মর্নিং সিকিনেস বা সকালের অসুস্থতা,ক্লান্তিবোধ,মাথা ধরা,খিঁচুনি,অনিদ্রা এবং গা গুলানো ও বমি বমি ভাব-এগুলি হল গর্ভাবস্থার পরিচিত কিছু সাধারণ লক্ষণ।আপনি যদি গর্ভবতী হয়ে থাকেন তবে আপনি অবশ্যই গর্ভাবস্থার এই সকল উপসর্গগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকবেন,এমনকি প্রকৃতপক্ষে আপনার অবশ্যই এখন এবং পরেও এই সকল অভিজ্ঞতাগুলি হয়ে থাকবে।কিন্তু এক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার আরও অন্যান্য অনেক লক্ষণ আছে যেগুলি আমাদের অলক্ষ্যেই থেকে যায়।মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া হল সেগুলির মধ্যে একটি,এটি গর্ভাবস্থার একটি সাধারণ উপসর্গ।কিন্তু বেশিরভাগ মহিলাই এটিকে গর্ভাবস্থার লক্ষণ হিসেবে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন।আপনি যদি এটি সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানতে চান এবং গর্ভাবস্থায় কেন কারুর মুখ শুকিয়ে যেতে পারে তা ভালভাবে বুঝতে চান,তবে এই নিবন্ধটি পড়ুন।
গর্ভাবস্থার বহু উপসর্গগুলির মধ্যে একটি হল মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া।আমাদের মুখের ভিতরকে আদ্র এবং পরিষ্কার রাখতে স্যালাইভার বা লালার প্রয়োজন হয়।এছাড়াও স্যালাইভা বা লালা আবার আমাদের খাদ্য হজমে এবং মুখের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক প্রতিরোধে সহায়তা করে থাকে।স্যালাইভা আমাদের মুখের ভিতরের অংশকে আদ্র রাখে কিন্তু যখন আমাদের মুখের ভিতরে যথেষ্ট পরিমাণে লালা বা স্যালাইভা উৎপন্ন হয় না,আমাদের মুখ শুষ্ক হয়ে ওঠে এবং আমরা অস্বস্তিবোধ করি।মুখের এই শুষ্কতা আবার জেরোস্টোমিয়া নামে পরিচিত এবং এটি হয়ে থাকে গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে যা বেশ কয়েকটি রাসায়নিক পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করে।এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে অনুভূত হয়ে থাকে এবং প্রায়ই রাত্রের দিকে এর আরও অবনতি হতে থাকে।আপনার মুখ যদি শুষ্ক হয়ে গিয়ে থাকে তবে আপনি এর সাথে আবার অবরুদ্ধ নাক,মাথা ধরা,মুখের ভিতরে একটা ধাতব স্বাদ অনুভূত হওয়া,ঠোঁট ফেটে যাওয়া ইত্যাদির মত উপসর্গগুলিও অনুভব করে থাকতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় আপনার যদি মুখ শুষ্ক হয়ে গিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনার হয়ত নিম্নলিখিত উপসর্গগুলির মধ্যে এক বা তার বেশি কয়েকটির অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে অথবা প্রথম ত্রৈমাসিকে মুখ শুষ্ক থাকার ফলে তা বিভিন্ন জটিলতার দিকে পরিচালিত করতে পারে।আপনার মুখে যদি শুষ্কবোধ হয় তবে আপনি ভোরবেলায় ওঠার সময় আপনার জিহ্বাটিকে বিবর্ণ ফ্যাকাসে সাদাটে রঙে রূপান্তরিত হতে দেখবেন। এটি অত্যধিক প্রস্রাব অথবা বমি করার সাথে দেহস্থ বেশ কিছু পরিমাণে জল হ্রাস পাওয়ার ফলে শরীরে জলের কিছুটা ঘাটতি হওয়ার কারণে হয়ে থাকে যা গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে বেশ সাধারণ।মুখের ভিতরের অংশ শুষ্ক হয়ে ওঠার ফলে তা মুখের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে এবং আপনার মধ্যে একটি অস্বস্তির সৃষ্টি করে।উপরের উল্লেখ অনুযায়ী আমাদের খাদ্য কণাগুলি ধুয়ে ফেলার জন্য এবং আমাদের মুখে ক্ষতিকারক জীবাণুগুলির ঝুঁকি কমাতে স্যালাইভা বা লালার প্রয়োজন।যদি আপনার মুখে পর্যাপ্ত লালা উৎপন্ন না হয়ে থাকে,তবে এটি সহজেই জিঞ্জিভাইটিস,দন্তফলক,দন্ত গহ্বরের মত দাঁত এবং মাড়ির সমস্যার দিকে পরিচালিত করতে পারে।এই অবস্থাটি অবজ্ঞা না করার ক্ষেত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আবার ভ্রূণের বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রায় সকল গর্ভবতী মহিলারই মুখ শুষ্ক হয়ে যায়।তারা আবার এই অবস্থার সাথে মুখে দুর্গন্ধ হওয়ার অভিযোগও করতে পারে।গর্ভাবস্থায় মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়ার সাথে সংযুক্ত সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
বিভিন্ন নির্ধারিত অথবা ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধগুলির একটি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া।এই ওষুধগুলির মধ্যে এন্টিডিপ্রেসেন্টস, ব্রোঙ্কোডাইলেটর, মূত্রবর্ধক ইত্যাদিগুলি রয়েছে।যদিও এই সমস্যাটি বিরক্তিকর হতে পারে,তবে আপনার গর্ভাবস্থায় নির্ধারিত ওষুধগুলিকে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কিছুতেই বন্ধ করা ঠিক হবে না।
যদি আপনি আপনার প্রতিদিনের নিয়ম মত আট গ্লাস করে জল পান করেও থাকেন, তথাপি আপনি নিজের মধ্যে জলশূণ্যতাবোধ করতে পারেন।গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার দেহে অনেক বেশি জলের প্রয়োজন হয় নিজেকে স্বাস্থ্যকর রাখতে এবং তার পাশাপাশি সন্তানেরও সুস্থ বিকাশের জন্য।মাঝেমধ্যে দেহস্থ জলের এই ঘাটতি গর্ভাবস্থায় মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়ার দিকে পরিচালনা করে থাকে।এটি আবার অনেক সময় শিশুর জন্মগত ত্রুটি এবং অকাল প্রসবের দিকেও পরিচালিত করে থাকে।সুতরাং জল গ্রহণের পরিমাণ বাড়ান এবং আপনার সন্তানকে সুরক্ষিত রাখুন।
গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার দেহে রক্ত প্রবাহের পরিমাণ বেড়ে যায়,যার পরিমাণ হ্যে দাঁড়ায় একজন অ-গর্ভবতী মহিলার সর্বোচ্চ রক্ত প্রবাহের পরিমাণের থেকেও প্রায় 50% বেশি।যখন আপনার দেহে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়,আপনার কিডনিও বেশি সময় ধরে কাজ করে,কাজেই প্রস্রাবের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং দেহকে জলশূণ্যতার দিকে পরিচালিত করে,যা আবার গর্ভাবস্থায় মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে ওঠে।
আপনার কোষীয় ক্রিয়াকলাপ যেমন শক্তি উৎপাদন,খাদ্যের ভাঙন ইত্যাদি আপনার গর্ভাবস্থার আগত মাসগুলিতে মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাবে।যার পরিণামস্বরূপ,আপনার দেহ শরীরে উপস্থিত জল ব্যবহার করবে, যা নিয়মিত পুনরায় পূরণ করা প্রয়োজন কিন্তু যদি এটি পুনরায় পূরণ না হয় তবে আপনার মুখ শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
থ্রাশ হ’ল ক্যানডিডা অ্যালবিকানসের একটি ছত্রাকের অধিক বৃদ্ধি। আমাদের সকলের মধ্যেই এটি স্বল্প পরিমাণে রয়েছে তবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি স্বাভাবিকভাবে কাজ না করে তবে এটি সীমার বাইরে চলে যেতে পারে। যদি গর্ভাবস্থায় আপনার প্রতিরোধ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ না করে তবে আপনার মধ্যে মুখের ক্ষত বিকাশ পেতে পারে।এই থ্রাশ বা ক্ষত আপনার মুখে একটি শুকনো, তুলোর ন্যায় নরম লাগার মত একটা অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় আপনার মুখ যদি শুষ্ক হয়ে গিয়ে থাকে,আপনার এটিকে অবহেলা করা উচিত নয় কারণ এটি আরও গুরুতর কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারে যার ফলে আপনার সাথে আপনার সন্তানেরে স্বাস্থ্যের উপরেও একটি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।গর্ভাবস্থায় মুখ শুকিয়ে যাওয়া আবার নিম্নে উল্লিখিত জটিলতাগুলির যেকোনও একটির সংকেতও হতে পারে এবং যার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করার প্রয়োজন হবে।
গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়বেটিস সাধারণত গর্ভাবস্থাকালে হয়ে থাকে এবং তা হ্রাস পায় গর্ভাবস্থার পরবর্তীতে।মাঝেমধ্যে গর্ভাবস্থাকালে মুখ শুকিয়ে যাওয়ার পিছনে এই গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিসও কারণ হয়ে ওঠে।এটি দেহে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেও হতে পারে(গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিসের কারণে),যা ঘন ঘন আপনাকে প্রস্রাব ত্যাগ করার মধ্যে পরিচালনা করার দ্বারা আপনার দেহে জলের পরিমাণ হ্রাস করতে পারে।যদি আপনার মধ্যে গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিস থেকে থাকে,আপনি হয়ত তৃষ্ণার্তবোধ করতে পারেন,মুখের ভিতরে একটি জ্বলন যন্ত্রণা অনুভূত হতে পারে,আপনার ঠোঁট চটচটে হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি আরও অন্যান্য উপসর্গগুলি দেখা দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মুখ শুকিয়ে যাওয়ার সাথে যদি গলা শুকনো হয়ে যাওয়া,ঠোঁটের কোণে কেটে যাওয়া এবং জিভে জ্বালা অনুভব করার মত অন্যান্য উপসর্গগুলি সংযুক্ত হয়ে থাকে,তবে সেক্ষেত্রে এটি অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার একটি লক্ষণ হতে পারে যার অনতিবিলম্বে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হবে।যদি আপনি এই সকল উপসর্গগুলি অনুভব করে থাকেন তবে অবিলম্বে আপনার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করুন।
যদি আপনার মুখ শুকনো হয়ে যায় এবং তার সাথে তীব্র মাথা ধরে থাকে,সেটি সম্ভবত হতে পারে আপনার হঠাৎ করে রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে।দেহে রক্তচাপ বেড়ে গেলে তা আপনার এবং তার সাথে আপনার বাচ্চার স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে।তাই এটির ব্যাপারেও আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন।
গর্ভাবস্থায় মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া কোনও বিশেষ একটি সমস্যা নয়, তাই এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য এর কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই।মূল ব্যাপারটি হল এর অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলির যত্ন নেওয়া যা মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমত দায়ী। শুকনো মুখের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিকারটি হল প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিন লিটার জল পান করা। এটি আপনাকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করবে এবং এর ফলে মুখ শুকনো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
গর্ভাবস্থাকালে আপনাকে সম্ভবত অনেক কিছুর সাথেই মোকাবিলা করতে হবে কিন্তু মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া যেন সেগুলির মধ্যে না থাকে।এখানে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল যেগুলি সম্ভবত গর্ভাবস্থায় আপনার মুখ শুকিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উপশম আনার জন্য সহায়তা করতে পারেঃ
উপরের বর্ণনা অনুযায়ী,গর্ভাবপস্থায় মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া ভয়ের কিছু ব্যাপার নয় এবং এটিকে বেশ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।তবে আপনি যদি এর সাথে আবার মাথা ধরা,মুখগহ্বরে জ্বলন অনুভূতি,চরম ক্লান্তি,তীব্র তৃষ্ণার্তবোধ,ডায়রিয়া,গা গুলানো,বমি বমি ভাব ইত্যাদির মত আরও অন্যান্য উপসর্গগুলি অনুভব করে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে,অবিলম্বে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করুন।
গর্ভাবস্থা হরমোনের বহু পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে যা বেশ কিছু জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।যদি আপনার মুখ শুষ্ক হয়ে গিয়ে থাকে তবে সেটি আপনার দেহের দ্রুত পরিবর্তনের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই নয়,যা আপনার দেহের অভ্যন্তরে আপনার ছোট্ট ব্যক্তিটিকে তৈরী করার জন্য আপনার দেহের বিপাকীয়, শারিরীক এবং শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।তবে যদিও গর্ভাবস্থায় মুখোমুখি হওয়া অন্যান্য সম্ভাব্য জটিলতাগুলির কাছে মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়াটা একটা ছোট্ট উদ্বেগের বিষয় হয়ে থাকে,এটিকে অবহেলা করা উচিত নয়।যদি এই শর্তটি গুরুতর হতে থাকে এবং আপনার স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে তবে দয়া করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।