এই পৃথিবীতে একটি শিশুর আনয়ন হল একটি বিস্ময়কর কৃতিত্ব এবং তা সহজেই অর্জন করা যায় না।যদিও সাধারণ যোনি প্রসবকেই জন্মদান প্রক্রিয়ার সাধারণ উপায় হিসেবে সাধারণত উল্লেখ করা হয়, তবে নতুন কৌশলগুলিও প্রসব শ্রমে মহিলাদের নানা উপায়ে সহায়তা করে, হয় তাদের যন্ত্রণা লাঘব করার দ্বারা কিম্বা প্রসব প্রক্রিয়াকে সহজ করার মাধ্যমে।চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে যাতে প্রসব প্রক্রিয়াটিকে সফলভাবে করা যেতে পারে এমনকি কোনও জটিলতা কিম্বা ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও।
প্রসব প্রক্রিয়ার সবচেয়ে সাধারণ ধরণগুলি
অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা নিম্নলিখিত প্রসব প্রক্রিয়াগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারেনঃ
1.যোনি প্রসব
যখন কোনও মহিলার দেহের বার্থ ক্যানেল বা জন্মনালীকার মধ্য দিয়ে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, তখন সেই ধরণের প্রসবকে যোনি প্রসব হিসেবে অভিহিত করা হয়।এপিডুলার বা ব্যথানাশক ওষুধের দ্বারা এটিতে সহায়তা করা বা না করাও যেতে পারে।এই সব ক্ষেত্রে প্রসবের একদম সঠিক সময়ক্ষণটিকে নির্ধারণ করা যায় না, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোনি প্রসব হয়ে থাকে গর্ভাবস্থায় 40 সপ্তাহ সম্পূর্ণ হওয়ার পর।
বেশিরভাগ ডাক্তারবাবুই যোনি প্রসবের পক্ষে সায় দিয়ে থাকেন যদি সেটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সেক্ষেত্রে সিজারিয়ান বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব না করারই পরামর্শ দেন।প্রসব শ্রমের ব্যথা ওঠার সময় যে চাপ পড়ে, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসের বিকাশের জন্য শিশুটি হরমোন নিঃসরণ করে; তদুপোরি জন্মনালীকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আবার শিশুর বুকে চাপ পরে ফলে বেশ কিছুটা অ্যামনিওটিক তরল পরিষ্কার হয়ে যায় এবং ফুসফুসকে কার্যকরভাবে প্রসারিত হয়।যে সকল মায়েরা একাধিক সন্তান গ্রহণের পরিকল্পনা করে থাকেন তাদের জন্য যোনি প্রসবের পক্ষে উচ্চ সুপারিশ করা হয়।এটি হওয়ার সময় যখন মলদ্বারের উপরের অঞ্চলে একটি ছেদন করা হয়, তখন এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় এপিসিওটমি।
সাধারণ যোনি প্রসবের ক্ষেত্রে প্রসবের পর দ্রুতই মায়েরা চাপ কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং কোলে সন্তান নিয়ে শীঘ্রই বাড়ি ফিরে আসেন।এই ক্ষেত্রে অন্যগুলির তুলনায় সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।যদি যোনির মধ্য দিয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করে থাকে সেক্ষেত্রে আবার শিশুর শ্বাসকষ্টে ভোগার সম্ভাবনাও কম থাকে।
2.স্বাভাবিক প্রসব
এটি হল এমন এক ধরনের জন্মদান প্রক্রিয়া যা একইভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে আসছে।এই প্রক্রিয়ায়, কোনওরকম চিকিৎসাগত পদ্ধতি বা বাইরে থেকে কোনওকিছু প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়া জড়িত নয় এবং প্রক্রিয়াটি যতটা বেশি সম্ভব স্বাভাবিক পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে।এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত পছন্দ হয়ে থাকে এবং সেক্ষেত্রে পুরো প্রণালীটি জুড়েই মায়ের উপরেই সকল ভার অর্পিত করা প্রয়োজন।
স্বাভাবিক উপায়ে প্রসব ক্রিয়া ঘটার সময় বিবেচনা করা যেতে পারে বিভিন্ন ব্যায়াম অনুশীলন এবং অবস্থান গুলির কথা।এই প্রক্রিয়াটিতে মাকে খোশমেজাজে হাসি খুশি রাখতে এবং প্রসব প্রক্রিয়ার সাফল্যতাকে নিশ্চিত করতে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সাথে সাধারণত একজন দাইমা থাকেন।প্রসব ক্রিয়াটি হাসপাতালে অথবা বাড়িতেই করা যেতে পারে সব রকম পূর্ব প্রস্তুতি সহ।
জলে প্রসব বা পুলে প্রসব প্রক্রিয়াটিতে জলের প্লবতার চাপটি এই প্রক্রিয়ায় হওয়া শ্রম বেদনা হ্রাস করতে পারে।এই পৃথিবোতে একটি নতুন সুন্দর ফুটফুটে জীবন আনয়নের সবচেয়ে স্বাভাবিক যন্ত্রণাবিহীন একটি উপায় হল জলে প্রসব প্রক্রিয়া।
স্বাভাবিক প্রসব একজন মায়ের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষমতাপ্রদানকারী একটি প্রক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে।প্রসবের পরক্ষণেই শিশুর সাথে মায়ের ত্বকে–ত্বকে যোগাযোগটি হওয়ার কারণে তা তাদের দুজনের মধ্যস্থ বন্ধনটিকে আরও সুদৃঢ় করে তুলতে সহায়তা করে।এছাড়াও এটি আবার শরীরে হরমোনগুলিকে উদ্দীপিত করে যা সেই মুহূর্ত থেকেই মায়ের দেহে স্তন দুধ উৎপাদন করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
3.অস্ত্রোপচার বিভাগ
সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হয় না।একজন মা হয়ত যোনি প্রসবের মধ্য দিয়ে যেতে চাইতে পারেন কিন্তু যদি জটিলতা দেখা দিয়ে তা বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে গ্রহণ করার মত একটি বিকল্প হয়ে উঠতে পারে সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচার পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে, মায়ের তলপেট কেটে শিশুটির প্রসব করানো হয় এবং অস্ত্রপচারের মাধ্যমে জরায়ুটি কেটে শিশুটিকে বার করে আনা হয়।এই নামটি ল্যাটিন শব্দ ‘সিডার‘ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ হল ‘কাটা‘।অতএব এই ধরণের কাটাটি সি–সেকশন বা সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচার বিভাগ নামে অভিহিত– আর এভাবেই প্রসব প্রক্রিয়াটিরও নাম হয়েছে সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচার পদ্ধতি।
অনেক মায়েরা আগে থেকেই সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচার পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন আর সেই অনুযায়ী হাসপাতাল এবং ডাক্তাররাও প্রস্তুতি শুরু করে দেন।এটি নিজের পছন্দের উপর ভিত্তি করেও করা যেতে পারে আবার আলট্রা সোনোগ্রাফি করার পর যদি তাতে সেওরকম কোনও বিশেষ পরিস্থিতি ধরা পড়ে যেখানে অস্ত্রপচার পদ্ধতিটি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে, যেমন গর্ভে যমজ কিম্বা তিনটি সন্তানের উপস্থিতি, গর্ভের মধ্যে শিশুর আড়াআড়ি বা তীর্যক অবস্থান অথবা শিশুর আকৃতি খুব বড় হয়ে থাকলে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে, প্রসব শ্রমের খুব ভাল প্রয়াস চালানোর পরেও যদি যোনি প্রসব ব্যর্থ হয় অথবা কোনও জটিলতা দেখা দেয়, যেমন প্রসবের সময় গর্ভস্থ শিশুর তীর্যক অবস্থান, মেকোনিয়াম(নবজাতকের কালো রঙের প্রথম মল) তরল স্রাবের দাগ অথবা জন্মনালীকায় বাধাবিঘ্ন দেখা দিলে ডাক্তাররা দ্রুত অস্ত্রপচার পদ্ধতির দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং সঠিক সময়ের মধ্যে শিশুকে জরায়ু থেকে বের করে আনার প্রয়াস করেন।
4.ফরসেপ বা সাঁড়াশী পক্রিয়ায় প্রসব
এটি আরও এক বিশেষ প্রকার প্রসব প্রক্রিয়া এবং যোনি প্রসবের কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এটি করার প্রয়োজন পরে।এটি স্বাভাবিক যোনি প্রসবের ক্ষেত্রে একটি সহায়ক হিসেবে কাজ করে যখন গর্ভস্থ শিশুটি জন্মনালীকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয় তখন এই প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করা হয়।এটি হতে পারে কোনও ছোট বাঁধার কারণে কিম্বা মা ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং অবসন্ন হয়ে পড়লে আর সেই কারণে শিশুকে প্রসব করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে অসমর্থ হয়ে পরলে।
এই সব ক্ষেত্রে, ডাক্তারবাবু বিশেষ ভাবে প্রস্তুত এক ধরণের চিমটা ব্যবহার করেন যা সাঁড়াশীর অনুরূপ এবং সেগুলিকে ধীরে ধীরে সাবধানে জন্মনালীকার ভিতরে আলতো করে প্রবেশ করান।এরপর জন্মনালীকার মধ্য দিয়ে সাবধানে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে শিশুর মাথাকে আলতো করে ধরতে সেগুলি ব্যবহার করা হয়।
5.ভ্যাকিউম নিষ্কাশন
এটি ফরসেপ বা সাঁড়াশী প্রসব প্রক্রিয়ার অনুরূপ, এই প্রসব কৌশলটি যোনি প্রসবের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিশুটি যদি বাইরে বেরিয়ে আসার পথে থাকে কিন্তু অগ্রসর বন্ধ করে পুনরায় জন্মনালীকার ভিতরের দিকে পশ্চাদধাবন করে, সেক্ষেত্রে ভ্যাকিউম নিষ্কাশন প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করা হয়।
এক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু একটি বিশেষ ধরণের প্রস্তুত ভ্যাকিউম পাম্প ব্যবহার করেন যেটি জন্মনালিকার মধ্য দিয়ে শিশুর কাছ পর্যন্ত প্রবেশ করানো হয়।এই ভ্যাকিউমের শেষ প্রান্তে একটি নরম কাপ মত থাকে যেটি গিয়ে শিশুর মাথার একেবারে উপরটাতে প্রতিস্থাপিত হয়।এই ভ্যাকিউমটি তৈরী করা হয় যাতে কাপটি শিশুটির মাথাটিকে ধরে রাখতে পারে এবং শিশুটিকে ধীরে ধীরে জন্মনালীকার মধ্য দিয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করে।
6.অস্ত্রপচারের পর যোনি প্রসব (VBAC)
বেশিরভাগ সময়ে, একবার কোনও মহিলার সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচার পদ্ধতিতে প্রসব হয়ে গেলে পরে যোনি প্রসবের সম্ভাবনা তার বেশ কমে যায়। তবে বর্তমানে, বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট কৌশল মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনি প্রসবকে সফল করে তোলা সম্ভব করে তুলেছে এমনকি পূর্বের প্রসব প্রক্রিয়াটি অস্ত্রপচার পদ্ধতিতে হয়ে থাকা সত্ত্বেও। এটিকেই সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচারের পরে যোনি পথে প্রসব (VBAC) হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
VBAC করার ক্ষেত্রে ছোটখাটো হাসপাতালগুলিকে নির্বাচন করবেন না বা তারাও সেটি করতে চায় না কারণ একটি জরুরিকালীন অস্ত্রপচার পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি কর্মীর এবং সংস্থানের যা হয়ত সবসময় সবক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না।এছাড়াও আবার গর্ভাবস্থায় থেকে থাকা যেকোনও পূর্ব জটিলতা কিম্বা মায়ের মুখোমুখি হওয়া যেকোনও পরিস্থিতিই ডাক্তারবাবুকে সেই মুহুর্তেই যোনি পথের দ্বারা প্রসবের বিরুদ্ধে পরামর্শ দিতে বাধ্য করে তুলতে পারে।
প্রসব কৌশলগুলির নিজস্ব কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আছে, তবে সন্তান প্রসবটি নিরাপদে হওয়া, একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দেওয়া এবং সমগ্র প্রসব প্রক্রিয়াটি জুড়েই যাতে মা সুরক্ষিত থাকেন সেটি নিশ্চিত করার দিকে সর্বদা দৃষ্টি রাখা উচিত।যখন একটি প্রসব প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গের বিষয়টি আসে আপনার সেটিকেই বেছে নেওয়া উচিত যেটি আপনার ডাক্তারবাবু আপনার জন্য নির্ধারণ করেছেন, ভবিষ্যতে যেকোনওরকম জটিলতাকে এড়াতে ডাক্তারবাবুর সুপারিশকৃত প্রক্রিয়াটির সাথে এগিয়ে চলাই সবচেয়ে ভাল।