গর্ভাবস্থায় যদি আপনি অনবরত ঢেকুর তুলতেই থাকেন, তখন আপনি হয়ত এই ভেবে বিস্মিত হতে পারেন যে, এটিও গর্ভাবস্থায় দেখা দেওয়া অবাঞ্ছিত উপসর্গগুলির মধ্যেই একটি নয় তো? প্রাতঃকালীন অসুস্থতা বা মর্নিং সিকনেস, পিঠ ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অবসাদ ইত্যাদির মত গর্ভাবস্থাকালে হয়ে থাকা সাধারণ উপসর্গগুলির সাথে আপনি নিশ্চই ইতিমধ্যেই সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন বা তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে চলেছেন।তবে ঢেকুর তোলার ব্যাপারটা কি? গর্ভাবস্থায় মাঝেমধ্যেই বারংবার ঢেকুর ওঠাটা কি সাধারণ ব্যাপার? তার সন্ধান পেতে পড়তে থাকুন!
গর্ভাবস্থায় দেখা দেওয়া বিভিন্ন উপসর্গগুলির মধ্যে, আপনি হয়ত ঢেকুর ওঠার ব্যাপারটা নাও শুনে থাকতে পারেন, কিন্তু এটি বরং আরও বেশ স্বাভাবিক।আপনি যদি গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকের থেকে বেশিই ঢেকুর তুলতে থাকেন, তবে সেটি আপনার গর্ভাবস্থার হরমোনগুলির কারণে হয়ে থাকে।এই সময় আপনার দেহের মধ্যে হয়ে চলা হরমোনীয় পরিবর্তনগুলির কারণে তা আপনার অন্ত্র এবং পাকস্থলির মধ্যে গ্যাসের অনুপাতকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।তার সাথে আবার আপনার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হওয়ার ফলে আপনি আবার মর্নিং সিকনেস বা প্রাতঃকালীন অসুস্থতা এবং অতিরিক্ত লালা হওয়া অনুভব করার মত অভিজ্ঞতাগুলিও অর্জন করতে পারেন। সর্বোপরি, গর্ভদশার চাপটিও আপনার শরীরকে সম্পূর্ণভাবে এক পৃথক অবস্থায় নিয়ে ফেলে দিতে পারে, যার ফলস্বরূপ অনিচ্ছাকৃতভাবেই ঢেকুরগুলি উঠতে থাকে।
গর্ভাবস্থায় টক ঢেকুর ওঠার পুনরাবৃত্তিটি এমনিতে স্বভাবতই বেড়ে যায়।এই ঢেকুর ওঠার প্রধান কারণ হল প্রোজেস্টেরন হরমোন, যা গর্ভাবস্থায় ক্ষরিত বা নিঃসৃত হয়।এই হরমোন নিম্ন গ্রাসনালীর স্ফিংক্টার পেশীকে শিথিল করে এবং গ্রাসনালীর মধ্যে অ্যাসিডকে সহজেই প্রবেশ করতে দেয়, যা আরও অ্যাসিডিটি বা অম্লতা এবং ঢেকুর ওঠার দিকে পরিচালিত করে।হজম প্রক্রিয়াকে এবং অন্ত্রের গতিবিধিকে ধীর করে তোলে আর তার সাথে সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
আপনি যদি গর্ভাবস্থায় অনবরত ঢেকুর তুলতে থাকেন, আপনি তবে তার সাথে আরও কিছু উপসর্গও লক্ষ্য করে থকতে পারেন যেমন–
এই সকল উপসর্গগুলির বেশিরভাগগুলিই গর্ভাবস্থার প্রথম দিকের মাসগুলিতে প্রকট হয়ে ওঠে, যার মধ্যে যখন আবার ঢেকুর ওঠার পুনরাবৃত্তিটিও উচ্চ মাত্রায় গিয়ে পৌঁছায়।
গর্ভাবস্থায় রাতের বেলায় ঢেকুর উঠতে থাকলে তা আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে আর তার পরিণামে আপনি পরের দিন হয়ত আপনার বিছানার ভুল পাশ থেকে ঘুম থেকে উঠতে পারেন।ঢেকুর ওঠা যদি আপনার ঘুমকে বিঘ্নিত করে ও আপনাকে জাগিয়ে তোলে, তবে সেক্ষেত্রে এটি প্রোতিরোধেরও কিছু উপায় আছে।গর্ভাবস্থায় আপনার ঢেকুর ওঠাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন এবং তার প্রকোপটাকে কীভাবেই বা সর্বোনিম্ন করতে পারেন তা জানতে আরও পরুনঃ
গর্ভবতী হলে আপনার ভালমত গভীর ঘুম হওয়াটা খুবই জরুরি, আর তার জন্য আপনাকে অবশ্যই সঠিক ভঙ্গিমায় ঘুমাতে হবে।ঘুমের সময় সঠিক ভঙ্গিমা বজায় রাখলে তা রাত্রে আপনার ঢেকুর ওঠার প্রকোপকে হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে।আপনার পা দুটিকে ভাঁজ করে কিম্বা সেগুলিকে একত্রে জড়ো করে আপনার বাম পাশ ফিরে শুয়ে পড়ুন।এই অবস্থানটি আপনার হজমে সহায়ক হয় এবং রাত্রি বেলায় আপনার পেটের ভিতরে খাদ্যগুলিকে প্রক্রিয়াজাত হয়ে সহজে পাচিত হতে সাহায্য করে এবং গ্যাস উৎপন্ন হওয়া রোধ করে।
গর্ভাবস্থায় আপনার দৌড়ানো কিম্বা ভারী ওজন তোলার মত কঠোর অনুশীলন করার কোনও প্রয়োজনই নেই।হালকা কিছু যোগ–ব্যায়াম নিয়মিত অনুশীলন করলে তা আপনার পাচন প্রক্রিয়াকে একটি সঠিক ও যথাযথ অবস্থায় রাখতে এক সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারে।আপনি যখন কোনও শারীরিক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হন, তখন তা আপনার দেহের মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক মুক্ত করবে যা আপনার দেহের বিভিন্ন অংশকে উদ্দীপ্ত করবে এবং তার ক্রিয়াকে বাড়িয়ে তুলবে।এক্ষেত্রে সাধারণ ক্রিয়াকলাপ যেমন বাসন ধোয়া কিম্বা জামা–কাপড় শুকানোর মত কৌশলটিকেও আপনি কাজে লাগাতে পারেন।
আপনার শারীরিক সুস্থতা, বিশেষ করে, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল বা পাচন স্বাস্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভর করে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর।কোনওরকম চিন্তা বা উদ্বেগের উপস্থিতি পাকস্থলীর মধ্যে রাসায়নিকের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা বদহজমের কারণ হয়ে ওঠে অথবা পেটের মধ্যে গ্যাস উৎপাদনের মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলে।সুতরাং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি নিয়মিত কিছু হালকা যোগ–ব্যায়াম অনুশীলন করুন কিম্বা ধ্যান করুন অথবা সাধারণ কিছু যোগা অভ্যাস করুন।এটি আপনার মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করবে আর আপনার শারীরিক ক্রিয়াকলাপগুলিকেও একটি সর্বোত্তম অবস্থায় বহাল রাখবে।
আপনার যদি ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকে, তবে সেটা বন্ধ করার সময় হয়েছে, যদি আপনি গর্ভবতী হয়ে থাকেন।একবার আপনি গর্ভবতী হয়ে উঠলে কিম্বা গর্ভধারণের প্রয়াস চালালে সহজাতভাবেই আপনার সিগারেট খাওয়া এবং মদ্যপান করা ছেড়ে দেওয়া উচিত।ধূমপান বা মদ্যপান আপনার স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আপনার গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলে, সুতরাং সেগুলি পরিহার করাই সর্বোত্তম।তদুপরি, ধূমপান এবং মদ্যপান করার সাথে বেশ কিছু বায়ু গিলে ফেলারও একটা প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়, যা ঢেকুর ওঠার প্রকোপকে বাড়িয়ে দিতে পারে।সুররাং সেগুলি পুরোপুরি এড়িয়ে চলাই সবচেয়ে ভাল।
তরল ধীরে ধীরে গিললে সেটি গর্ভাবস্থায় আপনার ঢেকুর তোলার পুনরাবৃত্তিটিকে হ্রাস করতে পারে।অনেক মানুষেরই বোতল থেকে সরাসরি জল পান করার অভ্যাস থাকে, কিন্তু এটা ভুল পন্থা।মুখে না লাগিয়ে বোতল থেকে আলগা করে জল খাওয়া, জলের সাথে অনেক বেশি পরিমাণে বায়ু গিলে ফেলার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করতে পারে যা পেটের মধ্যে আটকে থাকে।যখনই আপনি জল খাবেন, চেষ্টা করুন প্রতিবারই সেটিকে একটা কাপ বা গ্লাসের মধ্যে ঢেলে নিয়ে সোজা হয়ে বসে সেটি থেকে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে।
গর্ভবতী হলে আপনি এই কাজটি করার চেষ্টা করুন এবং আপনার খাবারটিকে উপভোগ করুন।গর্ভাবস্থা জনিত চাপের কারণে আপনি হয়ত আপনার খাবারটিকে যত শীঘ্র সম্ভব দ্রুত খেয়ে কিম্বা গিলে ফেলতে পারেন, যার সবকিছুই বদ হজম এবং তার সাথে পেটের মধ্যে গ্যাস হওয়াকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।সুতরাং আপনার খাবারটিকে ধীরে ধীরে খান এবং চেষ্টা করুন খাওয়ার সময় কোনওরকম কথা না বলার।এছাড়াও আপনার আহার কার্যটি সম্পন্ন হলে হজম প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করতে হালকা ঘোরাঘুরি করুন।
যখন আপনি আপনার পছন্দের কার্বোনেটেড পানীয়গুলি পান করে থাকেন ঢেকুর ওঠার প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে যায়।বাতান্বিত পানীয়গুলির মধ্যে উচ্চ পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং ক্যাফিন যুক্ত থাকে, যেগুলি একজন গর্ভবতী মহিলার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।অতএব গর্ভাবস্থায় চা, কফি, কোলা জাতীয় পানীয় ইত্যাদিগুলি এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।আপনি নিজেকে হাইড্রেট রাখার জন্য জল এবং তাজা ফলের রস পান করতে পারেন।আর আপনি যদি একান্তই চা পান করতে চান তবে সেক্ষেত্রে, হারবাল বা ভেষজ চা–কে বেছে নিতে পারেন কারণ এগুলি আপনার দেহকে শিথিল করে এবং তার পাশাপাশি আবার আপনার জন্য বহুবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে আসে।
বাতাস গ্রহণ করে ফেলা অথবা ঢেকুর ওঠার কারণ হতে পারে এমন সকল বিষয়গুলি সম্পর্কে যদি আপনি সকল প্রকার সতর্কতা অবলম্বন করেও ফেলেন, তবুও সেক্ষেত্রে এমন কিছু খাবার থেকেই যায় যেগুলি পরিণামে আপনার পেটের মধ্যে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে।এটি সেগুলির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই হয়ে থাকে।বাঁধাকপি, মূলো, ব্রকোলি এবং এমনকি মিষ্টি ছাড়া কিছু পণ্যতেও এমন কিছু উপাদান থাকে যা আপনার দেহের মধ্যে গ্যাস উৎপাদন করে।এর পরবর্তী লাইনেই রয়েছে ভাজাভুজি খাবারগুলি এবং সেগুলি মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা অম্বল, হৃদয়জ্বলনের দিকে পরিচালিত করে।সুতরাং সেগুলি আহার করা যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলুন।
একবারে একসাথে অনেকটা খাবার খেলে তা পেটের উপর চাপ বৃদ্ধি করতে পারে আর বদ হজম হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে অথবা পাচন প্রক্রিয়াটিকে মন্থর করে তুলতে পারে।এই সবকিছুই আপনার দেহের মধ্যে বেশ কিছুটা গ্যাস তৈরী করতে এবং ঢেকুর ওঠার পুনরাবৃত্তির হারকে বাড়িয়ে তোলার কাজ করে। চিরাচরিতভাবে আমাদের মধ্যে চলে আসা 3 বার মূল খাবার সময়টিকে ভেঙ্গে সেটিকে 6 বারে পরিবর্তিত করুন।এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারলে তা কখনই আপনার পেট ফাঁকা নয় বরং আপনাকে পূর্ণ রাখবে এবং অবাঞ্ছিত লোভকে আটকাবে আর তার সাথে বদহজমের অযাচিত প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা হ্রাস করবে।
ঢেকুর ওঠা থেকে অ্যান্টাসিডগুলিও মুক্তি আনতে পারে, তাই অন্যান্য প্রতিকারগুলি প্রয়োগ করার পরেও যদি আপনি ভাল বোধ না করেন তবে সেক্ষেত্রে আপনি সেগুলি গ্রহণ করতে পারেন।তবে সেগুলি কিন্তু অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানের অধীনেই গ্রহণ করবেন।
আপনি যদি এক–দু দিন ধরে স্বাভাবিকের থেকে তুলনায় বেশি বার ঢেকুর তুলতেই থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ একজন ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই।এটি কেবলমাত্র আপনার খেয়ে থাকা কোনও বিশেষ একটি খাদ্যের কারণেই হয়ে থাকা ঘটনা মাত্র হয়ে থাকতে পারে।কেবল আপনার খাদ্য তালিকার মধ্যে সকল পুষ্টিগুলি অব্যাহত রাখা এবং আপনার সুস্থ থাকার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করুন।যাইহোক, তবে এই ঢেকুর ওঠার সমস্যাটি যদি আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং আপনি বদ হজম এবং অম্বল হওয়া বোধ করেন, সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করুন।তিনিই আপনাকে সবচেয়ে সেরা গাইড করবেন! তিনি হয়ত আপনাকে শান্ত করার বেশ কিছু বিকল্পের পরামর্শ দেবেন এবং সেটি অন্য কোনও কারণ থেকে হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবেন।
গর্ভাবস্থায় ঢেকুর ওঠাটা বেশ সাধারণ একটা ব্যাপার কিন্তু আমরা জানি এটা বেশ কষ্টকর একটা ব্যাপার।তবে সমস্যাটি কিন্তু নিজে থেকেই সমাধান হয়ে যাওয়া উচিত।আপনার ঢেকুর ওঠা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপনি উপরিল্লিখিত পরামর্শগুলি অনুসরণ করতে পারেন।এই সকল পরামর্শগুলি সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থা জুড়ে আপনর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করবে।