গর্ভাবস্থায়, আপনার দেহ হরমোনজনিত পরিবর্তনের এক উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে যায়।হরমোনের অসামঞ্জস্যতা,বর্ধিত পেট,ঘুমের ভঙ্গিমার পরিবর্তন এবং অঙ্গ সঞ্চালনার অভাবের ফলে ঘাড়ে যন্ত্রণা হয়ে থাকে যা পিঠ এবং কাঁধেও ছড়িয়ে পড়ে।আপনার পরিবর্তিত দেহের আকৃতিটির জন্য পিঠ এবং মেরুদণ্ডের দিকে একটা চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা থেকে যায়,যার ফলস্বরূপ ঘাড়ে অস্বস্তিবোধ হয়।
একজন প্রত্যাশী মা প্রথম ত্রৈমাসিকে তার ঘাড়ে একটি স্টিফনেস বা কঠিনতা অনুভব করবেন এবং তার গর্ভাবস্থা বৃদ্ধির সাথে সাথে সেই যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকবেন। ঘাড়ে ব্যথা হল এক ধরণের বিরক্তিকর অস্বস্তি যা ঘাড়ে শুরু হয় এবং ক্রমশ কাঁধ ও পেশীগুলির কাছাকাছির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।এর ফলে ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, মাথা ব্যথা, অসাড়তা এমনকি ঘাড়ে ফোলাভাব পর্যন্ত দেখা দেয়।বেশীরভাগ গর্ভবতী মহিলারাই ভেবে থাকেন যে,এই যন্ত্রণা মোকাবিলা করার কোনও উপায় নেই এবং সেটিকে নীরবেই সহ্য করে যান।বেশ,কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু ভাল খবরও আছে।যেহেতু প্রত্যাশী গর্ভবতী মায়েদেরকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ বা পেইনকিলারগুলি খাওয়ার সুপারিশ করা হয় না তাই এক্ষেত্রে ঘাড়ে যন্ত্রণা মোকাবিলা করার সেরা উপায় হল কিছু সহজ ঘরোয়া প্রতিকারের ব্যবহার।
গর্ভাবস্থায় ঘাড়ে ব্যথার কিছু সাধারণ কারণ হলঃ
গর্ভধারণের পর শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এবং ভারসাম্যহীনতা ঘাড় ব্যথাকে পরিচালিত করে।হরমোনের অতিরিক্ত উত্থান পতন ও সঞ্চালনার কারণে ঘাড়ের পেশীগুলি শিথিল হয়ে ঝিমঝিম করতে থাকে এবং এই কারণে ঘাড়ের ঐ অঞ্চলে যন্ত্রণা হয়।
ঘাড়ের লিগামেন্টগুলি প্রসারিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং আপনার পেটটি বর্ধিত ভ্রূণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বৃদ্ধি পেতে শুরু করার জন্য পিঠ এবং মেরুদণ্ডের পেশীগুলি আরও বেশী চাপ অনুভব করে।এর ফলে ঘারে যন্ত্রণা হয়।
যেহেতু গর্ভবতী মহিলাদের পরামর্শ দেওয়া হয় তাদের বা পাশ ফিরে শুতে,ফলে তাদের ঘুমের এই ভঙ্গিমায় দেহের বাদিকের অংশে একনাগাড়ে অনবরত চাপ পড়ার ফলেও তাদের ঘাড়ের অংশ শক্ত হয়ে ওঠে এবং যার ফলে যন্ত্রণা হয়।
গর্ভাবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে,আপনার চারিপাশে ঘোরাঘুরি করার এবং অঙ্গ সঞ্চালনা করার অক্ষমতার কারণেও আপনার ঘাড়ে চাপ সৃষ্টি হয় এবং যন্ত্রণা করে।
প্রত্যাশী গর্ভবতী মায়েদের ব্যথা নিরাময়কারী বা অন্য কোনও ওষুধের বিষয়ে পরিষ্কারভাবে নিরস্ত থাকা উচিত যতক্ষণ না তাদের চিকিৎসক পরামর্শ দিয়ে থাকেন কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের যা তাদের সেই ব্যথা বা অস্বস্তি হ্রাস করতে পারে।এর অর্থ এই নয় যে,গর্ভবতী মহিলাদের ঘাড়ে এই অত্যন্ত যন্ত্রণা ভোগের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।এক্ষেত্রে বিভিন্ন নিরাপদ ঘরোয়া প্রতিকার রয়েছে যা ঘাড় যন্ত্রণা লাঘব করতে পারে যদি সেগুলি সঠিকভাবে অনুশীলন করা হয়।নিম্নে কিছু সহজ চিকিৎসার উল্লেখ করা হল যেগুলি গর্ভাবস্থায় ঘাড়,কাঁধ,পিঠের উপরিভাগের যন্ত্রণার উপশমে সাহায্য করবে।
প্রতিদিন ঘাড়ে বরফের প্যাক প্রয়োগ করা যন্ত্রণা উপশমের একটা দুর্দান্ত উপায়।ঠাণ্ডা এবং গরম এই উভয় ধরনের চিকিৎসাই প্রয়োজনীয় এবং এই ঠাণ্ডা-গরম কম্প্রেশনটি নিয়মিত বিরতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ভুলভাল বালিশ অথবা তাদের মাথাকে অবলম্বন দিতে একাধিক বালিশ নিয়ে শোওয়ার প্রবণতা থাকে যার ফলে তাদের ঘাড় এবং পিঠে ব্যথা হয়।একটি আরামদায়ক বালিশের জন্য বিনিয়োগ করুন এবং মাতৃত্বসুলভ অবস্থায় একটি ভাল ঘুমের ভঙ্গি বজায় রাখতে আপনার হাঁটুগুলির তলায় বালিশগুলি দিয়ে সমর্থন করা বাঞ্ছনীয়।
প্রসারণ বা স্ট্রেচিং ঘাড় এবং পিঠে ব্যথায় অনেকটা স্বস্তি আনবে।গর্ভাবস্থায় প্রত্যাশী মায়েদের জন্য এই প্রসারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রে পরিবর্তন এবং ওজন বৃদ্ধির ফলে পেশীগুলিকে টান করে এবং প্রসারিত হওয়া ব্যথাকে সহজ করে দেয়।
ঘাড়ে ব্যথার উপশমের জন্য অন্য আরেকটি প্রমাণিত প্রতিকার হল হাইড্রোথেরাপি। যখন আপনি সাওয়ারের বা ঝর্নার তলায় দাঁড়াবেন লক্ষ্য রাখুন জলের ধারাটিকে প্রভাবিত এলাকার উপরে ফেলতে।ঘাড়ের উপর সেই জলের ধারাটিকে 3-4 মিনিট ধরে বজায় রাখুন।আরও 60 সেকেন্ডের জন্য ঠাণ্ডা জলের ধারায় সেটি পরিবর্তন করুন। স্বস্তি পেতে কয়েকবার এটির পুনরাবৃত্তি করুন। গরম জল রক্ত সঞ্চালনকে উদ্দীপিত করে এবং শক্ত পেশীগুলিকে সহজ করে তোলে যখন ঠান্ডা জল বিদ্যমান যে কোনও প্রদাহকে হ্রাস করবে।
কিছু জলের খেলাধূলা যেমন সাঁতারের সাথে নিজেকে সংযুক্ত রাখুন যেহেতু এটি ঘাড়ে ব্যথাকে সহজ করে তুলতে পরিচিত।আপনার এই ব্যথাকে প্রশমিত করতে আপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে জল নির্ভর কিছু ধরণের অনুশীলনের পরামর্শ দিতে পারেন।
আপনার স্বামী বা পরিবারের কাউকে আপনাকে ঘাড়ে মালিশ করে দিতে বলুন,বিশেষ করে উষ্ণ ঝরনার পরে।উত্তাপটি আপনার পেশীগুলিকে শিথিল করতে সহায়তা করবে এবং গরম স্নানের পরে মালিশ করার ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হবে।আপনি যদি পারেন তবে প্রসবপূর্ব ম্যাসেজের কোনও সুবিধাকে বেছে নিতে পারেন। ভাল ফলাফলের জন্য ল্যাভেন্ডার তেল, নারকেল তেল বা জলপাই তেল দিয়ে মালিশ করার চেষ্টা করুন।
আপনাকে যন্ত্রণা থেকে উপশম পেতে আপনি কোনও টেনিস বলকে ভালভাবে ব্যবহার করতে পারেন। আপনার পিঠ এবং দেওয়ালের মধ্যে নরম বলটিকে রাখুন এবং আস্তে আস্তে এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরে সরে যান। পছন্দসই মাপে চাপ পেতে আপনার শরীরের ওজনকে ব্যবহার করুন।
ঘাড়ে ব্যথা উপশমের অন্য আরেকটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহবিরোধী উপাদান হল অ্যাপেল সীডার ভিনিগার।আপেল সীডার ভিনেগারের মধে কিছু তুলো বা একটি কাগজের তোয়ালে ভিজিয়ে রাখুন। এবার প্রভাবিত স্থানে সেটিকে দু-ঘন্টার জন্য রেখে দিন।ফলাফলের জন্য দুবার পুনরাবৃত্তি করুন।
যেহেতু বলা হয় যে,প্রতিরোধ সর্বদা নিরাময়ের চেয়ে ভাল,তাই,গর্ভাবস্থায় ঘাড় যন্ত্রণা প্রতিরোধের বেশ কিছু উপায় এখানে দেওয়া হল।
আপনার গর্ভাবস্থার সময় বিশেষত প্রথম ত্রৈমাসিকে আপনার ঘাড়ের যন্ত্রণা কয়েকটি সাধারণ ব্যায়াম এবং কাজের মাধ্যমে কমাতে পারেন। যেটা খুব সহজেই আপনি ঘরে করতে পারেন এই কাজগুলি আপনি প্রয়োগ করুন অবশ্যই তার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। যদি দীর্ঘক্ষন ধরে যন্ত্রণা হতে থাকে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।
গর্ভাবস্থাকালীন সময়ে ঘাড়ের যন্ত্রণা খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই সময়ে সমস্যাটিকে এড়াবার জন্য আপনি সাধারণত কোন রকম ওষুধ বা পেইনকিলার ব্যবহার করতে চাইবেন না। হবু মায়েদের এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্যের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে না যেহেতু এই সমস্যাটিকে দূরীভূত করা যায় কতগুলি সহজ ঘরোয়া পদ্ধতি প্রয়োগ করে কারণ ওষুধ খাওয়া সব সময় সবচেয়ে ভালো বিকল্প কখনই হয়ে ওঠেনা।তবে কোনরকম ঘরোয়া প্রক্রিয়া শুরু করার আগে সব সময় একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার বাবুর পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন যার দ্বারা যে কোনো রকম জটিলতা কে দূরে রাখা সম্ভব হবে।