স্যালাড অথবা স্যুপের সাথে যোগ করে আপনি সেগুলিকে খেতে পারেন।আরও ভাল ফলাফলের জন্য আপনি আবার এমনকি রুটির সাথেও ডাল যোগ করে গ্রহণ করতে পারেন।কড়াইশুঁটি, মুসুর এবং বীনসগুলি ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার বা তন্তু, আয়রণ এবং প্রোটিনে সমৃদ্ধ।সুতরাং এগুলি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটি সুষম আহার গড়ে তুলতে পারে।
-
শতমূলী
শতমূলী আয়রণে সমৃদ্ধ।আপনি যদি সহজে হজম করার জন্য হালকা কিছু খেতে চান, শতমূলীর এক কাপ গরম স্যুপ আপনি সেবন করতে পারেন।সেটিকে আরও উপাদেয় করে তুলতে আপনি এর সাথে আবার তিল বীজও যোগ করতে পারেন।
-
তাজা ফল
ডালিম এবং কমলার মত তাজা ফলগুলি খেলে সেগুলিও গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে পারে।ডালিম ভীষণভাবে আয়রণ উপাদানে সমৃদ্ধ আর কমলা ভিটামিন C তে সমৃদ্ধ যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং যা ঘুরে ফিরে আবার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়।কিউয়ি, পীচ, মোসাম্বি লেবু, পেয়ারার মত অন্যান্য ফলগুলি আবার আয়রণের একটি দুর্দান্ত উৎস এবং গর্ভাবস্থাকালে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে।তবে আপনি আপনার গর্ভদশায় এই ফলগুলিকে অন্তর্ভূক্ত করার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবু কিম্বা পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলে তাঁদের পরামর্শ নিয়ে নিতে ভুলবেন না।
-
ফোলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ সবজিগুলি
ফোলেট অথবা ফোলিক অ্যাসিড হল এক ধরণের ভিটামিন B এবং জলে দ্রবণীয় ভিটামিন যা গর্ভাবস্থায় নিউরাল টিউবের ত্রুটিগুলি প্রতিরোধে সহায়তা করে।এই ভিটামিনটি আবার হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।আপনার দেহের ফোলিক অ্যাসিডের চাহিদা পূরণ করতে আপনি ভুট্টা, কলা, শালগম, অঙ্কুরিত ছোলা, অ্যাভোকাডো, লেটুস, ওকরা ইত্যাদিগুলি খেতে পারেন কারণ এগুলি সবই ফোলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ।
-
স্মুদি
আপেল, শালগম এবং গাজর দিয়ে প্রস্তুত স্মুদি পান করুন।এই স্মুদিটি পান করলে তা আপনার গর্ভদশায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
-
দানা
আপনি আবার কুমড়োর দানা, আমণ্ড বীজ এবং সূর্যমুখীর বীজের মত আয়রণ সমৃদ্ধ কিছু দানা বা বীজও খেতে পারেন। এগুলি সেবনের ফলে তা গর্ভাবস্থায় আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।
খাদ্যগত পরিপূরকগুলি গ্রহণ করুন
খাদ্যগত পরিপূরকগুলি গ্রহণ করলে তা আবার গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতেও সহায়তা করতে পারে।
1.ফোলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন B-12 এর অভাবের কারণে হিমগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে।আপনার মধ্যে যদি ফোলিক অ্যাসিড অথবা ভিটামিন B-12 এর অভাব হয়ে থাকে, আপনি এগুলির জন্য সম্পূরকগুলি গ্রহণ করতে পারেন তবে অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়ার পরেই।
2.আপনার দেহে যদি আয়রণের অভাব হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনাকে আয়রণ সম্পূরকগুলি গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হবে।
3.আয়রণ সমৃদ্ধ খাবারগুলি খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তবে তার সাথেই আবার আপনার এমন খাদ্যগুলিও খাওয়া উচিত যেগুলি আয়রণ শোষণেও সহায়তা করে।আয়রণ শোষণে সহায়ককারী ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাদ্যগুলি আপনি যদি না খেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে ভিটামিন C এর সম্পূরকগুলি গ্রহণ করতে হবে।ভিটামিন C এর সম্পূরকগুলি আপনার দেহের আয়রণ শোষণ ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে পারে।আপনার ভিটামিন C এর পরিপূরকগুলির প্রয়োজন কিনা সে ব্যাপারে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করে পরামর্শ নিন।
লোহিত রক্ত কণিকার উদ্দীপকগুলি
লোহিত রক্ত কণিকাগুলিকে উদ্দীপিত করার জন্য আপনার ডাক্তারবাবু যেগুলির সুপারিশ করতে পারেন সেগুলি হলঃ
1.আপনার যদি দীর্ঘমেয়াদী কোনও রোগ থেকে থাকে, তার ফলে আপনার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে।সেক্ষেত্রে আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে আপনাকে হয়ত আয়রণ পিল এবং ভিটামিনগুলির সুপারিশ করা হতে পারে।
2.যখন কোনওকিছুই কাজ করে না সেই পরিস্থিতিতে আপনার গর্ভাবস্থায় আপনার ডাক্তারবাবু হয়ত আপনাকে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর ইঞ্জেকশন দেবেন।কৃত্রিম এরিথ্রোপয়েটিন ইনজেকশন লাল রক্তকণিকা তৈরীতে সহায়তা করতে পারে।
যোগ–ব্যায়াম
গর্ভাবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ানোর অন্যতম একটি সহজ উপায় হল যোগ–ব্যায়াম অনুশীলন।আপনি যখন যোগ-ব্যায়ামগুলি অনুশীলন করবেন তখন অক্সিজেনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আপনার শরীর আরও হিমোগ্লোবিন তৈরি করবে।আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়ার পরে আপনি মাঝারি তীব্রতার হাঁটাচলা বা ব্যায়ামাদিগুলির সাথে সেটি শুরু করতে পারেন।কঠোর ব্যায়ামাদিগুলির অনুশীলন গর্ভদশায় করা থেকে বিরত থাকুন কারণ এই সকল ব্যায়ামাদিগুলি এই অবস্থায় আপনার জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।আপনার দেহে হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আপনি আবার শিতলী প্রাণায়াম, নদি শোধন প্রাণায়াম কিম্বা কাপাল ভাতির মতো প্রাণায়মগুলিও করার চেষ্টা করতে পারেন।
স্টেরয়েড চিকিৎসাগুলিকে বেছে নিন
স্টেরয়েড চিকিৎসাটি আপনার শেষ অবলম্বন হওয়া উচিত।কোনও মহিলার জন্য স্টেরয়েড চিকিৎসাটি তখনই নির্ধারিত হয়, যখন হিমোগ্লোবিনের নিম্ন মাত্রার জন্য তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটির উপর চাপ পড়ে।এইসব ক্ষেত্রে সুস্থ RBC গুলি অনাক্রম্য কোষগুলির দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়।এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে একজন মহিলাকে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা দমন করার পরামর্শ দেওয়া হবে।এই চিকিৎসা জনিত অবস্থাটি হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া হিসাবে পরিচিত।
এগুলি হল গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করার কয়েকটি উপায়।তবে এ ব্যাপারে এমন একটি জিনিস রয়েছে যেটি আপনার গর্ভাবস্থায় আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হ্রাস পাওয়া প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা উচিত।
আয়রণ ব্লকারগুলি এড়িয়ে চলুন
আপনার যদি হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা কম থাকে, সেই সকল খাদ্য, পানীয় এবং তরলগুলি এড়িয়ে চলুন যেগুলি আপনার দেহের আয়রণ শোষণের ক্ষমতায় বাধা দান করে।চা, কফি, সফট ড্রিঙ্ক, বিয়ার এবং মাদক দ্রব্যগুলি বর্জন করুন।
গর্ভাবস্থাকালে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক ব্যপ্তি কত হওয়া উচিত?
হিমোগ্লোবিনের গণনা প্রতি ডেসিলিটারে গ্রামে(g/dl) পরিমাপ করা হয়।গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে, একজন মহিলার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হওয়া উচিত 11.6 g/dl – 13.9 g/dl এর মধ্যে।দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কোথাও 9.7 g/dl এবং 14.8 g/dl এর মধ্যে থাকে।আর গর্ভদশার সর্বশেষ ত্রৈমাসিকটিতে, হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা 9.5 g/dl – 15 g/dl এর মধ্যে থাকাই আদর্শ বলে বিবেচিত।
সারা দেহে অক্সিজেন চলাচলের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকলে তা দুর্বলতার কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার দিকে পরিচালিত করতে পারে।সুতরাং গর্ভাবস্থায় যথাযথ হিমোগ্লোবনের মাত্রা বজায় রাখা মা এবং গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রার উন্নতি সাধনের জন্য আপনি এই সকল উপায়গুলি প্রয়োগের চেষ্টা করতেই পারেন তবে অবশ্যই তা আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ গ্রহণের পরেই।