সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব হল একটি শল্যচিকিৎসার প্রক্রিয়া যেখানে ডাক্তার মায়ের পেটের প্রাচীর এবং তার জরায়ুতে একটি ছিদ্র করেন শিশু প্রসব করানোর জন্য। বেশিরভাগ সি-সেকশন প্রক্রিয়াগুলি করা হয় যখন স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চা প্রসব করানোয় সমস্যা থাকে। সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব জীবনের রক্ষাকর্তা হয়ে থাকে সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে স্বাভাবিক ভাবে শিশুর জন্ম দেওয়া অনেক জটিলতা ও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
আগেকার দিনগুলিতে বিশ্বাস করা হতো যে সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব বেশি ঝুঁকি সাপেক্ষ, কিন্তু অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে প্রক্রিয়াটি এখন এমন জায়গাতে এসে গেছে যেখানে কোনো রকম আশঙ্কার আর কারণ থাকে না। যদিও যোনির দ্বারা জন্ম দেওয়াটাই আপনার প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত যদি আপনার গর্ভাবস্থা বা প্রসব শ্রম নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকে, তবে একটি সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবও পুরোপুরি নিরাপদ।
একটি সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব প্রয়োজনীয় যেখানে জন্মের ক্ষেত্রে মায়ের বা শিশুর জীবনের বিপদ আছে। এই ধরনের ক্ষেত্রে মা এবং শিশু উভয়ের ভালোর জন্য, যোনির মাধ্যমে জন্ম দেওয়ার থেকে এটি বেশী ভালো বিকল্প। এছাড়াও, সি-সেকশন প্রক্রিয়াই হল একমাত্র বিকল্প যেখানে বাচ্চার প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয় কিন্তু আর অগ্রসর হয় না, বা যদি মা একাধিক বাচ্চাকে বহন করে, বা বাচ্চা যদি আকারে বড় হয়।
যদিও সমস্ত অপারেশনেই কিছু ঝুঁকি থেকে থাকে, তবে প্রথমবার সিজার করার ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো গুরুতর জটিলতা দেখা দেয় না, বিশেষত যদি অপারেশনটি পরিকল্পিত হয় এবং মা যদি স্বাস্থ্যবতী হয়।
সি-সেকশন আপনার এবং আপনার শিশুর জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে যদি আপনার ডাক্তার আপনাকে এটি বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সি-সেকশনের মাধ্যমে প্রসবের কিছু সুবিধা আছে যা স্বাভাবিকভাবে প্রসব করার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক ভাবে জন্মের থেকে সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় জন্মের সুবিধাগুলি হল:
যদি আপনার সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবটি পরিকল্পিত থাকে, তবে আপনি আপনার এবং শিশুর চাহিদাগুলি আগে থেকে বুঝতে এবং ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব হলে তা আপনাকে পিছনের দিকের পথ, পেরিনিয়াম এবং যোনির মধ্যেকার এলাকাটির ছিঁড়ে যাওয়ার চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যাইহোক, সি-সেকশনের সময়তেও প্রসব বেদনা হয় এবং সেটি যোনি দিয়ে প্রসবের বেদনার মতোই তীব্র হয়।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবেও যথেষ্ট পরিমাণ অস্বস্তি থাকে, তবে স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে হওয়া যোনি এবং পেরিনিয়ামের মধ্যেকার অঞ্চলের ব্যথা এবং আঘাত থেকে আপনি রক্ষা পেয়ে যান।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবের প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে রক্তপাত তুলনামূলকভাবে কম হয়।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রসব করা মহিলারা, কাশি বা হাসার সময় জল বেরোনোর অভিযোগ বেশী করেন না।
যাদের সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব হয়ে থাকে তাদের যৌন সমস্যা কম থাকে কারণ পেরিনিয়াম এবং যোনিতে কোনও কাটা এবং সেলাই থাকে না।
সি-সেকশনের ফলে পেলভিক মেঝের কোনোরকম ক্ষতি হয় না, যা একটি যোনির দ্বারা প্রসবের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবের ক্ষেত্রে সাঁড়াশির ব্যবহার কম হয়, এবং তাই জন্মের সময়কার আঘাতে শিশুর ভোগার সম্ভাবনাও কম হয়।
মায়ের যদি এইচআইভি-র মতো রোগ থাকে বা গর্ভাবস্থায় ভাইরাল লোড শনাক্ত হয়, সে ক্ষেত্রে সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব করালে মায়ের কাছ থেকে শিশুর কাছে সংক্রমণ যাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
একটি সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসব থেকে মা এবং শিশু উভয়ের জন্য যে সব ঝুঁকিগুলি তৈরি হতে পারে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় একজন মায়ের জন্য ঝুঁকিগুলির মধ্যে রয়েছে:
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় মায়েদের অনেক ব্যথা কমানোর ওষুধের প্রয়োজন এবং যোনির মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম দেওয়া মায়ের চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে সুস্থ হতে। সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবের পরে, মহিলাদের ক্ষত স্থানে(যেখানে সেলাই থাকে) ব্যাথা এবং পেটে অস্বস্তির অভিযোগ করতে দেখা যায়। পেটের অস্বস্তি কখনও কখনও এক মাসের বেশী স্থায়ী হয়।
সি-সেকশন অস্ত্রোপচারের সময়, মায়ের অনেক রক্তক্ষয় হতে পারে যদি স্বাভাবিকের থেকে বেশি রক্তপাত হয়। রক্তক্ষরণ বেশি হলে রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।
সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় অপারেশন করার আগে, মায়ের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমানোর জন্য এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। যাইহোক, সংক্রমণ তবুও হতেই পারে এবং এটি সি-সেকশন প্রক্রিয়ায় প্রসবের খুব সাধারণ একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। মহিলার ক্ষত থেকে রস ক্ষরণ ও লালভাব দেখা যেতে পারে, এবং অনেক ব্যথা অনুভূত হতে পারে বা ক্ষততে চিড়ভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে। যেসব মহিলাদের ওজন বেশি বা ডায়াবেটিস থাকে হয় তাদের এরকম বেশী ঘটতে পারে। এন্ডোমেট্রাইটিস হল জরায়ুর আস্তরণের একটি সংক্রমণ, এবং এতে অনেক বেশি ও অনিয়মিত রক্তপাত বা গন্ধযুক্ত স্রাব হয় এবং কখনও কখনও জন্মের পরে জ্বর সৃষ্টি করে। ক্যাথিটার ব্যবহারের ফলে মহিলাদের মূত্রনালীর সংক্রমণও ঘটতে পারে। যে লক্ষণগুলিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সেগুলি হলো পেটের নীচে বা কুঁচকিতে ব্যাথা, দেহের উচ্চ তাপমাত্রা এবং শীত করা।
প্রতিটি অস্ত্রোপচারে রক্ত জমে যাওয়ার একটি ঝুঁকি থাকে। যদি জমে যাওয়াটি ফুসফুসের মধ্যে হয় তাহলে মারাত্মক হতে পারে। ঘন ঘন শ্বাস পড়লে, হাঁটুর নীচের মাংসপেশীতে (কাফ) ফোলাভাব ও যন্ত্রণা হলে বা কাশি হলে আপনি অবিলম্বে চিকিৎসার সহায়তা নিন। রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য আপনাকে হেঁটে চলে বেড়াতে বলা হবে এবং রক্ত পাতলা করার ওষুধ গ্রহণ করতে বলা হবে।
যদিও খুব বেশী ঘটে না, তবু সংলগ্নতা (অ্যাডহেশন) সি-সেকশনের একটি ঝুঁকি। এই ক্ষেত্রে ক্ষতের টিস্যুগুলির পট্টি পেটের বিভিন্ন অঙ্গগুলিকে পরস্পরের সাথে বা পেটের ভিতরের প্রাচীরের সাথে আটকে দেয় এবং খুব ব্যথা হতে পারে। এর থেকে কিছু আন্ত্রিক সমস্যাও হতে পারে এবং, কিছু ক্ষেত্রে, প্রজনন সমস্যা হতে পারে।
অপারেশনের সময় দেওয়া অ্যানেস্থেসিয়া একটি গুরুতর মাথাব্যথা সৃষ্টি করতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে, স্নায়ুর সাময়িক ক্ষতিরও কারণ হতে পারে।
সি-সেকশনের পর যদি আপনি গর্ভবতী হন, তবে আর একটি সি-সেকশনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যদি কোনো মহিলার প্রথম ডেলিভারি সিজার করে হয়, তবে পরবর্তী ডেলিভারি সি-সেকশনের মাধ্যমেই ঘটে।
সি-সেকশন ক্ষেত্রে মায়ের মৃত্যুর হার বেশি।
শিশুর জন্য সি-সেকশনের অনেক ঝুঁকি আছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি হল:
সি-সেকশনের মাধ্যমে প্রসব হওয়া কিছু শিশুর শ্বাসের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যা গুরুতর নাও হতে পারে, কিন্তু শিশুর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। অকালে জন্মানো শিশু অথবা প্রসব শ্রম শুরু হওয়ার আগেই সিজারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটতে পারে।
বিরল ক্ষেত্রে, ডাক্তারের স্কাল্পেল দ্বারা শিশু আঘাত পেতে পারে, যদিও এটি সাধারণত নিরাময় হয়ে যায়।
সি-সেকশনের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী বাচ্চাদের জন্মের পরে যত্নে থাকার প্রয়োজন যোনি দিয়ে জন্মগ্রহণকারী বাচ্চাদের চেয়ে বেশি।
সি-সেকশন প্রসবে জন্মানো শিশুদের ঝুঁকিগুলির মধ্যে রয়েছে, শিশুর হাঁপানি বা অ্যাস্থমা দেখা দেওয়ার বেশী সম্ভাবনা থাকে।
মৃত শিশু প্রসব এবং শিশুর অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্মগ্রহণ করা বাচ্চাদের মধ্যে অনেক বেশি।
একটি সি-সেকশন প্রসবের কারণে কিছু অন্যান্য জটিলতাও তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
একটি সি-সেকশনের মাধ্যমে জন্ম ভবিষ্যতের গর্ভধারণকে নিম্নলিখিত উপায়ে প্রভাবিত করতে পারে:
ভবিষ্যতে গর্ভাবস্থায় সি-সেকশন ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়লেও, এটি কোনও ভাবেই প্রত্যাশী মায়েদের জন্য পড়ে থাকা একমাত্র বিকল্প নয়। প্রথমবার সিজারিয়ানের পর, দ্বিতীয় প্রসবের সময় কোনো জটিলতা না থাকলে, ভিবিএসি বা যোনির মাধ্যমে প্রসব সম্ভব হতে পারে। শিশু ব্রিচ অবস্থানে থাকার কারণে যদি কোনো মহিলার সিজার করে প্রসব হয়ে থাকে, তাহলে তার ভিবিএসি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে সেই মহিলার চেয়ে যার অঙ্গগুলির প্রসারণ করার পরও এবং শিশুর নির্গমন শুরু হওয়ার পরও স্বাভাবিকভাবে প্রসব করানো যায়নি এবং সি-সেকশন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রথমবার সি-সেকশনের পরে, আপনি যদি আপনার সামনে কোন কোন রাস্তা খোলা আছে তা বিচার করতে চান, তাহলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন এবং ভিবিএসি করাতে পারে এমন হাসপাতালগুলির তালিকা তৈরি করুন।
একটি অপরিকল্পিত সি-সেকশন ডেলিভারি মা এবং সন্তান উভয়ের জীবন রক্ষক হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ মায়ের কাছে যোনিপথে প্রসবই প্রত্যাশিত, এটি বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ যে সি-সেকশন ডেলিভারিও যথেষ্ট নিরাপদ।