পঞ্চম মাসের গর্ভাবস্থায় ডায়েট (17-20 সপ্তাহ)

পঞ্চম মাসের গর্ভাবস্থায় ডায়েট (17-20 সপ্তাহ)

প্রায় প্রতিটি মা-ই একজন মা হয়ে ওঠার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন এবং গর্ভাবস্থা এই মহান দুঃসাহসিক কাজটির কেবল সূত্রপাত করে।এটা হল এমন একটা সময় যখন একজন মহিলার ভীষণ ভাবে সাবধানী ও কঠোর হয়ে ওঠা উচিত তার খাবারের ব্যাপারে।গর্ভধারণের এই পঞ্চম মাসে আপনার প্রয়োজন হবে প্রতি দিন অন্তত কমপক্ষে 347 ক্যালোরি করে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করা এবং প্রায় 1-2 পাউন্ড মত ওজন বৃদ্ধি করা।এই ক্যালোরিগুলি আসা উচিত প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের উৎস থেকে।চর্বি সংযোজিত,শর্করা এবং কার্বোহাইড্রেট-গুলি থেকে এড়িয়ে চলতে আপনি যা করতে পারেন করুন।

গর্ভধারণের পঞ্চম মাসে কি খাবেন?

গর্ভধারণের পঞ্চম মাসে কি খাবেন?

এখানে কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া হল যেগুলি আপনার গর্ভধারণের পঞ্চম মাসের খাদ্য-তালিকায় সংযোজিত করা উচিত।

1. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার আপনার সন্তানের মসৃন শারীরিক বিকাশ সুনিশ্চিত করে যেহেতু প্রোটিনস্থিত অ্যামিনো অ্যাসিড হল দেহ গঠনকারী উপাদান।ডাল,ভক্ষ্য শস্য,বীজ এবং বাদাম,ছোলা,কটেজ চীজ এবং টফু-এই খাবার-গুলি হল আপনার জন্য প্রোটিনের ভাল উৎস যা পাঁচ মাসের গর্ভাবস্থাকালীন দারুণ খাবার তৈরি করে।

2. সম্পূর্ণ শস্য(হোল গ্রেইনস)

এগুলি ভীষণভাবে ম্যাগনেসিয়াম,আয়রণ,ভিটামিন E এবং ভিটামিন B কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ।সম্পুর্ণ শস্যের মধ্যে শস্যের তিনটি অংশই রয়েছে সেগুলি হল এণ্ডোস্পার্ম,ব্র্যান এবং জার্ম।প্রাতঃরাশ ভক্ষ্য শস্য,আটা গুঁড়ো,রুটি এবং আরও অন্যান্য জিনিস সম্পূর্ণ শস্য থেকে তৈরী হয়।

3. ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ

আমরা সকলেই জানি যে, হাড় এবং দাঁতের জন্য ভীষণ ভাল এবং আপনার উন্নয়ণশীল শিশুর জন্যও সেক্ষেত্রে কোনো ব্যাতিক্রম নেই।আপনার সন্তানের শক্তিশালী কঙ্কালতন্ত্র গঠন করা সুনিশ্চিত করার জন্য প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা নিশ্চিত করুন।ফলের মধ্যে যেমন কিউয়ি,মালবেরি বা তুঁত ফল,শুকনো ডুমুর এবং খেজুর গুলি অত্যন্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ।

4. উচ্চ তন্তু

গর্ভাবস্থাকালীন সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য একটা পরিচিত সমস্যা।এটি হওয়ার সম্ভাবনা কমানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হল তন্তু বা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।তন্তু সমৃদ্ধ কিছু খাবার-গুলি হল ফল এবং সবজি,বার্লি,ওট,গম এবং বাদাম।

5. প্রচুর স্যালাড খান

স্যালাড খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন যদি এখনও তা না করে থাকেন।আপনি স্যালাডের সাথে বেশ কিছুটা সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারেন এবং আপনার শরীরের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি,খনিজ এবং তন্তু-গুলি পাওয়ার জন্য এগুলি সেরা উপায় হয়ে ঊঠবে।সাজিয়ে রাখা স্যালাড এবং সবজির আচাড় এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলিতে সোডিয়ামের উপাদান অনেক বেশী থাকে।

6. প্রচুর পরিমাণে ফল খান

আপেল,আঙুর,কলা,অ্যাভোক্যাডো,ন্যাসপাতি,কমলা লেবু,পীচ এবং আরও অনেক!কোনো ফলের প্রতি উদাসী হওয়ার ক্ষেত্রে এতগুলি ফলের থেকে সেগুলিকে নির্বাচন করে ওঠা খুবই কঠিন ব্যাপার।এগুলি উচ্চ ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধও হয় এবং গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক-কালীন সময়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার।

7. হাইড্রেট থাকুন

হাইড্রেটেড থাকার ফলে মানুষের দেহে অনেকগুলি সুবিধা রয়েছে এবং গর্ভাবস্থায় এটি আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ।এটি গর্ভবতী মহিলাদের মুখোমুখি হতে হওয়া ভীষণ সাধারণ দুটি সমস্যা-কোষ্ঠকাঠিন্য এবং মূত্রনালীর সংক্রমণকে দূরে ঠেলে রাখে।প্রচুর পরিমাণে তরল পানও শরীরকে বিষমুক্ত করতে সাহায্য করে।যদি আপনি এমন এক ব্যক্তি হন যিনি সাধারণ জল পান করতে পছন্দ করেন না তবে সেক্ষেত্রে আখের রস এবং আমের জুসের মত স্বাস্থ্যকর পানীয় পান করতে পারেন যেগুলিতে কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার বা তন্তু সমৃদ্ধ থাকে।

গর্ভধারণের পঞ্চম মাসে কি খাবেন না?

যদিও আপনার খাওয়ার ইচ্ছে থাকতে পারে,এখানে এমন কিছু জিনিস দেওয়া হল যেগুলির বিষয়ে আপনার পরিষ্কার থাকা উচিত।

1. কার্বনেটেড পানীয়

ঠাণ্ডা পানীয়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি,চিনি এবং ক্যাফিন থাকে।এটি পূরণ করুন কিছু তাজা ফলের রসের দ্বারা অথবা বিশুদ্ধ তাজা লেবু জলের সাথে সংযুক্ত থাকুন।

2. কিছু নির্দিষ্ট ফল এবং সবজি

বেশ কিছু ফল যেমন আনারস,বেদানা এবং পেঁপে যেগুলি জরায়ুর সংকোচনের জন্য পরিচিত যা গর্ভস্রাব ঘটিয়ে থাকে সেগুলিকে এড়িয়ে চলুন।কালো আঙুরকেও খাওয়া থেকে এড়িয়ে চলা ভাল যেহেতু এগুলি শরীরে তাপমাত্রা গঠন করে যা আপনার সন্তানের জন্য ক্ষতিকারক।বাঁধাকপি এবং লেটুসের মত সবজি-গুলি খাদ্যজনিত অসুস্থতা বহন করে যখন বেগুন মাসিক উদ্দীপত করার জন্য পরিচিত যা গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের কারণ হতে পারে।

3. ক্যাফিন

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফিন খাওয়া পরবর্তীতে শিশুর জন্মের পর তার বিশ্রামহীনতা এবং নিদ্রাহীনতার কারণ হয়ে ওঠে।চা,কফি এবং চকোলেটের মধ্যে ক্যাফিন থাকে সুতরাং এগুলি সবগুলিকেই এড়িয়ে চলা সবথেকে ভাল।কিন্তু যদি আপনি এমন একজন ব্যক্তি হন যে এগুলি ছাড়া চলতে পারবেন না বলেই নিজেকে মনে করেন তবে সেক্ষেত্রে এটি খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিনে সর্বোচ্চ দুই কাপ করুন।

4. কাঁচা এবং স্মোকড সী-ফুড (ধোঁয়া দ্বারা রান্না করা সসামুদ্রিক খাবার)

যদি আপনি সুশি এবং সাশিমি ভালোবাসেন তবে সেক্ষেত্রে এটা একটা বিরতি নেওয়ার সময়।স্মোকড সী-ফুডে প্রায়ই “লিস্টারিয়া মনোসাইটোজেনাস ব্যাকটেরিয়া” নামক এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া থাকে যা লিস্টারিওসিসের,মৃত সন্তানের জন্মদানের,গর্ভস্রাবের অথবা নবজাতকের অসুস্থতার কারণ হয়ে ওঠে।

5. মার্কারি যুক্ত মাছ

মার্কারি হল এমন একটা জিনিস যা সমুদ্রে,জলধারায় এবং হ্রদে পাওয়া যায়।এটি আবার মানুষের শরীরের ভিতমে মিথাইল মার্কারিতে পরিণত হয়।যা একটা নিউরোটক্সিন,এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি ও শিশুর উন্নয়ণশীল বিলম্বের কারণ হতে পারে।সার্ক,সোর্ড ফিস বা তলোয়ার মাছ,কিং ম্যাকারেল এবং টাইল ফিসের মত মাছ-গুলিকে এড়িয়ে চলুন।স্যালমন অথবা হালকা মাংসের টুনা জাতীয় মাছগুলিকে খান।

6. কাঁচা অথবা কম রান্না করা ডিম এবং মাংস

আপনি নিরামিষাশী না হলে আপনার খাবারে একটি বিশাল অংশ হিসেবে ডিম এবং মাংসকে আবদ্ধ করুন।আর কখনই কাঁচা ডিম বা মাংস খাবেন না এবং সেগুলিকে ভালোভাবে রান্না করে খাওয়াকেই সুনিশ্চিত করুন।কাঁচা ডিমে “সালমোনেলা” নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে যা খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ।যখন খাদ্য বিষক্রিয়ার এই উপলক্ষটি আপনার সন্তানের ক্ষতি নাও করতে পারে,আপনার রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনাটি দুর্বল হয়ে পড়বে,এবং সেটি আপনের সন্তানের বিকাশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।আর কাঁচা মাংসে থাকে টক্সোপ্লাজমা প্যারাসাইট যা গর্ভাবস্থাকালীন ক্ষেত্রে প্রসবের সময় অথবা গর্ভস্রাবের সময় ভ্রূণের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

7. ভেষজ চা এবং সম্পূরক

এমন কিছু ভেষজ উপাদান রয়েছে যেগুলি চা,রুচিবর্ধক বস্তু অথবা সম্পূরকে ব্যবহৃত হয় এবং যেগুলি মা এবং সন্তান উভয়ের ক্ষেত্রেই ভীষণভাবে ক্ষতিকারক।বিভিন্ন উপাদান যেমন  কাবা কাবা, এঞ্জেলিকা,মোগার্ট, কাল এবং নীল কোহশ এবং অন্যান্য আরও কিছু উপাদান জরায়ু উদ্দীপক রূপে কাজ করে এবং এগুলিকে সম্পুর্ণ রূপে এড়িয়ে চলাই উচিত।

ভেষজ যেমন কালো আখরোট,মেথি,হর্সটেইল,যষ্ঠিমধুর মূল,সোনামুখী,সোমরাজ এবং অন্যান্যগুলি গর্ভস্রাবের কারণ হতে পারে।এছাড়াও আরো অন্যান্য কয়েকটি ভেষজ যেমন জিনসেঙ (এক ধরণের গাছ যার সুগন্ধি শিকড় ওষধিতে ব্যবহৃত হয়),ঘৃত কুমারী এবং প্রাইম রোজ(এক ধরণের ফ্যাকাসে হলুদ ফুল বিশেষের গাছ) এগুলিও এই সময়ে গ্রহণ করা নিরাপদ নয়।

একজন 5 মাসের গর্ভবতী মহিলার খাবারের পরামর্শ

এখানে আপনার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটি সুষম খাদ্য বজায় রাখার জন্য কিছু পরামর্শ দেওয়া হলঃ

  • প্রতিদিনের হিসেবে যে খাবার গুলি আপনি খান সেগুলির উপাদানগুলির পুষ্টি নিয়ে গবেষণা করুন এবং চেষ্টা করুন খুঁজে বের করতে সেগুলির কতটা পরিমাণ আপনার প্রতিদিন খাওয়া প্রয়োজন এবং আপনার খাবারের কতটা অংশ পরিবর্তন করা উচিত যদি প্রয়োজন হয়।
  • আপনার সন্তানের প্রয়োজনীয় বৃদ্ধির জন্য আপনার শরীরে সঠিক পরিমাণে পুষ্টি পাওয়াকে সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আপনার নিজের জন্য একটা সুষম খাদ্য পরিকল্পনা করুন।
  • আপনার কোনো খাবারে এলার্জি থাকলে তার বিকল্প হিসাবে খাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করে নিন।
  • প্রতি বারে অল্প করে খাবার খান এবং সারা দিন ধরে বারে বারে খান।
  • মাঝে মধ্যে যদি আপনার কিছু কুড়মুড় করে খাওয়ার ইচ্ছে হয় তবে ড্রাই ফ্রুট,বাদাম এবং বীজ গুলিকে পছন্দ করতে পারেন।এছাড়াও আপনি খাওয়ার মাঝে জলখাবার হিসেবে বেবি ক্যারোট এবং অন্যান্য সবজি গুলি খেতে পারেন।
  • স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য বজায় রাখার জন্য আপনার প্রতিটি খাদ্য গ্রুপের কতটা খেতে হবে তা নির্ধারণের জন্য গর্ভাবস্থার আগে আপনার উচ্চতা ও ওজনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।এই জন্যই সব থেকে ভাল উপায় হল একজন ডাক্তার অথবা পুষ্টি বিজ্ঞানীর পরামর্শ নেওয়া।

আপনি আগে থেকে এতদিন পর্যন্ত রাস্তার যে সকল ভাল ভাল লোভনীয় খাবার গুলি খেতেন সেগুলি খাওয়ার ইচ্ছেকে দমন করা সত্যই ভীষণ কঠিন হয়ে উঠতে পারে কিন্তু সেই ইচ্ছে গুলি পূরণ না করারই চেষ্টা করুন আপনার সন্তানের জন্য।এমনকি চেষ্টা করুন সকল অস্বাস্থ্যকর খাবার ইচ্ছে গুলিকেই আপনার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে অথবা সেগুলির বিকল্প রূপে স্বাস্থ্যকর খাবার গুলিকে আপনার খাওয়ার ইচ্ছেতে পরিবর্তন করতে যেগুলি আপনার ও আপনার সন্তানের উভয়ের জন্যই উপকারী।আপনি যা কিছুই খাবেন তার সরাসরি প্রভাব কেবল আপনার উপরেই পড়বে না তা আপনার সন্তানের উপরেও পড়বে। আপনার সন্তানের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার তুলনায় আর কোনও কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না সুতরাং যা কিছুই আপনি খান না কেন সে বিষয়ে সর্বদা সচেতন এবং সতর্ক থাকুন।