গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সাদা স্রাব- এটি কি স্বাভাবিক?

গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সাদা স্রাব- এটি কি স্বাভাবিক?

গর্ভাবস্থা হল একটি উত্তেজনাপূর্ণময় সময় এবং এটি শরীরে, মনে প্রচুর পরিবর্তন নিয়ে আসে।যখন আপনি গর্ভবতী হন, আপনার দেহের মধ্যে বহুবিধ পরিবর্তন হতে থাকে। আপনি হয়ত ইতিমধ্যেই এই সকল পরিবর্তনগুলির জন্য প্রত্যাশা করে থাকতে পারেন এবং এমনকি আবার সেগুলির মধ্যে কয়েকটির অপেক্ষাতেও থাকতে পারেন।যাইহোক, কিছু শারীরিক পরিবর্তন অপ্রত্যাশিত হয়ে থাকে এবং সেগুলি সময়ের সাথে সমস্যার কারণও হয়ে উঠতে পারে।সকল মহিলাই কোনও না কোনও সময় কিছু ধরণের যোনি স্রাবের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন আর গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যেও যোনি স্রাবের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকতে পারে।তবে গর্ভদশায়, যোনি স্রাব কিছু বেশি হতে পারে যা কিছু ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।অস্বাভাবিক স্রাব সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকতে পারে অথবা সেটি শ্রমের সাথে সম্পর্কিতও হতে পারে।

যোনি স্রাবের ব্যাপারে আলোচনা করতে মহিলারা প্রায়ই ইতস্তত বোধ করেন কিন্তু গর্ভবতী মহিলাদের এটি বোঝা উচিত যে কয়েকটি নির্দিষ্ট অস্বাভাবিক স্রাবের ক্ষেত্রে চিকিৎসাগত মনোনিবেশ করানোর প্রয়োজন।গর্ভাবস্থায় সাদা স্রাবের ব্যাপারে জানতে হলে পড়তে থাকুন।

গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সাদা স্রাব হওয়াটা কি স্বাভাবিক?

গর্ভদশার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে যোনি থেকে সাদা স্রাব কিম্বা হালকা দুধেল সাদা স্রাব হওয়াটা স্বাভাবিক এবং আপনি অবশ্যই এ ব্যাপারে নিজেকে দুশ্চিন্তা করাবেন না। গর্ভাবস্থায় শরীরে নানাবিধ পরিবর্তন হওয়ার কারণে, আপনার গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময়ে সাদা স্রাবের অভিজ্ঞতা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।কিন্তু আপনি অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করবেন যদি স্রাবের কোনও অস্বাভাবিক বর্ণ, গঠণ কিম্বা দুর্গন্ধ থেকে থাকে।আপনার প্রসব তারিখটি কাছাকাছি এসে যাওয়ার সাথে, আপনি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে রক্তের দাগ যুক্ত ঘন সাদা স্রাবও লক্ষ্য করে থাকতে পারেন।এটি এমন একটি সংকেত যা আপনাকে প্রসবের জন্য লেবার রুমে যাওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে পারে।

গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সাধারণ স্রাব

এমন বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আছে যেগুলি শ্রম বেদনা উত্তোলন এবং প্রসবের জন্য প্রস্তুত করতে আপনার শরীরের মধ্যে হতে থাকবে।এই সকল পরিবর্তনগুলি আবার আপনার যোনি স্রাবের পরিবর্তনগুলির সাথেও পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে থাকে।এই সময় সার্ভিক্সে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে আপনার হরমোনের স্তরগুলিতেও পরিবর্তন ঘটবে, যার ফলে বেশি মাত্রায় স্রাব হয়ে থাকে।অস্বস্তি কাটাতে আপনি এর জন্য প্যান্টি লাইনার বা প্যাডগুলি ব্যবহার করতে পারেন। একটা স্বাভাবিক স্রাবের কয়েকটি লক্ষণ এখানে উল্লিখিত হলঃ

  • এটি সাদাটে, স্বচ্ছ, তরল প্রকৃতির অথবা এমনকি সামাণ্য হলদেটে বর্ণেরও হয়ে থাকে।
  • গন্ধহীন হয়
  • প্রসব তারিখটি নিকটে এসে যাওয়ার কারণে সামাণ্য গোলাপী স্রাব হয়ে থাকতে পারে।

তবে স্রাবের কারণে আপনি যদি সামাণ্যতমও অস্বচ্ছন্দতা কিম্বা অস্বস্তির আভাস পান, অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অস্বাভাবিক স্রাব

অস্বাভাবিক স্রাবটি হলদেটে কিম্বা সবুজাভ বর্ণের হয়ে থাকে এবং তার সাথে দুর্গন্ধ সংযুক্ত থাকতে অথবা নাও থাকতে পারে।এই ধরণের পরিস্থিতিতে আপনার অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।এটি বিভিন্ন কারণের জন্য হয়ে থাকতে পারে এবং গর্ভস্থ বাচ্চার ওপর প্রভাব ফেলার আগেই আপনার এটির চিকিৎসা করে নেওয়া প্রয়োজন।

নিম্নোলিখিতগুলি হল গর্ভাবস্থায় একটি অস্বাভাবিক স্রাব হওয়ার কয়েকটি সাধারণ কারণঃ

  • ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস হল এমন একটি অবস্থা যা যোনি কিম্বা জরায়ুর নালীর মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনভাবে উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। হলদেটে যোনি স্রাব নিঃসরণের আরেকটি কারণ হল এই অবস্থাটি।এর উপসর্গগুলি হল প্রস্রাব ত্যাগের সময় একটা যন্ত্রণা বা জ্বলন অনুভূতি অনুভব করা।যদি এটি সময়মত চিকিৎসা করা না হয়, তবে এই অবস্থাটির কারণে অপরিণত শিশু কিম্বা আকারে ছোট শিশুর জন্ম হতে পারে।
  • ক্যান্ডিশিয়াসিস হল একটি ইস্ট জনিত সংক্রমণ এবং এর ফলে যোনি স্রাবটি হলদেটে অথবা সবুজাভ হতে পারে।হরমোন স্তরগুলিতে পরিবর্তনগুলি বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্যানডিডা ফাংগাস বা ছত্রাকের সংক্রমণের মাত্রাটি বেড়ে ওঠে।এটি আপনার মধ্যে চুলকানি এবং অস্বস্তিবোধের সৃষ্টি করে।
  • ক্ল্যামাইডিয়া হল একটি যৌনবাহিত রোগ(STD).এটি যোনি স্রাব ঘন এবং হলদেটে হয়ে ওঠার কারণ হয়ে উঠতে পারে।আপনি যদি এটিতে কিম্বা অন্য কোনও যৌনবাহিত রোগ বা STD-তে ভুগে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই অবিলম্বে আপনার ডাক্তারবাবুকে তা অবগত করুন এবং তার চিকিৎসা শুরু করান কারণ তা না হলে এটি অকাল প্রসবের কারণ হয়ে উঠতে পারে অথবা সংক্রমণটি অনাগত শিশুর মধ্যে স্থানান্তরিত হতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে লিউকোরিয়া হয়ে থাকে।এর ফলে একটা ঘন হলদেটে স্রাব নিঃসৃত হতে পারে।এই স্রাবটি হল সার্ভিক্স বা জরায়ুতে থাকা ব্যাকটেরিয়াল ফ্লোরা,পুরাতন যোনি কোষ এবং যোনি এবং সার্ভিক্সের অন্যান্য নিঃসরণের একটি সাধারণ সংমিশ্রণ।

তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সাদা স্রাবের সাথে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে

নিম্নোলিখিত করণীয় এবং অকরণীয় বিষয়গুলি যোনি স্রাবের সাথে মোকাবিলা করতে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে আপনাকে সহায়তা করবেঃ

যা করণীয়

নিম্নোলিখিত বিষয়গুলি যে আপনি করবেন তা নিশ্চিত করুনঃ

  • দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার পরিষ্কার জল এবং আপনার ডাক্তারবাবুর দ্বারা প্রস্তাবিত মেডিকেটেড সাবান দিয়ে আপনার যোনি অঞ্চলটিকে ধুয়ে পরিষ্কার করুন এবং শুকিয়ে নিন।
  • যোনি অঞ্চলটিকে যখন মুছবেন বা শুকনো করবেন, আপনার হস্ত সঞ্চালনাটি হওয়া উচিত সামনে থেকে পিছনের দিকে এবং কখনই তা পিছন থেকে সামনের দিকে হবে না।
  • সুতির পরিষ্কার অন্তর্বাস পরিধান করুন এবং দিনের মধ্যে কমপক্ষে দু’বার তা পরিবর্তন করুন।
  • বায়ু চলাচল করতে পারে এমন ধরণের আরামদায়ক পোশাক রাতের বেলায় পরিধান করুন।
  • প্যাড এবং প্যান্টি লাইনারগুলি ব্যবহার করলে তা আপনাকে শুকনো এবং স্বাচ্ছন্দে রাখবে।
  • যৌন বাহিত রোগগুলি প্রতিরোধ করতে সঙ্গমের সময় সুরক্ষা বজায় রাখুন।
  • স্বাভাবিকের বাইরে কোনওরকম উপসর্গ লক্ষ্য করা মাত্রই তৎক্ষণাৎ ডাক্তারবাবুকে কল করুন এবং সবকিছু তাঁকে জানান।
  • আপনার প্রসব তারিখটি আসার আগেই যদি আপনার অন্তর্বাসটি সমানে একনাগাড়ে ভিজে যেতে থাকে, অবিলম্বে আপনার ডাক্তারবাবুকে তা জানান।

যা করণীয় নয়

একটি সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থা বজায় রাখার জন্য এই বিষয়গুলি এড়িয়ে চলুনঃ

  • সুগন্ধি ক্রীম এব ফ্যানাপূর্ণ জলে স্নান করা এড়িয়ে চলুন।
  • ট্যাম্পন বা তুলোর পট্টি বা কাপড়ের ন্যাকড়াগুলি সংক্রমণের কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং যোনিতে ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাব ঘটাতে পারে, সুতরাং সেগুলি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
  • যোনি অঞ্চলে যদি আপনার দুর্গন্ধ হয়ে থাকে, তবে সেটিকে কোনও সেন্ট বা সুগন্ধি স্প্রে অথবা পাউডার দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।পরিবর্তে ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হন।
  • নিজে নিজেই ওষুধ খাওয়া এড়িয়ে চলুন এবং চুলকানি, লালচে ভাব ও ফুলে যাওয়ার মত যেকোনও অবস্থার ক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন।
  • যেকোনও রকম সংক্রমণ ঠ্যাকাতে পাবলিক টয়লেটগুলি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
  • ডুশ ব্যবহার করা কিম্বা স্নানাদি বা পরিষ্কারের জন্য দেহের ভিতরে প্রযুক্ত তরল পদার্থের ধারাপাত করা অথবা ডাচিং এড়িয়ে চলুন কারণ এটি আবার যোনিতে থাকা ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলিকে ধুয়ে ফেলতে পারে।

কখন একজন ডাক্তার ডাকা প্রয়োজন

যদি আপনি গর্ভাবস্থার 37 তম সপ্তাহের আগেই তরলের ন্যায় স্রাব নিঃসরণ অনুভব করেন অথবা এমন কোনও উপসর্গ লক্ষ্য করেন যা পুরোপুরি অস্বাভাবিক, আপনার একজন ডাক্তার দেখানো উচিত।আবার যদি আপনি খেয়াল করেন যে আপনার অন্তর্বাস অস্বাভাবিক ভাবে ভিজে যাচ্ছে বা আপনি এমন কোনও ধরণের অস্বস্তি যদি লক্ষ্য করে থাকেন, তবে সে ব্যাপারে আপনার পরিষ্কার হয়ে নেওয়া ভাল। 37 সপ্তাহের আগে একটি তরল স্রাব নিঃসরণের ক্ষেত্রে শুরুতেই আপনার সতর্ক হওয়া উচিত, এটা লাল সতর্কতা জারি করে।আপনার অতি অবশ্যই তড়িঘড়ি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত কারণ এটির অর্থ হতে পারে আপনার অ্যামনিওটিক থলিটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং সেখান থেকে অ্যামনিওটিক তরলটি লিক করতে পারে। যদিও গর্ভাবস্থায় সাদা স্রাব হওয়াটা খুব বড় উদ্বেগের কিছু নয়, তবে আপনি যদি কোনওকিছুই অস্বাভাবিক লক্ষ্য করে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেবেন।গর্ভাবস্থার নবম মাসে আপনি যদি প্রচুর পরিমাণে সাদা স্রাব হতে লক্ষ্য করে থাকেন, আপনার ডাক্তারবাবুকে তা অবগত করুন এবং তিনি যা বলেন সেই মত চলুন।