মা হিসেবে আমরা জানি যে,যখন আপনি আপনার ছোট্ট সোনাকে অনবরত কাঁদতে দেখেন সেটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে।এবং সবচেয়ে খারাপ অনুভূতি হল অসহায়তা,যেটি হয়, যখন আপনি জানেন না যে তার কষ্ট পাওয়া যন্ত্রণাটা কীভাবে আপনি কমাবেন অথবা কেন সে প্রথমে কাঁদছে।অনেক ক্ষেত্রেই এর কারণ হয়ে উঠতে পারে বেচারা পেট।
পেট ব্যাথা শিশুদের মধ্যে একটা সাধারণ সমস্যা।তাদের পাচন তন্ত্রগুলি এখনও কঠিণ/তরল খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে,সুতরাং তারা প্রায়শই গ্যাস,রিফ্লাক্স, অ্যাসিডিটি,ডায়রিয়া,বমি এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মত নানা সমস্যা ভোগ করতে পারে।যদিও এটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একটা ছোটখাটো শারীরিক সমস্যা কিন্তু একটা ছোট্ট শিশুর কাছে এটি এখনও প্রচুর অস্বস্তির কারণ হতে পারে এবং সেই কারণে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে এর যত্ন নেওয়া উচিত।
পেট যন্ত্রণার অনেক কারণ থাকতে পারে।কিছু পেট যন্ত্রণা খুব হালকা ধরনের হতে পারে এবং কোনওরকম চিকিৎসা ছাড়াই এর নিরাময় হয়ে যেতে পারে যখন কিছু ক্ষেত্রে আবার চিকিৎসাগত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।
গ্যাসের কারণে যন্ত্রণা প্রায় প্রতিটি শিশুকেই কোনও না কোনও সময়ে প্রভাবিত করে,তা সে স্তন দুধই পান করুক বা বোতলের দুধ।এটি বিশেষ করে 1- 4 মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে থাকে তাদের অনুন্নত পাচন তন্ত্রের জন্য।
যদি স্তন অথবা বোতল সঠিক ভাবে অবস্থান না করা হয়,বাচ্চা খুব বেশী বাতাস গ্রাস করে ফেলতে পারে যা পরবর্তীতে তার অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে।
যদি আপনি আপনার বাচ্চাকে খুব বেশি খাবার খাওয়ান,এটি স্বাস্থ্যের নানরকম সমস্যা ঘটাতে পারে যেমন পাচন তন্ত্রের ক্ষয়,পেট ফাঁপার কারণে ব্যথা ও পেটের উপরে চাপ সৃষ্টি এবং বমি।
কিছু বাচ্চা আবার এলার্জিপ্রবণ হতে পারে, তারা যে ফরমূলা দুধ খায় তার উপাদানগুলির প্রতি অথবা কিছু নির্দিষ্ট খাবারে।এই এলার্জি প্রতিক্রিয়াগুলিই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতে পারে যখন আপনার সন্তান সেই খাবারগুলিকেই খায় অথবা আপনার বুকের দুধের মাধ্যমেই এটি সে গ্রহণ করে।
এটি ঘটে থাকে যখন আপনার ছোট্ট সোনা মায়ের প্রথম হলদেটে স্তন দুধ অতিরিক্ত মাত্রায় খেয়ে ফেলে,যাতে ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে কিন্তু ল্যাকটোজের পরিমাণ বেশী থাকে।পাচন প্রক্রিয়াটিকে ধীর গতি সম্পন্ন করার জন্য এতে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পরিমাণ ফ্যাট না থকায় ল্যাকটোজ সঠিকভাবে পাচিত হয় না,তার ফলে অতিরিক্ত গ্যাস তৈরী হয়।
আমরা যেমনটি উপরে আলোচনা করেছি যে,ছোট বাচ্চাদের এমন একটি পাচন তন্ত্র থাকে যা খাদ্য,গ্যাস এবং মল প্রক্রিয়াকণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিকশিত নয়।তাদের মাইক্রফ্লোরা(অনন্য প্রকৃতির মাইক্রর্গানিজম বা অণুজীব যেগুলি অন্ত্রের অভ্যন্তরে বাস করে),যা তাদের হজম পদ্ধতিতে এবং অনাক্রম্যতার শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে,এখনও সেগুলি তৈরী হতে থাকে।আপনার ছোট্ট সোনার পেটে গ্যাস হওয়ার এটিও একটি কারণ হতে পারে।
স্তন দুধ পান করা শিশুদেরও গ্যাস হতে পারে যদি তাদের মায়েরা ফুলকপি,বীনস, পিঁয়াজ এবং বাঁধাকপির মত সবজিগুলি খাওয়া শুরু করেন।যদি আপনি এই ধরনের খাবারগুলি খেয়ে যদি দেখেন যে সেগুলি আপনার বাচ্চার মধ্যে কোনও পার্থক্য তৈরী করছে তবে সেগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকলে সব থেকে ভাল হয়।
শিশুর খাবারের পরিবর্তন,খাদ্যাভ্যাস অথবা জল খাওয়ার পরিমাণের পরিবর্তন শিশুর শুষ্ক এবং কঠিণ মল উৎপাদন করতে পারে।এটিও কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা শিশুর পেটে ব্যথার কারণ হতে পারে।
সাধারণত শিশুদের এক থেকে তিন মাস বয়সের মধ্যে তাদের কোনওকিছু খাওয়ানোর সাথে সাথেই সেই খাবারের কিছু অংশ তারা তাদের মুখ থেকে উগরে দেয়।এটি হয়, কারণ পাকস্থলী এবং খাদ্য নালীর মধ্যস্থ কবার্টিকাটি (ভাল্ভ)তখনও সম্পূর্ণ রূপে বিকাশপ্রাপ্ত হয় না।এই উগরে ফেলা খাবারের অংশটা আবার কিছু সময় পুনরায় মুখ এবং গলার মধ্যে ফিরে যায়,যার ফলে পরবর্তীতে পেট ব্যথা করে।
যদি শিশুর অন্ত্রে কোনও বাধা থাকে বা অতিরিক্ত বায়ুপূর্ণ হয়ে যায় তবে তার ফলে পেটে ব্যথা হতে পারে।
এমন অনেক প্রাকৃতিক প্রতিকার আছে যেগুলিকে আপনি আপনার ছোট্ট সোনার পেট ব্যাথা প্রশমিত করার কাজে নিযুক্ত করতে পারেন,তবে ধৈর্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আতঙ্কিত হবেন না আপনার ছোট্ট শিশুটি হল সেই একজন যার আপনার সাহায্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।
সবচেয়ে ভাল করণীয় বিষয়টি হল কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করে আপনার সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করুন এবং পরিস্থিতির তীব্রতা বিচার করুন।সাধারণত সময়ের সাথে পেট ব্যথা কমে যায়।যদি না কমে,তবে সেক্ষেত্রে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকার আছে যেগুলি আপনি অনুসরণ করার চেষ্টা করতে পারেন আপনার বাচ্চার পেট ব্যথায় স্বস্তিদান করার জন্য।
আপনার বাচ্চাকে কিছু পরিমাণ গরম ক্যামোমাইল চা(প্রতি টিব্যাগে এক কাপ জল) দিন।ডাক্তাররা বলেন যে,ক্যামোমাইলের প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি পেট ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে যেহেতু এটি পাচন তন্ত্রের উচ্চভাগের পেশীগুলিকে শিথিল করে দেয়, সংকোচনকে মুক্ত করে এবং পেটের খিঁচুনি কমায়।
পেট ব্যথা কমানোর অন্য একটি উপায় হল বাচ্চা যখন পেট ব্যথার কারনে কাঁদতে শুরু করে ধীরে ধীরে গরম সেঁক দিয়ে তার পেটের উপর চাপ দিন।এই কার্যপ্রণালীটি দিনে ও রাতে 2-3 বার পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
যদি ডায়রিয়ার জন্য আপনার বাচ্চার পেটে ব্যথা হয়,তখন ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলি মলের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে,যেগুলি পাকস্থলী এবং অন্ত্রের মধ্যে গ্রহণ করা পুষ্টি উপাদানগুলির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন।দইয়ের মধ্যে সেই ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলি থাকে যেগুলি সেই হারিয়ে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে,এবং আপনার বাচ্চাকে দই খাওয়ানোর ফলে তার পরিপাক পদ্ধতিটিকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।
আপনার সোনাকে চিৎ করে শুয়ে দিয়ে তার পেটের উপর সরষের তেল মালিশ করে দিন।বাচ্চার নাভির চারপাশে এটি প্রয়োগ করুন এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে হালকা চাপ দিয়ে মালিশ করতে থাকুন।এটি বাচ্চার পাচন তন্ত্রকে উদ্দীপিত করতে এবং আপনার সন্তানের পেটের ভিতরে আটকে থাকা গ্যাস অপসারণ করতে সাহায্য করবে।প্রতিদিন আপনার সন্তানকে মালিশ করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ন।
প্রতিবার খাওয়ানোর পর আপনার বাচ্চাকে ঢেকুর তোলান,যখন তার মাথাটি থাকবে আপনার কাঁধের উপর এবং আপনি তার পিঠে আলতো করা চাপড়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই কাজটি সম্পাদন করুন।যদি আপনের বাচ্চা সহজে ঢেকুর না তুলে থাকে,’ফুটবল হোল্ড‘ ব্যবহা্রের চেষ্টা করুন।তা্র পাগুলিকে আপনার কনুইয়ের দিকে ফাঁক করে তাকে আপনার হাতের সামনের দিক করে রাখুন।তার চিবুকটিকে আপনার হাতে রাখুন এবং তার পিঠে হালকা করে আঘাত করার সময় ধীরে ধীরে চাপ প্রয়োগ করুন।এই উপায়ে অতিরিক্ত বায়ু বের করে দেওয়া উচিত যা হয়ত তাকে খাওয়ানোর সময় তার দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে গিয়েছিল।
যখন আপনার বাচ্চা পিঠের উপর ভর দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে,তখন তার ছোট্ট পাগুলিকে নিয়ে বাইসাইকেলের গতিতে আগে–পিছে ঘোরান,এই আবর্তন তার পেট থেকে গ্যাস মুক্ত করে তার পেট যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করবে।
এক চিমটে হিং নিয়ে সেটিকে সামান্য উষ্ণ জলের মধ্যে গুলে নিন।এবার এই পেষ্টটিকে বাচ্চার নাভির চারপাশে ধীরে ধীরে প্রয়োগ করুন।এটি গ্যাস মুক্ত করতে এবং আপনার বাচ্চার পেট যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করবে।
পেট যন্ত্রণায় আপনার বাচ্চা কাঁদতে থাকলে তাকে দোলা দিতে থাকুন,এটি আপনার সন্তানের অতিরিক্ত গ্যাস, চলাচলের মাধ্যমে অপসারণে সাহায্য করতে পারে।শুধু এই কান্না থেকেই সে আরও বায়ু গ্রাস করে ফেলে যা তার আরও বেশী গ্যাস তৈরীর কারণ হয়ে ওঠে।তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার বাচ্চার কান্নাটিকে থামান।
কিছু কৌশল পায়ের পাতার বিভিন্ন স্নায়ুতে প্রয়োগ করা যেতে পারে,যেগুলি শরীরের অন্যান্য অংশে আরামবোধ সৃষ্টি করবে।উদর অঞ্চলটি, বাম পায়ের পাতার কেন্দ্রীয় খিলানের সাথে অনুরূপ।অতএব,আপনার বাচ্চার বাম পায়ের পাতাটি আপনার ডান হাতের তালুর মধ্যে নিন এবং তার পায়ের পাতার বলকে সমর্থন করার সময় অবিরত আপনার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে যান।এটি আপনার বাচ্চাকে আরাম দেবে এবং তার পেট ব্যথা কমাতেও সাহায্য করবে।
এছাড়াও আরও অন্যান্য ঘরোয়া প্রতিকার আছে,যেমন আদার জল,মৌরি,পিপারমিন্ট বা মেন্থলের চা এবং মধু,কিন্তু উপরে উল্লিখিত এগুলির বেশীরভাগটাই বেশ কার্যকর, যেহেতু সারা বিশ্ব জুড়ে প্রায় সকল মায়েদের দ্বারাই এগুলি পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত।প্রাকৃতিক প্রতিকার ব্যব্যহার করা সব সময়ের জন্যই সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে যাতে আপনার ছোট্ট সোনার তন্ত্রগুলি বাইরের কোনও বিকারক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
এখন,মাঝেমধ্যেই আপনি দেখতে পারেন যে,উপরের সকল প্রকার ব্যবস্থা আপনার বাচ্চার সাথে প্রয়োগ করার চেষ্টা করার পরেও সে পেটে ব্যথায় ভুগছে।সে এখনও অনবরত কেঁদে যেতে পারে এবং পেটে ব্যথা বা গ্যাসের কারণে অস্বস্তিবোধ করতে পারে।এইসব ক্ষেত্রে,অবিলম্বে আপনার শিশুরোগ বিশ্বষজ্ঞের সাথে আলোচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যদি আপনি লক্ষ্য করে থাকেন যে,আপনার বাচ্চা ক্রমাগত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি প্রদর্শন করাতে থাকেঃ
যদি কোনও ক্ষেত্রে আপনার ছোট্ট সোনার সাধারণ পেটে ব্যথাটি আরও কিছুটা গুরুতর হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আপনার সন্তানকে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ করতে পারেন।
শিশুরা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে গ্যাস এবং পেটের সমস্যাগুলি কমতে থাকে এবং বেশি রোগ প্রতিরোধক হয়ে ওঠে।এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং বেশীরভাগ সময়েই খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে না এবং সাধারণ কিছু ঘরোয়া প্রতিকারের সাহায্যেই এটা খুব তাড়াতাড়িই সেরে যায়।কিন্তু এর সাথে এটা জানাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে কখন এর জন্য সাহায্যেরও প্রয়োজন আছে।আপনার বাচ্চা যদি আশঙ্কাজনক লক্ষণগুলি প্রকাশ করে তবে সেক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।