এটি অনস্বীকার্য যে, গর্ভধারণ প্রতিটি মহিলার জীবনে অত্যন্ত সুন্দর ও উত্তেজনাময় মুহূর্ত।। কারণ এই সময় থেকেই শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর উপভোগ্য পরিস্থিতি। যাইহোক মহিলাদের গর্ভধারণের লক্ষণ গুলি কে সঠিকভাবে চিনতে পারাটা অত্যন্ত জরুরী । কারণ স্বরূপ বলা যায় পিরিয়ড বাদ যাওয়ার পর থেকেই মহিলাদের মনে এই আশার সঞ্চার হতে থাকে। এই খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগে প্রেগনেন্ট হওয়ার লক্ষণ গুলিকে সঠিকভাবে চিনতে পারাটা খুবই প্রয়োজন।
ডাক্তাররা বলেন কিছু ক্ষেত্রে কনসিভ করার একদিন পর থেকেই এই লক্ষণ গুলি কি বুঝতে পারা যায়। এটি আরো নির্ভর করে যে আপনি আপনার শরীর, এবং এই পরিস্থিতির জন্য কতটা সজাগ তার ওপর। যদিও ডিম্বাণুটি ফ্যালোপিয়ান টিউবে যেতে এবং জরায়ুর মধ্যে প্রতিস্থাপিত হতে প্রায় ৬ দিন মতো সময় নেয়, কিন্তু ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই শরীর তার নির্দেশ দিতে শুরু করে দেয়।
এই পর্বটি কিছুটা যন্ত্রণাদায়ক, বিশেষত প্রথমবার গর্ভবতী হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা উদ্বিগ্ন হওয়া ও স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাকে নিরুদ্বেগ থাকার চেষ্টা করতে হবে। সব সময় ইতিবাচক থাকুন আপনার চারিপাশে যারা আপনাকে ভালবাসেন এবং আপনার খেয়াল করেন তাদের সাথে। আপনি সমস্ত সমস্যাগুলি আপনার ডাক্তারবাবু আত্মীয়–স্বজন, বন্ধু–বান্ধবদের থেকে জেনে মিটিয়ে নিন যাতে আপনাকে আর কোন অপ্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তায় পড়তে না হয়
সঙ্গমের পর পিরিয়ড মিস করা একটি সাধারন ব্যাপার। পিরিয়ড মিস করলে তা গর্ভধারণের লক্ষণ হিসেবে সব সময় চিহ্নিত হয় না,কিন্তু এক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনা থেকে যায় সন্তান ধারণের। সে ক্ষেত্রে বাড়িতে একটি প্রেগনেন্সি টেস্ট করে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন।
এখানে গর্ভধারণের সাধারণ কিছু প্রাথমিক লক্ষণ আলোচনা করা হলো
গর্ভধারণের ভীষণ সাধারন একটি লক্ষণ হলো বমি বমি ভাব। এই বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি সন্তান ধারণের দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে আবার কিছু ক্ষেত্রে সন্তান ধারণের এক থেকে দু মাস পরেও শুরু হয় এটি দিনের যেকোনো সময় অনুভব করতে পারেন– সকালে, বিকেলে, সন্ধ্যের সময় কিম্বা রাত্রে। কিছু জনের এই বমি বমি ভাবটি প্রেগনেন্সির পুরো সময় ব্যাপী থাকতে পারে যখন অন্য কিছু জনের তা গর্ভধারণের প্রথম কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। । খুব কম ভাগ্যবতী মহিলা থাকেন যাদের এরকম সমস্যায় পড়তে হয় না।
এই সময় বমি বমি ভাব এবং হজমের সাথে সম্পর্কযুক্ত আরো কিছু সমস্যা যেমন এসিডিটি এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, যেহেতু এই সময় তাদের হরমোন ও পেটের গঠন পরিবর্তিত হতে থাকে। মর্নিং সিকনেস কমাতে বা দূর করার জন্য ডাক্তাররা কিছু ওষুধ দেন যেগুলির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না। এটি পরামর্শ দেওয়া হয় যে এই সময় কোন রকম অ্যালকোহল বা তামাক সেবন করা উচিত নয়। দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকা থেকেও বিরত থাকতে হবে। যদি আপনার মর্নিং সিকনেসের অভিজ্ঞতা থাকে তবে আপনাকে তরল পানিয়ের মাত্রা বাড়াতে হবে যা আপনার স্টমাকে অ্যাসিড তৈরির মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
এই সময়ে বিভিন্ন গন্ধযুক্ত, তেল জাতীয়, মশলাদার, ভারী এবং ভাজা খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। বারে বারে অল্প পরিমাণে হালকা খাবার গ্রহণ করতে হবে। আদা এবং ভিটামিন B6 যুক্ত খাবার মর্নিং সিকনেস কিছুটা কমাতে সাহায্য করে
গর্ভধারণের প্রাথমিক পর্যায়ে স্তনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন—
এগুলি হয় কারণ এই সময় শরীরের ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন নামক হরমোন গুলির পরিবর্তন হতে থাকে। হরমোন গুলির এই পরিবর্তন স্তন এলাকায় রক্ত সরবরাহ বাড়ায় এবং এগুলিকে খুব সংবেদনশীল করে তোলে। প্রেগনেন্সির সময় কখনো কখনো স্তন এলাকায় ফাটল শুরু হয় যার ফলে স্ট্রেচ মার্ক বা প্রসারিত হওয়ার চিহ্নগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে এবং অ্যারিওলার চারিপাশটি কিছুটা ফুলে ওঠে।
এই সময় আপনার স্তনটি যেহেতু বেড়ে ওঠে তাই পরামর্শ দেয়া হয় যে বড় সাইজের ব্রা ব্যবহার করতে। সব সময় ভাল মানের এবং সুতির ব্রা ব্যবহার করতে হবে যা আপনার স্তনটিকে আরামদায়ক ও সুরক্ষিত রাখে।
প্রেগনেন্সির সময় মহিলাদের শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন হতে থাকে। এর ফলে তারা মাঝে মধ্যেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। যার প্রভাব প্রেগনেন্সিতেও পরে।
এই সমস্যাগুলি দূর করতে যে গুলি করা প্রয়োজন—
যেহেতু হরমোনের পরিবর্তনের ফলে শরীরে রক্ত চলাচল এর মাত্রা বেড়ে যায়,কিডনিতে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে মূত্রাশয় টি ঘনঘন ভরে ওঠে। গর্ভাবস্থা যত এগোতে থাকে মূত্রত্যাগের পরিমাণও তত বাড়তে থাকে। কারণ শ্রোণী অঞ্চলে রক্ত সরবরাহের মাত্রা বাড়তে থাকে।
এছাড়া গর্ভস্থ শিশুটিও ক্রমশ মূত্রস্থলীর উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। ঘন ঘন মূত্র ত্যাগের এটিও একটি অন্যতম কারণ। এছাড়া গর্ভবতী মহিলাদের লিগামেন্ট প্রসারিত হয়ে জরায়ুর আকার বৃদ্ধি করে এর ফলে মূত্রাশয়ে জায়গা কমে যায়, তার ফলেও ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ হয়।
অনেক মহিলার গর্ভাবস্থায় খাবার ইচ্ছে কমে যায় এবং ক্ষুধামান্যতায় ভোগেন ভীষণ মাত্রায়। মাঝেমধ্যেই গর্ভবতী মহিলারা খাবার দেখলেই বিরক্ত হন। এবং এক সময় যে খাবারটি তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল,গর্ভাবস্থার পর্যায়ে এসে তিনি সেই প্রিয় খাবারটি প্রতিও আর দ্বিতীয় বার ফিরে তাকাতে চান না। এটির কারণ হল গর্ভবতী মহিলা টির শরীরে নিয়মিতভাবে হরমোনগুলি পরিবর্তিত হতে থাকে। যার ফলে তার খাবারের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়।
ঋতুচক্র বন্ধ হওয়ার পর গর্ভাবস্থার আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হলো অবসাদ। এই সময় আপনি শরীরে সব সময় একটি ক্লান্তি অনুভব করতে থাকেন। তখন আপনাকে বিশ্রাম নিতে হবে এবং ব্যাপারটি সবসময় সহজ করে তুলতে হবে। প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাস খুব ঝুঁকিপূর্ণ থাকে তাই এই সময় খুব বেশি ভারী ওজন বহন করবেন না, আরামে থাকার চেষ্টা করুন,সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকুন, এবং জীবনের সমস্ত অপ্রয়োজনীয়‘ ব্যাপারগুলি ত্যাগ করুন।
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস অমরা –টির বিকাশের জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়,যার ফলে অবসাদ আসে। এছাড়াও রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, সেই কারণে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে। যাই হোক এটি নিয়ে বিশেষ ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ–গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস এই অনুভূতিটি খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন এই সময় আপনার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, পিরিয়ড হওয়ার আগে যেরকম হতো ঠিক সেইরকম। এবং আপনি সবসময় শরীরে গরম তাপমাত্রা অনুভব করেন। দু –সপ্তাহ আপনার শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে পারে। এগুলি শরীরের হরমোনগুলির ক্রমশ পরিবর্তন, –যেমন প্রোজেস্টেরনের মাত্রা ভীষণ ভাবে বেড়ে যায় এবং মেটাবলিজমের মাত্রাও বেড়ে যায়,এর ফলে হয়।
প্রেগনেন্সির প্রথমদিকে বিভিন্ন কারণে কোমরের নিচের দিকে যন্ত্রণা হয়। প্রথম কারণ হলো–।ওজন বৃদ্ধি, এবং জরায়ুর প্রসারণ, শরীরের লিগামেন্ট গুলি শিথিল হয়ে পড়ে ফলে ধড়ের অঙ্গবিন্যাস –এ অনেক পরিবর্তন আসে।। এর ফলে ব্যাক পেইন বা কোমরের নিচের দিকে যন্ত্রণা হয়।
কোমরের উপরের অংশ কিংবা ধরের দিকে সব থেকে বেশি ওজন থাকে,যা কোমরের সাথে যুক্ত থাকে এবং চাপ সৃষ্টি করে। গর্ভাবস্থায় প্রত্যেকেরই খুব সাবধানে অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন করা উচিত। কারণ অনেক মহিলাই অবহেলা করে তাদের পিছনের দিক টির ক্ষতি করে ফেলে,যা সারা জীবনের মতো তাদের শারীরিক গঠনের পরিবর্তন করে দেয়। এই বিষয়গুলি লক্ষ্য রাখবেন–। তাদের কাঁধ ঝুকে যেতে পারে,গোলাকৃতি গলা দেখা যায়,এবং জোড়া চিবুক –এইসব লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায় সব মহিলাই যে এরকম সমস্যায় পড়েন এমন নয়, তবে অনেকেরই এই সমস্যা হয়। তাই সাবধানে থাকা ভালো।
গর্ভাবস্থায় কিছু মহিলা সামান্য রক্তপাত– এর মতন সমস্যায় পড়েন। কারণ এই সময় নিষিক্ত ডিম্বানু জরায়ুর মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে,। সাধারণত এই কারণে গর্ভধারণের তিন থেকে ছয় দিন পরে সামান্য রক্তপাত হয়ে থাকে। যেহেতু নিষিক্ত ডিম্বানু প্রতিস্থাপিত হয়।
।আরো লক্ষ্য করলে দেখবেন এই সময় যোনি জাত স্রাব কি হালকা গোলাপি বর্ণের হয়। যা সাধারণ ঋতুস্রাব চলাকালীন অত গাঢ লাল বর্ণের হয় না। নিষিক্ত ডিম্বাণু কি প্রতিস্থাপিত হওয়ার ফলে কিছু মহিলার আবার স্রাব এর পরিমাণ বেড়ে যায় এবং পেটে খিঁচুনি ও ব্যথা হয়। যাইহোক যদি রক্তপাত হতেই থাকে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
নানা রকম হরমোনের পরিবর্তন এবং বমি বমি ভাব এগুলির ফলে গ্যাস্ট্রিক প্রবলেম বা পাচন জনিত সমস্যা হয়। যার ফলে কিছু মহিলা সর্বক্ষণ ফুলো ফুলো ভাব অনুভব করেন। এই সময় পরিপাকতন্ত্রের পেশীগুলি কিছুটা শিথিল হতে শুরু করে যাতে শ্রোণীচক্র টি কিছুটা প্রসারিত হতে পার এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে প্রসবের জন্য। এক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বানুও, যোনির প্রাচীর ফুলে ওঠার অন্যতম কারণ। এইসব কারণগুলির জন্যই মহিলাদের ব্লটিং দেখা দেয়।
যদি আপনি ভাবেন যে মাসিক বন্ধ হওয়ার কতদিন পর আপনি প্রেগনেন্সি টেস্ট করবেন তবে আপনার একবার মাসিক বন্ধ হওয়ার পর ঠিক এক সপ্তাহ অপেক্ষা করুন। বাড়িতে খুব সহজেই আপনি এই পরীক্ষাটি করতে পারেন। যদি আপনার উপরে আলোচিত লক্ষণ– গুলির বা অন্য কোনো রকম অভিজ্ঞতা থাকে এ বিষয়ে, তবে নিজেকে আর প্রশ্ন না করে এই পরীক্ষাটি করে ফেলুন। যার জন্য আপনাকে কিনতে হবে একটি প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট এবং নিজের মূত্রের সামান্য নমুনা সংগ্রহ করুন। এবার ড্রপার এর সাহায্যে কয়েক ফোঁটা মূত্র ওই কিট এর উপরে দিয়ে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করুন। কিছু কিছু কিটের নিয়ম ফলাফলের জন্য মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করা। যদি এটি পজিটিভ রেজাল্ট দেখায় তবে নিশ্চিত যে আপনি গর্ভবতী হয়েছেন।
এটা মানা হয় যে নিশ্চিত ফলাফল জানার জন্য আপনাকে অন্তত এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে আপনার মাসিক বন্ধ হওয়ার পর। গর্ভবতী মহিলাদের মূত্রে HCG( হিউম্যান ক্রনিক গোনাডোট্রপিন)নামক হরমোনটি প্রচুর পরিমাণে থাকে,যেটি প্রজননের পর অমরা তে উৎপন্ন হয়,যার ফল হলো আপনি প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে সফল ফল পেতে চলেছেন। যখন আপনি পরীক্ষা করে এ ব্যাপারে সফলভাবে নিশ্চিত হবেন,তখন জানবে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় হয়েছে।যাতে গর্ভাবস্থা চলাকালীন সব রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে প্রয়োজনমতো চিকিৎসার মাধ্যমে আপনি একটি সুস্থ ও সুন্দর শিশুর জন্ম দিতে পারেন।