আরে আপনি গর্ভবতী যে, অভিনন্দন!আপনার গর্ভাবস্থার সংবাদটি নিঃসন্দেহে অবশ্যই আনন্দের কিন্তু তা ধীরে ধীরে ক্রমশ চাপা পড়ে যেতে ও স্বাভাবিক একটা ব্যাপারের সমান হতে থাকবে, তবে আপনি নিশ্চই এর মধ্যেই আপনার ডায়েটের ব্যাপারে দু‘বার করে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন।গর্ভাবস্থা স্বাস্থ্যকর পছন্দগুলিকে বেছে নেওয়ার আহ্বান জানায়– আপনি একথা জানেন, কিন্তু এখন আপনার সেগুলি কার্যকর করার সময় এসেছে।গর্ভাবস্থায় আপনি যা কিছুই খাবেন তা আপনার স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আপনার গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলবে।এই সময় আবার এমনকি আপনি সেই সকল স্বাস্থ্যকর মশলাপাতিগুলি ব্যবহারের ব্যাপারেও দ্বিধা বোধ করতে বা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন যেগুলি একসময় আপনার পছন্দের শাক–সবজি এবং ডালের মধ্যে উদার হস্তে যোগ করতেন।আজ আমরা সেধরণেরই একটি মাত্র বিশেষ মশলার ব্যাপারে আলোচনা করব– হলুদ– যা এর ঔষধি বৈশিষ্ট্যাবলীর জন্য পরিচিত।হলুদ নামক এই পীত বর্ণের মশলাটি একজন গর্ভবতী মহিলার জন্য অসংখ্য উপকারিতা নিয়ে আসে, কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় এটি ব্যবহারের ফলে তা আবার ভ্রূণের ক্ষতিসাধন করতে পারে।গর্ভবতী মহিলার জন্য হলুদ নিরাপদ, নাকি নয় তা জানার জন্য আরও পড়ুন।
হলুদ কিছু নির্দিষ্ট বায়ো–অ্যাক্টিভ যৌগ সমন্বিত, যেমন কারকিউমিন যা হলুদের মধ্যে তার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ–বিরোধী বৈশিষ্ট্যাবলী প্রদান করে।এছাড়াও এটি ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, এবং আয়রনের মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ খনিজেও সমৃদ্ধ।উপরন্তু হলুদ আবার ভিটামিন B6 এবং ভিটামিন C এর মত কিছু অপরিহার্য ভিটামিনের এক দুর্দান্ত উৎস।ফাইবার বা তন্তু সমৃদ্ধ হওয়ায় হলুদ আবার একটি অত্যন্ত কার্যকর ঔষধি গুণ যুক্ত মশলায় পরিণত হয়েছে।তাছাড়াও এটি হজম এবং লিভার বা যকৃতের কার্যক্ষমতার উন্নতি ঘটানো, নিয়মিত অন্ত্রের গতিবিধির সহজীকরণ, রক্তজমা লাঘব করা ইত্যাদির মত অগণিত স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি সরবরাহ করে।
নিম্নলিখিত সারণিতে হলুদের পুষ্টি মানের একটি পরিমাণগত অনুমান উপস্থাপন করা হলঃ
পুষ্টি উপাদান | প্রতি টেবিল–চামচে মান(15গ্রাম) |
ক্যালোরি | 42 কিলোক্যালোরি |
কার্বোহাইড্রেট | 7.38 গ্রাম |
প্রোটিন | 1 গ্রাম |
ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ | 1 গ্রাম |
ফাইবার বা তন্তু | 3.21 গ্রাম |
সোডিয়াম | 3 মিলিগ্রাম |
ক্যালসিয়াম | 18.3 মিলিগ্রাম |
আয়রণ | 6.9 মিলিগ্রাম |
হলুদ নামক এই সোনালী মশলাটি যখন দুধের সাথে গ্রহণ করা হয়, তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হয়ে থাকে।এটি গর্ভবতী মহিলাকে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে যা বিকাশকারী ভ্রূণের কঙ্কাল তন্ত্রের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। আপনি গর্ভাবস্থায় হলুদ–দুধ খেতে পারেন কারণ এটি আপনার জন্য প্রচুর উপকারিতা নিয়ে আসবে, তবে সেটি আপনি সংযমের সাথে পরিমিত পরিমাণে পান করা নিশ্চিত করুন কারণ এটি অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে তা আবার আপনার গর্ভস্থ ভ্রূণের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
গর্ভাবস্থায় হলুদ–দুধ খাওয়া হলে তা কোনও গর্ভবতী মহিলার দেহে তার হরমোনীয় ভারসাম্যহীনতার কারণে ঘটে থাকা বিভিন্ন পরিবর্তনগুলি(যেমন জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দুর্বল অনাক্রম্যতা) প্রতিরোধ করতে সহায়তা করতে পারে।যেহেতু এই সময় ক্রমবর্ধিত ভ্রূণ এবং বর্ধিত জরায়ুর কারণে আভ্যন্তরীণ অঙ্গাণুগুলির উপর চাপ বৃদ্ধি হয়, যা গর্ভবতী মহিলাকে কিছুটা কাহিল করে দেয়, তাই এই সময় হলুদ–দুধ পান করলে তা গর্ভাবস্থায় একটি মহিলাকে শক্তি যোগায়।সুতরাং হলুদ দুধ পান করলে তা বমি বমি ভাব এবং অস্বস্তি হ্রাস করে গর্ভাবস্থাকে তুলনামূলক একটি স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক অভিজ্ঞতা করে তোলে।
গর্ভাবস্থায় হলুদ–দুধ পান করায় যে সকল স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি পাওয়া যায় তার একটি তালিকা নীচে দেওয়া হলঃ
হলুদের প্রদাহ–বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় উপশম নিয়ে আসে।গর্ভাবস্থায় অধিকাংশ মহিলার মধ্যেই পায়ের পাতা ফুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকে এবং তাছাড়াও তাদের দেহে জলধারণ এবং হরমোনীয় পরিবর্তনগুলির কারণে অস্থি সন্ধির যন্ত্রণা বা জয়েন্ট পেইনের অভিজ্ঞতাও হয়ে থাকতে পারে।হলুদ এই সকল যন্ত্রণাগুলি নিরাময়ে সাহায্য করে।
হলুদ মধ্যস্থ এর প্রদাহ–বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি সর্দি–কাশি, জ্বর থেকে উপশম আনতে সাহায্য করে।সাধারণ সর্দি–কাশির সাথে গলা ব্যথার নিরাময়ে একটি দ্রুত ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে উষ্ণ হলুদ–দুধ পান করা বেশ কার্যকর হিসেবে পরিচিত।
হলুদ উচ্চ অ্যান্টঅক্সিডেন্ট যুক্ত হওয়ায় সেটি ফ্রী র্যাডিক্যাল বা মুক্ত মূলকগুলিকে অপসারিত করার মাধ্যমে হালকা সংক্রমণগুলিকে দূরে ঠেলে রেখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।হলুদের অ্যান্টিলিপিডেমিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমবর্ধমান কোলেস্টেরলের মাত্রা একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখে। কারকিউমিনের বেশ কয়েকটি উপকারী কারণের জন্য হৃদরোগ প্রতিরোধে এর একটি ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।এটি এন্ডোথেলিয়ামের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং তাছাড়াও এটি হল একটি শক্তিশালী অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি বা প্রদাহ বিরোধী এজেন্ট এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট।
সকল গর্ভবতী মহিলার মধ্যেই গর্ভাবস্থাকালীন ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে না, কিছু মহিলার মধ্যে আবার এমনকি গর্ভাবস্থায় হঠাৎ ব্রণের প্রাদুর্ভাব ঘটে, বিশেষ করে প্রথম ত্রৈমাসিকে হয়ে থাকা হরমোনীয় পরিবর্তনগুলির কারণে, তবে গর্ভাবস্থাকালীন ডায়েটের মধ্যে সোনালী মশলাটির সংযোজন করলে তা ব্রণ রদ করার ক্ষেত্রে প্রভূত সহায়তা করতে পারে।হলুদের প্রদাহ–বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি ব্রণ এবং একজিমা হ্রাস করতে সহায়তা করে এবং তাছাড়াও আবার এর মধ্যে থাকা রক্ত শোধনকারী বৈশিষ্ট্যগুলি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আসে।
এক গ্লাস উষ্ণ হলুদ–দুধ, গর্ভবতী মহিলার মধ্যে হয়ে থাকা অস্বস্তি, যা তাদের একটি গভীর ও গাঢ় নিশ্চিন্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত করে, তা দূর করে তার ভাল ঘুমের সহায়ক ও প্রেরণাকারী হিসেবে পরিচিত।
হলুদ খুব বেশি মাত্রায় খাওয়া হলে, তা গর্ভবতী মহিলার পাশাপাশি তার গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকারক হতে পারে।এর সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলি নিম্নরূপঃ
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত পরিমাণে হলুদ সেবন করলে, তা জরায়ুর পেশী সহ মসৃণ পেশীগুলিতেও সংকোচন সৃষ্টি করতে পারে।আর গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুর সংকোচনগুলি শ্রম বেদনাকে উদ্দীপ্ত করতে পারে যা গর্ভপাতের দিকে পরিচালিত করে।সুতরাং হলুদ সর্বদা সংযমের সাথে পরিমিত পরিমাণেই সেবন করা উচিত। এমনকি পূর্ণ গর্ভদশাতেও বা কোনও মহিলা যখন তার গর্ভাবস্থার 37 সপ্তাহের কাছাকাছি সময়ে এসে উপনীত হন, তখনও এটি অতিরিক্ত পরিমাণে সেবন করা উচিত নয়।
বেশি মাত্রায় কারকিউমিন ভ্রূণের মধ্যে বেশ কিছু ত্রুটি গড়ে তুলতে এবং ভ্রূণের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।যেহেতু কারকিউমিন হল হলুদের মধ্যে থাকা একটি প্রধান উপাদান, তাই সেটি ক্রমবিকশিত ভ্রূণের পক্ষে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।সুতরাং, আপনি যদি গর্ভাবস্থায় এটি সেবন করতে চান, তবে সেক্ষেত্রে তার আগে আপনার ডাক্তারবাবু এবং একজন পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলে নেওয়ার পরামর্শই আপনাকে দেওয়া হয়।
খুব বেশি পরিমাণে হলুদ সেবন করলে তা রক্তক্ষরণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।এটি আবার অস্বাভাবিক এবং অত্যধিক রক্ত জমাট বাঁধারও কারণ হয়ে উঠতে পারে যা আরও জটিলতাগুলি গড়ে তুলতে পারে।হলুদের পরিপূরকগুলিও আবার এমনকি প্রাথমিকভাবে স্পটিং–র কারণ হয়ে উঠতে পারে, সেগুলি সেবন করার পরে।
গর্ভাবস্থায় অত্যধিক পরিমাণে হলুদ সেবন করলে তা গা গুলানো, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, বুক জ্বালা এবং বদ হজমের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য হলুদ দুধের অবশ্যই বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি আছে।তবে গর্ভাবস্থা যেহেতু বিভিন্ন সংক্রমণ এবং টেরোটোজিনিসিটি–র ঝুঁকির এক সাবলীল অবস্থা, তাই পরামর্শ দেওয়া হয় যে গর্ভবতী মহিলারা যেকোন খাবার (ভেষজ এবং মশলা সহ), দোকান থেকে ক্রয় করা অন্যান্য খাদ্যপণ্য বা ওষুধ সামগ্রীগুলি সেবন করার আগে সে ব্যাপারে সর্বাধিক যত্ন নেবেন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।