গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়া

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়া

গর্ভাবস্থায় মহিলাদের কি খাওয়া উচিত সে ব্যাপারে তাদের যত্নশীল হওয়া উচিত কারণ এই সময়ে তাদের দেহ দুর্বল থাকে এবং কিছু নির্দিষ্ট ধরনের খাদ্যের জন্য তাদের দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।আমণ্ড বা বাদামে রয়েছে প্রয়োজনীয় ফ্যাট,প্রোটিন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনগুলি যেগুলির সবই প্রতি ত্রৈমাসিকে শিশুর স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।যদি প্রতিদিনের ডায়েটে সঠিক পরিমাণে সেটি সংযুক্ত করা যায় তবে একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থা অনুসরণ করা নিশ্চিত!

গর্ভাবস্থায় বাদামের উপকারিতা সম্পর্কিত প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু বিষয়, প্রশ্ন এবং তাদের উত্তরগুলি নীচে দেওয়া হল

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়া

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়া নিরাপদ নয় -এই বিশ্বাসের বিপরীতে,প্রকৃত সত্যটি হল সেগুলি খাওয়া নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর যদি সেগুলিকে সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।আসুন দেখা যাক গর্ভাবস্থায় বাদাম খাওয়ার কিছু উপকারিতাগুলির দিকে। আমণ্ড বাদামে সমৃদ্ধ সকল পুষ্টিকর উপাদানগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলচিত হলঃ

  • আমণ্ড মধ্যস্থ ফাইবার বা তন্তু সঠিক হজমের জন্য অপরিহার্য যখন এর ভিটামিন E চুল এবং ত্বককে স্বাস্থ্যকর রাখে।
  • মস্তিষ্কের সঠিক ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি স্নায়ুতন্ত্র বজায় রাখার জন্য ম্যাগনেসিয়াম, রাইবোফ্লাভিন এবং ফোলেট (ভিটামিন B-9) প্রয়োজন যেগুলির সবগুলিই আমণ্ডে পাওয়া যায়।
  • এর মধ্যস্থ ম্যাঙ্গানিজ মা এবং শিশু উভয়ের দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।

আমণ্ডের (বাদাম) পুষ্টিমান

একটি জলখাবার বা খাবার হিসেবে কাঁচা আমণ্ড বাদামগুলিকে খাওয়া যেতে পারে যদি সেগুলি সংযমের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়।

আমণ্ড বাদামের পুষ্টি চার্ট(প্রতি 100 গ্রাম পরিমাণে)

  • এনার্জি- 576 কিলোক্যালোরি
  • কার্বোহাইড্রেট-21.69 গ্রাম
  • ফ্যাট-49.42 গ্রাম
  • প্রোটিন-21.22 গ্রাম
  • ভিটামিন-বিটা ক্যারোটিন,A,B-1,B-2,B-3,B-5,B-6,B-9,কোলাইন,E,K
  • উপস্থিত ধাতব পদার্থগুলি – ক্যালসিয়াম,আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সোডিয়াম,জিঙ্ক।

(সূত্রঃ ন্যাশানাল নিউট্রিয়েন্ট ডাটাবেস)

উপরের চার্টটি থেকে আমরা দেখতে পাই যে ছোট আকারের আমণ্ড বাদামের মধ্যে একাধিক নানাবিধ পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে!

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড (বাদাম) খাওয়া কি নিরাপদ?

উচ্চ তাপ এবং চর্বিযুক্ত উপাদানের কারণে মহিলারা সাধারণত তাদের গর্ভাবস্থায় বাদাম এবং শুকনো ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

সত্যটি হল,গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়া সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ।গর্ভাবস্থায় বাদাম খাওয়ার ফলে,গর্ভবতী মায়ের বাদাম অ্যালার্জি সহ একটি অনাগত শিশু লাভ করার সম্ভাবনা থাকে এ ধরণের গুজব এবং কল্পকাহিনীতে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অভাব রয়েছে।সেগুলিকে এড়িয়ে চলার একমাত্র কারণ হতে পারে যখন আপনি সেগুলির প্রতি অ্যালার্জি প্রবণ হয়ে থাকেন।সাধারণভাবেই যদি আপনার মধ্যে বাদাম বা আমণ্ডে অ্যালার্জি থাকে,তবে সেগুলিকে আপনার ডায়েটে সংযুক্ত করার আগে দয়া করে আপনার ডাক্তারবাবুর সহিত আলোচনা করে নিন।তবে গর্ভধারণের পূর্বে যদি আপনার সেগুলিতে অ্যালার্জি না হয়ে থাকে তবে গর্ভাবস্থাতেও সেটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।

যাইহোক,দয়া করে মনে রাখবেন যে অকাল প্রসবের মত ঘটনার কয়েকটি রিপোর্টে কাঁচা বাদামের অত্যধিক গ্রহণের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। সুতরাং, সংযম করাই হল সর্বশ্রেষ্ঠ।

আমন্ড খাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর উপায় হল সেগুলিকে সেবন করার পূর্বে জলের মধ্যে ভিজিয়ে রেখে তার খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া।এর খোসার মধ্যে রয়েছে ট্যানিন যা হল এমন একটি যৌগ যেটি আমণ্ডের মধ্যে তার মধ্যস্থ সকল পুষ্টিকর উপাদানগুলিকে আবদ্ধ করে রাখে।এর খোসা ছাড়িয়ে নেওয়ার ফলে সেগুলির মধ্যস্থ পুষ্টিকর উপাদানগুলি উন্মুক্ত হবে।আমণ্ডগুলিকে ভিজিয়ে রাখা হলে তার মধ্যস্থ হজমের জন্য উপকারী উৎসেচকগুলিও মুক্ত হয়।

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়ার সেরা স্বাস্থ্য সুবিধাগুলি

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড খাওয়াকে বিজ্ঞান সমর্থন করে কারণ সেগুলি নিরাপদ।আমণ্ডের সাথে জড়িত প্রধান স্বাস্থ্য-উপকারিতাগুলির মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলঃ

1. আমণ্ড বাদাম ফলিক অ্যাসিড সরবরাহ করে যা ভ্রূণের মস্তিষ্ক এবং স্নায়বিক বিকাশের একটি অখণ্ড প্রয়োজনীয়তা।

2. আমণ্ডগুলি আবার খাদ্যগত ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেটের একটি ভাল উৎস।এগুলি আবার অক্সিডেটিভ স্ট্রেস,প্রদাহ এবং রক্তের শর্করা হ্রাসেও সহায়তা করে থাকে।এটি সাধারণত উচ্চ ঝুঁকিময় গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে যেমন হবু মায়েদের মধ্যে স্থূলতা এবং ডায়বেটিসের মত ঝুঁকিগুলি থেকে থাকলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী জীবনে বাচ্চাদের বিপাকীয় ব্যাধি থেকে বাধা দানে সহায়তা করে থাকে।

3. আমণ্ড ক্ষুধা হরমোন ঘেরলিন হ্রাস এবং ক্ষুধা হ্রাস বা ক্ষুধামান্দ্য হরমোন লেপটিন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এটি আপনাকে স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে।এটি আবার গর্ভাবস্থার পরবর্তীতেও আপনার ওজন হ্রাসে সহায়তা করবে।

4. এটি আয়রণে সমৃদ্ধ যা শিশুর হৃদযন্ত্রের বিকাশে এবং অনাক্রম্যতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

5. প্রতিদিন সকালে 4-6 টি আমণ্ড বাদাম খেলে তা আপনার স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

6. সারা রাত ধরে আমণ্ড বাদামগুলিকে জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর পরদিন সকালে সগুলিকে সেদ্ধ করে একটি পেস্ট বানিয়ে নিন।তারপর এই পেস্টটিকে একটি ফেস প্যাক হিসেবে ব্যবহার করলে তা মৃত ত্বকের কোষগুলিকে উঠিয়ে ফেলে এবং আপনাকে একটি উজ্জ্বল ত্বক প্রদান করে।

7. আমণ্ডগুলিকে যখন ভিজিয়ে রাখা হয় তখন এটি একটি প্রয়োজনীয় লাইপাসের মুক্তি শুরু করে যা ফ্যাটের ভাঙ্গনে সহায়তা করে। এটি হজম এবং পুষ্টির শোষণকে উন্নত করে।

8. গবেষণায় দেখা যায় যে,আমণ্ড গ্রহণের ফলে তা আলফা টোকোফেরলের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।এই আলফা টোকোফেরল হল এমন এক যৌগ যা রক্তে উপস্থিত থেকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

গর্ভাবস্থায় আমণ্ড বাদাম খাওয়ার সময় যে সাবধানতাগুলি অবলম্বন করতে হবে

1. ভিটামিন E এর ওভারডোজ

আমণ্ড বাদামগুলি হল ভিটামিন E এর অন্যতম একটি সেরা উৎস,যার কেবল মাত্র 1 আউন্সই প্রায় 48% মত সরবরাহ করে বলে সুপারিশ করা হয়।গর্ভাবস্থায় খেয়ে থাকা অন্যান্য খাদ্যগুলি যেমন সবুজ শাক-সবজি এবং ফলের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন E থাকে।খুব বেশি মাত্রায় ভিটামিন E খাওয়ার ফলে ঝাপসা দৃষ্টি,মাথা ধরা এবং ডায়রিয়া হয়ে থাকতে পারে।

2. পেট ফাঁপা এবং কোষ্ঠকাঠিণ্য

প্রস্তাবিত ভোজনের চেয়ে বেশি আমণ্ড খাওয়ার ফলে পেট ফেঁপে যেতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।এর কারণ হল আমণ্ড ফাইবারে সমৃদ্ধ হয়ে থাকে আর দৈনিক ভিত্তিতে এতটা পরিমাণ ফাইবার আপনার দেহ গ্রহণ করতে সমর্থ হয় না।

আমণ্ড খাওয়ার সেরা উপায়গুলি

আমণ্ড খাওয়ার সেরা উপায়গুলি

1. জলখাবারে কাঁচা বাদাম

সেগুলিকে কুঁচি কুঁচি করে কেটে নিয়ে বিভিন্ন খাবারের ডিশের উপর ছড়িয়ে দিয়ে, আবার বিভিন্ন স্যালাডের সাথে যোগ করে একটি কুড়মুড়ে মজাদার স্বাদে সমৃদ্ধ করে তুলুন।আবার একটা দ্রুত জলখাবার হিসেবে আপনি এগুলি কাঁচাও খেতে পারেন।

2. জলে ভিজানো আমণ্ড

সারা রাত ধরে আমণ্ড বাদামগুলিকে জলে ভিজিয়ে রাখার ফলে এর বহিরাবরণ থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি দূর হয়ে যায়,এর আঠালো গ্লুটিন উপাদানটি বিশ্লিষ্ট হয় এবং ফাইটিক অ্যাসিড মুক্ত করে।যা এগুলিকে কাঁচা খাওয়ার জন্য আরও বেশি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলে।

3. গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে আমণ্ড দুধ

যদিও গরুর দুধের মত অতটা স্বাস্থ্যকর নয়,তথাপি আমণ্ড বাদামের দুধ এখনও উচ্চ মাত্রায় পুষ্টিকর এবং যারা ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু তাদের জন্য দুর্দান্ত পছন্দ সরবরাহ করে।

4. আমণ্ড বাটার বা মাখন

আমণ্ড বাদামকে বেটে পেস্ট বানিয়ে নিলে তা আপনাকে খাওয়ার ক্ষেত্রে আমণ্ড মাখনের যোগান দেয় আর তার সাথে জল যোগ করলেই তা আবার আপনাকে আমণ্ড দুধের যোগান দেয়।আমণ্ড বাটার হল প্রোটিন,ফাইবার এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের একটি দুর্দান্ত উৎস এবং এটি আবার খারাপ কোলেস্টেরলও হ্রাস করে।

একজন গর্ভবতী মহিলার দিনে কয়টি করে আমণ্ড বাদাম খাওয়া উচিত?

প্রতি আউন্সে(28গ্রাম)গড়ে 23 টি করে আমণ্ড বাদাম থাকে।প্রতিদিন 1 আউন্স করে খাওয়ার ক্ষেত্রে তা কোনওরকম ত্রুটি ছাড়াই সবচেয়ে সেরা উপকারিতাগুলি সরবরাহ করতে পারে বলে বিবেচনা করা হয়।

1 আউন্স আমণ্ড বাদামের মধ্যে রয়েছে 164 ক্যালোরি,14.36 গ্রাম ফ্যাট(73%),5.6 গ্রাম কার্বোহাইড্রেট(14%) এবং 6.03 গ্রাম প্রোটিন(13%)।

আমণ্ড বাদামকে কিশমিশ এবং খেজুরের সাথে মিশ্রিত করলে তা রক্তে পিট্টার(Pitta) অধোগমন হ্রাস করে।পিট্টা পাচন তন্ত্রের মধ্যে উপস্থিত থাকে এবং সঠিক স্তরে বজায় না থাকলে তা গলা বুক জ্বালা,অম্বল এবং অ্যাসিডিটির কারণ হতে পারে।

কখন এবং কটা করে আমণ্ড বাদাম আপনি খেতে পারেন তার একটি সময়সূচী যদি আপনি জানতে চান,তবে সেক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভাল ভোরবেলায় 10টি এবং সন্ধ্যে বেলায় 10 টি করে খাওয়া একটি ভাল পরিকল্পনা হতে পারে।প্রতিটি মানুষের দেহই ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে,সুতরাং আপনার শরীরে যেটি সহ্য হবে তার ভিত্তিতে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করে আপনার আমণ্ড বাদাম খাওয়ার পরিকল্পনাটি গড়ে তুলুন।

উপসংহারঃ আমণ্ড বাদামের অসংখ্য উপকারিতাগুলির কথা বিবেচনা করে অ্যালার্জিহীন গর্ভবতী মহিলাদের ডায়েটে অবশ্যই বাদাম সংযোগ করা উচিত।সেগুলি সর্বদা সংযমের সহিত খাওয়া নিশ্চিত করুন কারণ খুব বেশি পরিমাণে সেবন করলে তা খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।খাওয়ার পূর্বে সারা রাত ধরে আমণ্ড বাদামগুলিকে জলে ভিজিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।এই ভিজানো বাদামগুলি তাদের শুকনো অবস্থার তুলনায় অনেক বেশি উপকারী বলে বিবেচিত।উপযুক্ত পরিমাণে সমানভাবে গ্রহণ করুন এবং ভাল স্বাস্থ্য ও একটি সুখী গর্ভাবস্থা উপভোগ করুন।