In this Article
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক প্রায়ই গর্ভাবস্থার সুবর্ণ সময় হিসাবে পরিচিত হয়, কারণ এটি এমন সময়, যখন গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের অস্বস্তিগুলি চলে যায় এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকের অস্বস্তিগুলি তখনও শুরু হয়না । এই সময়ের সবচেয়ে ভালো ফল পেতে, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যা আপনার এবং আপনার বাড়ন্ত শিশুর জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করে ।
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কী কী খেতে হবে?
১৪তম থেকে ২৬তম সপ্তাহের সময়কালটিকে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক বলা হয়, এই সময় আপনার শিশুর প্রায় ৩৫ সেমি পর্যন্ত বৃদ্ধি হয় । প্রথম ত্রৈমাসিকের মতো দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ । স্বাস্থ্যকর খাবার এই সময় অপরিহার্য পুষ্টির সরবরাহ অব্যাহত রাখবে । একটি পুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার শিশুর হাড় ও পেশী গঠনের জন্য অপরিহার্য । আপনাকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে ।
স্বাস্থ্যকর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি এবং তাদের উত্স
আপনার খাবারে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ এবং প্রচুর পরিমাণে জল থাকতে হবে । প্রতিবারের খাবারে প্রতিটি খাদ্যশ্রেণির ৩টি অংশ থাকা উচিত । আপনার পরিকল্পিত মোট খাবারের পরিমাণকে এর এক বারের প্রধান খাবার এবং একটি স্ন্যাকে বিভক্ত করা উচিত, যাতে সারাদিন আপনার শক্তির মাত্রা ঠিক থাকে ।
আপনার খাবারে নিম্নলিখিতগুলি দিয়ে গঠিত হওয়া উচিত-
- ফোলিক অ্যাসিড এবং লোহার যোগান অবিরত রাখার জন্য, আপনাকে প্রতিদিন ৫টি করে সবজি (সবুজ পাতাওয়ালা সবজি যেমন পালংশাক, বাঁধাকপি) এবং ফল খেতে হবে ।
- আপনার প্রত্যেকবারের খাবারে কার্বোহাইড্রেট (স্টার্চযুক্ত বা শাঁসযুক্ত খাবার, গোটা দানার রুটি, শস্যদানা) থাকা উচিত ।
- ক্যালসিয়ামের যোগান নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২-৩ বার কম ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়া উচিত ।
- উচ্চ পরিমাণে প্রোটিনযুক্ত খাদ্য (যেমন মাছ, ডিম, মটরশুটি) দিনে অন্তত দুবার খাওয়া উচিত ।
- তৈলাক্ত মাছ (সপ্তাহে একবার এবং সপ্তাহে দুই বারের বেশি নয়) আপনাকে যথেষ্ট ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সরবরাহ করার জন্য, যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে ।
- আপনাকে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক এবং পানীয় (যেমন- স্যান্ডউইচ, দই) বেছে নিতে হবে ।
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের জন্য খাবার পরিকল্পনা
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের সময় আপনার খাদ্য পরিকল্পনা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আপনার শিশু সঠিক অনুপাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় এবং ওজন সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায় ।
খাবারের পরিকল্পনা করার সময় তাতে সমস্ত মরশুমে লভ্য ফল এবং সবজি রাখা গুরুত্বপূর্ণ । যদি কোনো একটি ফল বা সবজি না পাওয়া যায়, তবে আপনি সেই ঋতুতে পাওয়া যায় এবং একই পুষ্টিগুণ-সম্পন্ন অন্য কোন ফল বা সবজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারেন ।
কখনও কখনও একটি একক খাদ্য একাধিক পুষ্টির উৎস হতে পারে; অতএব আপনি হয়তো দেখবেন যে, একটি নির্দিষ্ট পুষ্টির জন্য একটি ত্রৈমাসিকে কোনো খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয় এবং সেই একই খাবার অন্য একটি ত্রৈমাসিকে অন্য কোন পুষ্টির জন্য সুপারিশ করা হয় ।
এই পুরো সময় জুড়ে, আপনার প্রচুর জল খাওয়া উচিত । গর্ভাবস্থায় ক্যাফিন খাওয়া কম করা উচিত ।
খাবার পরিকল্পনার নমুনা
জলখাবার (ব্রেকপফাস্ট) | ২ বাটি শস্যদানা, ১ টি ফল, ১ আউন্স মাংস / বীনস ও ১ কাপ দুধ ।
নমুনা জলখাবার – ২ আউন্স গোটা শস্যর ব্যাগেল টোস্ট এবং ১ চা চামচ মার্জারিন এবং ডিমের ভুজিয়া, ১ কাপ ফুটি এবং ১ কাপ দুধ (ফ্যাট-ছাড়া) । গর্ভাবস্থায় আপনার প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে দুগ্ধজাত পণ্যের মাধমে দিনে ১০০০-৩০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হবে । |
মধ্যাহ্ন আহার (লাঞ্চ) | ২ বাটি শস্যদানা, ১ কাপ সবুজ পাতাওয়ালা শাক-সবজি, ১ কাপ ফল, ১ বাটি দুধ এবং ২ আউন্স মাংস, বীনস ।
নমুনা মধ্যাহ্নভোজ – রোস্ট করা ২ আউন্স মাংস ও গোটা গমের পাউরুটি, ১ চা চামচ মেয়োনিজ, টমেটো এবং লেটুস দিয়ে তৈরি স্যান্ডউইচ । আপনি ১ কাপ ছোট গাজর, তাজা কমলালেবু এবং ১ কাপ ফ্যাট-ছাড়া দুধও খেতে পারেন । গর্ভাবস্থায় আপনার প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম লোহার প্রয়োজন হবে । |
নৈশাহার (ডিনার) | ২ বাটি করে শস্যদানা ও সবজি এবং ৩ আউন্স মাংস / বীনস ।
নমুনা নৈশাহার – ৩ আউন্স গ্রিল করা মুরগি, ১ কাপ বাদামী ভাত, রসুন ও অলিভ তেল দিয়ে সাঁতলানো ১ কাপ পালং শাক, ১ টেবিল চামচ স্যালাড ড্রেসিং সহ গার্ডেন স্যালাড । গর্ভাবস্থায় আপনার প্রতিদিন ৬০০ মিলিগ্রাম ফোলেট দরকার । |
স্ন্যাক | এক একটি স্ন্যাকে ১ বাটি করে শস্যদানা এবং দুধ থাকা উচিত ।
নমুনা স্ন্যাক – গোটা শস্যদানা ১ কাপ, সঙ্গে ১ কাপ ফ্যাট-ছাড়া দুধ । |
খাবারের প্রতি অনিচ্ছা এবং তীব্র ক্ষিদে
এই সময়ে অনেক মহিলা কোন নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং কিছু খাবারের প্রতি তীব্র ক্ষিদে অনুভব করতে পারেন, এটি হরমোনের দ্রুত পরিবর্তনের ফলে হতে পারে ।
কিছু মহিলার চকোলেট বা মশলাযুক্ত খাবার বা কিছু ধরনের মুখরোচক খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা করতে পারে ।
অন্যদিকে কিছু মহিলার কিছু খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা হতে পারে । মূলত, তারা এই খাবারগুলি কখনো খেতে না চাইতে পারেন । যে সবজি বা দুগ্ধজাত পণ্যগুলি বাচ্চাদের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলির প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হলে সমস্যা হতে পারে । এ অবস্থায় আপনার ডাক্তার সেগুলির বদলে অন্য কিছু খাবার খেতে পরামর্শ দিতে পারেন অথবা খাবারগুলির সম্পূরকের সুপারিশ করতে পারেন, যাতে পুষ্টির অভাব যথেষ্ট পরিমাণে পূরণ হয় ।
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ওজন বৃদ্ধি
আপনার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ওজন বৃদ্ধি আপনার প্রথম ত্রৈমাসিকের চেয়ে দ্রুত হবে । প্রতি সপ্তাহে আপনার ১ থেকে ২ পাউন্ড ওজন বাড়বে । বেড়ে যাওয়া ওজন শুধু শিশুর মধ্যেই যায় না । এটি স্তন টিস্যুতে যুক্ত হয়, শরীরে তরল পদার্থের বৃদ্ধি ঘটায়, শিশুর চারপাশে অ্যামনিওটিক তরলের বৃদ্ধি পায়, প্ল্যাসেন্টার বৃদ্ধি হয় এবং গর্ভাশয়ের পেশী বৃদ্ধি করে এবং শরীরে চর্বি ও প্রোটিনের সঞ্চয় বৃদ্ধি করে ।
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বমিভাব বন্ধ হয়ে যায় এবং আপনি একটি সুখী অবস্থানে থাকেন কারণ শিশু তখনও আপনার অঙ্গগুলিতে চাপ তৈরি করার মতো যথেষ্ট বড় হয়নি । তবে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি প্রসবের সময় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে ।
যে যে খাবারগুলি এড়িয়ে যেতে হবে
২য় ত্রৈমাসিকে গর্ভাবস্থার খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ । তবে, গর্ভাবস্থার ৬ষ্ঠ থেকে ১৪তম সপ্তাহে নির্দিষ্ট কিছু খাবার খাওয়া কমানো এবং এড়িয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ।
১) কাঁচা এবং আধসিদ্ধ মাংস এড়ানো উচিত, কারণ এতে ব্যাকটিরিয়া সালমেনেলা এবং টক্সো প্লাজমোসিসের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে ।
২) উচ্চমাত্রার পারদ বা অন্যান্য দূষণকারী পদার্থযুক্ত মাছ এড়ানো উচিত । পারদ মস্তিষ্কের বিকাশকে কমিয়ে দেয় ।
৩) গর্ভাবস্থায় কাঁচা ডিম না খাওয়াই উচিত, কারণ এথেকে স্যালমোনেলার সংস্পর্শে আসার ভয় থাকে ।
৪) কিছু ধরণের আমদানি করা নরম চীজ বা পনিরে লিস্টারিয়া থাকে, যা এড়ানো উচিত ।
৫) নির্বীজকৃত নয় এমন দুধে লিস্টারিয়া থাকতে পারে, এটি এড়ানো উচিত ।
৬) গর্ভাবস্থায় ক্যাফিন খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ।
৭) এই সময় অ্যালকোহল বা মাদকজাত পানীয় সম্পূর্ণরূপে এড়ানো উচিত ।
৮) যে সব শাকসবজি এবং ফল ধোয়া নয়, সেগুলি খাওয়া একেবারেই নিরাপদ নয় ।
একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য পরিকল্পনা মেনে চলার সাথে সাথে, খাবারের পরিমাণ যেন আপনার প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সরবরাহ করে, সেটা দেখাও সমানভাবে আবশ্যক । আপনার দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণের বিষয়ে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত । খাদ্য তালিকা মেনে চলার উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধি ।