In this Article
আপনি যখন গর্ভাবস্থার যাত্রা শুরু করেন, তখন আপনি গর্ভাবস্থা, শিশু এবং আপনার শরীরের প্রত্যাশিত পরিবর্তন সম্পর্কে সবকিছু জানতে বই, ম্যাগাজিন এবং অন্যান্য অনলাইন সংস্থাঙ্গুলিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা, আপনার স্বাস্থ্যকর থাকা এবং একটি স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্ম দেওয়া আপনার প্রধান লক্ষ্য। সুতরাং, আপনি পুষ্টি, জীবনধারা, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, আপনার শরীরের পরিবর্তন, ব্যায়াম, মেডিকেল পরীক্ষা এবং গর্ভাবস্থার কিছু সাধারণ উপসর্গ সম্পর্কে আরও পড়েন। সকালের অসুস্থতার মতো, আরেকটি সাধারণ সমস্যা হল পিঠে ব্যথা যা অনেক গর্ভবতী মহিলাদেরই প্রভাবিত করে। গর্ভাবস্থায় দুই–তৃতীয়াংশেরও বেশি গর্ভবতী মহিলারা গুরুতর পিঠব্যথা ভোগ করে।
গর্ভাবস্থা এবং পিঠ ব্যথা
গর্ভবতী মহিলাদের অভিযোগ করা সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হল পিঠ ব্যথা। কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে, এটি গর্ভাবস্থার প্রারম্ভে শুরু হয় এবং তাঁদের গর্ভাবস্থার নয় মাস ধরে চলতে থাকে। অন্য মহিলাদের ক্ষেত্রে, এটি আরো খারাপ অবস্থায় যায় এবং শিশুর জন্মের পরেও তাদের ভোগাতে থাকে। কিছু মহিলারা গর্ভাবস্থায় উপরের পিঠের ব্যথা অনুভব করেন, আবার কিছু মহিলারা নীচের পিঠের ব্যথা অনুভব করেন।
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে বা প্রথম ত্রৈমাসিকে পিঠে ব্যথা
যদিও সাধারণত প্রথম ত্রৈমাসিকে পিঠের ব্যথা খুব একটা হয় না, তবে প্রাথমিক গর্ভাবস্থাতেও পিঠের ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন হল অন্যতম প্রধান কারণ। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে, শরীরে প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় – একটি হরমোন যা জরায়ুকে উত্তেজিত করে। এটি মেরুদণ্ডের সাথে পেলভিক হাড়কে সংযুক্ত করা লিগামেন্টগুলিকে আলগা করে দেয়। আপনার নিতম্বের জয়েন্টগুলো আলগা হওয়ার জন্য এবং লিগামেন্টগুলির শিথিল হওয়ার কারণে, হাঁটা, দাঁড়িয়ে থাকা এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য বসে থাকার সময় আপনি ব্যথা অনুভব করতে পারেন।
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে পিঠে ব্যথা
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে পিঠে ব্যথা বেড়ে ওঠার ঝুঁকি বেশী থাকে। যেহেতু জরায়ু প্রসারিত হয়, এটি পেটের পেশীকে দুর্বল করে এবং আপনার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রকে পরিবর্তিত করে। এটি আপনার অঙ্গভঙ্গিকে প্রভাবিত করে এবং আপনার পিঠের উপর চাপ বাড়ায়। যদি আপনার পিঠের চাপটি একটি স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে, তবে পিঠে ব্যাথা শুরু হয়।
গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পিঠে ব্যথা
আপনি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পা রাখলে, আপনার ওজন আরো বাড়ে। অতিরিক্ত ওজন বহন করার জন্য আপনার জয়েন্টগুলোতে চাপ বেশী পড়ে এবং আপনার পেশীকে বেশী কাজ করতে হয়। পেশীর ভারসাম্যহীনতা এবং চাপ পিঠে ব্যথা বাড়ায় যখন আপনি হাঁটেন, দীর্ঘ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, নীচু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান, বা ঝুঁকে জিনিস তোলেন।
আপনি যদি প্রাথমিকভাবে পিঠে ব্যথা অনুভব না করেন, কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকের দ্বিতীয়ার্ধে গুরুতর ব্যথা অনুভব করা শুরু করেন, তবে এটি অকাল প্রসব শ্রমের একটি চিহ্ন হতে পারে। আপনি অবশ্যই একবার আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
গর্ভাবস্থায় পিঠ ব্যথা কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা সহ আপনার শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন আশা করা স্বাভাবিক। যদিও বেশিরভাগ শারীরিক পরিবর্তন গর্ভাবস্থার অংশ হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই ঘটে থাকে, তবুও তারা বিভিন্ন সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসে। এর মধ্যে কয়েকটি আপনাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে এবং কিছু শারীরিকভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে পারে। গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা বিস্ময়কর নয়। এটি একটি উপসর্গ যা বেশিরভাগ গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ঘটে কারণ প্রাকৃতিক পরিবর্তন যেমন শরীরের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র সরে যাওয়া, ওজন বৃদ্ধি, পেশীর ভারসাম্যহীনতা এবং পেশীর ক্লান্তির জন্য পিঠে চাপ পড়ে এবং এটি পিঠে ব্যথা সৃষ্টি করে। গর্ভাবস্থা–সম্পর্কিত হরমোনগুলির বৃদ্ধি ঘটায় জয়েন্টগুলির পিচ্ছিলতা বাড়িয়ে দেয় এবং ফলে জয়েন্টগুলো থেকে প্রয়োজনীয় অবলম্বন হ্রাস পায়, যার ফলে পিঠ ব্যথার সমস্যা হয়। এছাড়াও, মেরুদন্ডে ভার বাড়ায় যে কাজগুলি, সেগুলি করলে গর্ভবতী মহিলাদের পিঠে ব্যথা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
গর্ভবতী হওয়ার সময় আমার পিঠে ব্যাথা হয় কেন?
গর্ভাবস্থা আপনার শরীরের অঙ্গভঙ্গি এবং জীবনধারাতে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনে। পিঠের ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয় যদি আপনার পেট ও পিঠের পেশীগুলি দুর্বল হয়, এবং সাথে যদি শরীর নড়াচড়া না করা হয় ও বসে বসে জীবন কাটানো হয়। একাধিক শিশুর (যমজ বা তিনটি) বহন করলেও পিঠে ব্যথা বৃদ্ধি পায়। সহজ ও সাধারণ কাজগুলি করার সময় আপনি কিভাবে নিজেকে বহন করেন তা–ও জয়েন্টগুলো এবং পেশীর উপর একটি প্রভাব ফেলে। জরায়ুর বৃদ্ধি, মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের স্থানান্তর, অতিরিক্ত ওজন এবং হরমোন পরিবর্তনগুলির মতো শারীরিক পরিবর্তনগুলি ছাড়াও, গর্ভবতী থাকার সময় আপনার পিঠ ব্যথার জন্য দায়ী অন্যান্য কিছু কারণ নিম্নরূপ:
-
আপনার শিশুর বৃদ্ধির সাথে সাথে, আপনি নিজেকে সামনের দিকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পিছনের দিকে ঝুঁকে থাকেন। আপনার অঙ্গভঙ্গির এই সামান্য পরিবর্তন আপনার নীচের পিঠের পেশীগুলিতে চাপ দিতে পারে, যা পিঠের ব্যাথা সৃষ্টি করে
-
উঁচু হিলওয়ালা জুতা পরলে ভারসাম্য পরিবর্তন করে এবং পিঠে আরও চাপ দেয়। এর ফলে পিঠে ব্যথা তৈরি হওয়ার এবং পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে
-
কোনো জিনিস ওঠানোর সময়, যদি আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন এবং বাঁকেন তবে এটি পিঠে চাপ বাড়ায়
-
বেশী শারীরিক কাজ করার জন্য মেরুদন্ডে টান পড়ার জন্য যে ক্লান্তি আসে তার থেকেও পিঠে ব্যথা বাড়ে
-
মানসিক চাপও পিঠের পেশীতে টান সৃষ্টি করতে পারে, যার থেকে পিঠে ব্যথা বা পিঠের খিঁচুনি হতে পারে
গর্ভাবস্থায় পিঠের ব্যথার ধরন
গর্ভাবস্থায় আপনি কটিদেশীয় পিঠ ব্যথা এবং পিছনের পেলেভিক অঞ্চলে ব্যথা সহ বিভিন্ন ধরনের ব্যথা ব্যথা অনুভব করতে পারেন।
প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় কটিদেশীয় পিঠ ব্যথা কী?
কটিদেশীয় ব্যথা কোমরের উচ্চতায়, মেরুদণ্ডের উপরে এবং চারপাশে অনুভূত হয়। কখনও কখনও, আপনি ব্যথাটি যেন আপনার পায়ের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে অনুভব করতে পারেন। কটিদেশীয় ব্যথা কটিদেশীয় মেরুদণ্ডে ঘটে, যা আপনার পিঠের নিচের দিকে অবস্থিত। দীর্ঘ ঘন্টা ধরে বসে থাকা এবং দাঁড়িয়ে থাকা বা ভারী বস্তু উত্তোলনের মতো কাজগুলি ব্যথা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
গর্ভাবস্থায় পিছনের দিকের পেলভিক ব্যথা কী?
গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে পিছনের দিকের পেলভিক ব্যথা হল একটি সাধারণ ধরনের পিঠের নীচের দিকের ব্যথা। এই ব্যথা পেলভিসের পিছনের দিকে অনুভুত হয়। আপনার নিতম্বের এক বা উভয় পাশে বা আপনার উরুর পিছনের দিকে গুরুতর ব্যথা হয়। কিছু মহিলার পিউবিক হাড়ের উপর ব্যথা অনুভূত হয়। হাঁটা, সিঁড়ি আরোহণ, বিছানাতে গড়ানো, বস্তু উত্তোলন, এবং একটি বাথ টাব বা নীচু চেয়ারে বসতে বা তা থেকে উঠে দাঁড়াতে পিছনের পেলভিক ব্যথা বেশী অনুভূত হয়। অতএব, গর্ভাবস্থায় চেয়ারে বসে থাকার সময় আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। এই ভঙ্গিতে, যদি আপনি একটি ডেস্কের উপর সামনের দিকে ঝোঁকেন, ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
গর্ভবতী মহিলাদের পিঠের ব্যথার কারণ কী কী?
পিঠের ব্যথা সাধারণত স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টে হয়, এই জয়েনট হল একটি বিন্দু যেখানে পেলভিস আপনার মেরুদন্ডের সাথে মিলিত হয়। এই পিঠের ব্যথার কিছু কারণ নিম্নে দেওয়া হল:
1. ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থার সময় ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক এবং শিশুর বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। সাধারণত ওজন বৃদ্ধি 11 থেকে 15 কিলো পর্যন্ত হয়, এবং মেরুদণ্ড শরীরের এই ওজন বহন করে। এই অতিরিক্ত ভার পিঠে একটি ব্যথা উৎপন্ন করে। উপরন্তু, ক্রমবর্ধমান শিশু ও ক্রমবর্ধমান জরায়ুর ওজন পিঠ ও পেলভিস এলাকার রক্তের নালীগুলির উপর এবং স্নায়ুর উপর চাপ বৃদ্ধি করে।
2. ভঙ্গির পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি আপনার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রকে পরিবর্তন করে, এবং আপনি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। এই স্থানান্তর ধীরে ধীরে ভঙ্গির একটি পরিবর্তন ঘটায়। ভঙ্গির এই পরিবর্তন পিঠে ব্যথা ঘটায়।
3. হরমোন পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায়, রিল্যাক্সিন এবং ইস্ট্রোজেনের মতো হরমোনগুলি আপনার শরীরের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। রিল্যাক্সিন, একটি গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত হরমোন, পেলভিক অঞ্চলের লিগামেন্টগুলিকে শিথিল করে, এবং জয়েন্টগুলি আলগা হয়ে যায়। অন্য কথায়, এই হরমোন জয়েন্টে পিচ্ছিলতা সৃষ্টি করে। মেরুদণ্ডকে অবলম্বন প্রদানকারী লিগামেন্টগুলিও শিথিল হয় বা আলগা হয়ে যায়। লিগামেন্টের এই শিথিলতা অস্থিরতা এবং ব্যথা বাড়ায়। হরমোনের হঠাত বৃদ্ধি, সাথে ওজন বৃদ্ধি এবং মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের পরিবর্তনের ফলে জয়েন্টগুলিতে অবলম্বন হ্রাস পায়, যার ফলে পিঠে ব্যাথা হয়।
4. পেশী বিচ্ছেদ
রেকটাল অ্যাবডোমিনিস পেশী আলাদা হওয়ার ফলেও পিঠে ব্যথা শুরু হয়। রেকটাস অ্যাবডোমিনিস পেশীগুলি শরীরের সামনের দিকে পেট অঞ্চলের ভিতরে অবস্থিত। আপনার গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে, জরায়ু বৃদ্ধি পায় এবং প্রসারিত হয়। এই প্রসারণটির ফলে রেকটাল অ্যাবডোমিনিস পেশীগুলির দুটি সমান্তরাল পাত কেন্দ্রীয় সিম বরাবর আলাদা হয়ে যায় যার ফলে পিঠে ব্যথা তৈরি হয়।
5. মানসিক চাপ
আপনার আবেগ গর্ভাবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, যে কোনো ধরনের মানসিক আঘাত বা চাপ আপনার স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটি গর্ভাবস্থাতেও সত্য। আপনি লক্ষ্য করবেন যে মানসিক চাপ বাড়লে, পিঠে ব্যথার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। মানসিক চাপ পিঠ অঞ্চলে পেশীর টান সৃষ্টি করতে পারে, এবং পেশীর শক্ত হয়ে যাওয়া ও ব্যথা বৃদ্ধি করতে পারে। এই টান পিঠ ব্যথা বা পিঠে খিঁচুনি সৃষ্টি করতে পারে।
6. অবসাদ
দৈনিক যে সব কাজগুলিতে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয় এবং সাংঘাতিক শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় যা আপনাকে ক্লান্ত করে তোলে, সেই ধরনের কাজগুলি করলে গর্ভাবস্থায় আপনার অবসাদ বাড়াবে। উপরন্তু, মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের পরিবর্তন পেশীর ক্লান্তি সৃষ্টি করে, যার ফলে আপনার ভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়। খারাপ ভঙ্গি পিঠে ব্যথা বাড়ায়।
7. পেশীর ভারসাম্যহীনতা
গর্ভাবস্থার সময়, ওজন বৃদ্ধির কারণে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রে পরিবর্তনের জন্য পেশীর ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে, কারণ শরীরকে অতিরিক্ত ওজন বহন করতে হয়। এই অতিরিক্ত ওজনের জন্য আপনার পেশীকে বেশী কাজ করতে হয়। এটি আপনার জয়েন্টগুলোতে চাপও বাড়ায়। এই পেশী ভারসাম্যহীনতা শরীরের ভারবহনকারী অঙ্গগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে। আপনার যদি আগে থেকেই পেশীর দুর্বলতা বা অনমনীয়তা থাকে, তবে এই পেশী ভারসাম্যহীনতা এটিকে আরও খারাপ করে এবং পিঠে ব্যথা বৃদ্ধি করে।
গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা থেকে ত্রাণ পাওয়ার জন্য 10টি কৌশল
পিঠে ব্যথা সম্পর্কে আপনার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে, আসুন এটি থেকে কিভাবে ত্রাণ পেতে হবে তা দেখি। ব্যায়াম, যোগ এবং অন্যান্য চাপ–উপশমকারী প্রতিকারগুলি আপনাকে পিঠে ব্যথার সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথার প্রতিকারের জন্য ব্যায়াম
ব্যায়াম হল আপনাকে পিঠে ব্যথা থেকে ত্রাণ দিতে সবচেয়ে ভাল বিকল্পগুলির একটি। তবে, আপনার ব্যায়াম কর্মসূচী শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। সবচেয়ে উপযোগী কিছু ব্যায়ামের মধ্যে রয়েছে:
1. সাঁতার
সাঁতার গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটি খুব ভাল ব্যায়াম। এটি আপনার পেট এবং নিম্ন–পিঠের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করার সাথে সাথে, জলের প্লবতা লিগামেন্ট এবং জয়েন্টগুলিতে চাপ কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে জলে ব্যায়াম গর্ভাবস্থায় পিঠের ব্যথার তীব্রতা কমায়। তবে, আপনার সাঁতার অনুশীলন শুরু করার আগে আপনার চিকিত্সকের সাথে পরামর্শ করুন এবং পুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন।
2. ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ
ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ আপনার মনোবল গড়ে তোলে এবং পেটের পেশী, পিঠের পেশী এবং পা–কে শক্তিশালী করে। অতএব, এটি গর্ভাবস্থায় নিম্ন পিঠের ব্যাথা প্রতিরোধ করতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ আপনার ডাক্তারের অনুমোদনের পরে পেশাদার প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকের উপদেশ অনুযায়ী করা উচিত। গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণে উবু হওয়া এবং কাঁধ–পার্শ্ববর্তী ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত থাকে।
3. হাঁটা এবং প্রসারিত করা
প্রসারিত করা এবং হাঁটা দুটিই অতি সহজ, তবু কার্যকর ব্যায়াম যা আপনাকে পিঠে ব্যথা থেকে ত্রাণ পেতে সাহায্য করে। প্রসারিত করা পেশীর নমনীয়তা বাড়ায় যে পেশী আপনার পা এবং পিঠকে অবলম্বন দেয়। প্রসব পূর্ববর্তী প্রসারণ যোগব্যায়াম ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে। হাঁটা একটি সহজ উপায় এবং এটিকে আপনার দৈনন্দিন রুটিনের অংশ বানালে বিস্ময়কর ফল পাওয়া যায়। এটি একটি কার্যকর কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম যা নিরাপদ এবং আপনাকে গর্ভাবস্থায় সক্রিয় থাকতে সহায়তা করে।
তবে নিশ্চিত করুন যে আপনি যথাযথ পাদুকা পরেন – একটি আরামদায়ক, সঠিক মাপের, কম–হিলযুক্ত জুতো বেছে নিন যা আপনার পা–কে অবলম্বন দেয় এবং তাদের শ্বাস নিতে দেয়। এছাড়াও হাঁটার সময় নিজেকে হাইড্রেটেড রাখুন; পুষ্টি বহন করার জন্য, পাচন সমস্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য এবং ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এখন আপনার শরীরের প্রচুর পরিমাণে জল প্রয়োজন। সুতরাং, আপনার হাঁটা উপভোগ করুন এবং নিজেকে অবসন্ন হতে দেবেন না।
গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথার প্রতিকার
ব্যায়াম ছাড়াও, আসুন আমরা অন্যান্য প্রতিকারগুলি দেখি যা আপনাকে পিঠ ব্যথা থেকে ত্রাণ দিতে সহায়তা করতে পারে। এই প্রতিকারগুলির মধ্যে রয়েছে:
1. ভাল ভঙ্গির অনুশীলন
আপনার গর্ভাবস্থার যাত্রার অগ্রগতির সাথে সাথে, আপনার শিশুর বৃদ্ধি হয়, এবং আপনি সামনের দিকে পড়ে যাওয়া এড়াতে, আপনি শেষ পর্যন্ত পিছনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। এই ভঙ্গি নিম্ন পিঠের পেশীর চাপ পরিবর্তন করে এবং পিঠে ব্যথা শুরু করায়। অতএব, ভাল ভঙ্গির অনুশীলন পিঠে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক হতে পারে। সেরা ভঙ্গিগুলির মধ্যে রয়েছে:
- সোজা এবং লম্বাভাবে দাঁড়ানো
- আপনার বুক উঁচু করে রাখা
- আপনার কাঁধ এবং পিঠ শিথিল রাখা
- দাঁড়িয়ে থাকার সময় আরামদায়ক ভাবে পা ফাঁক করে দাঁড়ানো
- আপনার পা–কে বিশ্রাম দেওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়াতে হলে ঘন ঘন বিরতি গ্রহণ করা
- হাঁটু লক হয়ে যাওয়াকে এড়ানো
- অবলম্বন যুক্ত চেয়ার বেছে নিয়ে বা ঠেসান দেওয়ার জন্য পিঠের পিছনে একটি বালিশ রাখার মাধ্যমে বসার সময় যত্ন নেওয়া
2. সঠিক পোশাক–পরিচ্ছদ পাওয়া
পোশাকের মতো, অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণ যেমন পাদুকাও গর্ভাবস্থায় আরামদায়ক ভাবে থাকা নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওজন বৃদ্ধি এবং মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের স্থানান্তরের কারণে, উচ্চ–হিল যুক্ত জুতা পরা এড়িয়ে যান কারণ তারা আপনার ভারসাম্যকে আরো কমাতে পারে এবং আপনি পড়ে যেতে পারেন। কম হিলযুক্ত পাদুকা যাতে বাঁকা অংশে ভালো অবলম্বন দেওয়া থাকে, তা পরলে আপনার হাঁটার অভিজ্ঞতাকে সহজ করতে সাহায্য করে।
3. সঠিকভাবে উত্তোলন
গর্ভাবস্থায় ভারী বস্তু উত্তোলন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। সুতরাং, সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো। সাহায্য নিতে উপদেশ দেওয়া হয় কারণ নীচু হয়ে ভারী বস্তু উত্তোলন করলে পিঠে টান পড়তে পারে এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। আপনাকে যদি কোনো ছোট বস্তু তুলতেই হয়, তাহলে উবু হন এবং আপনার পায়ের উপর অবলম্বন করে ধীরে ধীরে সেটিকে তুলুন।
4. যথোপযুক্তভাবে ঘুমানো
আপনার ঘুমের ভঙ্গি গর্ভাবস্থায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপরন্তু, সঠিক ঘুমের ভঙ্গি পিঠ ব্যথা থেকে মুক্তি প্রদান করতে পারে। রাতে ভালো ঘুমাতে, চিত হয়ে ঘুমাবেন না। পাশ ফিরে ঘুমান এবং আপনার হাঁটু ভাঁজ করে রাখুন। আপনি অবলম্বনের জন্য বালিশও ব্যবহার করতে পারেন। হাঁটুর মাঝখানে, পিঠের পেছনে এবং পেটের এলাকার নীচে বালিশগুলি রাখুন। আপনি আপনার পিঠে অবলম্বন দেওয়ার জন্য একটি দৃঢ় গদিও ব্যবহার করতে পারেন।
5. শিথিল হওয়ার কৌশল অনুশীলন
যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস এবং মালিশের মত শিথিল হওয়ার কৌশল অনুশীলন করলে গর্ভাবস্থার পিঠ ব্যথা থেকে আরাম পেতে সাহায্য করতে পারে। যোগ এবং গভীর শ্বাস পেশীর টান কমাতে সাহায্য করতে পারে, এবং গভীর ঘুমের মাধ্যমে আপনাকে শিথিল করে। যদিও এটি প্রমাণ করার জন্য কোন গবেষণা ফলাফল নেই তবে, আপনি আপনার পিঠে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে হালকা মালিশ করতে পারেন অথবা গরম বা ঠান্ডা প্যাক প্রয়োগ করতে পারেন। অনেক গর্ভবতী মহিলারা মালিশ এবং গরম / ঠান্ডা প্যাকের মাধ্যমে কিছু আরাম উপভোগ করেন।
6. পরিপূরক থেরাপি ব্যবহার করে
গবেষণা জানায় যে আকুপাংচার গর্ভাবস্থায় হওয়া পিঠ ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়। কাইরোপ্র্যাক্টিক চিকিত্সাও পিঠে ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। এই চিকিত্সায় পিঠে ব্যথা কমানোর প্রচেষ্টায় মেরুদন্ডকে হাত দিয়ে নড়িয়ে–চড়িয়ে ঠিক করার উপর জোর দেয়। তবে, যদি আপনি এই থেরাপিরগুলি ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পরিপূরক বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে পরামর্শ করুন।
7. আপনার রুটিনে দৈনিক শারীরিক কর্মসূচী যুক্ত করা
হাঁটা, প্রসারিত করা, স্কোয়াটিং, জল ব্যায়াম এবং অন্যান্য সাধারণ সাংসারিক কাজকর্মের মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ আপনাকে সক্রিয় রাখতে এবং আপনার পিঠকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। যদিও আপনি পিঠের ব্যথার সময় বিছানায় কুঁকড়ে থাকতে চাইবেন, কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ আপনার পিঠে ব্যথাতে আরাম দিতে পারে।
পিঠে ব্যথার জন্য এই প্রতিকারগুলি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খুব উপকারী হতে পারে, তবে এগুলি শুরু করার আগে আপনার চিকিত্সক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে পরামর্শ করার উপদেশ দেওয়া হয়।
গর্ভাবস্থায় দুই–তৃতীয়াংশের বেশি গর্ভবতী মহিলাদের পিঠের ব্যথা অনুভব হয়, প্রায় এক শতাংশ নারী “সায়াটিকা” দ্বারা প্রভাবিত হয়। কখনও কখনও, নিম্ন পিঠের ব্যথা উরু এবং নিতম্বতে ছড়িয়ে পড়ে, এবং সেটিকে সায়াটিকা ভেবে ভুল করা হয়। গর্ভাবস্থায় সায়াটিকা সাধারণত হয় না, এবং এটি মেরুদণ্ডের নিচের অংশে একটি ডিস্কের ফুলে যাওয়ার কারণে ঘটে। আপনার যদি সায়াটিকা থাকে, তবে ব্যথা হাঁটুর নীচে, পা এবং পায়ের পাতায় চলে যায়। এর সাথে পায়ে একটি চিনিচিনে বেদনা বা অসাড়তা থাকে। গুরুতর সায়াটিক ব্যথা আপনার জঙ্ঘা বা যৌনাঙ্গ অঞ্চলে অসাড়তা সৃষ্টি করতে পারে। আপনার প্রস্রাব বা মলত্যাগে অসুবিধা হতে পারে। আপনি যদি এই উপসর্গগুলি দেখতে পান, তবে আপনার ডাক্তারের সাথে দেখা করার এবং সায়াটিক ব্যথার চিকিত্সা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে মালিশ, কাইরোপ্র্যাকটিক যত্ন এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপ।
এখন আপনি গর্ভাবস্থায় পিঠ ব্যথা, এর কারণগুলি, ধরন এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রতিকারগুলি সম্পর্কে সচেতন, তাই এখন ধৈর্য না হারিয়ে গর্ভাবস্থার যাত্রা উপভোগ করার সময়। আপনার মেরুদন্ড, পিঠ এবং পায়ে বিশেষ মনোযোগ প্রদান করে আপনার শারীরিক সুস্থতার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ভুলবেন না। আপনার স্মরণীয় যাত্রায় চলার সময়, শিথিল হওয়ার পদ্ধতিগুলি শিখলে এবং যথাযথ ঘুমের ভঙ্গিগুলি মেনে চললে আপনার অনেক সাহায্য হতে পারে।