গর্ভাবস্থা একজন মহিলার জীবনে বহু পরিবর্তন নিয়ে আসে।আনন্দ আনা সত্ত্বেও,এটা আবার মর্নিং সিকনেস,বমি বমি ভাব,কোমড়ে যন্ত্রণা,মাথা ধরা ইত্যাদির মত নানা সমস্যাও নিয়ে আসে।যদিও মর্নিং সিকনেস,মেজাজের দোলাচল অথবা কোমড়ে যন্ত্রণার মত উপসর্গগুলি বিস্তারিত ভাবে বহু চর্চিত,কিন্তু যোনি স্রাব এবং যোনি গন্ধের মত অন্যান্য উপসর্গগুলি প্রায়শই উপেক্ষিত হয়ে থাকে।কিছু মহিলা আবার তাদের মধ্যে যোনি থেকে অস্বাভাবিক গন্ধও অনুভব করে থাকে।আসুন জেনে নেওয়া যাক এই যোনি গন্ধের কারণগুলি কি এবং এই অপ্রীতিকর গন্ধ থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনি কি করতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কোনও মহিলার যোনি স্রাব হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।কিছু মহিলা আবার যোনি-দুর্গন্ধও লক্ষ্য করতে পারেন।গর্ভাবস্থায় যোনি-দুর্গন্ধ হওয়াটা আপনার ভাবনার থেকেও অনেক বেশি সাধারণ।65% এর বেশী মহিলাদের মধ্যেই তাদের গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে যোনি-গন্ধ থাকে।গর্ভাবস্থায় 10 জনের মধ্যে কমপক্ষে 6 জন মহিলাই তাদের যোনি থেকে আঁশটানি গন্ধ অনুভব করেন।সুতরাং হ্যাঁ,এটা হওয়া স্বাভাবিক।
গর্ভাবস্থায় যোনির তীব্র দুর্গন্ধ হতে পারে pH এর ভারসাম্যের পরিবর্তনের ফলে,ঘাম, সংক্রমণ,হরমোন এবং খাদ্য তালিকার পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে।এটি হওয়ার কারণের পিছনে যদি কোনও চিকিৎসাগত শর্ত না থাকে তবে সে ক্ষেত্রে আপনি একবার সন্তান প্রসবের পরেই সেই দুর্গন্ধ উধাও হয়ে যাবে।যে সব মহিলা গর্ভবতী নন তাদের মধ্যেও গন্ধযুক্ত যোনি থাকতে পারে তাদের ঘাম এবং খাদ্যগত পরিবর্তনের কারণে।
যোনি-গন্ধের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কারণগুলি হলঃ
গর্ভাবস্থায় যোনি সংক্রমণের ফলে তা তীব্র বা দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে।যোনিতে প্রাকৃতিকভাবেই অতিরিক্ত গুণিতকে ছত্রাক বৃদ্ধির কারণে একটি ইস্ট সংক্রমণ হয়ে থাকে।এই কারণে অবিরাম চুলকানি এবং দুর্গন্ধের সহিত স্রাব নির্গত হয়ে থাকে। ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনসিস হল এমন এক সংক্রমণ যা যোনির মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারের কারণে হয়।এটির জন্যও গর্ভাবস্থায় দুর্গন্ধ যুক্ত স্রাব হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় গন্ধ যুক্ত যোনির আরেকটি অন্যতম কারণ হল গর্ভাবস্থাকালে খাদ্যগত পরিবর্তন।উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,যদি আপনি গর্ভাবস্থাকালে বেশি পরিমানে রসুন অথবা মশলাদার খাবার খান,তবে এটি আপনার যোনি স্রাবের গন্ধের পরিবর্তন করতে পারে।
যোনির স্বাভাবিক pH এর মাত্রা হল 3.8-4.5 এর মধ্যে,যা আম্লিক পরিসরের মধ্যে পরে।এই অ্যাসিডিক pH উপকারী ব্যাকটিরিয়া বা প্রাকৃতিক যোনি ফ্লোরার কারণে ঘটে যা যোনিতে থাকে এবং ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপাদন করে।গর্ভাবস্থায়,যোনি অঞ্চলে অতিরিক্ত রক্ত সরবরাহ হওয়ার কারণে এই pH এর পরিবর্তন হয়।এটি ভ্যাজিনাইটিসের মত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের জন্য যোনিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে এবং এই কারণে যোনি থেকে আঁশটানি গন্ধযুক্ত স্রাব নির্গত হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার দেহে অসংখ্য হরমোনের পরিবর্তন ঘটে।গর্ভাবস্থাকালে প্রোজেস্টেরণ এবং ইস্ট্রোজেন নামক এই দু ধরনের হরমোনের উৎপাদন হঠাৎ বৃদ্ধি পায়।শরীরের মধ্যে এই দুই হরমোনের নাটকীয় বৃদ্ধি অমরার গঠণে এবং শিশুর যথাযথ পরিচর্যা সরবরাহে সাহায্য করে থাকে।যখন কোনও মহিলা গর্ভবতী হন,তার প্রোল্যাকটিনের মাত্রাও বাড়বে,যা পরবর্তীতে তার বুকের দুধ উৎপাদনে সাহায্য করে।হরমোনের এই পরিবর্তনগুলি যোনি স্রাবের পরিমাণ বাড়াতে পারে এবং সেটিকে গন্ধযুক্ত করে তুলতে পারে।
যোনি দুর্গন্ধ এবং গন্ধযুক্ত স্রাবের চিকিৎসা নিম্নলিখিত উপায়গুলির দ্বারা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
আপনি যখন গর্ভবতী,তখন আপনার যোনিকে পরিষ্কার এবং শুকনো রাখা নিশ্চিত করা উচিত। মাঝে মাঝেই ঈষদুষ্ণ জলের ধারায় যোনি অঞ্চল পরিষ্কার করুন। এছাড়াও আপনি কোনও হালকা ধরনের সাবান অথবা কোনও মহিলাগত হাইজিন ওয়াশ ব্যবহার করতে পারেন,যদি ডাক্তারবাবু নির্দেশ দিয়ে থাকেন।এছাড়াও গুপ্ত লোমগুলিকে ছোট ছোট এবং ঝরঝরে রাখুন।
সুগন্ধিযুক্ত মহিলাগত স্প্রে,যোনি পরিষ্কারের ওয়াইপ ইত্যাদির মত প্রসাধনীগুলির ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।এছাড়াও ত্বকের জন্য কড়া এবং যোনিতে অবস্থিত প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়াগুলিকে কেটে ফেলে সংক্রমণকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে এমন ধরনের সাবান জাতীয় পণ্য ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
একটি সিন্থেটিক অন্তর্বাস পছন্দের পরিবর্তে সুতিরগুলিকে নির্বাচন করুন।একটি নরম,সুতির অন্তর্বাস পরিধান করলে তাতে বাতাস চলাচলের মাধ্যমে ত্বকের শ্বাস ভালোভাবে হবে এবং অতিরিক্ত ঘাম শুঁষে নেবে।
গর্ভাবস্থাকালে খাদ্যগত পরিবর্তন সাধন করা অনিবার্য।আপনার খাবারের সাথে প্রচুর পরিমাণে ফল এবং সবজিকে যুক্ত করুন।বেশি মশলাদার খাবার অথবা অতিরিক্ত রসুন যুক্ত খাবারগুলিকে এড়িয়ে চলুন।এটিতে ঘামের গন্ধ পরিবর্তিত হতে পারে এবং যোনি-দুর্গন্ধ কমাতে পারে।
যদি যোনি-দুর্গন্ধের কারণ কোনও সংক্রমণ হয়ে থাকে,একজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন এবং আপনার ডাক্তারের নির্দেশিত ওষুধই গ্রহণ করুন।
গর্ভাবস্থাকালে বিশ্রী যোনি দুর্গন্ধের কারণ হতে পারে ঘাম অথবা খাদ্যগত পরিবর্তনের মত সাধারণ জিনিসগুলি,তবে এটি হওয়ার পিছনে আপনার কোনও সংক্রমণ কিম্বা আর অন্য কোনও শর্ত আছে কিনা,যা আপনার বাচ্চার জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে,সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে একজন ডাক্তারের সাথে আলচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।নিম্নলিখিত পরিস্থিতিগুলির ক্ষেত্রে,আপনার একজন দক্ষ মেডিক্যাল পেশাদারীর সাথে আলোচনা করা উচিত।
গর্ভাবস্থাকালে কখনও কখনও একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে।এটি যদি আবার হলুদ অথবা সবুজ স্রাবের সাথে হয়ে থাকে,আপনার একজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা উচিত।একটা হলুদ অথবা সবুজ স্রাব সাধারণত ইস্ট অথবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের লক্ষণ এবং সেটিকে কখনই হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।
যোনিতে বিরক্তিকর অথবা অসামালযোগ্য চুলকানি আবার মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণের একটি লক্ষণ,এবং এক্ষেত্রে অবিলম্বে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনার পরামর্শ দেওয়া হয়।
যৌনাঙ্গ প্রেরিত রোগগুলিও তীব্র দুর্গন্ধের সহিত অতিরিক্ত যোনি স্রাবের কারণ হতে পারে।একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে সেই অবস্থার চিকিৎসার জন্য আপনাকে ওষুধ দিতে পারেন এবং আপনি এবং আপনার সন্তান সুস্থ রয়েছেন তা সুনশচিত করতে পারেন।
সঙ্গম অথবা প্রস্রাব করার সময় যন্ত্রণা অথবা জ্বলন অনুভব করা হল একটি সংক্রমণেরই লক্ষণ।প্রদাহ এবং চুলকানিগুলি হল সংক্রমণের লক্ষণের পূর্বাভাস এবং এ ব্যাপারে আপনার সঠিক ভাবে ডাক্তার দেখানো উচিত।
যদি আপনার যোনি স্রাবের মধ্যে রক্ত লক্ষ্য করেন,যদি এটির গঠণ কটেজ চীজের ন্যায় হয়,যদি এটি আঁশটানি গন্ধযুক্ত হলদেটে অথবা সবুজাভ হয়ে থাকে,এটি আপনার দেহে কিছু ভুল হওয়ারই ইঙ্গিত দেয়।আপনার এ ব্যাপারে এখনই একজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা উচিত।
ভাল স্বাস্থ্যবিধি বিশ্রী দুর্গন্ধ যুক্ত যোনি স্রাবকে প্রতিরোধ করতে পারে।এখানে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল যেগুলি আপনি অনুসরণ করতে পারেন গন্ধযুক্ত স্রাব রোধ করার জন্য।
1.হাইড্রেট থাকুনঃ যোনি থেকে দুর্গন্ধ দূর করার সবথেকে ভাল একটি উপায় হল হাইড্রেট বা জলয়োজন থাকা।নিয়মিত নূন্যতম 2-3 লিটার তরল পান করুন।
2.সামনে থেকে পিছনের দিকে মুছে নিনঃ আপনার যোনিতে ফিকাল ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে কমাতে সর্বদা যোনি থেকে মলদ্বারের দিকে মুছুন।
3.ডাচ করবেন নাঃ ডাচিং আপনার যোনির কলাগুলিকে অতিষ্ঠ করতে পারে এবং আপনার মূত্র নালীর মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশে সাহায্য করে সংক্রমণকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।আপনি আপনার যোনি ঈষদুষ্ণ জল দিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন।সুগন্ধি সাবান এবং স্প্রে ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন নেই।
গর্ভাবস্থায় একটি দুর্গন্ধ যুক্ত যোনির অর্থ যা কিছুই হতে পারে।এটি হরমোনের ওঠা-নামার মত অক্ষতিকারক হতে পারে অথবা এটি সংক্রমণের একটা ইঙ্গিতও হতে পারে।সৌভাগ্যক্রমে,এক্ষেত্রে এমন বহু প্রতিকার আছে যেগুলি দুর্গন্ধকে হ্রাস করে সম্পূর্ণরূপে এটিকে দূর করতে পারে।যদি আপনার গন্ধ যুক্ত যোনি স্রাব হয়ে থাকে,আপনি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা নিশ্চিত করুন।তবে,যদি সমস্যা ক্রমশ গুরুতর হয়ে উঠতে থাকে,একজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করাই হবে আপনার সবচেয়ে সেরা বাজি।