গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম সেবন করা

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম সেবন করা

গর্ভাবস্থার সাথে অনেকগুলি করণীয় এবং অকরণীয় ব্যাপারগুলি এসে যুক্ত হয়, বিশেষ করে ডায়েটের সাথেযদিও প্রস্তাবিত ডায়েটের সাথে সাধারণত ড্রাই ফ্রুট এবং বাদাম অন্তর্ভূক্ত করা থাকে কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মায়ের মধ্যেই এই ভয়ের উদ্রেক হয় যে চিনাবাদাম খেলে তা হয়ত তার অনাগত শিশুর মধ্যে চিনাবাদাম জনিত অ্যালার্জির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবেএর অর্থ কি আপনাকে পুরোপুরি চিনাবাদাম খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে? না না, তা সত্যি নয়।চিনাবাদাম খাওয়ার উপকারিতা এবং সেগুলি সেবন করার ক্ষেত্রে যে সকল প্রয়োজনীয় সাবধানতাগুলি অবলম্বন করা প্রয়োজন তার সন্ধান পেতে পড়ুন।

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম খাওয়াটা কি নিরাপদ?

গর্ভাবস্থায় বহু মহিলার চিনাবাদাম খাওয়া থেকে বিরত থাকার প্রধান কারণ হল অ্যালার্জির ভয়।প্রায় এক চতুর্থাংশ গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যেই এই অ্যালার্জির অভিজ্ঞতা হয়ে থাকেকিছু অ্যালার্জি গর্ভাবস্থায় মাথা চাড়া দিয়ে বেড়ে ওঠে, যখন কিছু মহিলার পরিবারের মধ্যেই আবার অ্যালার্জি প্রবণতা থেকে থাকে।চিনাবাদামেই যে মায়ের অ্যালার্জি আছেএ বিষয়টি প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সেক্ষেত্রে এমন কোনও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব নেই যা প্রমাণ করে যে, চিনাবাদাম খেলে (অথবা অন্য যেকোনও খাদ্য যার মধ্যে গ্রানোলা বার, দানাশস্য ইত্যাদি রয়েছে) তা আপনাকে প্রভাবিত করবে বা শিশুকে অ্যালার্জি হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলবে।

সুতরাং, আপনার নিজের যদি অ্যালার্জি না থাকে, তবে গর্ভাবস্থায় আপনি নির্দ্বিধায় চিনাবাদাম খেতে পারেন।

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম খাওয়ার উপকারিতাগুলি কি?

 

প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, চিনাবাদাম খাওয়া গর্ভাবস্থার পক্ষে ভাল।চিনাবাদামের প্রাকৃতিক ফ্যাট বা চর্বি এর জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যা করে।চিনাবাদামের পুষ্টি মূল্য বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে এটি অন্যান্য বাদামের মধ্যে থাকা মূল্যবান পুষ্টি উপাদানগুলির মতই স্বাস্থ্যকর।

চিনাবাদাম এমন প্রোটিনে পরিপূর্ণ যা আখরোটের মধ্যেও থাকে।বিভিন্ন ভিটামিন (B1, B4, B5, B6, C, E) এবং ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রণ ও পটাশিয়ামের মত বহুবিধ খনিজের একটি ভারসাম্য যুক্ত সংগ্রহ চিনাবাদামকে একটি পুষ্টিকর জলখাবারে পরিণত করেছে।চিনাবাদামের মধ্যে থাকা ক্যালোরি বল এবং শক্তির যোগান দেয়।

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম খাওয়া একটা বুদ্ধিযুক্ত পছন্দ হয়ে ওঠে, কারণ চিনাবাদাম প্রোটিন এবং ফোলেটে পরিপূর্ণ, আর এই উভয় উপাদানই আপনার গর্ভাবস্থাকালীন ডায়েটের একটি আবশ্যিক অংশ হওয়া উচিত।ফলিক অ্যাসিড এবং ফোলেট জন্মগত অক্ষমতা এবং মেরুদণ্ডের ক্ষতি হওয়া প্রতিরোধ করে, অন্যদিকে একজন মা এবং তার বেড়ে ওঠা শিশুর বিকাশের জন্যও প্রোটিন অপরিহার্য

এছাড়াও চিনাবাদামে নিম্নলিখিত উপকারিতাগুলিও রয়েছেঃ

1.অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যাবলী

প্রাকৃতিক ফ্যাট এবং ভিটামিন, বিশেষত ভিটামিন B এবং E দ্বারা পরিপূর্ণ চিনাবাদাম ফ্লু এবং অন্যান্য সাধারণ অসুস্থতা থেকে শরীরকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যগুলি সরবরাহ করে

2.ত্বকের সমস্যাগুলি নিরাময়ে সাহায্য করে

চিনাবাদামের তৈলাক্ত উপাদানটি চর্মরোগ সম্পর্কিত সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং ঘাক্ষত ও ত্বকের জ্বলন নিরাময়ে প্রাকৃতিক নিরাময়কারী হিসেবে কাজ করে

3.হাড়ের বিকাশ ঘটায়

স্বাস্থ্যকর হাড়ের জন্য ডায়েটে ম্যাঙ্গানিজ অন্তর্ভূক্ত করাটা অত্যন্ত জরুরি।চিনাবাদাম মধ্যস্থ মাঙ্গানিজ উপাদানটি গর্ভস্থ শিশুর হাড়ের স্বাস্থ্যকর বিকাশে সহায়তা করে।

4.হজমে সাহায্য করে

চিনাবাদামে থাকা ফাইবার বা তন্তু জাতীয় উপাদানটি কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সমস্যাগুলি উপশমের জন্য পরিচিত।পেটের সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পেতে হবু মায়েরা তাদের ডায়েটের মধ্যে প্রতিদিন অল্প পরিমাণে চিনাবাদাম যোগ করতে পারেন।

5.রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া নিরাময় করে

গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য আপনার দেহে আরও বেশি পরিমাণে রক্ত উৎপাদনের প্রয়োজন হবে।কিন্তু আপনি যদি পর্যাপ্ত আয়রণ না পেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার শরীর তা কার্যকর ভাবে করতে সমর্থ হবে না, যার পরিণাম হিসেবে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দেবেএ ধরণের ঝুঁকির মোকাবিলা করতে, গর্ভবতী মহিলাদের পর্যাপ্ত আয়রণ গ্রহণ করাটা অবশ্যই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।আর চিনাবাদামগুলি আয়রণের একটি দুর্দান্ত উৎস, তাই এই বৈশিষ্ট্যটি চিনাবাদামকে অ্যানিমিয়ার চিকিৎসার জন্য একটি আদর্শ খাদ্য রূপে গড়ে তুলেছে।

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদামের অ্যালার্জির লক্ষণগুলি

গর্ভাবস্থায় কিছু মহিলার মধ্যে হয়ত অ্যালার্জিগুলি বেড়ে যেতে পারে।চিনাবাদামের অ্যালার্জির লক্ষণগুলি এখানে উল্লেখ করা হলঃ

  • ডায়রিয়া বা বমি হওয়া
  • কাশি
  • সাঁ সাঁ করে নিঃশ্বাস ফেলা, হ্রস্ব শ্বাস এবং শ্বাস কষ্ট
  • গলা এবং জিভে চুলকানি
  • ত্বকে চুলকানি অথবা র‍্যাশ দেখা দেওয়া
  • গলা এবং ঠোঁট ফুলে যাওয়া
  • নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে জল গড়ানো
  • চোখ কটা হওয়া, লালা হয়ে যাওয়া এবং চুলকানো
  • অ্যানাফিল্যাক্সিসঃ এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর লক্ষণ যা নাড়ির স্পন্দনের হার কমিয়ে দেয়।এই উপসর্গটি যেহেতু প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, তাই যদি সেটি দেখা দিয়ে থাকে তবে অবিলম্বে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।

গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে চিনাবাদামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম খাওয়ার ফলে মাঝেমধ্যে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষত বেশি হয় যদি আপনার মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে থাকে যা আপনাকে চিনাবাদাম খাওয়ার ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু করে তুলতে পারে

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদামের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি হলঃ

1.নেতিয়ে যাওয়া পুরানো বা পচা চিনাবাদাম খাওয়ার ঝুঁকি

নেতিয়ে যাওয়া পচা ও পুরানো চিনাবাদাম না খাওয়ার ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করুন।মজুত করে রাখা পুরানো, খারাপ হয়ে যাওয়া এবং নেতিয়ে যাওয়া চিনাবাদামগুলি কখনও কখনও ফুড পয়জন বা খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

2.বিষাক্ত চিনাবাদাম

চিনাবাদামগুলি যদি উষ্ণ এবং আদ্র ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় মজুত করে রাখা হয় তবে সেক্ষেত্রে সেগুলিতে ছাতা পড়ে যেতে পারে এবং বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।

3.পেট জ্বালা

আপনার যদি গ্যাস্ট্রাইটিস (পেটের আস্তরণের প্রদাহ) থেকে থাকে তবে চিনাবাদাম খেলে তা পেট জ্বালা বাড়িয়ে তুলতে পারে

4.ওজন বৃদ্ধি

চিনাবাদামে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট থাকে যা আপনার ওজনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।আপনি যদি অতিরিক্ত ওজনের হয়ে থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে চিনাবাদাম খাওয়া এড়ানোই সবচেয়ে ভাল।

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম খাওয়ার উপায়গুলি

সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় চিনাবাদাম খেলে তা আপনার শিশুর মধ্যে অ্যালার্জি হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।সুতরাং আপনার মধ্যে যদি চিনাবাদামে অ্যালার্জি থাকার কোনও পূর্ব ইতিহাস না থেকে থাকে, তবে এগিয়ে যান এবং গর্ভাবস্থাকালে চিনাবাদাম খাওয়ার জন্য আপনি নানা উপায়গুলি প্রয়োগ করতে পারেন।

  • চিনাবাদামের মধ্যে থাকা অ্যালার্জেনগুলিকে দূরে রাখার জন্য সেগুলিকে অল্প তেলের মধ্যে ভাজা যেতে পারে।
  • লবণ জলের মধ্যে খোসা সমেত চিনাবাদামগুলিকে সেদ্ধ করে নিতে পারেন।মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজের মাঝে যদি এক বিস্তৃত ব্যবধান গড়ে ওঠে, তবে সেক্ষেত্রে সেদ্ধ চিনাবাদাম একটা দুর্দান্ত জলখাবারের কাজ করে।
  • গর্ভবতী মহিলারা যদি চিনাবাদাম খাওয়াও জন্য আকুল হয়ে ওঠেন, তবে সেক্ষেত্রে সেটি খাওয়ার কোনও ক্ষতি নেই।কিন্তু চিনাবাদামের মধ্যে অতিরিক্তভাবে যুক্ত করা লবণটি শরীরে অতিরিক্ত জল ধারণ করে রাখার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ গড়ে তুলতে পারে, তাই সে ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকা ভাল।
  • আপনার স্যালাড, ডিপ এবং চাটনিগুলিকে আরেকটু ঘন এবং ক্রীমি করে তোলার জন্য সেগুলির উপর অল্প করে চিনাবাদাম বা চিনাবাদাম বাঁটা ছড়িয়ে দিতে পারেন।

গর্ভাবস্থায় চিনাবাদামের মাখন খাওয়া কি নিরাপদ?’-এ ধরণের যে সাধারণ প্রশ্নটা প্রায়শই করা হয়ে থাকে, তার সহজ উত্তর হল হ্যাঁ।যেকোনও খাদ্য আইটেমের মধ্যে তার একটি উপকরণ হিসেবে সামঞ্জস্য পরিমাণে যুক্ত থাকা চিনাবাদামটি ততক্ষণই খাওয়া যেতে পারে যতক্ষণ আপনি তার স্বাদটিকে উপভোগ করেন এবং আপনার বাদাম জনিত কোনও অ্যালার্জি দেখা না দেয় বা আপনার মধ্যে এ ধরণের অ্যালার্জির কোনও ইতিহাস না থেকে থাকে।আপনার যদি পিনাট বাটার বা চিনাবাদামের মাখন খাওয়ার তীব্র বাসনা হয়ে থাকে, তবে সে পথে এগিয়ে যান এবং আপনার সাধের স্যান্ডুইচের মধ্যে মাঝেমধ্যে সেটিকে কিছুটা ছড়িয়ে দিয়ে তার স্বাদকে আরও একটু বাড়িয়ে তুলুন।

একজন গর্ভবতী মহিলাকে ফল, শাকসবজি, চাল, গম, দুধ, বাদাম, নানা ধরণের ডাল এবং অন্যান্য খাদ্য সমন্বিত একটি সুষম আহার গ্রহণ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।চিনাবাদাম আপনাকে সেই সকল অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানগুলি সরবরাহ করতে পারে যেগুলি বাদাম থেকে পাওয়া যায়।আপনি চিনাবাদাম খেতে পারেন কিনা তা জানতে ও বুঝতে একজন ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলে তার পরামর্শ গ্রহণ করুন এবং আপনার শরীরের ওজন এবং আপনার গর্ভাবস্থার সামগ্রিক অবস্থা অনুযায়ী আপনার জন্য প্রস্তাবিত পরিমাণটি কি হতে পারে তা নিশ্চিত হয়ে নিন।