সামাজিক দূরত্ব কি এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় এটি আবশ্যকীয় কেন

সামাজিক দূরত্ব কি এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় এটি আবশ্যকীয় কেন

সাম্প্রতিক পৃথিবী ব্যাপী হয়ে চলা কোভিড-19 মহামারীটির সাথে আপনি খুব সম্ভবত “সামাজিক দুরত্ব’ শব্দটিকে সামাজিক মাধ্যমের চারপাশে ভেসে আসতে শুনেছেন।বিভিন্ন শপিং মল এবং রেস্তোরাঁগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়া, অধিকাংশ অফিসগুলিতে ওয়ার্ক ফর্ম হোম ঘোষিত হওয়া কিম্বা সারা বিশ্ব জুড়ে অনেক ইভেন্টগুলি বাতিল হয়ে যাওয়া-যাই হোক না কেন, এই সব কিছুই সামাজিক দূরত্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।সুতরাং সামাজিক দূরত্বটা আসলে ঠিক কি এবং কেনই বা এটির জন্য সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনগুলির দ্বারা এত দৃঢ়ভাবে জোড় দেওয়া হচ্ছে? আসুন জানা যাক!

সামাজিক দূরত্ব কি?

সামাজিক দূরত্ব হল এই ক্ষেত্রে কোভিড-19 করোনাভাইরাসের ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াকে হ্রাস করতে সারা পৃথিবীর নাগরিকদের গৃহীত একটি প্রয়াস।যতবার মানুষেরা সরাসরি মিলিত হন  বা শারীরিকভাবে যোগসূত্র ঘটে কিম্বা যোগাযোগ করেন, তারা ততবারই জীবাণু বা মাইক্রোবসগুলিকে বিনিময় করেন, যা তারপর আরও অন্যান্য লোকেদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, যাদের সাথে তারা সাক্ষাৎ করেন, মিলিত হন ইত্যাদি মাধ্যমে, আর এইভাবেই ভাইরাস জনিত সংক্রমণগুলি ছড়িয়ে পড়ে।সামাজিক দূরত্বের অর্থ হল বাড়ির বাইরে পা রাখুন কেবল তখনই যখন কোনওকিছুর প্রয়োজন এবং কারণ থাকবে, যার মধ্যে রয়েছে কাজের জন্য, অত্যাবশকীয় জিনিসের প্রয়োজনের জন্য অথবা আরও অনেক কারণে বাইরে পা রাখা।মানুষ যখন বাড়ির মধ্যে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করেন, তারা সংক্রামিত হওয়া থেকেও নিজেরা সুরক্ষিত থাকেন। একজন ব্যক্তির সামাজিক দূরত্ব অনুশীলন করার মানে হল তার নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারা, কিন্তু সমগ্র সমাজের এটি অনুশীলন করার দ্বারা এই ভাইরাসটিকে সম্পূর্ণ রূপে থামিয়ে দেওয়া যেতে পারে।চলুন দেখা যাক কেন এটি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণঃ

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সুবিধাগুলি

এই পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা কেবল আপনার নিজের জন্যই উপকারী নয়, সমগ্র জাতির জন্যও।এখানে বলা হল এই মহামারীর সময় কেন এটি এত প্রয়োজনীয়ঃ

1.মানুষকে নিরাপদে রাখে

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুস্পষ্ট উপকার হল এটি আপনাকে রাখে সুরক্ষিত, যা ঘুরেফিরে আপনার চারপাশের মানুষজনকেও রক্ষা করে।জেনে রাখার ক্ষেত্রে এর চেয়েও আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল এই যে কিছু মানুষ বিশেষ কিছু ভাইরাসের প্রতি খুব বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকেন, যেগুলির দ্বারা তারা খুব সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়েন।সেরকমই কোভিড-19 এর ক্ষেত্রেও, এতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি প্রবীণ অথবা শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত অসুস্থতা আছে এমন ব্যক্তিদের ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাবিশিষ্ট ব্যক্তিদের।অতএব, আপনি যদিও উচ্চ ঝুঁকির সারণীতে নাও পড়ে থাকেন কিন্তু তবুও এই ভাইরাসটি আপনাকেও ধরে নিতে পারে এবং আপনি তা বহন করে চলতে পারেন, এবং তা আবার আপনার থেকেও অন্য কারুর কাছেও চলে যেতে পারে যিনি হয়ত আবার এটির দ্বারা গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়ে উঠতে পারেন।সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস করার মাধ্যমে আপনি আপনার চারপাশে থাকা মানুষজনের প্রতি আপনার দায়িত্বটি বেশ ভালভাবেই পালন করতে পারেন।

2.ভাইরাসের বিস্তারকে হ্রাস করে এবং বন্ধ করে

অবশ্যই এমন কতগুলি বিষয় আছে যা ভাইরাসগুলির বিস্তারকে প্রতিহত করে, তবে এটি বন্ধ করার প্রধান চাবিটিই হল প্রথমে সেটির প্রসারকে খর্ব করা।যখন মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না তখন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্পূর্ণ রেখাটি ছিন্ন হয়ে যায়।একবার সকল সংক্রামিত ব্যক্তিকে পৃথক করে রেখে তাদের নিরাময় করে তুলতে পারলে, ভাইরাসের বিস্তারটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যা এই ধরণের মহামারীর সমাপ্তিকরণের জন্য অপরিহার্যভাবে সবচেয়ে ভাল উপায়।

3.স্বাস্থ্যসেবা ইন্ডাস্ট্রিতে বোঝা হ্রাস করে

প্রতিটি দেশেই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা আছে এবং তারা একসাথে এতগুলি কেস কেবল খুব সীমিতবারই সামাল দিতে পারে।ভুললে চলবে না, ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্টাফেরা প্রতিদিন তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে চলেন।আপনার নিজেকে এবং তার সাথে আপনার আশেপাশের সকলকে সুরক্ষিত রাখলে, স্বাস্থ্যসেবা ইন্ডাস্ট্রিগুলি যে বিপুল চাপের মুখোমুখি হয়ে চলেছে তার বোঝাকে কিছুটা হ্রাস করার ক্ষেত্রে আপনি সহায়তা করতে পারেন।এই উপায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও যেমন নিরাময় হয়ে উঠতে পারেন আবার তার সাথেই ভাইরাসের প্রসারও দ্রুত থামানো যেতে পারে।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অন্যান্য সুবিধাগুলি

পূর্ববর্তী সুবিধাগুলি ছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় প্রাথমিক লক্ষ্য, তবে এক্ষেত্রে আরও এমন কিছু সুবিধা রয়েছে যেগুলি স্পষ্টতই উপরি পাওনা।

1.নিজেকে আরও বেশি সময় দিতে পারা

আপনার দৌড়ঝাঁপময় ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে আপনার নিজের জন্য নিজেকে কিছু সময় দেওয়া যে কতটা কঠিন তার অভাব যা আপনি এতকাল বোধ করছিলেন তা হয়ত এখন আর অনুভব করতে পারবেন না।যখন আপনি এখন ভ্রমণে গিয়ে বা বাইরে বেড়িয়ে অথবা কর্মক্ষেত্রে এবং প্রায়শই প্রয়োজনে বাইরে বেড়োতে পারছেন না, তখন আপনি সেই মূল্যবান সময়টিকে এখন দিতে পারেন তাকে, যার এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, হ্যাঁ আপনার নিজেকে!অতএব, নিজের ভাল লাগা-না লাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছের মত ছোট খাটো বিষয়গুলি যেগুলি আপনাকে সহজেই খুশী করে তুলতে পারে সেগুলিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সাথে যুক্ত হন, তা সে একটি ভাল বই পড়াই হোক বা উষ্ণ জলে আরামদায়কভাবে পা ভিজিয়ে রাখার এক সুন্দর অনুভূতি কিম্বা এক কাপ গরম কফির কাপে উষ্ণ চুমুকের আস্বাদ নেওয়া অথবা শুধুই আলিস্যি ভরা একটি ভালো ঘুমই অন্তর্ভূক্ত করুন না কেন।

2.বেশি সাশ্রয়

রোজের গাড়ি ভাড়া নেই, বাইরে খাওয়া দাওয়া নেই, পান করা নেই- আর আপনি শেষ পর্যন্ত কত টাকা সাশ্রয় করতে পারলেন তা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাবেন। যদিও অবশ্যই সেটি আপনার জীবনযাত্রার মানের উপর নির্ভর করে, সুতরাং এই পরিস্থিতিতে গৃহবন্দী হয়ে থাকাকালীন সেটি মেনে চলার চেষ্টা করুন এবং রাহা খরচে সীমাবদ্ধতা এনে সাশ্রয়কে বাড়িয়ে তুলুন।

3.পারিবারিক বন্ধনকে আরও অটুট করে তোলার সময়

সামাজিক ব্যবধান আপনাকে এনে দিয়েছে আরও বেশি সময় আপনার বাড়িতে আপনার পরিবারের সাথে কাটানোর জন্য।সুতরাং আপনি আপনার সঙ্গী, বাচ্চাদের অথবা শ্বশুরবাড়ির সকলের সাথে একসঙ্গে এই সময়টিকে সুন্দরভাবে কাটাতে পারেন এবং বিগত মাসগুলিতে আপনি এই একসাথে কাটানোর ব্যাপারে কি কি অভাববোধ করেছেন সে ব্যাপারগুলি নিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পারেন।আবার এই সময় বাড়িতে থাকার সুযোগে পরিবারের সাথে যৌথভাবে কিছু মজাদার ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থেকে মুহূর্তগুলিকে আরও স্মরণীয় করে তুলতেও ভুলবেন না যেন।

4.না করা কিছু জিনিস করতে পারার সুযোগ

কয়েক মাস যাবৎ আমরা করতে চেয়ে এসেছি কিন্তু করে উঠতে পারিনি এমন কিছু বিষয়ের লম্বা তালিকা আমাদের সকলের কাছেই আছে, তা সে ঘরে কিছু গৃহস্থলীর কাজই হোক, একটা ভাল বই পড়াই হোক কিম্বা কোনও নতুন শখ শেখার ইচ্ছে।বেশ, আপনার সেই সকল ইচ্ছের তালিকায় বেশ কিছু টিক দেওয়ার সুযোগ বস্তুত এখনই আপনার হাতের মুঠোয়।

সামাজিক ব্যবধান মেনে চলার নিয়মগুলি

অবশ্যই এ ব্যাপারে আপনাকে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, তবে সামাজিক দূরত্বের অর্থ তাই বলে এই নয় যে আপনার নিজেকে সমগ্র বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে।আপনার অনুসরণ করার জন্য এখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কিছু নিয়ম নীতির উল্লেখ করা হলঃ

1.যতটা সম্ভব সম্ভাব্য খেলার তারিখ এবং বাড়ির অনুষ্ঠানগুলিকে এড়িয়ে চলুন

এতে নতুন করে বলার কিছু নেই যে আপনার কিটি পার্টি এবং বাড়ির অনুষ্ঠানগুলি হলে সেখানে স্বভাবতই বাইরে থেকেও বেশ কিছু অতিথি এসে থাকেন, যারা বাইরে ভ্রমণের সময় অন্য কারুর সাথেও জড়িত হয়ে থাকেন।সুতরাং কোনও রকম ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে তাদের এড়িয়ে চলুন যারা বাইরে থেকে আসছেন এবং পরবর্তীতে আপনার পরিবারের সাথে মিশে সেখানেও সংক্রমণ বা ভাইরাসের স্থানান্তকরণ করেন, আর সেটি করার জন্য চেষ্টা করুন আপনার কিটি পার্টি এবং বাড়ির অনুষ্ঠানগুলির পুনরাবৃত্তির হার হ্রাস করতে।আর যখন আপনি তা একেবারেই পারবেন না সেক্ষেত্রে আপনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়টি নিশ্চিত করুন বিশেষ করে যখন বাইরে থেকে যারা আসেন, বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথে তাদের হাতগুলি জীবাণু নাশক হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধোয়া বাধ্যতামূলক করুন।

2.হাঁটতে বেরোন/ বাইরে ছুটতে বেরোন, তবে ভিড় জায়গাগুলিকে এড়িয়ে চলুন

 

আপনি যদি প্রয়োজন বোধ করেন তবে আপনি বাড়ির বাইরে হাঁটতে কিম্বা দৌঁড়াতে বেরোতে পারেন, তবে ভিড় স্থানগুলিকে সম্পূর্ণ রূপেই এড়িয়ে চলুন।অন্য যেকোনও ব্যক্তির থেকে আপনার দূরত্ব কমপক্ষে 6 মিটার রাখা নিশ্চিত করুন এবং এমন সময়কে বেরোবার জন্য বেছে নিন যখন বাইরে ভিড় খুবই কম থাকে।সবচেয়ে ভালো হয় আপনার বাড়ির ছাদকে এই সময় কাজে লাগান।

3. নির্বাচক হয়ে উঠুন

সামাজিক ব্যবধান মেনে চলার সময় আপনার বলয়টিকে ছোট করুন, যার মধ্যে 10 জন মানুষের বেশি কোনও জটলা থাকবে না এবং সেখানে কোন লোকেরা থাকবেন সে ব্যাপারে অবশ্যই নির্বাচক হয়ে উঠতে হবে।বিচক্ষণতার সাথে সমীচীন পছন্দগুলি এই সময় আপনার পরিবারকে এবং আপনাকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করবে।

4.মুদিখানার জিনিসগুলি মজুত রাখুন

অবশ্যই এর অর্থ এই নয় যে কোনও দুরূহ সময় বা অনিশ্চিত ভবিষ্যত আসার মত করে সবকিছু মজুত করা শুরু করবেন একবারে বেশ কিছুটা মুদিখানার জিনিস ক্রয় করে মজুত করে রাখতে বলার কারণ এই যে যাতে প্রতিনিয়ত জিনিস কেনার তালে আপনার বেরোনোর হারে হ্রাস টানা যায়।এই ক্ষেত্রে স্ন্যাকস জাতীয় কিছু শুকনো খাবার দাবার অথবা আগে থেকে প্যাকেট করা খাদ্যগুলি যেমন চিপস, পপকর্ন, বেবি ফুড, ডাল, নানা ধরণের দানা শস্য ইত্যাদি আপনার হাতে রাখুন।

5.ইন্টারনেটের পূর্ণ সুবিধা উপভোগ করুন

আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে কথা বলুন কিম্বা কাজ যাই করুন না কেন, ইন্টারনেট আপনাকে আপনার বাড়ির ভিতরে থেকে পূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যে সে সকলকিছুই করার সুযোগ দেয়।আপনি আবার এমনকি অনলাইনে আপনার শখও পূরণ করতে পারেন, আপনার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারেন কিম্বা ভিডিও কলের মাধ্যমে একসাথে ডিনারটাও সেরে নিতে পারেন, অথবা অনলাইনেই চালিয়ে যেতে পারেন বুক ক্লাব বা কিটি পার্টিগুলি।এরকম আরও অনেক কিছুই আছে যেগুলি আপনি করতে পারেন, সুতরাং খুঁজুন খুঁজুন!

এই মহামারীর প্রাদুর্ভাবটি নিয়ন্ত্রণের অধীনে না আসা অবধি এই সময় সামাজিক ব্যবধান রাখাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।অতএব, ওয়ার্ক ফর্ম হোম চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলুন, বাইরের সাথে সরাসরি যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা আনুন এবং বাড়িতে আপনার পরিবারের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য অতিবাহিত করুন যতক্ষণ না বাইরে বেড়োনো চূড়ান্তভাবে নিরাপদ হয়ে ওঠে!