In this Article
- গর্ভের মধ্যে থাকা শিশুর মাথাটি নীচের দিক করে থাকাটা কেন তার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ?
- গর্ভস্থ শিশুর অনুকূল মাথা নীচু অবস্থানটি কি?
- গর্ভস্থ ভ্রূণটি কখন তার মাথা নীচু অবস্থানে আসে?
- শিশুটি ‘মাথা নীচু‘ অবস্থায় রয়েছে কিনা তা কীভাবে আপনি জানতে পারবেন?
- গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভস্থ শিশুটির মাথা কীভাবে নীচের দিকে করানো যেতে পারে?
- আপনার সন্তান যদি গর্ভের মধ্যে তার মাথা নীচু অবস্থানে না থাকে তবে কি হবে?
গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের শেষের দিকে, শিশুরা সাধারণত গর্ভের মধ্যে তাদের মাথাকে নীচের দিকে ঘোরাতে শুরু করে।এটা স্বভাবত হয়ে থাকে গর্ভদশার 32-36 সপ্তাহের মধ্যে।মাথাটা নীচের দিকে থাকার এই অবস্থানটি শ্রমকে সংক্ষিপ্ত করে এবং একজন গর্ভবতী মহিলার পক্ষে তার সন্তান প্রসব প্রক্রিয়াটিকে করে তোলে সহজ এবং নিরাপদ।শ্রমের আগে কেন একটি শিশুর মাথা নীচের দিকে থাকাটা জরুরি এবং শিশুর মাথাটিকে কীভাবে নীচের দিক করে ঘোরানো যেতে পারে তার কয়েকটি পরামর্শ বা টিপসগুলি সম্পর্কে জানতে পড়তে থাকুন।
গর্ভের মধ্যে থাকা শিশুর মাথাটি নীচের দিক করে থাকাটা কেন তার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সন্তান প্রসবের সময় গর্ভস্থ শিশুটির চলন তার মায়ের শ্রোণীর মধ্য দিয়ে একটি কোণ বরাবর হতে দেখা যায়।এটি মায়ের পক্ষে শিশুটিকে বাইরের দিকে ঠেলে বের করাকে সহজ করে তোলে। তাছাড়াও প্রসবের আগে যদি শিশুটির মাথা নীচের দিক করে থাকে, তবে প্রসবের সময় দেখা দেওয়া জটিলতার ঝুঁকিগুলি কমে। যদি শিশুটির মাথা নীচের দিকে থাকে তবে সেক্ষেত্রে আবার শ্রমটি হবে সংক্ষিপ্ত এবং কম বেদনাদায়ক কারণ এটিকেই প্রসবের জন্য আদর্শ এবং ঝুঁকিমুক্ত অবস্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
গর্ভস্থ শিশুটি যখন মাথা নীচু অবস্থায় থাকে, তখন শিশুর মাথাটি তার মায়ের সার্ভিক্সের উপর চাপ দেবে।এটি সার্ভিক্সকে প্রশস্ত হতে এবং মায়ের সার্ভিক্সের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনগুলি উৎপাদনে উদ্দীপিত করতে সাহায্য করবে।স্বাভাবিক প্রসবের সময় বাচ্চার মাথা নীচের দিকে থাকা অবস্থায় মায়ের শ্রোণীটির নীচের দিকে পৌঁছলে শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই মাথা ঘুরিয়ে দেয়।এটি মায়ের শ্রোণীর বিস্তৃত অংশের মধ্যে শিশুটির মাথাটিকে রাখে, যার ফলে শিশুর মাথাটি পিউবিক হাড়ের নিচে সহজে পিছলে যেতে পারে এবং জন্ম প্রক্রিয়াটিকে করে তোলে সহজ ও মসৃণ।
গর্ভস্থ শিশুর অনুকূল মাথা নীচু অবস্থানটি কি?
গর্ভস্থ শিশুর জন্য অনুকূল মাথা নীচু অবস্থানটি হল অক্সিপিটো অ্যান্টেরিওর অবস্থান সহ সেফালিক উপস্থাপন।এটি তখনই হয়, যখন শিশুর মাথাটি তার মায়ের যোনির দিকে নীচু হয়ে থাকে এবং তার মুখ আর দেহের সম্মুখভাগটা পিছনের দিকে থাকে।যখন শিশুটি তার মাথা নীচু অবস্থায় থাকে, তার মেরুদণ্ডটি তার মায়ের পেটের দিক বরাবর থাকে।এইভাবেই স্বাভাবিক প্রসবের সময়, শিশুটি যখন তার মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে তার মাথাটিকেই সর্বপ্রথম বেরিয়ে আসতে দেখতে পাওয়া যায়।
গর্ভস্থ ভ্রূণটি কখন তার মাথা নীচু অবস্থানে আসে?
অধিকাংশ শিশুই মাথা নীচুর দিকে থাকার অবস্থায় ঘুরে যেতে পারে গর্ভাবস্থার 32-36 সপ্তাহের মধ্যে।আবার কিছু শিশু এমনকি গর্ভাবস্থার 37 সপ্তাহ পরেও তাদের মাথাকে নীচের দিকে ঘুরিয়ে থাকে, তবে এটা বিশেষ কয়েকটা বিষয়ের উপর নির্ভর করে।অন্যান্য শিশুরা আবার শ্রম শুরু হওয়ার পরে অক্সিপিটো অ্যান্টেরিওর অবস্থানে আসতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে সেফালিক উপস্থাপনটি 36 সপ্তাহ পরে হবে।সে যাই হোক, একটা শিশুর তার মাথা নীচু অবস্থানে অবস্থিত হওয়ার বা সেই অবস্থায় আসার আদর্শ সময়টি কিন্তু হল গর্ভাবস্থার 32-36 সপ্তাহের মধ্যেই।
শিশুটি ‘মাথা নীচু‘ অবস্থায় রয়েছে কিনা তা কীভাবে আপনি জানতে পারবেন?
শিশুটি গর্ভের মধ্যে তার মাথা নীচু অবস্থায় আছে কিনা তা অনুধাবন করার অনেকগুলি উপায় আছে, সেগুলি হলঃ
- ডাক্তারবাবু একটা ভ্রূণ বা ফিটাল ডপলার ব্যবহার করে কিম্বা একটা আল্ট্রাসাউন্ড পরিচালনা করে আপনার পেটটি অনুভব করার মাধ্যমে সেটি নির্ধারণ করতে পারবেন।
- এক্ষেত্রে আপনি পেট বা বেলি–ম্যাপিং পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারেন।এটি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মধ্যে আপনি একটি ত্রি–ধাপ প্রক্রিয়ার দ্বারা আপনার পেট এবং পেটের ভিতরে শিশুর চলাচলগুলি অনুভব করার মাধ্যমে আপনার গর্ভস্থ শিশুর মাথার অবস্থানটি নির্ধারণ করতে পারবেন।
- আপনি যদি আলতো করে ধীরে ধীরে আপনার পিউবিক হাড়ের চারপাশটায় চাপ দেন এবং গোলাকার শক্ত কিছু অনুভব করেন, তাহলে সেটি আপনার গর্ভস্থ সন্তানেরই মাথা।কিন্তু অনেক গর্ভবতী মহিলাই পশ্চাদ ভাগটিকে শিশুর মাথা ভেবে ভুল করে থাকে।আপনি অবশ্যই এটা মাথায় রাখবেন যে পশ্চাদভাগ মাথার তুলনায় নরম হয়।
- আপনি আপনার সঙ্গীকে পেটের উপর কান পেতে গর্ভস্থ ছোট্টটির হৃদ্স্পন্দন শোনার কথা বলতে পারেন।আর তিনি যদি সেটা আপনার তলপেটের দিক থেকে শুনতে পান, সেক্ষেত্রে আপনার শিশুটি মাথা নীচু অবস্থায় থাকার একটা ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে।
- আপনি যদি আপনার পেটের নীচের দিক থেকে হালকা স্পন্দন এবং হেঁচকি ওঠার মত কিছু অনুভব করেন, সেখানে স্পর্শ করে কিছু শক্ত বোধ করেন এবং উপরের দিকে বেশ জোরালো কিছু পদাঘাত অনুভব করেন, সেক্ষেত্রে এগুলি শিশুটি মাথা নীচু অবস্থায় থাকার একটি লক্ষণ হতে পারে।হালকা স্পন্দনগুলি যেখানে গর্ভস্থ শিশুটির হাত এবং হাতের আঙ্গুলগুলির মৃদু আন্দোলনের কারণে হয়ে থাকে, সেখানে পদাঘাতগুলি শিশুটির পায়ের পাতা এবং হাঁটু ছোড়ার ফলে হয়।
গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভস্থ শিশুটির মাথা কীভাবে নীচের দিকে করানো যেতে পারে?
গর্ভদশার 36 সপ্তাহের মধ্যে যদি আপনার গর্ভস্থ শিশুটির মাথা নিজে থেকেই নীচের দিকে ঘোরাতে না পারে, তবে সেক্ষেত্রে এমন কতগুলি পদক্ষেপ আছে যেগুলি বাচ্চার মাথাকে নীচের দিকে ঘুরিয়ে আনতে সহায়তা করে বলে মানুষ বিশ্বাস করেন।
বিঃদ্রঃ অনেক মহিলাই তাদের গর্ভস্থ শিশুর মাথাকে নীচের দিকে করানোর জন্য এই সকল কৌশলগুলি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু এ ব্যাপারে এমন কোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রমাণ নেই যা শিশুর মাথা নীচু অবস্থায় আনার কাজে প্রয়োগ করার জন্য এই সকল প্রক্রিয়াগুলি প্রয়োগ করার পরামর্শ দেয়।সুতরাং এগুলি এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।কিন্তু আপনি যদি তা সত্ত্বেও সেগুলি করে দেখতে চান, আপনার সেগুলি একমাত্র করা উচিত আপনার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করার পরেই।আপনার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যদি এ ব্যাপারে মত দিয়ে থাকেন তবে তাঁর তত্ত্বাবধানের অধীনে আপনি তা করার চেষ্টা করতে পারেন।আসুন দেখা যাক, সেই ব্যায়ামগুলি কি যেগুলি হয়ত কাজে আসতে পারে।তবে অবশ্যই এ কথা স্মরণে রাখবেন যে আপনার ডাক্তারবাবুর অনুমতি ব্যতীত কিছুতেই সেগুলি করার চেষ্টা করবেন না।
- আপনি পুরোপুরি হামাগুড়ি দেওয়ার মত অবস্থায় আসুন এবং এই অবস্থায় কয়েক মিনিট ধরে পিছনে ও সামনে আন্দলিত হন।আপনি প্রতিদিন কয়েকবার করে এটা করতে পারেন।এটি আপনার গর্ভস্থ শিশুর মাথা নীচু অবস্থায় আনতে সহজেই সাহায্য করতে পারে।
- প্রতিদিন কমপক্ষে 20 মিনিট করে হাঁটুন।এই একটা সাধারণ শারীরিক ক্রিয়াকলাপ আপনার শ্রোণীর মধ্যে আন্দোলন তৈরী করবে, যা আবার গর্ভস্থ শিশুটিকে তার মাথাকে নীচের দিকে ঘোরাতে উদ্দীপ্ত করবে।
- বসার সময় আপনার হাঁটুগুলি যাতে আপনার নিতম্বের তুলনায় উঁচুতে না থাকে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিন।আপনার শ্রোণির সাথে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসুন।এটি শিশুটিকে সহজেই তার মাথা নীচের দিকে করতে সাহায্য করবে।
- টিভি দেখার সময় একটি ব্যায়াম করার বলের উপর বসুন অথবা তার উপর ঝুঁকে হেলান দিন।এটি শিশুটিকে দ্রুত মাথা নীচু অবস্থায় ঘুরতে সাহায্য করবে।
- একটি সোফার উপর হাঁটু গেড়ে বসুন এবং আপনার হাতগুলি নীচে মেঝে স্পর্শ করুন আর আপনার মাথাটিকে নীচের দিকে ঝোঁকান।এবার এই অবস্থায় আপনার পিঠটিকে টানটান করুন আর নিতম্বটাকে উপরের দিকে উঁচু করে তুলুন।এই অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকুন আর তারপর উঠে পড়ুন।
- চিৎ হয়ে শুয়ে থাকার সময় আপনার পায়ের পাতাগুলিকে উপরের দিকে তুলে রাখা এড়িয়ে চলুন।এটি আপনার গর্ভস্থ শিশুকে একটি পশ্চাদ্বর্তী অবস্থানে নিয়ে যাবে যা শ্রমকে দীর্ঘায়িত করে তুলতে পারে এবং সন্তান প্রসবের সময় তীব্র পিঠে ব্যথা হওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।এছাড়াও রাত্রে চিৎ হয়ে শোয়ার বদলে সর্বদা আপনার বাম পাশ ফিরে শোয়ার চেষ্টা করুন।শোয়ার এই অবস্থানটি শিশুর পক্ষে সবচেয়ে ভাল এবং শিশুকে সহজেই তার মাথা নীচের দিকে করতে সাহায্য করে।
আপনার সন্তান যদি গর্ভের মধ্যে তার মাথা নীচু অবস্থানে না থাকে তবে কি হবে?
সবকিছু চেষ্টা করার পরেও যদি আপনার গর্ভের মধ্যে শিশুটির মাথা নীচের দিকে না নামে এবং ব্রীচ অবস্থানে থেকে থাকে, তবে সে ব্যাপারে আপনার ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হন।
মনে রাখবেন, প্রতিটি গর্ভাবস্থা তথা গর্ভদশাই পৃথক প্রকৃতির হয়ে থাকে।কিছু গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রে তাদের প্রথম গর্ভাবস্থাতেই গর্ভস্থ শিশু সম্মুখবর্তী অবস্থানে থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে সেই মহিলারই দ্বিতীয় গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রেও কিন্তু গর্ভস্থ শিশুটির মাথা নীচু অবস্থায় বা নীচের দিক করে নাও থাকতে পারে।এটা মাথায় রাখবেন যে যদি গর্ভস্থ শিশু অক্সিপিটো অ্যান্টেরিওর অবস্থানে না থাকে তবে সেক্ষেত্রে সকল গর্ভবতী মহিলার মধ্যে প্রায় 5% জনের ক্ষেত্রেই সিজারিয়ান পদ্ধতির দ্বারা প্রসব ক্রিয়া সম্পন্ন করাতে হয়।ব্রীচ অবস্থানে থাকার কারণহেতু শিশুর জীবন ঝুঁকি এড়িয়ে চলার জন্যই মূলত এই পন্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
গর্ভের মধ্যে শিশুর মাথা নীচু অবস্থা এবং অক্সিপিটো অ্যান্টেরিওর অবস্থান প্রসব প্রক্রিয়া সহজ এবং মসৃণ করা নিশ্চিত করার ব্যাপারে মা এবং বাচ্চা উভয়ের পক্ষেই নিরাপদ।তবে আপনার বাচ্চা যদি এই অবস্থানগুলির মধ্যে না থাকে সেক্ষেত্রে আপনার এ ব্যাপারে মারাত্মক চিন্তা করার কোনও প্রয়োজন নেই।আপনার ডাক্তারকে দেখান এবং আলোচনা করুন কি করা যেতে পারে, তিনিই আপনাকে সবচেয়ে সেরা পরামর্শটি দেবেন এবং গাইড করবেন!