গর্ভাবস্থায় একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের প্রতিটি কার্যই তার গর্ভস্থ শিশুটির উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রভাব ফেলে।একজন মায়ের খাদ্যাভ্যাস তার গর্ভের মধ্যে থাকা শিশুটির স্বাস্থ্য এবং বিকাশকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে,আর সেই কারণেই পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ একটি সুষম আহার গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কোনও গর্ভবতী মহিলার খাদ্য পরিকল্পনায় যেকোনও খাদ্যপদকে অংশীভূত করার পূর্বে সেটি মা এবং সন্তান উভয়ের জন্যই কীভাবে এবং কতটা উপকারি বা ক্ষতিকারক প্রভাব(যদি কিছু ক্ষতিকারক হয়ে থাকে)ফেলতে পারে সে সম্পর্কে বিশদে জানাটা খুবই জরুরী।
অবশ্যই হ্যাঁ,গর্ভাবস্থায় আমলকি(ভারতীয় বৈঁচিজাতীয় ভক্ষণযোগ্য ফল বিশেষ) খাওয়া একদম নিরাপদ।আমলকি হল ছোট একটা পাতিলেবুর মত দেখতে এক প্রকার ফল,যা পাকা অবস্থায় টক–মিষ্টি স্বাদের এবং উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে।এই ফলটি পুষ্টিতে সমৃদ্ধ বিশেষত ভিটামিন C তে,যা এটিকে ভীষণ ভাল একটা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে হিসেবে গড়ে তুলেছে।অধিকাংশ আয়ুর্বেদিক ওষুধের একটা মূখ্য উপকরণ হল আমলকি এবং এটি আবার গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটি সুপারিশকৃত খাদ্যও বটে।এর উচ্চ ভিটামিন এবং ফাইবার উপাদানটি এটিকে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটা দুর্দান্ত পছন্দ করে তুলেছে।
সাধারণত সারা ভারত ব্যাপী আমলকি সহজেই পাওয়া যায় এবং কোনও রকম ওষধি ও পুষ্টি গুণ না হারিয়েই এটিকে গুঁড়ো করে পাউডার আকারে সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে।গর্ভাবস্থায় আমলকি খাওয়ার মধ্যে মা এবং সন্তান উভয়ের জন্যই এক ব্যাপক বিস্তৃত পরিসরের উপকারিতাগুলি উপস্থিত থাকে।নিচে আলোচিত হল আমলকি খাওয়ার বেশ কিছু উপকারিতাগুলি সম্পর্কেঃ
আমলকি হল একটি দুর্দান্ত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক। এর মধ্যস্থ উচ্চ ভিটামিন C উপাদানটি স্বাভাবিকভাবে গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকা সাধারণ জ্বর এবং মূত্রনালীর সংক্রমণের মত সংক্রমণগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।একটি অতিরিক্ত সুবিধা হল এই যে,এটি আবার এমনকি প্রসবের পর মায়ের স্তন পান করানোতেও সহায়তা করে থাকে,যা আপনার সন্তানের অনাক্রম্যতা বৃদ্ধিকারী মায়ের বুকের দুধ সঠিক মাত্রায় পাওয়ার ব্যাপারটিকেও নিশ্চিত করে।
আমলকির মধ্যে উচ্চ মাত্রায় তন্তু জাতীয় উপাদান থাকায় এটি নিয়মিত অন্ত্রের গতিবিধিতে সহায়তা করে এবং গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিণ্যকে প্রতিরোধ করে।
আমলকি বদহজম এবং অ্যাসিড হওয়ার মত সমস্যাগুলিকে লাঘব করে কারণ এটি পাকস্থলীর মধ্যে পাচক রসকে উদ্দীপ্ত করে এবং খাদ্য হজমে সহায়তা করে।
আমলকিতে থাকা প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C রক্তবাহগুলিকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে,যা স্বাভাবিক রক্তচাপকে ধরে রাখতে এবং বজায় রাখতে সহায়তা করে।
আমলকির টক–মিষ্টি স্বাদটি বমি বমি ভাবটিকে,যেটি হল গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে হয়ে থাকা একটা সাধারণ উপসর্গ, নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।আমলকির রস পান কিম্বা কাঁচা আমলকি ভক্ষণ প্রাতঃকালীন অসুস্থতা হ্রাস করতে এবং দেহকে বলদায়ী করে তুলতে সাহায্য করে।
এর প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে আমলকি ওডেমা হিসেবে পরিচিত হাত এবং পায়ের পাতা ফুলে যাওয়াকে হ্রাস করতে সাহায্য করে,যা সম্ভবত গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে।
আমলকি হল একটি চমৎকার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং এর মধ্যস্থ উচ্চ জলীয় উপাদান প্রস্রাব ত্যাগের পুনরাবৃত্তির হারকে বাড়িয়ে তোলে।এইভাবে এটি দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি এবং মূলকগুলি অপসারণ করতে সাহায্য করে।
কখনও ডায়াবেটিসের ইতিহাস না থাকা মহিলাদের মধ্যেও আবার এমনকি তাদের গর্ভাবস্থাকালে এমন একটি অবস্থার অভিজ্ঞতা হতে পারে যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নামে খ্যাত।দেহের মধ্যে যখন গর্ভাবস্থার হরমোনগুলি ইনসুলিনের মাত্রায় হস্তক্ষেপ করে থাকে তখন এটি হয়।আমলকির মধ্যে ডায়াবেটিক বিরোধী গুণ থাকায় তা হবু মায়েদের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাতে সীমাবদ্ধতা আনতে সহায়তা করে।
আমলকির রস সেবন করলে তা আপনার গর্ভস্থ শিশুটির স্মৃতি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
এই ফলটির মধ্যে থাকা ভিটামিন C গর্ভাবস্থায় মুখে দুর্গন্ধ,মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার মত অবস্থাগুলি প্রতিরোধে সহায়তা করার মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মুখের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।এটি আবার দন্তক্ষয় প্রতিরোধেও সহায়তা করে থাকে যার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপনের যোগ্য হল এর মধ্যস্থ ক্যালসিয়াম উপাদানটি।
গর্ভাবস্থাকালে প্রতিদিন আপনার এক কিম্বা দুটি করে তাজা আমলকি খাওয়া নিরাপদ।যদি আপনি গর্ভাবস্থায় আমলকিকে তার গুঁড়ো রূপে খেয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে খাওয়ার জন্য প্রতিদিন এক চা–চামচ হল আদর্শ।
আমলকি হল এমন একটি ফল যার মধ্যে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য প্রচুর উপকারিতা রয়েছে।তবে আপনি যদি গর্ভাবস্থায় সেটি খুব বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেন তবে সেক্ষেত্রে বদহজম,কোষ্ঠকাঠিণ্য,ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে এবং এছাড়াও আপনার পেটে বিপর্যয়তার সহিত আপনাকে জলশূণ্যও করে তুলতে পারে।আর সেই কারণেই আপনাকে কেবল সীমিত পরিমাণেই আমলকি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
গর্ভবস্থায় গুজবেরি বা আমলকির রস খাওয়া নিরাপদ।তবে আপনার প্যাকেটে করা প্রক্রিয়াজাত আমলকির রস খাওয়া এড়িয়ে চলাই উচিত কারণ এগুলি খুব মিষ্টি হতে পারে এবং এর সাথে নানা রকম সংরক্ষকগুলিও মিশানো থাকতে পারে,যা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কখনই সুপারিশ করা হয় না।
আপনি বাড়িতেই আমলকি মধ্যস্থ এর শাঁসটির নির্যাস বের করে নিতে পারেন এবং এর সাথে জল মিশিয়ে সেটি পান করতে পারেন।প্রতিদিন প্রায় 5-10 মিলিলিটার করে আমলকির রস হল সেবন করার জন্য একটি আদর্শ পরিমাণ।
আমলকির পুষ্টি উপাদানগুলির সম্পূর্ণ উপকারিতাগুলি পেতে কাঁচা আমলকি খাওয়াই হল সবচেয়ে ভাল।আমলকিকে রান্না করলে তা তার পুষ্টি গুণগুলিকে বহুলাংশে নষ্ট করে ফেলে বা কমিয়ে দেয়,সুতরাং এটি খাওয়ার সুপারিশ করা হয় না।যদি কোনও ক্ষেত্রে আপনি কাঁচা আমলকি না খেতে পারেন,সেক্ষেত্রে আমলকি খাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায় হল আমলকির রস সেবন করা অথবা সেটিকে গুঁড়ো করে নিয়ে তা জলের সাথে মিশিয়ে পান করা।
যদিও আমলকিতে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই,যদি সেটি পরিমিত পরিমাণে সেবন করা হয়ে থাকে,তবে আপনি যদি সর্দি কাশিতে ভুগে থাকেন সেক্ষত্রে এই ফলটি খাওয়া এড়িয়ে চলাই হল বুদ্ধিমত্তার কাজ।আমলকি শরীরের উপর একটি শীতল প্রভাব ফেলে,আর সেই কারণেই ঠাণ্ডা লাগার সময় আপনি যদি সেই ফলটি একটিও খেয়ে থাকেন তা আপনার ঠাণ্ডা লাগার প্রকোপকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
আবার আপনার যদি প্রবল পেট খারাপ হয়ে থাকে সেক্ষত্রেও আমলকি খাওয়া অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত কারণ এই ফলের রেচক বৈশিষ্ট্যটি এই অবস্থাটিকে ভালো করার বদলে কেবল আরও খারাপই করে তোলে।
কিছু মহিলার কাছে যখন আমলকিগুলি বেশ সুস্বাদু বলে মনে হয় তখন আবার অপর কিছু মহিলার কাছে এর টক জাতীয় খাট্টা স্বাদটি পছন্দের নাও হয়ে উঠতে পারে এবং হয়ত সেটিকে তারা সরাসরি খেতে নাও পছন্দ করতে পারেন।তাই আপনার ডায়েটে আমলকিকে নানা উপায়ে অন্তর্ভূক্ত করার কয়েকটি পরামর্শ এখানে দেওয়া হলঃ
আপনার মধ্য প্রাতঃরাশ হিসেবে আপনি আমলকির আচারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন কারণ এর টক–মিষ্টি খাট্টা স্বাদটি আপনার অতিরিক্ত খেয়ে ফেলার তীব্র বাসনা থেকে আপনাকে দূরে ঠেলে রাখবে।এছাড়াও আবার আপনি আমলকির আচারটিকে আপনার খাবারের সাথেও খেতে পারেন।
আপনার সাধারণ স্যালাডের সাথে আমলকির কাটা কিছু কুঁচি মিশিয়ে নিয়ে তা ভক্ষণ করলে আমলকির মধ্যে থাকা এর সুপ্ত তীব্র স্বাদটির আস্বাদন করতেও সাহায্য করে থাকে।
এই ফলের শাঁসটিকে নিসৃত করে জলের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সেটিকে জ্যুস হিসেবে পান করুন।আপনি আবার একটি জুসারের মধ্যে আমলকিকে থেঁতো করে তা দিয়ে জ্যুস বানিয়ে সেটিকে পুদিনা পাতার সাথে সুশোভিত করে সঞ্জীবনী আমলা পানীয় রূপে উপভোগ করতে পারেন।
আপনি আবার আপনার খবার পরে মধুর সাথে আমলকি মিশিয়েও খেতে পারেন এবং সেটিকে একটি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর মিষ্টান্ন পদে পরিণতও করে তুলতে পারেন।
আপনি যদি কাঁচা আমলকি খেতে পছন্দ না করে থাকেন,আপনি সেক্ষেত্রে সাম্বার,কোর্মা অথবা অন্য কোনও সবজির রেসিপিতে আমলকিটিকে এগুলির একটি উপকরণ হিসেবে যোগ করে ফলটি থেকে সমান উপকারিতা লাভ করতে পারেন।
প্যাকট করা আমলকির রসে অতিরিক্ত মিষ্টি এবং সংরক্ষকগুলি মেশানো থাকার কারণে এগুলি এড়িয়ে চলাই হল সবচেয়ে ভাল।আপনি যদি এর তাজা রস পান করতে না পারেন এবং প্রক্রিয়াজাত একটা প্যাকাটের রসকেই বেছে নেন,তবে সেক্ষত্রে একটা বিশ্বাসযোগ্য ব্র্যান্ডকেই বেছে নেওয়া নিশ্চিত করুন,যার একটা দীর্ঘ কার্যকারী স্বায়িত্বকাল আছে।
আপনি আপনার গর্ভাবস্থাকালে আমলা পাচক অথবা আমলকির সুপারি খেতে পারেন,যেগুলি হল আমলকির শুকনো রূপ।এগুলির মধ্যে তাজা আমলকিগুলির প্রায় সকল উপকারিতাগুলিই বর্তমান।এছাড়াও আবার আপনি বাড়িতেও সহজেই আমলকি শুকিয়ে নিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় লবণ গ্রহণে সীমাবদ্ধতা আনা এবং উচ্চ মাত্রায় লবণযুক্ত খাবারগুলিকে এড়িয়ে চলা হল সবচেয়ে ভাল, কারণ সেগুলি তরল–ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য রক্ষায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং পেটের সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বিভিন্ন উপকারিতার সাথে আমলকি হল গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিশেষ একপ্রকার সুপার খাদ্য বিশেষ।শুধু উল্লিখিত সাবধানতাগুলি মাথায় রাখুন আর ফলটিকে আনন্দের সাথে উপভোগ করুন আপনার অন্তঃসত্ত্বাকালীন অবস্থায়।