শীতের কনকনে ঠান্ডা ও শীতল দিনগুলি ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আপনার ছোট শিশুর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আপনার উদ্বেগ বেড়ে ওঠার সম্ভাবনাও প্রবল হতে থাকে।শীতকালে আপনার সন্তানের কীভাবে যত্ন নেওয়া যায় সে সম্পর্কে আপনি হয়ত আপনার আত্মীয়স্বজন এবং সমকক্ষ বাবা–মায়েদের কাছ থেকে প্রচুর পরামর্শ ও উপদেশ পাবেন, যা আপনাকে সেই সকল চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দায়িত্ব নেওয়ার মতো করে হয়ত সত্যই প্রস্তুত করতে পারে না, বরং আপনাকে আরও সন্দেহের গোলকধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়!
শিশুদের দেহ অত্যন্ত ঠুনকো ও নশ্বর প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশের পর্যায়ে থাকায় একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ার এবং ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের বেশি থাকে, বিশেষকরে শীতকালে।আপনি হয়ত এই ঋতুর শীতল বাতাস ও আবহাওয়াটিকে বেশ পছন্দ করতে পারেন এবং আপনার বাড়ি থেকে বাইরে বেরোতে চাইতে পারেন, তবে আপনার ছোট শিশুর পক্ষে সেটি সেরা ধারণা নাও হতে পারে।এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, আপনি যতটা সম্ভব সর্বোত্তম উপায়েই আপনার সন্তানের যত্ন নিচ্ছেন, তবে শীতের সময় তার জন্য প্রয়োজন একটু “অতিরিক্ত” মাত্রায় ভালবাসা এবং যত্ন।আর আপনি কীভাবে তাকে তা দিতে পারেন তা এখানে বলা হল!
শীতকালে পারদমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে আপনার শিশুর সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং সে অসুস্থ হয়ে পড়ে; আর সেই কারণে একজন মা–বাবা হিসাবে তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আপনাকে আরও এক মাইল অতিরিক্ত পথ হাঁটতে হবে।আপনি কীভাবে শীতে আপনার শিশুর যত্ন নিতে পারেন এবং সারা শীতকাল ব্যাপী প্রতিটি দিনই সারাদিন ধরে তাকে নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং উষ্ণ রাখতে পারেন তার একটি সহজ গাইডলাইন এখানে দেওয়া হল।
শীতের কনকনে ঠান্ডার কামড়ের হাত থেকে আপনার শিশুকে রক্ষা করতে স্বভাবতই আপনার সুস্পষ্ট পছন্দ হয়ে উঠবে তাকে মোটা সোয়েটার, দস্তানা, মোজা এবং আর কী দিয়ে না তাকে ঢেকে রাখা।এইসকল শীতকালীন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় হলেও খুব বেশি উষ্ণতা আবার তাকে অস্বস্তি বোধ করাতে পারে। প্রথমে, ঘরের তাপমাত্রা মূল্যায়ন করুন এবং সেই অনুযায়ী আপনার শিশুকে পোশাক পরান।তাকে এমন পোশাক পরিধান করান যা তার দেহটিকে ঢেকে রাখে তবে তার চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে না।তাকে বিছানায় রাখার সময়, তার দস্তানা এবং মোজাগুলি পরিয়ে দিন কারণ এগুলি তার হাত ও পায়ের পাতাগুলি গরম রাখে এবং তাকে নির্বিঘ্নে আরামদায়কভাবে ঘুমাতে সাহায্য করে।
আপনার বাড়িতে, বিশেষত আপনার শিশুর ঘরটিকে উষন রাখার জন্য সেখানে গরম তাপমাত্রা বজায় রাখুন।শীতের শুরু থেকেই, শীতল বাতাস সমস্ত দিক থেকে বয়ে আসার আগে হিটার, হিউমিডিফায়ার এবং গিজারের মতো সমস্ত গরম করার সরঞ্জামগুলি যে কার্যকরী অবস্থায় রয়েছে তা নিশ্চিত হয়ে নিন।আপনি যদি এমন কোনও জায়গায় বসবাস করেন যেখানে বেশিরভাগ রাতেই ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো কনকনে ঠাণ্ডা পড়ে, তবে জানালাগুলি বন্ধ রাখুন এবং হিটারটি চালিয়ে দিন।আপনি যদি আপনার শিশুর ঘরে হিটার ব্যবহার করেন তবে ঘরের তাপমাত্রা তার পক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যজনক কিনা তা পরীক্ষা করে দেখুন – এটি খুব বেশি গরম হওয়া উচিত না।এছাড়াও, আপনার শিশুর ঘরটিকে বায়ুচলাচল উপযুক্ত রাখুন।
শীতকালে আপনার ছোট্টটিকে ম্যাসাজ করার ব্যাপারে আর কোনও দ্বিতীয় চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন নেই, কারণ একটা মালিশ তার ত্বক এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী হয়ে উঠতে পারে।ভিকস বেবিরাব* এর মতো একটি প্রশমনকারী বাম দিয়ে আপনার শিশুকে ম্যাসেজ করলে তা তার ত্বকে আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং সেটি শুকিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।আবার নিয়মিত ম্যাসেজ তার দেহে রক্ত প্রবাহকে উদ্দীপিত করতে এবং তার রোগ প্রতিরোধ কার্যক্ষমতার উন্নতি করতে সহায়তা করবে।সুতরাং, বাচ্চাকে মালিশ করা বাদ দেবেন না।যাইহোক, তবে ম্যাসেজের জন্য সময় এবং স্থানটি যথাযথভাবে বিবেচনা করুন।আদর্শগতভাবে, আপনার বাচ্চা যখন খেলার মেজাজে ও আনন্দপূর্ণ হয়ে থাকে তখন তাকে ম্যাসেজ করুন।এছাড়াও, শিশুকে মালিশের জন্য এমন একটি ঘর চয়ন করুন যেটি তার পক্ষে পর্যাপ্ত উষ্ণ এবং আরামদায়ক।
আদর্শগতভাবে বাচ্চার ছয় মাস বয়স পর্যন্ত তার মায়ের বুকের দুধই তার জন্য পুষ্টি এবং অ্যান্টিবডিগুলির একমাত্র উৎস হওয়া উচিত।বুকের দুধ এমনকি আবার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সর্দি–কাশি ও সংক্রমণ থেকে তাকে দূরে রাখে।সুতরাং, আপনার বাচ্চাকে যতটা সম্ভব স্তন্যপান করান।যদি আপনার শিশুটি ছয় মাসের সীমারেখাটি অতিক্রম করে থাকে, তবে আপনি তার ডায়েটে গরম তরল অন্তর্ভুক্ত করার সাথে স্তন্যপান পান করানোকেও বজায় রাখতে পারেন।এটি তাকে অতিরিক্ত পুষ্টি সরবরাহ করবে এবং শীতকালে তাকে নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং উষ্ণ রাখবে।
শিশুদের শীতকালে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, এর মূলে যে বিষয়টি রয়েছে তা হল এই যে, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাটি থাকে কম।আপনি যদি আপনার বাচ্চার ঘুমের সময় তাকে জোরে জোরে শাঁ শাঁ শব্দের সাথে শ্বাস ফেলতে, মারাত্মক কাশতে লক্ষ্য করেন অথবা শ্বাসকষ্ট জনিত অসুবিধা হতে দেখেন, সেক্ষেত্রে সে হয়ত কোনও সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে, অবিলম্বে আপনার বাচ্চাকে তার চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।আর যদি এটি একটি সাধারণ সর্দি–কাশি হয় এবং অবস্থাটি খুব তীব্র না হয় তবে আপনি ঘরোয়া প্রতিকারগুলি বেছে নিতে পারেন। একটা সাধারণ সর্দি–কাশিও আপনার শিশুর ঘুমের ধরণকে ব্যাহত করতে পারে এবং তা পরের দিন তাকে ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে।তাই তাকে রাত্রে ঠিকমতো বিশ্রাম পেতে সহায়তা করার জন্য ভিক্স ভেপোরাব** (2 বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদের জন্য উপযুক্ত) দিয়ে তার গলা, বুক এবং পিঠের উপর একটা হালকা মালিশ করে তার গায়ে একটা হালকা কম্বল জড়িয়ে দিন।মেন্থল এবং ইউক্যালিপটাস তেলের প্রাকৃতিক গুণ আপনার শিশুকে কোনওরকম অসুবিধা ছাড়াই শ্বাস–প্রশ্বাস নিতে এবং কাশি থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে। 3 মাস বা তারও বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য আপনি ভিকস বেবিরাব * ব্যবহার করতে পারেন যা কোনও শিশুকে ময়েশ্চারাইজ, প্রশমিত ও শান্ত করতে সহায়তা করে।বেবিরাব এবং আপনার স্নেহের স্পর্শ যৌথভাবে আপনার শিশুকে ময়েশ্চারাইজ করবে আর এই বামের ল্যাভেন্ডার এবং রোজমেরির সুবাস তাকে শিথিল করতে এবং ঘুমাতে সহায়তা করবে।
শীতকালে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে তার ঠান্ডা লাগা বা সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।অতএব, একটি অতিরিক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে, তাকে অবশ্যই নির্ধারিত তারিখগুলিতে টিকা দেওয়াতে হবে।সঠিক সময়ে সঠিক টিকাদান করলে তা তাকে সারা জীবন সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করবে।সুতরাং, আপনার শিশুর টিকাদানের কোনও একটি সময়সূচীকেও এড়িয়ে যাবেন না।
শীতকালে, আপনার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিটি হল আপনার বাচ্চাকে বেশ কয়েক স্তরের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে রাখা এবং তার ঘুমের সময় তার গায়ে একটা ভারী কম্বল চাপা দিয়ে দেওয়া, কিন্তু এটা আপনার ছোট্ট শিশুর পক্ষে সবচেয়ে ভাল কিছু নাও হতে পারে।মোজা এবং দস্তানাগুলির সাথে তাকে উষ্ণ রাখার সময়, ভারী কম্বলটি চাপা দেওয়া–একেবারেই না – এটি তার পক্ষে দমবন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং আপনার শিশুর জন্য এসআইডিএস হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।সুতরাং, আপনার শিশুর জন্য হালকা কম্বল ব্যবহার করুন এবং ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখুন।
একান্ত প্রয়োজন না হলে আপনার শিশুকে বাইরের ঠান্ডা, কনকনে বাতাসের মধ্যে নিয়ে বের করা এড়িয়ে চলুন।তাকে নিরাপদে বাড়িতেই সুরক্ষিত রাখুন।যদি তাকে নিতান্তই বাইরে নিয়ে যেতে হয় তবে তাকে গরম পোশাক পরান – তার বুক, কান, হাত এবং পা ঢেকে রাখুন।জরুরী কিছু না থাকলে, দুপুরে বা পরে যে কোনও সময় যখন ঠাণ্ডা বাতাস বওয়া হ্রাস পায়, তখন তাকে বাইরে নিয়ে যান।আর আপনি যদি আপনার শিশুকে নিয়ে বাইরে হাঁটার কোনও পরিকল্পনা করেন তবে তাকে একটি শিশুধারক ঝোলা বা বেবিওয়ারিং স্লিং–এর মধ্যে রেখে আপনার বুকের কাছাকাছি ধরে রাখুন কারণ আপনার শরীরের উষ্ণতা তাকে উষ্ণ এবং স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবে।
যদিও শিশুর জন্য শীতের যত্ন নেওয়ার সেরকম বিশেষ কোনও পরামর্শ নেই, তবে এটি উল্লেখ করাটাও দরকার।আপনি অনেকটা সময়ই আপনার শিশুর সাথে ব্যয় করেন; তাই আপনার শিশুর মঙ্গলার্থেই আপনাকে পরিষ্কার এবং সুস্থ থাকতে হবে। আপনার শিশুকে কোলে নেওয়ার বা ধরার আগে আপনার হাতগুলি ভালোমতো ধুয়ে নিন (সম্ভব হলে স্যানিটাইজ করুন)।পরিবারের যে কোনও সদস্য বা বাড়িতে আগত অতিথিদের যেকোনও ব্যক্তির থেকেই তার মধ্যে সংক্রমণ হয়ে যেতে পারে, তাই শিশুর কাছে যাওয়ার আগে বিনয়ের সাথে তাদের হাত ধুতে বলুন।প্রতিরোধ হল সর্বোত্তম যত্ন যা আপনি আপনার একরাশ আনন্দের এই ক্ষুদ্র ডালিটিকে দিতে পারেন, তাই স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন এবং রোগ–জীবাণু থেকে দূরে থাকুন।
যদি স্নান করানোর পরে আপনার বাচ্চার দিকে সেভাবে মনোযোগ না দেওয়া হয় তবে তার সর্দি–কাশি হয়ে যেতে পারে। শীতের সময় আপনার বাচ্চাকে মাঝেমধ্যে কখনওসখনও স্নান করান।হালকা গরম জল ব্যবহার করুন এবং বাথরুম ও ঘরের তাপমাত্রার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখুন।স্নানের পরে, তাকে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রাখুন এবং আরও বেশি দেরি না করে চটপট তাকে পোশাক পরিয়ে দিন।শীতকালে তাকে স্পঞ্জ স্নান করানোটাই সবচেয়ে ভাল, আর আবহাওয়া যদি খুব শীতল বা ঠান্ডা হয় তবে সেটি এড়ানোই ঠিক হবে!
শীতকালে আপনার বাচ্চার যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে আপনাকে একটু অতিরিক্তই যত্নশীল হয়ে উঠতে হবে, আবার মাঝেমধ্যে অত্যধিক সতর্কতাও অবলম্বন করা প্রয়োজন।কিন্তু আপনার বাচ্চা যতক্ষণ উষ্ণ এবং নিরাপদে সুরক্ষিত থাকে, ততক্ষণ এসব কিছুই ঠিক আছে।শীতের সুন্দর দিনগুলিতে আপনার শিশুর ভালভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য উপরে উল্লিখিত নির্দেশিকাটি অনুসরণ করুন আর আপনার বাচ্চা যদি এক–দু‘বার হাঁচিও দেয় অযথা আতঙ্কিত হবেন না।
প্রসবের পরে প্রথম কিছু দিন মা–বাবার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে পড়ে।আপনার শিশুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদাগুলিকে অনুধাবন করতে এবং তার কান্নার পার্থক্য বুঝতে আপনার কয়েক দিন সময় লাগবে কারণ তার প্রতিটি অসুবিধাই তারা তাদের ‘কান্নার’ মাধ্যমে প্রকাশ করে।তবে আপনি তা আপনার অভিজ্ঞতা দিয়েই শিখে যাবেন।তদুপরি, কোনও শিশুর যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে সেরকম কোনও স্থির ও নির্ধারিত উপায় নেই।আপনার নির্ধারিত পন্থাগুলির উপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখুন এবং কোনওরকম প্রশ্ন থাকলে আপনার শিশুর চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ
*অসতর্কতায় বা দুর্ঘটনাক্রমে গভীরে প্রবেশ করা বা হাঁটার সময় পিছলে যাওয়া এড়াতে প্রয়োগের স্থানগুলি হালকা করে আচ্ছাদিত রাখুন।সতর্কতার সাথে নির্দেশাবলী পড়ুন।নির্দেশ অনুসারে ব্যবহার করুন।
** সর্বদা ওষুধের লেবেল পড়ে নিন।শুধুমাত্র নির্দেশ অনুসারেই তা ব্যবহার করুন।লক্ষণগুলি যদি অব্যাহত থাকে তবে তা আপনার ডাক্তারবাবু অথবা একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারকে দেখান।