In this Article
গর্ভাবস্থা প্রতিটি মহিলার জীবনে একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময়। গর্ভবতী হওয়া বাচ্চা হওয়ার রোমাঞ্চ এবং আনন্দকে ডেকে আনে, তবে এটি চাপ, রাগ, বিরক্তি এবং উদ্বেগের অনুভূতিগুলিতেও একজন মহিলাকে আক্রান্ত ও দুর্বল করে তোলে। যদিও গর্ভাবস্থাকালীন সময়ে রাগ এবং হতাশ হওয়া একেবারে স্বাভাবিক, ক্রমাগত ক্রোধের কিছুটা প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে। মা-সন্তানের বন্ধন এমন যে শিশু তার মায়ের ক্রোধ সহ সমস্ত কিছুই অনুভব করে।
এগুলি বাদ দিয়ে, দীর্ঘমেয়াদী দমন করা ক্রোধের ফলে হতাশার সৃষ্টি হতে পারে – এটি কেবল কোন সম্পর্কের উপর বিরূপ প্রভাবই ফেলে না, পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, হাঁপানি, মাথা ব্যথা এবং হজমজনিত সমস্যার মতো চিকিৎসাগত পরিস্থিতিরও কারণ হতে পারে। এটি শিশুর জন্য একটি অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারে যা গর্ভাবস্থার জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের পক্ষে ইতিবাচক ও শান্ত থাকা জরুরী, এবং বিভিন্ন ধরণের আবেগগুলি কোনওভাবেই তাদের উপর প্রভাব ফেলতে দিতে নেই।
গর্ভবতী অবস্থায় যে কারণগুলি ক্রোধের কারণ হতে পারে
গর্ভবতী অবস্থায় ক্রোধের কারণ হতে পারে এমন কয়েকটি কারণ হল:
১. হরমোন পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় ক্রোধকে গর্ভাবস্থার হরমোনকে ওঠানামা করানোর জন্য দায়ী করা যেতে পারে। এই সময়ে হরমোনের পরিবর্তনগুলি নিয়মিত মেজাজের পরিবর্তন, অতি সংবেদনশীলতা এবং দৃঢ় ও তীব্র অনুভূতিগুলিকে ট্রিগার করতে পারে। সাধারণত, ক্রোধের উৎসাহগুলি এমন কিছু বিরক্তিকর পরিস্থিতির সাথে সনাক্ত করা যেতে পারে যা এর আগে ঘটেছিল।
২. স্ট্রেস
গর্ভাবস্থায় কিছুটা চাপ অনুভব করা সাধারণ বিষয়। শারীরিক অস্বস্তি, অপর্যাপ্ত বিশ্রাম, ঘুমের অভাব, একটি অসমর্থনকারী সঙ্গী, কাজের একটি অতিরিক্ত বোঝা, চাকরি সম্পর্কিত চাপ এবং আর্থিক উদ্বেগের কয়েকটি কারণে মানসিক চাপ হতে পারে। ক্রমাগত চাপ যে কোন মানুষের ক্রোধ পরিচালনার ক্ষমতাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং রাগান্বিত করতে পারে।
৩. ভয়
গর্ভাবস্থায় রাগের আরেকটি কারণ অজানা কিছুর বা ভবিষ্যতের ভয় হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভাবস্থার সুগমভাবে অগ্রগতি, প্রসব শ্রমের বেদনা, অনাগত শিশুর স্বাস্থ্য অথবা কোন সম্ভাব্য জটিলতা বা অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ থাকতে পারে। এই ভয়গুলি বেশ অপ্রতিরোধ্য হতে পারে এবং রাগ তাদের জন্য একটি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াতে পরিণত হতে পারে।
৪. অস্বস্তি
এই পর্যায়ে সংঘটিত শারীরিক পরিবর্তনের কারণে গর্ভাবস্থায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অস্বস্তি হওয়া অনিবার্য। গর্ভবতী মহিলারা সাধারণত অন্যান্য জিনিসগুলির মধ্যে অসুস্থতা, বমি বমি ভাব এবং ক্লান্তি অনুভব করেন। অস্বস্তির কারণে অপ্রত্যাশিত সময়ে রাগের মতো বিরক্তি বা তীব্র আবেগ দেখা দিতে পারে, বিশেষত যদি অস্বস্তির কারণগুলি যথাযথভাবে মোকাবেলা করা না হয়।
রাগ কি আপনার অনাগত সন্তানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে?
রাগ অনুভব করা একজন গর্ভবতী মহিলার কিছুটা জৈবিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হতে পারে, যেমন উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট রেট বাড়া; এপিনেফ্রিন ও অ্যাড্রেনালিনের মতো হরমোনগুলির মাত্রা বেরে যায়, যার ফলে রক্তনালীগুলি সঙ্কীর্ণ হয়। এটি ভ্রূণের অক্সিজেন এবং রক্তের সরবরাহ হ্রাস করে, যা শিশুর বিকাশের জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় দীর্ঘায়িত বা চরম রাগের কারণে এমনকি প্রসবের সময় কিছু জটিলতা বাড়ে, এমন প্রবণতা থাকতে পারে। এটি বিশ্বাস করা হয় যে গর্ভাবস্থায় ক্রমাগত ক্রুদ্ধ হওয়া শিশুকে নিম্নলিখিত উপায়ে প্রভাবিত করে:
- কম জন্মগত ওজন
- অকাল প্রসব
- শিশুর মেজাজের উপর বিরূপ প্রভাব (আরও বেশি বিরক্তি ও হতাশার ঝুঁকিতে)
- কোনও শিশু হাইপারেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
- সীমাবদ্ধ জ্ঞানীয় ক্ষমতা।
ক্রোধ মোকাবেলার টিপস
আপনাকে নিজের চেয়ে ভাল আর কেউই জানে না, তাই আপনি নিজের ক্রোধ শিথিল করতে এবং পরিচালনা করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন। গর্ভাবস্থায় আপনি নিজের রাগ পরিচালনা করতে পারেন এমন কয়েকটি উপায় এখানে রইল:
১. স্বাস্থ্যকর ডায়েট
গর্ভাবস্থায়, স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার যত্ন নেওয়া উচিত। প্রচুর প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট, সবুজ শাকসব্জী ও ফলমূল সহ একটি ভারসাম্যযুক্ত খাদ্য শক্তির স্তর বজায় রাখতে এবং ক্লান্তি ও অবসন্নতা মোকাবেলায় সহায়তা করবে, যার ফলস্বরূপ আরও ভাল মেজাজ তৈরি হবে।
২. নিয়মিত ব্যায়াম
হালকা ব্যায়াম বা নিয়মিত পদচারণায় লিপ্ত হয়ে গর্ভাবস্থায় একটি সক্রিয় রুটিন বজায় রাখুন। গর্ভাবস্থায় সক্রিয় ও ফিট থাকা আপনাকে এন্ডোরফিনগুলি প্রকাশের মাধ্যমে মেজাজের পরিবর্তন এবং ক্রোধের যত্ন নিতে পারে, আপনার মনকে সুখী ও ইতিবাচক অবস্থায় রাখে।
৩. প্রিয় ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হওয়া
গর্ভবতী মহিলারা যে শখগুলি উপভোগ করেন সেগুলিতে জড়িত হওয়া তাদের পক্ষে উপকারজনক – তাদের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া বা সময় কাটানো, সিনেমা দেখতে যাওয়া, পেইন্টিং করা, সংগীত শোনা, বা বাগান পরিচর্যা করার ফলে স্ট্রেস উপশম হতে পারে এবং আরও বেশি উৎপাদনশীল ও বিনোদনমূলক জিনিসের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ হতে পারে।
৪. ধ্যান
গর্ভবতী মহিলারা চাপ এবং রাগ মোকাবেলায় মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করতে পারেন। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলনগুলি শিখতে পরামর্শ দেওয়া হয় যা উত্তেজনা মুক্ত করতে এবং নিজেকে শান্ত করতে সহায়তা করে।
সঠিক শ্বাস-প্রশ্বাস একটি দুর্দান্ত স্ট্রেস-বাস্টার হতে পারে যখন সঠিকভাবে করা হয়। গর্ভাবস্থায় আপনি অনুশীলন করতে পারেন এমন কিছু শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন এখানে রয়েছে:
- প্রাণায়াম: এটি একটি শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন যা মনের উপরে শান্তকারী প্রভাব ফেলাসহ বিভিন্ন উপকারিতা দেয়। একটি প্রাথমিক প্রাণায়াম অনুশীলন হল একটি দীর্ঘ শ্বাস নেওয়া, ধরে রাখা এবং আপনার নাক দিয়ে শ্বাস বের করে দিন। ৫ সেকেন্ডের বিরতি নিতে নিতে প্রতিদিন ১০ মিনিটের জন্য এটি করুন।
- গভীর এবং অগভীর শ্বাস: আপনার নাক থেকে শ্বাস নিন এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধরে রাখুন। তারপরে, আপনার মুখ থেকে নিঃশ্বাস বের করে দিন। প্রতিদিন ৫ সেকেন্ডের বিরতির সাথে ১০ মিনিটের জন্য এটি করতে থাকুন।
- পেটের শ্বাস: আপনার পা ক্রস করে (পদ্মাসন) সোজা হয়ে বসুন বা একটি আরামদায়ক চেয়ারে বসুন। একটি গভীর শ্বাস নিন এবং যখন আপনি এটি করবেন তখন আপনার ডায়াফ্রামটি প্রসারিত করুন – শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে পেটটি ফুলে উঠতে হবে। ৫ সেকেন্ড ধরে এটি ধরে রাখুন ও নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন এবং আপনার পেটটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে দেখুন। এটি প্রতিদিন ১০ মিনিটের জন্য এটি চালিয়ে যান।
৫. ম্যাসাজ
কোমল ম্যাসাজ গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে উভয়ভাবেই শিথিল করতে সহায়তা করে। স্পা ট্রিটমেন্ট দিয়ে নিজের অশান্ত মনকে প্রশমিত করার পাশাপাশি পেশীর ব্যথাকেও সহজ করতে পারে।
৬. তর্ক-বিতর্ক থেকে দূরে থাকুন
কখনও কখনও কেবল একটি কঠিন এবং উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি এড়ানোই উপকারী হতে পারে। আপনি যদি মনে করেন যে আপনি আপনার শান্তি হারাতে চলেছেন বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পক্ষে খুব মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠছে, কেবল দূরে চলে যাওয়াই ভাল।
৭. কাজের অগ্রাধিকার
গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে, আপনার চাকরী এবং আপনার পরিবার উভয়কেই পরিচালনা করা কঠিন কাজ হয়ে উঠতে পারে। এই জাতীয় ক্ষেত্রে, আপনি যা চান তাকে অগ্রাধিকার দিন এবং প্রয়োজনে সহায়তা চান। অকারণে নিজেকে চাপ না দেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের সাথে জড়িত হোন, সহায়ক ভাড়া নিন বা আপনার সহকর্মীদের সহায়তা গ্রহণ করুন।
৮. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
সঠিক বিশ্রাম এবং একটি ভাল রাতের ঘুম গর্ভাবস্থায় অপরিহার্য। যদি আপনি সঠিক পরিমাণ ঘুম থেকে বঞ্চিত হন তবে এটি তীব্র বিরক্তি তৈরি করতে পারে এবং এর ফলে রাগান্বিত হতে পারেন। ঘন ঘন ন্যাপ নেওয়ার মতো বিশ্রামের মাইলফলক স্থাপন করা, আপনার পা উপরে রাখা এবং প্রায়শই বিশ্রাম নেওয়া আপনি প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম পান তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।
৯. অনুভূতি প্রকাশ করুন
আপনার অনুভূতিগুলিকে উৎসাহ দেওয়া – এটি আপনার বাচ্চাকে স্বাগত জানানোর উত্তেজনা হোক অথবা পরিবারের সদস্য বা সহকর্মীর কারণে বিরক্তি যাই হোক – তা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার অনুভূতিকে মনে আটকে রাখা আপনার বিরক্ততিকে কেবল বাড়িয়ে তুলবে। কোনও ভাল বন্ধু বা আপনার সঙ্গীকে বিশ্বাস করুন এবং আপনার অনুভূতিগুলি প্রকাশ করুন। পর্যায়ক্রমে, আপনি একটি জার্নাল বা ডায়েরির মাধ্যমে আপনার আবেগ প্রকাশ করার চেষ্টা করতে পারেন।
১০. নিজেকে অগ্রাধিকার দিন
গর্ভাবস্থায় আপনার সুখ এবং স্বাস্থ্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আপনার শিশুর সুস্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি এটি জড়িত। আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান এবং আরামদায়ক তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করুন; আরামদায়ক পোশাক এবং জুতো পরিধান করুন, আপনার সঙ্গীর সাথে হৃদয় থেকে হৃদয়ে কথোপকথন করুন এবং আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা চিকিৎসকের সাথে আপনার আশঙ্কা ভাগ করে নিন।
১১. পেশাদারী সহায়তা নিন
যদি আপনি গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রচণ্ড রাগ অনুভব করে থাকেন তবে পেশাদারী পরামর্শদাতা বা থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়া ভাল।
গর্ভাবস্থায়, আপনার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় এক ধরণের চাপ এবং রাগ অনুভব করা কেবল সাধারণই নয়, প্রত্যাশিতও। তবে, জীবনের এই রোমাঞ্চকর পর্যায়কে যথাসম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করা উচিত এবং একটি সুন্দর শিশুকে স্বাগত জানানোর সুখের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।