গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা

গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা

পিঠে ব্যথা এমন একটি জিনিস যা সমস্ত হবু মায়েরা তাদের গর্ভাবস্থায় কোনো না কোনো সময় অনুভব করে। তবে, বেশিরভাগ পিঠে ব্যথা হয় পিঠের নিচের দিকে, তলপেটের কাছাকাছি এবং এটি গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন বাড়ার কারণে হয়

উপরের পিঠে ব্যথা নিচের পিঠের ব্যথার মতো সাধারণ নয়, তবে এর প্রভাবগুলি ততটাই অপ্রীতিকর হতে পারে। গর্ভাবস্থায় যে কোনো সময় ব্যথা হতে পারে, তবে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এটি বেশি সাধারণ। উপরের পিঠে ব্যথা সাধারণত তখন ঘটে, যখন গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে শরীরের ওজন বিতরণ পরিবর্তিত হয় এবং পিঠকে সমস্ত অতিরিক্ত ওজন সহ্য করতে হয়। লিগামেন্টগুলির টানের ফলে এবং পিঠের পেশীগুলি প্রসব শ্রমের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে আলগা হয়ে যায়, যা দেহের সহজাত স্থায়িত্বকে হ্রাস করে। যেভাবেই হোক না কেন, গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা নিচের পিঠের ব্যথার মতোই বড় সমস্যা, তাই মায়ের আরামের জন্য এই ব্যথা কমাতে যত্ন নেওয়া উচিত

গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা হওয়ার কারণগুলি

গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা হওয়ার কারণ এখানে দেওয়া হল

  • ভারসাম্যের পরিবর্তন: জরায়ু পুরো গর্ভাবস্থা জুড়ে প্রসারিত হয়, তাই মা ভারী শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে তার ঘাড়ের পেশীগুলি প্রসারিত হতে শুরু হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাঁধ টানটান রাখতে বাধ্য হয়। এটি মেরুদণ্ডে চাপ সৃষ্টি করে এবং হবু মায়ের শরীরে উপরের পিঠে ব্যথা হয়
  • জরায়ুর আকার: জরায়ুর আকার পুরো গর্ভাবস্থা জুড়ে বাড়তে থাকে, যা তার চারপাশে চাপ দেয়। মেরুদণ্ডের চারপাশের নার্ভের এবং রক্তনালীগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যার ফলে পিঠে ব্যথা হয়। এটি বিশেষত সেই সময় হয় যদি মা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে তার পিঠে ভর দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে।
  • মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের স্থানান্তর: আপনার গর্ভাবস্থা যখন এগিয়ে যায়, আপনি ধীরে ধীরে আপনার শরীরের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রকে সামনের দিকে সরে যেতে দেখবেন। এতে আপনার পিঠের পেশীগুলিকে এত বেশি ওজন ধরে রাখতে অভ্যস্ত না হওয়ায় পিঠে ব্যথা প্ররোচিত হতে পারে।
  • ভুল ভঙ্গিমা: ভুল ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো বা বসা পিঠ এবং মেরুদণ্ডের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ দিতে পারে, যার ফলস্বরূপ উপরের পিঠে ব্যথা হয়। একজন মা তার গর্ভাবস্থায় প্রায় দশ থেকে পনেরো কেজি অতিরিক্ত ওজন লাভ করে, তাই দীর্ঘ সময় ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালে ওপরের পিঠে ব্যথা হতে পারে। হাই হিল পড়া আপনার মেরুদণ্ডের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
  • সিম্ফিসোপ্যাথি: সিম্ফিসোপ্যাথি একটি বংশগত অবস্থা যেখানে মায়ের পাবলিক আর্টিকুলেশন এবং শ্রোণী অঞ্চলটি খুব নরম ও অত্যধিক প্রসারিত হয়এর ফলে এই অঞ্চলে রক্তক্ষরণ হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের চলাচলের খুব কম সমন্বয় থাকে।
  • হরমোনের পরিবর্তন: রিল্যাক্সিন হরমোন যা গর্ভবতী মহিলার দেহে লুকায়িত থাকে তা শ্রোণী জয়েন্টগুলি এবং লিগামেন্টগুলি শিথিল করতে সহায়তা করে শরীরকে প্রসবের জন্য তৈরি করেএই প্রক্রিয়াটির একটি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল পেশী এবং মেরুদণ্ডে স্ট্রেনের ফলে মা পিঠে ব্যথা অনুভব করে।

 

গর্ভবতী অবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা উপশমের জন্য প্রতিকার

গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠের ব্যথা উপশম করতে আপনি এই প্রতিকারগুলি ব্যবহার করতে পারেন।

  • প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করুন: ক্যালসিয়াম শরীরের হাড় এবং পেশীগুলিকে শক্তিশালী করতে পারে যাতে আপনার শরীর সমস্ত অর্জিত ওজন ধরে রাখতে সক্ষম হয়। দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস, সবুজ শাকসবজি এবং মাছ গর্ভবতী মায়ের জন্য পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ধারণ করে। আপনি যদি ক্যালসিয়াম পরিপূরক পছন্দ করেন তবে ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নিন।
  • জুতোগুলিতে ফোকাস করুন: যে কোনো জুতো যা মেরুদণ্ডের উপর অযৌক্তিক চাপ দেয়, আকার সঠিক না হলে এগুলি গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথাতে সরাসরি অবদান রাখে। হাই হিলগুলি অবশ্যই এড়ানো উচিত এবং আপনাকে অবশ্যই সঠিক জুতো নির্বাচন করতে হবে, যা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি, আরামদায়ক এবং ভাল সোল থাকতে হবে
  • সঠিকভাবে ঝুঁকুন: ঝোঁকা পেঠের পেশী এবং মেরুদণ্ডের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ দিতে পারে যেহেতু মা এখন অনেক অতিরিক্ত ওজন বহন করছেন। যদি আপনি মেঝে থেকে কোনো জিনিস তুলতে চান তবে নীচের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার আগে আপনার হাঁটুকে প্রথমে বাঁকানো এবং আপনার পিঠের পরিবর্তে আপনার হাঁটুতে উপরে ভর দিয়ে ওঠার কথা মনে রাখবেন।
  • অঙ্গভঙ্গিই হল সবকিছুর: আপনি হয়তো দেখেছেন যে গর্ভবতী মহিলারা প্রায়শই কাঁধ টানটান করে এবং পিঠ সোজা করে হাঁটেন। হাঁটার সময় এই ভঙ্গিটি একটি কারণে অনুসরণ করা হয় এটি হাঁটার সময় মেরুদণ্ডের উপর আসা প্রচুর ওজনের বোঝা কম করে। আপনার অবস্থানকে যতবার সম্ভব পরিবর্তন করতে হবে, যাতে কোনো অংশ খুব বেশি চাপের মধ্যে না পড়ে।
  • ভালো ঘুম: ঘুম কেবল গর্ভবতী মাই নয়, সবার স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় ঘুমানোর সঠিক অবস্থান হল আপনার ডানদিকে পাশ ফিরে থাকা, এবং চিৎ হয়ে নয়। ডান পাশে ফিরে শোওয়ার ভঙ্গিতে শুয়ে থাকলে বেশিরভাগ ওপরের পিঠের ব্যথা চলে যায়।
  • ব্যায়াম অনুশীলন: গর্ভাবস্থায় ওজন বাড়া স্বাভাবিক মনে হলেও এটা বোঝায় না যে মায়ের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ওজনের থেকে বেশি ওজন বাড়ানো উচিত। গর্ভাবস্থার শেষ পর্যন্ত আপনার প্রায় ১৪ কিলো বৃদ্ধি হবে বলে আশা করা যায়, তাই আপনি এই সীমাটি যেন অতিক্রম না করেন তা নিশ্চিত করতে ব্যায়াম অনুশীলন করা জরুরি। সাঁতার কাটা এবং হাঁটা হবু মাকে ফিট রাখার জন্য সেরা ব্যায়াম অনুশীলন।
  • বেলি ব্যান্ড: গর্ভাবস্থায় বেলি ব্যান্ডগুলি আপনার পিঠে আপ ফেলা ওজন বিতরণে সহায়তা করতে উপকারী হতে পারে। এগুলি মেরুদণ্ডের ভার কম করে এবং পিঠে ব্যাথায় আক্রান্ত মায়েদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।

গর্ভবতী মহিলারা কিভাবে উপরের পিঠে ব্যথা প্রতিরোধ করতে পারেন?

আপনি গর্ভবতী অবস্থায় উপরের পিঠে ব্যথা হওয়া রোধ করতে পারেন, তার জন্য কয়েকটি উপায় রয়েছে

  • ভারী জিনিস তোলা এবং বহন করা এড়িয়ে চলুন: আপনার পিঠ এবং মেরুদণ্ড ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে চাপের মধ্যে রয়েছে, তাই অপ্রয়োজনীয় বা ভারী জিনিসগুলি তুলে বা বহন করে সেই চাপকে বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপনার হাঁটুর সাহায্যে ঝুঁকুন এবং তোলার সময় সাবধানে হাটুতে ভর দিয়ে উঠুন
  • আরামদায়ক পোশাক পরুন: একটি সাপোর্ট ব্রা গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে উপরের পিঠের ব্যথা রোধ করতে সাহায্য করতে পারে। যেমনটা আগে বলে রয়েছে, জুতো পিঠের ব্যথা রোধে একটি বিশাল ভূমিকা নিতে পারে।
  • মানসিক চাপের মাত্রা কম করুন: শারীরিক চাপ স্পষ্টতই পিঠে ব্যথার ক্ষেত্রে অবদান রাখে, তবে মানসিক চাপও একটি ভূমিকা পালন করে। এটি পিঠের পেশীগুলিতে স্প্যামস এবং টান সৃষ্টি করতে পারে যা পিঠের উপরের অংশে ব্যথা হিসাবে প্রকাশ পায়। তাই আপনার বন্ধু বা চিকিত্সকের সাথে আপনার মানসিক চাপের কথা বলুন এটি আপনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পিঠে ব্যথা উপশমের টিপস

  • টাইট পেশীগুলি শিথিল করার জন্য একটি উষ্ণ ও ঠান্ডা কমপ্রেস বা সেঁক ব্যবহার করা
  • গর্ভাবস্থার ম্যাসাজ বিশেষজ্ঞ বা বিশেষ ম্যাসাজ থেরাপিস্টের কাছ থেকে প্রসবপূর্ব ম্যাসাজ পাওয়া
  • ব্যথা উপশম করতে কায়রোপ্রাকটিক পরিষেবা বা আকুপাংচারের মতো বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করা।

কখন আপনার চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করবেন

আপনি যদি নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি লক্ষ্য করেন তখন আপনার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে:

  • আপনার লক্ষণগুলি বোঝাচ্ছে যে আপনি এবার প্রসব শ্রমে প্রবেশ করবেন
  • আপনার যোনি থেকে রক্তক্ষরণ বা তরল লিক হওয়ার সাথে পিঠে ও তলপেট ব্যথা হয়।
  • আপনার প্রস্রাব করার সময় পিঠে ব্যথা বা জ্বালা থাকে এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হয় এটি মূত্রনালীর সংক্রমণকে ইঙ্গিত করতে পারে।
  • ব্যথা তীব্র হয় এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে চিকিত্সার চেষ্টা করার পরেও কমার লক্ষণ দেখায় না।
  • ব্যথাটি এমন যেখানে সংবেদনশীল অনুভূতি হয় বা ঝিনঝিন করে এবং আপনি সেই অংশের অনুভূতিগুলি কমে যাওয়া লক্ষ্য করেন, যা মেরুদণ্ডের স্নায়ুগুলির সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।

ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করে এবং আপনার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে এবং সারা গর্ভাবস্থা জুড়ে উপরের পিঠে ব্যথা প্রতিরোধ করা বা নিরাময় করা যেতে পারে, তাই মায়েদের এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার দরকার নেই। তবে, প্রতিকারগুলি ব্যবহার করার পরেও যদি লক্ষণগুলি থেকে যায়, তবে আপনাকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ওপরের পিঠে ব্যথা কি প্রসব শ্রমের লক্ষণ? হ্যাঁ, এটি হতে পারে এবং যদি আপনি এটির সাথে সংকোচনের অভিজ্ঞতাও পান তবে দেরী না করে হাসপাতালের দিকে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে