In this Article
পাস্তা হল অন্যতম জনপ্রিয় একটি ইতালিয়ান খাবার। হোয়াইট সস বা রেড সস পাস্তার একটি প্লেট সারা বিশ্বের মানুষের কাছে দারুণ প্রিয়। তবে গর্ভাবস্থায় পাস্তা খাওয়া কি নিরাপদ? জেনে নিন।
আপনি কি গর্ভবতী অবস্থায় পাস্তা খেতে পারেন?
সঠিক উপাদান ব্যবহার করে তৈরি করা হলে পাস্তা ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ফাইবার সমৃদ্ধ জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ হতে পারে। তবে এটি মনে রাখা জরুরী যে পাস্তায় ল্যাকটিন এবং ফাইটেটসও রয়েছে যা শিশুর মধ্যে জিংক ও ম্যাগনেসিয়ামের পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি করে। তাছাড়া, বেশিরভাগ পাস্তাগুলি সাধারণত পরিশোধিত ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয়, যা খুব একটা স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয় না। সমগ্র শস্যের গম দিয়ে তৈরি পাস্তা গর্ভাবস্থায় খাওয়া যায়, তবে কেবল পরিমিতভাবে।
কোন ধরণের পাস্তাকে ভাল বিবেচনা করা হয়?
পাস্তা সুস্বাদু, সস্তা এবং রান্না করাও সহজ। তবে এটিকে খুব পুষ্টিকর বলে মনে করা হয় না। এর মানে কি আমাদের পাস্তা খাওয়া বন্ধ করা উচিত? না। আজকাল, এমন অনেকগুলি স্বাস্থ্যকর বিকল্প রয়েছে যা এই খাবারের পুষ্টির মান বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাদের কয়েকটি নীচে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
১. সমগ্র গমের পাস্তা
সমগ্র গমের পাস্তা মিহি ময়দা থেকে তৈরি পাস্তার একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প, কারণ এতে প্রচুর ফাইবার এবং প্রোটিন রয়েছে। এটি স্থূলত্ব, হৃদরোগ, সেকেন্ড টাইপ ডায়াবেটিস এবং কয়েক ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে। তবে, যে ব্যক্তিরা গ্লুটেনের প্রতি সংবেদনশীল বা যাদের সিলিয়াক রোগ রয়েছে তাদের এটি এড়ানো উচিত।
২. কুইনোয়া পাস্তা
কুইনোয়া পাস্তা কুইনোয়া ময়দা থেকে তৈরি, যা কুইনোয়া বীজ পিষে উত্পাদিত হয়। কুইনোয়া পাস্তা প্রোটিনে সমৃদ্ধ, এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে এবং এটি গ্লুটেন–মুক্ত, যা এটিকে সব ধরণের পাস্তার মধ্যে সেরা এবং স্বাস্থ্যকর করে তোলে। এটি রক্তে শর্করা, ইনসুলিন এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হ্রাস করে বলে মনে করা হয়।
৩. স্পেল্ট পাস্তা
স্পেল্ট এমন একটি দানাশস্য, যা গমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। স্পেল্ট পাস্তা ফাইবারে পূর্ণ এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ। এটিতে মাঝারি পরিমাণে গ্লুটেন থাকে। সুতরাং, গ্লুটেনের প্রতি সংবেদনশীলতাযুক্ত মানুষদের এড়ানো উচিত। তবে হালকা গ্লুটেন অসহিষ্ণুতাযুক্ত মানুষরা এটি খেতে পারেন।
৪. ব্রাউন রাইস পাস্তা
ব্রাউন রাইস পাস্তা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমে (আইবিএস) আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আদর্শ। এটি গ্লুটেন মুক্ত এবং এফওডিএমএপ (ফার্মেন্টেবল অলিগোস্যাকচারাইডস, ডিসাকচারাইডস, মনোস্যাকচারাইডস অ্যান্ড পলিওল) থেকে মুক্ত হয় – অর্থাৎ আইবিএসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্বারা অণুগুলি শোষিত হয় না।
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পাস্তা খাওয়ার কি কোনো স্বাস্থ্যকর উপকারিতা আছে?
সঠিক উপায়ে এবং সঠিক জিনিস দিয়ে তৈরি করা হলে পাস্তা ভরাটি এবং পুষ্টিকর। অত্যন্ত পছন্দসই এই খাবারের উপকারিতাগুলি নীচে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
১. ফাইবার সমৃদ্ধ
হোলগ্রেইন পাস্তা সবুজ শাক সহ অনেক শাকসবজি দিয়ে তৈরি করা হয়, যা ফাইবার এবং খনিজগুলির একটি ভাল উত্স হতে পারে।
২. গ্লুটেন মুক্ত
যদি আপনাকে গ্লুটেন মুক্ত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় তবে আপনি ব্রাউন রাইস পাস্তা এবং কুইনোয়া পাস্তা খেতে পারেন। উপরে বলা হয়েছে, এই ধরণের পাস্তা গ্লুটেন–মুক্ত এবং তাই আইবিএস বা অন্যান্য গ্যাস্ট্রো সংক্রান্ত সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিরাপদ।
৩. রক্তচাপ এবং রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে
সমগ্র গমের পাস্তা, কুইনোয়া পাস্তা এবং অঙ্কুরিত শস্যের পাস্তা রক্তে শর্করার মাত্রা ও রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে বলে পরিচিত। বিশেষত কুইনোয়া পাস্তা স্থূলত্বের সম্ভাবনা হ্রাস করে, এইভাবে গর্ভবতী মহিলাদের হৃদরোগ এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে।
৪. ফলিক এসিড এবং আয়রন সমৃদ্ধ
সমগ্র গমের পাস্তা ফোলিক অ্যাসিড এবং আয়রন সমৃদ্ধ, যা মাতৃগর্ভে শিশুর সামগ্রিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।
৫. অন্ত্রের আন্দোলন উন্নত করে
সমগ্র গমের আটা এবং কুইনোয়া আটা থেকে তৈরি পাস্তাতে প্রচুর ফাইবার থাকে। উন্নত অন্ত্রের গতিবেগের জন্য আপনার খাবারে সবুজ শাকসব্জী যুক্ত করা উচিত, এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং রক্তক্ষরণের মতো সাধারণ গর্ভাবস্থার সমস্যা রোধ করে।
৬. শক্তির স্তর বৃদ্ধি করে
পাস্তায় থাকা কার্বোহাইড্রেট উপাদান গর্ভবতী মহিলাদের শক্তির স্তর উন্নত করতে সহায়তা করে এবং তাদের সক্রিয় রাখে।
৭. সংক্রমণ প্রতিরোধ করে
পাস্তায় থাকা ভিটামিন এ সামগ্রী গর্ভাবস্থা জুড়ে বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণকে বাধা দেয়।
গর্ভবতী অবথায় পাস্তা খাওয়ার ঝুঁকি
গর্ভাবস্থায় পাস্তা খাওয়ার সাথে কিছু ঝুঁকি যুক্ত রয়েছে, যা এখানে জানানো হল।
১. ফাইটেটস এবং ল্যাকটিন রয়েছে
পাস্তায় ফাইটেটস এবং ল্যাকটিন রয়েছে। ফাইটেটস গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় দুটি পুষ্টি ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্ক শোষণ থেকে শরীরকে বাঁধা দেয়। ল্যাকটিনগুলি অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে রক্তে বিষক্রিয়া প্রবেশের জন্য উত্সাহ দেয়।
২. গ্লুটেনের উপস্থিতি
বেশিরভাগ ধরণের পাস্তায় গ্লুটেন থাকে। অতএব, যে সমস্ত ব্যক্তিরা গ্লুটেনের প্রতি সংবেদনশীল বা আইবিএস বা সেলিয়াক রোগে ভুগছেন তাদের পাস্তা খাওয়া এড়ানো উচিত। বেশি পরিমাণে গ্লুটেন খাওয়ার ফলে মহিলাদের মধ্যে অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দেয়, কারণ এটি লক্ষণগুলি আরও বাড়িয়ে তোলে এবং সমস্যা তৈরি করতে পারে।
৩. ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি প্রসব শ্রমের সময় জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই গর্ভবতী মহিলাদের এমন খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত যা ওজন বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার মধ্যে একটি হল পাস্তা।
৪. আয়রনের উপস্থিতি
আয়রন গ্রহণ রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে, তবে অন্য দিক থেকে ভাবলে, খুব বেশি আয়রন কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করতে পারে, যা হেমোর্রয়েডের কারণ হতে পারে।
৫. রক্তে সুগার বৃদ্ধি
যদি কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন তবে পরিশোধিত গমের ময়দা থেকে তৈরি পাস্তা আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। অতএব, সমগ্র গমের আটা বা কুইনোয়া আটা থেকে তৈরি পাস্তা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
গর্ভবতী অবস্থায় পাস্তার লোভ কিভাবে পরিচালনা করবেন
কোনো খাবারের প্রতি লোভ গর্ভাবস্থার একটি অংশ। তবে পাস্তা এমন একটি খাবার যা উচ্চ শর্করাযুক্ত ও (প্রায়শই) গ্লুটেন উপাদান থাকে এবং বেশিরভাগ পরিস্থিতিতে এড়ানো উচিত। আপনি যদি নিজের লালসাকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তবে সেগুলি পরিচালনা করার কয়েকটি উপায় এখানে দেওয়া হল:
- রান্না করার সময় বেশি শাক–সবজি এবং কম পাস্তা রাখার চেষ্টা করুন। এইভাবে, আপনি আপনার লালসাকে তৃপ্ত করতে এবং স্বাস্থ্যকরভাবে খেতে সক্ষম হবেন।
- অল্প পরিমাণে খান। একসাথে অনেকটা খাবেন না।
- হোয়াইট সস পাস্তা না খেয়ে স্বাস্থ্যকর রেড সস পাস্তা বা একটি সাধারণ অলিভ ওয়েল পাস্তা খান।
- পরিশোধিত সাদা ময়দার পাস্তার পরিবর্তে আপনার রান্নায় সমগ্র–গমের পাস্তা বা কুইনোয়া পাস্তা ব্যবহার করুন।
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পাস্তার স্বাস্থ্যকর রেসিপি
স্বাস্থ্যকরভাবে খেতে এবং আপনার লালসা পরিচালনা করতে এখানে দুটি পাস্তা রেসিপি রয়েছে।
১. মশলাদার চিংড়ি টমেটো পাস্তা
খাদ্যপ্রেমীদের জন্য এটি একটি সহজ এবং সুস্বাদু পাস্তা রেসিপি। এটি রান্না করা সহজ এবং উপাদানগুলি সহজেই পাওয়া যায়।
আপনার যা দরকার
- সমগ্র গম / কুইনোয়া / ব্রাউন রাইস পাস্তা – ২০০ গ্রাম
- অলিভ তেল – ২ চামচ
- রসুন – ৪–৫ কোয়া
- চিংড়ি (পরিষ্কার করা ও ধোওয়া) – ১০০ গ্রাম
- টাটকা টমেটো (ডাইস করে কাটা) – ৩–৪টি
- শুকনো লঙ্কা রোস্ট করে গুঁড়িয়ে নেওয়া (ঐচ্ছিক)
- গোলমরিচ গুঁড়ো
- টাটকা ধনে পাতা (কুচি করা)
- মাখন – ২ চামচ
- লবন।
পদ্ধতি
- প্যাকেজের নির্দেশাবলী অনুযায়ী ফুটন্ত জলের একটি বড় পাত্রে পাস্তা সিদ্ধ করুন।
- পাস্তাকে একটি ছাকনিতে ফেলে দিন এবং আলাদা করে রাখুন।
- একটি প্যান গরম করুন এবং অলিভ তেল ও মাখন যোগ করুন। রসুন কুচি করে করে প্যানে ভাজুন। রসুন ভাজা হয়ে গেলে চিংড়ি যোগ করুন।
- কয়েক মিনিটের জন্য চিংড়িটি রেখে দিন এবং প্যান থেকে বের করে নিন। একপাশে সরিয়ে রাখুন।
- এবার ডাইস করা টমেটো, শুকনো লঙ্কার ফ্লেক্স ও গোলমরিচ গুঁড়ো যোগ করুন।
- টমেটো সিদ্ধ হয়ে গেলে এবং সসের মতো ঘনত্ব তৈরি হলে, সিদ্ধ করা পাস্তা এবং ভাজা চিংড়ি যুক্ত করুন।
- সসের মধ্যে পাস্তা ভাল করে রান্না করুন এবং লবণ যোগ করুন। ভালো করে নাড়ুন।
- আঁচ বন্ধ করে ধনেপাতা কুচি যোগ করুন। গরম গরম পরিবেশন করুন।
২. ভেজি পাস্তা
এই সহজ এবং হালকা পাস্তার ডিশটি আপনার গর্ভাবস্থায় আপনার যা প্রয়োজন একেবারে সেটাই।
আপনার যা দরকার
- কুইনোয়া পাস্তা / সমগ্র–গমের পাস্তা / ব্রাউন রাইস পাস্তা – ৪ কাপ
- ব্রোকলি – ৪–৫টি খন্ড
- গাজর (ডাইস করে কাটা) – ১/৪ কাপ
- লাল বেলপেপার (পাতলা সরু করে কাটা) – ১/৪ কাপ
- পেঁয়াজ (পাতলা করে কাটা) – ১/৪ কাপ
- রসুন (সূক্ষ্ম কুচি করে কাটা) – ৩–৪ কুচি
- জুচিনি (পাতলা করে কাটা) – ১/৪ কাপ
- চেরি টমেটো – ১/২ কাপ
- সবুজ মটরশুটি – ১/২ কাপ
- পরমেশান চীজ (গ্রেট করা) – ১/২ কাপ
- অলিভ তেল – ৪–৫ চামচ
- লবন।
পদ্ধতি
- একটি বড় পাত্রে, জল ফুটিয়ে নিন এবং পাস্তা সিদ্ধ করুন। পাস্তা নরম হয়ে যাওয়ার পরে, এটি ঠান্ডা জলে রাখুন।
- তারপরে, একটি বড় প্যানে তেল দিন। তেল গরম হয়ে এলে কুচিকরা রসুন দিন। গন্ধ না বের হওয়া পর্যন্ত এটি ভাজুন।
- পেঁয়াজ যোগ করুন এবং বাদামী হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ভাজুন। তারপরে ব্রোকলি (আধা–সিদ্ধ করা), গাজর, লাল বেলপেপার, মটরশুঁটি এবং জুচিনি যোগ করুন। সবজিগুলি নরম না হওয়া পর্যন্ত কয়েক মিনিটের জন্য নাড়াচাড়া করুন। চেরি টমেটো যোগ করুন।
- পাস্তা এবং লবণ যোগ করুন।
- সব উপকরণ একসঙ্গে মেশান। শেষে গ্রেটেড চীজ যোগ করুন এবং গরম গরম পরিবেশন করুন।
অন্যান্য খাবারের মতো, গর্ভাবস্থায় পাস্তাও সাবধানতার সাথে খাওয়া উচিত। এর অত্যধিক কারণে স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা প্রসব শ্রমের সময় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বা আপনার গর্ভের শিশুর উপর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। মনে রাখবেন যে, গর্ভাবস্থায় আপনার খাদ্যাভাসের যত্ন নেওয়া একটি স্বাস্থ্যকর শিশুর প্রসব করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়ে দেয়।