প্রত্যেকেই সচেতন যে, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী । কিছু মানুষের জন্য, বিশেষ করে যারা প্রথমবার মা হয়েছেন, তাঁদের কাছে এটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে । যত্ন নেওয়ার প্রাথমিক দিনগুলি প্রচুর প্রশ্নের সঙ্গে সমস্যাকর সময় হতে পারে । আপনি বুকের দুধ খাওয়ানোর ধারণা এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানলে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে পারবেন, যা আপনাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে ।
কিছু সাধারণ প্রশ্নের আলোচনার মাধ্যমে বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ে আপনি সঠিক উপলব্ধি করতে পারবেন ।
এই কথাটি প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় – “বুকের দুধ এখনো আসেনি” । কিন্তু এই কথাটি ব্যবহার করা ভুল । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, সন্তান জন্মের পর প্রথম দিনগুলিতে মহিলারা কোলোস্ট্রাম বা প্রথম দুধ উত্পাদন করেন । কোলোস্ট্রাম হলো পুরু, দুধের মতো পদার্থ, যা অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ, যা প্রকৃত বুকের দুধ উৎপাদনের পূর্বে তৈরি হয় । সাধারণত জন্মের পর কয়েক দিনের মধ্যে শরীর বুকের দুধ উৎপন্ন করতে শুরু করে ।
না, স্তনের আকার দুধ উৎপাদনকে প্রভাবিত করে না । বেশিরভাগ মহিলারা তাদের স্তনের আকার নির্বিশেষে তাদের শিশুর চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট দুধ উত্পাদন করেন । ক্ষুদ্র–স্তনযুক্ত মহিলারা অতিরিক্ত পরিমাণের দুধ উৎপাদন করতে পারেন, যেখানে কিছু বড়–স্তনযুক্ত মহিলা যথেষ্ট পরিমাণে দুধ উৎপাদন করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন ।
ডাক্তারদের মতে, বিভিন্ন স্তনের বিভিন্ন পরিমাণের সংরক্ষণ ক্ষমতা থাকতে পারে । তাছাড়া, দুধ সরবরাহের পরিমাণ স্তনের টিস্যু উপর নির্ভর করে । কিন্তু মায়েদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে চিন্তা করার দরকার নেই । সাধারণভাবে দুধ খাওয়ানো মায়েরা তাদের বাচ্চাদের যতটা প্রয়োজন ততটা উৎপাদন করতে সক্ষম । তবে, যদি দুধ সরবরাহ কম বলে আপনার সন্দেহ হয়, তবে দুধের উৎপাদন কম হওয়া আটকানোর জন্য বিশেষজ্ঞের নির্দেশ নিন ।
বুকের দুধ খাওয়ানো সবচেয়ে প্রাকৃতিক জিনিস হিসাবে মনে করা হয় । তবে এটি প্রত্যেকের জন্য সহজ নাও হতে পারে, প্রধানত প্রসবের পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহে । এটি একটি অর্জিত দক্ষতা যা বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের ধৈর্য এবং অনুশীলনের সাথে শিখতে হয় । কিছু মহিলার জন্য, প্রাথমিক দিনগুলি অস্বস্তিকর ও কষ্টদায়ক হতে পারে, বিশেষ করে যখন তারা প্রসব–পরবর্তী স্তরের সমস্যাগুলির সাথে মোকাবিলা করছেন । বুকের দুধ খাওয়ানো সাধারণত সময় এবং অভিজ্ঞতার সাথে সাথে সহজ হয়ে যায় ।
একটি শিশু কখনো কখনো বুকে থাকতে পারে, তবে কেবল পুষ্টিগত কারণে নয় । কিছু শিশু স্তন টানার মাধ্যমে সান্ত্বনা পায় । তারা দীর্ঘ সময় ধরে স্তনপান করতে পারে এবং স্তনকে স্বান্তনাদায়ী (প্যাসিফায়ার) হিসাবে ব্যবহার করতে পারে । আপনি যদি আপনার শিশু সত্যিই দুধ খাচ্ছে কিনা নিশ্চিত না হন, তবে কিছু কিছু বিষয় পরীক্ষা করুন, যেমন– টানার সময় তার চোয়াল ওঠানামা করছে কিনা, সে গিলছে কিনা, দুধ খাওয়ানোর পরে আপনার স্তন হালকা বোধ হচ্ছে কিনা, এবং এরকম অন্যান্য বিষয়গুলি ।
বেশিরভাগ মহিলারা সাধারণত চিন্তা করেন যে, তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে দুধ উৎপাদন করছেন কিনা । আপনি কিছু লক্ষণ লক্ষ্য করতে পারেন, যেমন:
দুধ সরবরাহ বিভিন্ন কারণে কম হতে পারে । যদি আপনি চিন্তিত হন যে আপনি পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদন করছেন না, তবে এরকম কিছু চেষ্টা করুন:
কিছু মহিলারা বেদনাদায়ক স্তনের অভিজ্ঞতা পেতে পারেন, যদি সেগুলি খুব পূর্ণ হয় । যখন একজন মা তাঁর বাচ্চার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দুধ উত্পাদন করেন বা বাচ্চা হঠাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে কম খেতে শুরু করে, তখন সাধারণত স্তন ফুলেফেঁপে ওঠে । দুগ্ধনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও স্তন ফুলে উঠতে পারে । এইরকম পরিস্থিতিতে, ফোলাভাব কমানোর জন্য আপনি ঠাণ্ডা চাপ বা বাঁধাকপির পাতা ব্যবহার করে দেখতে পারেন । কিছু দুধ বের করে দেওয়ার জন্য ব্রেস্ট পাম্প বা হাতের স্পর্শ কৌশল ব্যবহার করুন ।
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় আপনার শিশুর পেটব্যথা হলে, আপনি কী খাচ্ছেন তা বিবেচনা করুন । গরুর দুধ, ফুলকপি, চকোলেট, ব্রোকোলি, পেঁয়াজ এবং মশলাযুক্ত খাবারের মতো কিছু খাবার আপনার শিশুর সহ্য না হলে, তার পেটব্যথা হতে পারে । আপনার খাদ্যতালিকা থেকে কোন কোন খাবার বাদ দিতে হবে, সেই বিষয়ে আপনার শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন । আপনি একে একে খাবার বাদ দিয়ে এটি করার চেষ্টা করতে পারেন এবং তারপরে আপনার শিশুর পেটব্যথার লক্ষণগুলি কমলো কিনা দেখার জন্য অপেক্ষা করুন ।
কালশিটে পড়া বা ফেটে যাওয়া স্তনবৃন্ত দুধ খাওয়ানোকে বেদনাদায়ক করে তুলতে পারে । আপনি আপনার নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ানোর অবস্থান পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করতে পারেন । দুধ খাওয়ানোর পরে আপনার স্তনবৃন্তকে হাওয়ায় শুকোতে দিন । আঁটোসাঁটো ব্রা এবং শার্ট এড়িয়ে চলুন । নরম সুতীর পোশাক ব্যবহার করুন, যাতে ত্বকে জ্বালা না করে । আপনার দুধ খাওয়ানোর প্যাড নিয়মিত পরিবর্তন করুন । হাতের স্পর্শ কৌশলে বের করা কিছু বুকের দুধ আপনি কালশিটে পড়া স্তনবৃন্তে ঘষে দিতে পারেন, যাতে সেগুলির নিরাময় হয়ে যায় ।
কখনও কখনও, ফেটে যাওয়া স্তনবৃন্ত থেকে রক্তপাত হতে পারে । তবে আপনি তখনও স্তনপান করাতে পারেন, তবে সেটি বেশ অস্বস্তিকর হতে পারে । স্তনদুধের সামান্য পরিমাণে রক্ত শিশুর ক্ষতি নাও করতে পারে । তবে, শিশুকে সঠিকভাবে স্তনের সাথে ধরে না রাখার ফলেও স্তনবৃন্ত ফেটে যেতে পারে । আপনি শিশুকে উপযুক্তভাবে স্তনের সাথে ধরে রাখার কৌশল সম্পর্কে জানতে কয়েকটি সেশন নিতে পারেন ।
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কোনো ব্যথা হওয়া ঠিক নয় । বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় আপনার কাঁটা ফোটার মত বা কাঁপুনির মতো অনুভূতি হতে পারে । কিন্তু কোন ব্যথা হওয়ার মানে শিশুটিকে সঠিকভাবে স্তনের সাথে ধরে রাখা হচ্ছে না । তার মুখ বড় করে খুলুন (তার চিবুক ধরে আলতোভাবে নীচের দিকে টেনে ধরুন) যাতে সে যতটা সম্ভব এরিওলা (স্তনবৃন্তের চারপাশের লালচে জায়গা) এবং স্তন মুখে নিতে পারে । যদি তার মুখ যথেষ্ট পরিমাণে না খোলে, তবে স্তনবৃন্তের সাথে তার বাঁধন সঠিক নাও হতে পারে, যার ফলে স্তনবৃন্ত থেকে তার মুখ সরে যেতে পারে, ফলে স্তনবৃন্ত ফেটে যায় ।
আটকে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া নালী থেকে বেদনাদায়ক পিন্ড তৈরি হতে পারে, কারণ তারা দুধকে সঠিকভাবে স্তন থেকে বের হতে বাধা দেয় । আপনি ঘন ঘন দুধ খাওয়ালে, অবস্থার উন্নতি হতে পারে । অন্যান্য চিকিত্সার মধ্যে রয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত স্তনে উষ্ণ চাপ প্রয়োগ বা মালিশ করা, যাতে দুধের প্রবাহ বাড়ানো যায় । দুধ খাওয়ানোর পর আপনার স্তন সঠিকভাবে খালি হয় কিনা, তা সবসময় নিশ্চিত করুন ।
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় খাবার খাওয়ার বিষয়ে সংযমই হবে মূল নীতি । সুষম খাদ্যতালিকা নির্বাচন করুন । এমন খাবারগুলি থেকে বিরত থাকুন, যা থেকে আপনার পেট ফাঁপতে পারে, কারণ এর থেকে আপনার সন্তানের পেটব্যথা হতে পারে । প্রচুর পরিমাণে জল, তাজা ফলের রস এবং স্যুপ পান করুন ।
আপনার কিছু অন্তর্নিহিত স্তনবৃন্তের সমস্যা, যেমন– চ্যাপটা স্তনবৃন্ত, ফুলে ওঠা বা কালশিটে পড়া স্তনবৃন্তের সাথে মোকাবিলা করতে আপনার ডাক্তার স্তনবৃন্তের রক্ষক বা আবরণ ব্যবহার করার সুপারিশ করতে পারেন । যাইহোক, সেগুলি দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে ব্যবহার করা উচিত নয় এবং শুধুমাত্র একজন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানেই ব্যবহার করা উচিত ।
এটার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অনেক মায়েরা পাম্পিং পছন্দ করতে পারেন কারণ যখন তিনি খাওয়াতে অক্ষম হবেন, তাঁর সন্তানকে অন্য কেউ খাওয়াতে পারেন । কিছু মা তাদের দুধ সরবরাহ বাড়াতে পাম্প করা বেছে নিতে পারেন । যদি আপনি পাম্পিং করা বেছে নেন, তাহলে দিনে দুইবার দুধ খাওয়ানোর ঠিক পরে এটি করার চেষ্টা করুন, যাত একবার দুধ খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত দুধ জমা করা যায় ।
কখনো কখনো নবজাতক শিশুদের উচ্চতর বিলিরুবিনের মাত্রার জন্য জন্ডিস হয়, যার ফলে তাদের চোখ ও ত্বকে একটি হলুদ আভা দেখা দেয় । কিছু ক্ষেত্রে, শিশুর জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহে বুকের দুধ কম সরবরাহ বা অপর্যাপ্ত দুধ খাওয়ানোর কারণে জন্ডিস খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছাতে পারে । এর থেকে চরম মাত্রায় ওজন কমে যায় এবং ডিহাইড্রেশন ঘটে । এরকম ক্ষেত্রে, বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া উচিৎ, যাতে তাদের বুকের দুধ খাওয়ানো আরো ফলপ্রসূ হয় ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অন্যান্য খাবার দেওয়া শুরু করার আগে প্রায় ছয় মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয় । তারপরে, শিশুর প্রায় ২ বছর বা তার বেশি বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর সাথে অন্যান্য পরিপূরক শক্ত খাবার দেওয়া যেতে পারে । তবে, এটি ব্যক্তিগত পছন্দের উপর বেশি নির্ভর করে ।
বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েরা অসুস্থ হলেও বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করার প্রয়োজন নেই । কিছু পরিস্থিতিতে কিন্তু বন্ধ করার প্রয়োজন হয়, যেমন সক্রিয় যক্ষা, এইচআইভি, ব্রুসেলোসিস, ক্যান্সারের জন্য কেমোথেরাপির ব্যবস্থা, নিষিদ্ধ ওষুধ গ্রহণ, বুকের উপর হার্পিসের ফোড়া ইত্যাদি । তবে কেবল জ্বর বা সর্দির কারণে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা উচিত নয়, যদি না ডাক্তার এরকম করতে পরামর্শ দেন ।
আদর্শভাবে, নবজাতকের প্রাথমিক মাসগুলিতে প্রতিদিন তাকে ৮ থেকে ১২ বার খাওয়ানো উচিত । আপনার শিশু প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর সময় প্রায় ৫০ মিলিলিটার খাওয়ার পর প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পরে ক্ষুধার্ত বোধ করবে । প্রাথমিক মাসের শেষের দিকে ধীরে ধীরে সে প্রায় ১২০ মিলিলিটার পর্যন্ত খেতে শুরু করতে পারে । বাচ্চার ৬ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে প্রায় ৩০ মিলিলিটার বৃদ্ধি আশা করুন ।
বুকের দুধ খাওয়ানো মা এবং শিশু উভয়কে সাহায্য করে, কারণ এটি অনেক রোগ থেকে মা এবং শিশুকে রক্ষা করতে পারে । অতএব, বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের যতদিন সম্ভব তাদের বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া উচিৎ ।