গর্ভাবস্থা

নবম মাসের গর্ভাবস্থায় ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস (33-36 সপ্তাহ)

গর্ভবতী হওয়া হল এমন একটা সময় যখন আপনি আপনার গর্ভে আশীর্বাদ বহন করে চলেন।আপনি নিজের থেকেও বেশী আপনার সন্তানের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য প্রতিটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে থাকেন।নবম মাসটি হল আপনার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রসবের আগের চূড়ান্ত কয়েকটি দিন।এটি আপনার যতটা বেশী সম্ভব নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেওয়ার সময়।আপনি নিজেকে সঞ্চালনা করতে প্রকৃতই ভীষণ ভারী ও অস্বস্তিকর মনে করবেন,কিন্তু আপনার ছোট্ট সোনাটির সহিত সাক্ষাৎকারের অত্যুৎসাহ এই সকল অসুবিধা-গুলিকেই ছায়াচ্ছন্ন করে তুলবে।

আপনার শিশুটিকে আপনার হাতের ছোঁয়ায় স্পর্শ করার প্রতীক্ষা চলতে থেকে দীর্ঘ নয় মাস ধরে এবং সেক্ষেত্রে প্রতিটি ত্রৈমাসিকেই ভীষণ ভালোভাবে যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে অনেকগুলি বিষয় থাকে,কিন্তু বিশেষ করে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আপনার পাশাপাশি আপনার শিশুরও ভালো ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য আপনার খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মান হওয়া উচিত পরিকল্পিত।

গর্ভাবস্থার নবম মাসের ডায়েট

নয় মাসের মধ্যে আপনার সন্তানের বৃদ্ধি প্রায় শেষ হয়ে যায়।এখন থেকে ধীরে ধীরে তাদের দেহে শিশু ফ্যাট জমতে থাকে এবং ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে।তাদের দুটি অঙ্গ ফুসফুস এবং মস্তিষ্ক পরিণত হতে থাকে।

প্রথম এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের ন্যায় স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার অভ্যাসগুলি বজায় রাখুন কিন্তু এটির পরিমাণ কিছুটা বাড়ান কারণ এই সময়ে শিশুর কিছুটা ওজন বৃদ্ধি করানোর প্রয়োজন।

আপনার গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আপনার খাদ্যের সাথে সংযোজিত হওয়া কিছু অপরিহার্য পুষ্টির উল্লেখ করা হল।

1. উচ্চ তন্তু যুক্ত খাবার খান

আপনার খাদ্যটি হওয়া উচিত স্বাস্থ্যকর সকল প্রকার খাবারের একটা আদর্শ মিশ্রণ।তাজা শাক-সবজি,ফল,দানা শস্য,ওট,রুটি এবং যা কিছুই সম্পূর্ণ দানা শস্য থেকে তৈরী -সমস্ত কিছুই আপনার খাবারের সাথে অন্তর্ভূক্ত করুন।

2. উচ্চ ক্যালশিয়াম সমন্বিত খাবার খান

গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ক্যালশিয়াম যুক্ত খাবারের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন।আপনার সন্তানের বৃদ্ধির সময় থেকেই তার প্রচুর পরিমাণে ক্যালশিয়ামের প্রয়োজন হয় যেহেতু এটি হাড়ের গঠনে শক্তি যোগায় এবং শক্তি বৃদ্ধি করে।

3. উচ্চ আয়রণ যুক্ত খাবার খান

আয়রণের ঘাটতি হল এই সময়ে গর্ভবতী মহিলাদের কাছে আরও বড় ধরণের একটা সমস্যা,যার সম্মুখীন তাদের হতে হয়।যদিও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে আয়রণের সম্পূরক-গুলি দেওয়া হবে তবুও আপনার খাদ্যগুলি হওয়া উচিত আয়রণের মূখ্য উৎস।

কিশমিশ,আলুবোখারা,লাল পালং,ব্রকোলি,চিকেন,কড়াইশুঁটি,বেরী,ডিম, মাছ প্রভৃতি থেকে সহজেই আয়রণ পাওয়া যায়।এগুলি থেকে অন্তত তিন ধরণের খাবার প্রতিদিন খান।

4. উচ্চ ভিটামিন C যুক্ত খাবার খান

প্রচুর পরিমাণে টমেটো,ফুলকপি,স্ট্রবেরী,ব্রকলি,কমলা লেবু ইত্যাদি খান।এগুলি সব-গুলিই উচ্চ ভিটামিন C সমৃদ্ধ যা ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ভালো।

5. উচ্চ ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খান

ফলিক অ্যাসিড আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রয়োজন,মূলত পিঠের শিরদাঁড়ার বিকাশের ক্ষেত্রে।প্রথম ত্রৈমাসিকের পর ফলিক অ্যসিডের জন্য কোনো সম্পূরক দেওয়া হয় না সুতরাং বিনস,সবুজ শাক-সবজি,ছোলা ইত্যাদি জাতীয় খাবার যেগুলি ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ সেগুলিকে আপনার খাবারের সাথে অন্তর্ভূক্ত করুন।

6. উচ্চ ভিটামিন  A সমৃদ্ধ খাবার খান

মায়ের চোখের যত্নের সাথে শিশুর চোখের বিকাশের জন্য ভিটামিন  A এর অত্যাবশ্যক প্রয়োজন।প্রতিদিন অন্তত এক ধরণের ভিটামিন  A সমৃদ্ধ খাবার আপনার খাদ্য-তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করুন।

যদি আপনি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অবস্থান করেন তবে একটাই বিষয় যেটি আপনার মাথায় থাকবে তা হল আপনার প্রসব।সেই কারণে এখানে দেওয়া হল স্বাভাবিক প্রসবের জন্য নয় মাসের গর্ভাবস্থায় আপনার কি খাওয়া দরকার তার বিশদ বিস্তারিত।

Related Post

‘ঘি’ ভীষণ উপকারী একটা খাবার যা শিথিল করতে এবং স্বাভাবিক প্রসব ঘটাতে সাহায্য করে।আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ‘ঘি’ হল একটি ওষুধ যা গর্ভবতী মহিলাদের দেওয়া হয় তাদের গর্ভাবস্থার 7 মাস সময় থেকে।এটি মা এবং বাচ্চা উভয়ের জন্যই ভীষণ ভাবে ভালো।এটি সাহায্য করে-

  • স্বাভাবিক প্রসবে
  • মেজাজের অস্থিরতা প্রশমনে
  • কোষ্ঠকাঠিন্যে
  • পেশী শিথিল করতে ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

যে খাবার-গুলি আপনার গর্ভাবস্থার 9 মাসে আপনার ডায়াটের সাথে সংযুক্ত করতে হবে-

  • তাজা ফল-খাবারের সাথে প্রতিদিন অন্তত দুই ধরণের সংযোজন করুন
  • সম্পূর্ণ শস্য থেকে প্রস্তুত খাবার যেমন চাপাটি অথবা রুটি
  • সব ধরণের সবজি বিশেষ করে সবুজ শাক পাতা
  • দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য যেমন মাখন,ঘি, চীজ ইত্যাদি
  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ,মাংস ইত্যাদি।
  • প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ জল পান করুন কারণ এগুলি আপনার দেহ থেকে সমস্ত বিষ গুলিকে বহিষ্কার করে দিয়ে আপনাকে হাইড্রেট রাখে।

নিজেকে সুস্থ রাখতে সর্বদা স্বাস্থ্যকর খাবার খান,যা আপনাকে সন্তান বহন করার শক্তি যোগাবে।স্বাস্থ্যকর খাবার প্রসবের পূর্বে এবং পরে আপনাকে এবং আপনার সন্তানকে সকল প্রকার জটিলতা-গুলি থেকে দূরে রাখবে।সুষম খাবার গর্ভাবস্থার সাধারণ উপসর্গ-গুলিকে দমন করবে, যেমন গলা-বুক জ্বালা, অম্বল, কোষ্ঠকাঠিণ্যের মত সমস্যাগুলি থেকে দূরে রাখবে।এটি ভ্রূণের সঠিক বিকাশ ঘটায় এবং অবশেষে একটি স্বাস্থ্যকর ছোট্ট শিশুর পরিণতি ঘটিয়ে আপনার এক গুচ্ছ আনন্দকে সুনিশ্চিত করে।

গর্ভধারণের নবম মাসে কোন খাবার-গুলি এড়িয়ে চলতে হবে?

যে খাবার গুলিকে আপনি আপনার গর্ভধারণের শুরু থেকে দূরে ঠেলে রেখেছিলেন,আপনার গর্ভাবস্থার চূড়ান্ত নবম মাসে পৌঁছেও সেই একই খাবার গুলিকেই আপনার এড়িয়ে চলা উচিত।গর্ভাবস্থার নবম মাসে যে খাবার গুলিকে এড়িয়ে চলতে হবে তার একটা তালিকা নিচে লিপিবদ্ধ করা হল।

1. ক্যাফিন

গর্ভাবস্থার যেকোনো পর্যায়ে আপনার ছোট্ট সোনার ক্ষেত্রে এটি উচ্চ মাত্রায় বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত।সবথেকে ভাল উপায় হল এটিকে এড়িয়ে চলা।যদি আপনাকে একান্তই পান করতে হয় তবে সেটি গ্রহণের মাত্রা প্রতিদিন 200 মিলিগ্রামের মধ্যে সীমিত রাখাই উচিত।চকোলেট হল এমন একটি পরোক্ষ খাবার যার মধ্যেও ক্যাফিন সংযুক্ত থাকে সুতরাং সেটির ব্যবহার সীমিত করাই ভাল।

2. অ্যালকোহল বা মাদক দ্রব্য

এটি সব দিক থেকে বিপজ্জনক, তাই গর্ভাবস্থায় সম্পূর্ণরূপে অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।

3. সফট বা নরম চীজ

এই চীজগুলি পাস্তুরাইজড নয় এবং এগুলি আপনার শিশুর মধ্যে একটা ঝুঁকিপূর্ণ সংক্রমণ ঘটাতে পারে যা লিস্টেরিওটিক নামে পরিচিত।সুতরাং এগুলি থেকে দূরে থাকুন।

4. টোবাকো বা তামাক

যদি তামাকের ব্যবহার করে থাকেন তবে তা বন্ধ করুন কারণ এটি আপনার সন্তানের উপর ভীষণ অস্বাস্থ্যকর ভাবে প্রভাব ফেলে।

5. কাঁচা সমুদ্রজাত খাবার

কাঁচা অথবা অর্ধেক রান্না করা সমুদ্রজাত খাবার খাওয়া কঠোর ভাবে এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলিতে ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া থাকতে পারে।

গর্ভাবস্থার ত্রৈমাসিকে শুধুমাত্র স্বাভাবিক খাবারের মাধ্যমে ওমেগা 3 লাভ করা কঠিন। বিশেষ এটির জন্য বিভিন্ন ধরণের খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে।সেগুলির মধ্যে কিছু হল ভেজিটেবিল অয়েল এবং কম মার্কারী আছে এমন ধরণের মাছ।যদি শরীরে ওমেগা 3 এর অপর্যাপ্ততা ঘটে তবে ডাক্তারবাবু এর পরিপূরক নির্ধারণ করেন।তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময় ডাক্তাররা বলেন যে ভ্রূণের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন পূরণের জন্য তার 70 মিলিগ্রামের মত ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রয়োজন হয়।

9-ম মাসের গর্ভাবস্থায় ডায়েটের পরামর্শ

সব রকমের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়ার সেরা উৎস হল পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ,কিন্তু আপনি যদি খাবার থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি শোষণ কর‍্তে না পারেন,আপনার সম্পূরক নেওয়ার প্রয়োজন।এটি সম্পন্ন করা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন।নির্ধারিত কিছু সম্পূরক-গুলি হল-

  • আয়রণ সম্পূরক
  • মাল্টিভিটামিন সম্পূরক
  • ক্যালসিয়াম সম্পূরক
  • মাল্টি মিনারেল সম্পূরক
  • ফলিক অ্যাসিড সম্পূরক

নিম্নতালিকাভুক্ত খাবার গুলিকে যখনই সম্ভব বাদ দিয়ে দিন খাবার অভ্যাস থেকে কারণ সেগুলি কম স্বাস্থ্যকর,এবং অযথা অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি করে ও খুব নিম্ন মানের পুষ্টি সমন্নিত হয়।

  • উচ্চ ফ্যাট এবং মিষ্টি যুক্ত খাবার
  • ভাজা খাবার
  • ক্যান্ডি বা মিছরি জাতীয় খাবার
  • চীজ
  • ডেজার্ট বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার

এই সকল অস্বাস্থ্যকর খাবারের পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে ফল,সবজি,সম্পূর্ণ শস্য এবং দুধ খান।

  • 3 বার বড় ধাপে খাওয়ার পরিবর্তে সেটিকে 6-7 টি ধাপে বিভক্ত করুন।
  • জল হল গুরুত্বপূর্ণ মুখ্য পানীয়,খাবার খাওয়ার মাঝে মাঝে যতটা সম্ভব সেটা পান করুন।
  • কম ফ্যাটযুক্ত দুধ আপনার হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে এবং সন্তান জন্ম দানের পর যত শীঘ্র সম্ভব তাকে বুকের দুধ পান করাতে সাহায্য করে।
  • বাদাম এবং বীজ খান,তবে খুব বেশী নয়, কিন্তু এক মুঠো যা আপনাকে স্বাস্থ্যকর রাখে।
  • গ্যাস-অম্বল,কোষ্ঠকাঠিণ্য এবং ফুলে যাওয়া থেকে আরাম পেতে প্রতিদিন 15-30 মিনিট করে হাঁটুন।
  • আপনার স্বাভাবিক প্রসব ঘটানোর জন্য আপনার গর্ভাবস্থার নবম মাসে আপনার খাদ্যতালিকার সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে ‘ঘি’ এর সংযোজন ঘটান।
  • যোগা অনুশীলন করুন কারণ প্রসারণ পেশী-গুলিকে খুব শিথিল করে আরাম প্রদান করে।
  • মানসিক চাপ ও চিন্তাকে এড়িয়ে চলুন যেহেতু এটি আপনার প্রসবের ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
  • C সেকসন বা সিজার করাকে এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রে জন্ম পূর্ববর্তী কিছু মালিশ করার জন্যও সুপারিশ করা হয়।

সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে,সুষম খাদ্য গ্রহণের সাথে দ্রুত হাঁটা এবং যোগার মত পর্যাপ্ত যোগ-ব্যায়াম সংযুক্ত করলে তা কোনও রকম জটিলতা ছাড়াই একটা মসৃন আরামদায়ক প্রসবে সাহায্য করে যা মা এবং সন্তান উভয়েরই ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে দেয়।

Share
Published by
দেবশ্রী ব্যানার্জী