গর্ভাবস্থা

গর্ভাবস্থায় ছোলা (চানা)-উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি

কোন মানুষটা ছোলা খেতে ভালোবাসেন না?এটি হল সকলের দ্বারা আস্বাদিত একটি সমাদৃত খাদ্য পদ।তবে আপনি যখন গর্ভাবস্থায় প্রবেশ করেন তখন আপনার অন্ত্রে কি প্রবেশ করছে সে ব্যাপারে আপনার সচেতন হওয়া উচিত,ছোলা হল সেগুলির মধ্যে অন্যতম।প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে শুরু করে তৃতীয় ত্রৈমাসিক পর্যন্ত আপনার ডায়েটের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠার বিষয়টি বিবেচনা করা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

কিন্তু তাই বলে এর অর্থ কখনই এই নয় যে ছোলা খাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দেবেন।এর ক্ষতিকারক দিকটির তুলনায় উপকারিতাগুলি এত বেশি যে,যেকোনও গর্ভবতী মহিলার জন্য ছোলা একটা ভাল পছন্দ হয়ে ওঠে।আসুন অন্বেষণ করা যাক এর উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উভয় দিকগুলিই।

গর্ভাবস্থায় ছোলা খাওয়া কি নিরাপদ?

ছোলাকে গর্ভাবস্থাকালে খাওয়ার জন্য অন্যতম একটি নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।কেবল যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার তা হল যথাযথ নরম না হওয়া পর্যন্ত ছোলাগুলিকে ভালভাবে রান্না করতে হবে।আর অন্য বিষয়টি হল ছোলা সবসময় পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।এর মধ্যে উচ্চ পুষ্টিমূল্য বজায় থাকায়,ছোলা প্রোটিন, খনিজ এবং প্রয়োজনীয় ফোলিক অ্যাসিডের ভাল মাত্রা সরবরাহ করে।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ছোলার উপকারিতাগুলি

মা এবং ভ্রূণ উভয়ের জন্যই ছোলাগুলি নানা উপায়ে উপকারি হতে পারে।কীভাবে?তা জানতে হলে পড়ুনঃ

1. স্নায়বিক নালীর ত্রুটিগুলি প্রতিরোধ করে

গবেষণায় দেখা যায় যে ছোলা ফোলেট বা যাথাযোগ্যভাবে পরিচিত ফলিক অ্যাসিডে সমৃদ্ধ।শরীরের মধ্যে এই অ্যাসিডের উপস্থিতি আশীর্বাদ বয়ে আনে,স্নায়বিক নালীর ত্রুটিগুলি প্রতিরোধ করার কারণে।

গবেষণা এই তথ্যের প্রমাণ দেয় যে,ছোলায় উপস্থিত ফোলিক অ্যাসিড স্পাইনা বিফিডা এবং অ্যানেন্সেফালির মত স্নায়বিক ত্রুটিগুলি এড়িয়ে চলে।সাধারণত আপনার গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে দেখা যায় যে,এই স্নায়বিক ত্রুটিগুলি আপনার স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে হয়ত খুব বেশি সময় নেয় না।সুতরাং পরের বার আপনি হয়ত এই ভেবে অবাক হবেন যে,গর্ভাবস্থায় ব্যাসন খাওয়া নিরাপদ কিনা?মনে রাখবেন,উচ্চ মাত্রার ফোলেট কার্যকরভাবে ভ্রূণকে স্বাস্থ্যকর রাখে।

2. অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে

অ্যানিমিয়া হল মানব দেহের এমন এক অবস্থা,যেখনে হয় লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যায় অথবা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে দেখা যায়।এইভাবে স্বাভাবিক রক্তের পরিমাণ এবং হিমোগ্লোবিন প্রত্যাশার চেয়ে কম থাকে।

আয়রণ হল এমন এক উপাদান যা উল্লেখযোগ্যভাবে লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনে সহায়তা করে।আর মজার ব্যাপারটি হল প্রতি 100 গ্রাম ছোলা পরিবেশনে প্রায় 22% মত আয়রণ থাকে।বলার অপেক্ষা রাখে না যে,পরিণামস্বরূপ আয়রণ দেহে লোহিত রক্ত কণিকা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে,যার ফলে ক্লান্তিবোধ ও বমি বমি ভাবের অনুভূতিটি আর সেরকম থাকে না।

3. শক্তির দুর্দান্ত উৎস

গর্ভাবস্থাকালটি কোনও ছেলেখেলার কাজ নয়।গর্ভাবস্থার গুরুত্বপুর্ণ মাসগুলিতে,একজন মহিলা প্রায় সকল প্রকার ক্লান্তি এবং অবসন্নবোধ করেন।আপনার গর্ভের অতিরিক্ত ওজন বহন করার জন্য আপনার অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হবে।তবে ছোলা গ্রহণ এক্ষেত্রে সমাধান নিয়ে আসতে পারে।

Related Post

ছোলার একটি সম্পূর্ণ পরিবেশনে থাকে প্রোটিন,আয়রণ এবং এমনকি প্রয়োজনীয় মাত্রায় ক্যালরি।গর্ভাবস্থায় কালো ছোলার উপকারিতার কথা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না।গর্ভাবস্থার মুখোমুখি হওয়া যেকোনও চ্যালেঞ্জকে বহন করার প্রয়োজনীয় শক্তির মাত্রা সরবরাহ করার ক্ষত্রে কালো ছোলাগুলি দুর্দান্ত।

4. মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে

ছোলা কোলাইন সমন্বিত,যার অর্থএটি হল একটি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা মস্তিষ্কের বিকাশে এবং স্বাস্থ্যকর স্নায়ু গঠনে সহায়তা করে।আপনি যখন আপনার পছন্দের ছোলাগুলিকে কুড়িমুড়িয়ে চিবিয়ে গুঁড়ো করেন, আপনি আপনার অজান্তেই পরোক্ষভাবে ভ্রূনের মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের বিকাশে সহায়তা করে থাকেন।

100 গ্রাম ছোলা পরিবেশনের মধ্যে থাকে 43 গ্রাম ক্লোরিনএর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে?

5. ভ্রূণের সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে

ছোলার মধ্যা থাকে ম্যাঙ্গানিজ যা হাড়কে শক্তিশালী করে তুলতে এবং তরুণাস্থির বিকাশে সহায়তা করে।এই পুষ্টিকর উপাদানটি আবার কোষের রক্ষায় এবং অ্যামাইনো অ্যাসিড ও কার্বোহাইড্রেটের বিপাকে সাহায্য করে।

একজন মহিলার দেহে একদিনে প্রায় 2 মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজের প্রয়োজন হয়।মহিলারা এক কাপ অর্থাৎ প্রায় 164 গ্রাম ছোলার থেকে মোটামুটি প্রায় 1.69 মিলিগ্রাম মত ম্যাঙ্গানিজ পেয়ে থাকে।

গর্ভাবস্থায় চানা খাওয়ার প্রভাবগুলি

ছোলা খাওয়ার এমন বেশ কিছু প্রভাব রয়েছে,যেগুলি আপনার জানা উচিত।সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ

  • গর্ভবতী মহিলারা তাদের ক্রমবর্ধিত ওজন সম্পর্কে ভীষণ সচেতন হন।এক্ষেত্রে ছোলা খাওয়া আপনার স্থূলতার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করতে পারে।
  • পূর্বে আপনি যদি কখনও ছোলার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থেকে থাকেন,সেক্ষেত্রে ছোলাগুলি থেকে আপনার মধ্যে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
  • ছোলা আবার কিছু মহিলার মধ্যে অ্যাসিডিটি বা অম্বল সৃষ্টি করতে পারে।তবে ভাবার কিছু নেই,সারা রাত ধরে ভিজিয়ে রাখা ছোলাগুলি আপনাকে এর অ্যাসিডিক উপাদানগুলি থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করতে পারে।
  • ছোলা থেকে আবার বৃক্কে পাথর অথবা এমনকি গেঁটে বাতও হয়ে থাকতে পারে এটি খাওয়ার জন্য অত্যধিক ইউরিক অ্যাসিড নিঃসৃত হওয়ার কারণে।ছোলার মধ্যে থাকা পিউরন এই ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদনের কারণ।
  • আপনি যদি ডায়রিয়ায় ভুগে থাকেন,সেক্ষেত্রে আপনার ছোলা খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত কারণ তা না হলে ছোলা আপনার অবস্থাটিকে হয়ত আরও খারাপ করে তুলতে পারে।
  • ছোলার মত উচ্চ তন্তুযুক্ত খাবার কোষ্ঠকাঠিণ্য দমন করতে সহায়তা করতে পারে।তবে আধা শক্ত ছোলাগুলি হজমের সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে।তাই গর্ভাবস্থায় আপনার সেগুলি পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়।
  • যেকোনও কিছুই অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া হল ক্ষতিকর।এই একই ব্যাপারটি ছোলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ভিত্তিতে ছোলা বেশি মাত্রায় খেলে তা পেটে ব্যথা এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।যদিও কারণ জানা যায় না,তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে,ছোলা হল পেট ফেঁপে যাওয়া এবং পেটে গ্যাস জমার অপর একটি কারণ।
  • সোয়াবিনে অ্যালার্জি থাকা কিছু মহিলার মধ্যে আবার ছোলাতেও অ্যালার্জি হতে দেখা যেতে পারে।যদি কোনওরকম চুলকানি,বমি বমি ভাব অথবা এমনকি পেটে ব্যথা বা অন্য কোনও পেটের সমস্যা দেখা দেয়,সেক্ষেত্রে ছোলাগুলি খাওয়া বর্জন করুন।

কীভাবে ছোলাগুলিকে রান্না করবেন?

ছোলার কিছু রেসিপি প্রস্তুত করার জন্য এখানে কয়েকটি পরামর্শ রইল।সেগুলির মধ্যে যেগুলি জানা গুরুত্বপূর্ণ,তার মধ্যে রয়েছেঃ

  • ছোলা দিয়ে একটি সুস্বাদু পদ তৈরী করা শুরু করার জন্য,আপনাকে সেগুলি সারা রাত ধরে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
  • সকালে উঠে সেই চানাকে তৈরী করুন সেগুলিকে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে সেদ্ধ করে,তারপর কিছু মশলার সাথে সেগুলিকে নেড়ে চেড়ে নিয়ে।
  • আপনি যদি ক্যানে করে যে সকল প্রক্রিয়াজাত ছোলাগুলি পাওয়া যায় সেগুলি চয়ন করতে চান,আপনাকে শুধু সেই ক্যানটিকে খুলতে হবে আর খাবারটির আস্বাদ গ্রহণ করা শুরু করতে হবে।যদিও এইভাবে পাওয়া সেদ্ধ বা ভাজা ছোলাগুলি গর্ভাবস্থায় খাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।
  • একবার ছোলাগুলিকে সেদ্ধ করা হয়ে গেলে তা সে কাবলি কিম্বা কালো ছোলাও হতে পারে,তার সাথে নুন,গোল মরিচ,টমেট এবং ধনে পাতা যোগ করুন।এটা এত দুর্দান্ত একটা স্ন্যাকস জাতীয় জলখাবার তৈরী করে যে তা আপনার স্বাদ কোরকের রসস্বাদনে পরিতৃপ্ত করবে।
  • গর্ভাবস্থায় কাবলি ছোলা হল একটি সুপারিশকৃত ডায়েট বিকল্প।আপনি কাবলি ছোলাগুলিকে ওভেনে সামাণ্য জলপাই তেল এবং মশলা সহযোগে ভেজে নিতে পারেন।এটি কুড়মুড় করে খাওয়ার জন্য বেশ মুখোরোচক একটা মুচমুচে জলখাবার প্রস্তুত করে তোলে।
  • আপনার প্রতিদিনের গ্রহণ করা স্যুপে সেদ্ধ ছোলা যুক্ত করুন।আপনি নিশ্চিতভাবেই এর স্বাদটিকে ভালোবেসে ফেলবেন এবং এর দুর্দান্ত স্বাদটি আপনার খাদ্য আকাঙ্খাকে পরিতৃপ্ত করবে।
  • একটা চমৎকার স্বাদের অভিজ্ঞতার জন্য আপনার এক কাপ দইয়ের পরিবেশনের সাথে গারবানজো কলাই বা ছোলা যুক্ত করুন।আপনি আবার এটিকে বেশ স্বাদবহুল করে তোলার জন্য এর সাথে শসা এবং কিশমিশও যোগ করতে পারেন।

এগুলি হল ছোলার সাথে যুক্ত কিছু উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।মুদ্রার উভয় পাশেই দৃষ্টি রেখে,ছোলাকে আপনার ডায়েটে অন্তর্ভূক্ত করতে মনে রাখবেন,তবে পরিমিত পরিমাণে।আপনার এবং আপনার ভ্রূণের সুস্বাস্থ্যটি বজায় রাখাই হল সকল বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

Share
Published by
দেবশ্রী ব্যানার্জী