নির্ধারিত সময়ের পূর্বে প্রসবিত শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করার উপায়

নির্ধারিত সময়ের পূর্বে প্রসবিত শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করার উপায়

একটি অকালে প্রসবিত শিশুর, যাকে অনেক সময় প্রিমি-ও বলা হয়ে থাকে,সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে হয়। মা বা তার তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে, আপনাকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং আপনার শিশুর সর্বোত্তম পুষ্টিকেও নিশ্চিত করতে হবে।

অকাল প্রসবে জন্মানো শিশুর ওজন বৃদ্ধি করার অনেক উপায় আছে। তবে, আপনার বাচ্চার জন্য ওজন-বৃদ্ধির পরিকল্পনাটিকে নির্ধারণ করার আগে, আসুন দেখি অকালে প্রসবিত শিশু বলতে ঠিক কী বোঝায় এবং সেই ধরনের শিশুদের ওজন ঠিক কত হতে পারে।

কোন শিশুকে অকালে প্রসবিত শিশু বলা হয়?

কোনো শিশু যদি গর্ভাবস্থার 37 সপ্তাহ পূরণ হওয়ার আগে প্রসবিত হয় তবে তাকে অকালে প্রসবিত শিশু বলা হয়।

এই ধরনের শিশুদের সাধারণত কতটা ওজন হতে পারে?

পূর্ণ মেয়াদে জন্মানো শিশুদের প্রসবের সময়কার ওজন আনুমানিক তিন কেজি হয়ে থাকে। অকাল প্রসবে জন্মানো শিশুর জন্মের সময়কালের উপর দৈনিক ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ভর করে। যত আগে তার প্রসব হবে, তত তার ওজন কম হবে। অকালে প্রসবিত বাচ্চাদের ওজন সাধারণত 2.3 কেজিরও কম হয়ে থাকে।

জন্মের সময় অত্যন্ত কম ওজন শিশুটির বেঁচে থাকার পক্ষে একটি গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। চিকিৎসাশাস্ত্রের অগ্রগতিকে ধন্যবাদ, কারণ বাস্তবে 800 গ্রাম বা তার বেশি ওজনের এইসব প্রিমিদের শতকরা 90%-এরও বেশি জীবিত থাকতে পারে। বর্তমান সময়ে, যেসব অকাল প্রসবিত শিশুরা প্রায় ৫০০ গ্রামের বেশি ওজন নিয়ে জন্মায়, তাদের প্রায় শতকরা ৬০% বেঁচে থাকে।

ওজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমস্ত নবজাতকরা একটি ছক অনুসরণ করে থাকে। সাধারণত জন্মের পরের প্রথম কয়েকটি দিনে তাদের ওজন কিছুটা হ্রাস পায়। এই ওজন হ্রাস বেশ কিছু কারণে হতে পারে। আপনার প্রসবকে ত্বরাণ্বিত করার জন্য চিকিৎসক যদি বিশেষ কোনো হরমোনের প্রয়োগ করেন, তবে সদ্য জন্মানো শিশুটির মধ্যে কিছুটা তরল থেকে যেতে পারে। সেইসব ক্ষেত্রে, জন্মের পরে শিশুটির চেহারা নিটোল ও স্বাস্থ্যবান হয় কিন্তু শেষপর্যন্ত তার ওজন হ্রাস পেতে থাকে। তবে যদি আপনার বাচ্চাটির ওজন তার শারীরিক ওজনের থেকে শতকরা 10%-এরও বেশি হ্রাস পায়, তবে তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে এবং আপনার অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক ওজন হ্রাসের কারণ সন্ধানের জন্য খাদ্যগ্রহণ এবং মলত্যাগের বৃত্তিগুলিকে বিশ্লেষণ করেন।

জন্মের পঞ্চম দিনের পর থেকে ওজন হ্রাস বন্ধ হয়ে যায়।

আদর্শগতভাবে, শিশুরা 14 দিনের মধ্যে তাদের প্রসবকালীন ওজন ফিরে পায়। কিছু শিশুরা একটু বেশি সময় নিতে পারে। এর ঠিক পর থেকেই তারা ওজন বৃদ্ধি শুরু করে। তারা প্রতি সপ্তাহে প্রায় 112 গ্রাম থেকে 200 গ্রাম পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি করে থাকে এবং তাদের 4 মাস বয়স হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে। অকাল প্রসবিত শিশুদের ক্ষেত্রে ওজন বৃদ্ধি সাধারণত কম হয়। ক্ষুদ্রাকৃতি নবজাতকেরা প্রতিদিন 5 গ্রামের মতো ওজন বৃদ্ধি করে থাকে এবং আকারে বড় শিশুদের ক্ষেত্রে এই ওজন বৃদ্ধি দৈনিক 20 গ্রাম পর্যন্ত হয়।

অকাল প্রসবিত শিশুর বয়স কিভাবে গণনা করতে হয়

অকাল প্রসবিত শিশুদের ওজন স্বাভাবিক কিনা জানতে হলে আপনাকে তার সঠিক বয়স খুঁজে বের করতে হবে। জন্মের তারিখ থেকে তার আসল বয়স আলাদা হবে কারণ শিশুটি নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রসবিত হয়েছে।

শিশুটি যত সপ্তাহ আগে জন্মেছে তত সপ্তাহ বর্তমান সপ্তাহ থেকে কমিয়ে দিন। এর অর্থ এই যে যদি আপনার শিশুটির বয়স 9 সপ্তাহ হয় এবং যদি সে 2 সপ্তাহ আগে প্রসবিত হয়, তবে আপনার শিশুর বৃদ্ধিমাত্রা একটি 9 সপ্তাহ বয়সী শিশুর বদলে একটি 7-সপ্তাহ বয়স্ক শিশুর বৃদ্ধিমাত্রার সঙ্গে যাচাই করতে হবে।

অকালে জন্মানো শিশুর ওজন তালিকা

গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন বয়স (সপ্তাহে) গড় ওজন (গ্রামে) গড় ওজন (আউন্সে) গড়দৈর্ঘ্য (সেন্টিমিটারে) গড় দৈর্ঘ্য (ইঞ্চিতে) মস্তকের গড় পরিধি (সেন্টিমিটারে) মস্তকের গড় পরিধি (ইঞ্চিতে)
23 584 20.6 29.9 11.8 20.9 8.2
24 651 23.0 31.1 12.2 21.8 8.6
25 737 26.0 32.3 12.7 22.7 8.9
26 827 29.2 33.6 13.2 23.6 9.3
27 936 33.0 35 13.8 24.5 9.6
28 1061 37.4 36.5 14.4 25.5 10.0
29 1204 42.5 38 15.0 26.5 10.4
30 1373 48.4 39.5 15.6 27.5 10.8
31 1546 54.5 41 16.1 28.4 11.2
32 1731 61.1 42.3 16.7 29.3 11.5
33 1956 69.0 43.7 17.2 30.2 11.9
34 2187 77.1 45 17.7 31.1 12.2
35 2413 85.1 46.2 18.2 31.9 12.6
36 2664 94.0 47.4 18.7 32.7 12.9
37 2937 103.6 48.5 19.1 33.3 13.1
38 3173 111.9 49.5 19.5 33.7 13.3
39 3338 117.7 50.2 19.8 34 13.4
40 3458 121.8 50.8 20.0 34.3 13.5
41 3530 124.5 51.3 20.2 34.5 13.6

দ্রষ্টব্য: প্রদত্ত পরিমাপগুলি গড়পড়তা হিসেবে প্রযোজ্য এবং একটি স্বাস্থ্যবান শিশুর আকার বড় বা ছোটও হতে পারে।

কখন অকালে জন্মানো শিশুগুলির ওজন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে?

প্রিমিদের ওজন বৃদ্ধি অনেক কারণের উপর নির্ভর করে। তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলির মধ্যে অন্যতম হল শিশুটির জন্মক্ষণ। জন্মের কয়েকদিন পর থেকেই তারা তাদের ওজন বৃদ্ধি করতে শুরু করে দেয়।

অকালে জন্মানো শিশুদের পরিপূর্ণ লালনপালন

স্তন্যদুগ্ধ পান করানো, বাচ্চার সুস্থভাবে ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং এটি বাচ্চার সুবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম। মাতৃদুগ্ধ একটি অকালে প্রসবিত শিশুর শক্তি এবং স্বাস্থ্য নির্মাণ করার সেরা উপায়। এটি তাদের পরিপাক নালীর বৃদ্ধিতে এবং সমস্ত ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করবে।

কোলোস্ট্রাম হল আপনার স্তনে উৎপাদিত প্রথম দুধ, এবং এটি থেকেই আপনার বাচ্চার খাদ্য গ্রহণ শুরু হওয়া উচিত। কোলোস্ট্রাম সম্পূর্ণভাবে পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং এটি আপনার শিশুর বর্তমান সময়ের অপরিহার্য পুষ্টিগুণগুলির চাহিদা পূরণ করে।

প্রিমিদের খাদ্যপ্রবণতা অনুসারে খাদ্য প্রদানের একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুসরণ করা উচিত। আপনি আপনার শিশুকে খাদ্যপ্রদানের সময়গুলিকে নথিভুক্ত করে রাখুন এবং তাকে নিয়মিত বিরতির অন্তরে খাওয়াতে থাকুন। এই ভাবে আপনার শিশুটি সঠিক সময়ে তার অপরিহার্য পুষ্টিগুলি পেতে পারে। কত ঘন ঘন শিশুটিকে খাওয়ানো দরকার তা আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন। আপনার চিকিৎসক হয়ত আপনাকে প্রতি 2 থেকে 3 ঘন্টার বিরতিতে বাচ্চাটিকে খাওয়ানোর নির্দেশ করতে পারেন এবং এটিকে পালন করা বাচ্চার ঘুমের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার শিশুর বয়স 4 থেকে 5 মাস হলে তাকে কিভাবে শক্ত খাবারে অভ্যস্ত করা যায় সে বিষয়ে আপনার চিকিৎসক পরামর্শ প্রদান করতে পারেন।

প্রসবের প্রাথমিক সপ্তাহগুলিতে প্রিমিদের কিভাবে খাদ্য প্রদান করা উচিত?

একজন নবজাতকের রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আপনার শিশুর বর্তমান অবস্থাগুলিকে বিচার করার পর, তার জন্য জন্মের প্রাথমিক সপ্তাহগুলিতে খাদ্যপ্রদানের সর্বোত্তম উপায় সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে থাকেন। অকালে প্রসবিত শিশুদের খাদ্যপ্রদানের উপায়গুলির মধ্যে কয়েকটি হল:

আই ভি (ইন্ট্রাভেনাস লাইন)  প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্যপ্রদান

শিশুটির হাত,পা অথবা মস্তিষ্কের সঙ্গে একটি আই ভি নল স্থাপনের দ্বারা তাকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং পুষ্টিগুলিকে তরলাবস্থায় প্রদান করা হয়। সঠিক সময়ের অনেক আগে জন্মানো শিশুদের ক্ষেত্রে, ফুসফুস সম্পূর্ণরূপে বিকশিত না হওয়ার দরুণ শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা থাকলে এবং পাচক অঙ্গসমূহ অপরিণত থাকলে, এই পদ্ধতিটি খাওয়ানোর জন্য পছন্দ করা হয়।

মুখ এবং নাসিকার মাধ্যমে খাওয়ানো

নাসাল ফিডিং বা নাসিকাদ্বারা খাদ্যপ্রদানের (যা গ্যাভেজ ফিডিং বা কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নাসিকার মাধ্যমে খাদ্য প্রেরণ করার পদ্ধতি নামেও পরিচিত ) মাধ্যমে বাচ্চাটির জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃদুগ্ধ বা ফরমূলা দুধ সরাসরি শিশুর পাকস্থলীতে বা পেটে তাদের নাক বা মুখের ভিতর দিয়ে টিউবের দ্বারা প্রেরণ করা হয়। এই পদ্ধতিটি, যে সব শিশুদের হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুস অপরিণত ও দুর্বল এবং দেহের সমন্বয়সূচক সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয়।

আম্বিলিকাল ক্যাথিটার (নাভিতে নলস্থাপনমূলক একটি পদ্ধতি)

আপনার শিশুটিকে খাওয়ানোর জন্য এটি একটি যন্ত্রণাহীন উপায়, যেখানে চিকিৎসক আপনার শিশুর নাভির অন্তস্থ নাড়িতে একটি নল সংযুক্ত করে। যেহেতু এতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি, এবং তাই এটি শুধুমাত্র সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতিগুলির ক্ষেত্রেই সুপারিশ করা হয়।

বোতল ও স্তন্য দ্বারা খাদ্যপ্রদান

যখন শিশুটি চুষতে এবং তা উদরস্থ করতে সক্ষম হয়, তখন স্বাস্থ্যবিদরা আপনাকে স্তন্যদুগ্ধ খাওয়ানোর প্রচেষ্টাতে সহায়তা করবেন।

সেন্ট্রাল লাইন ফিডিং

সেন্ট্রাল লাইন ফিডিং

একটি আই ভি নল আপনার শিশুর শিরাতে প্রবেশ করানো হয় যার মাধ্যমে আপনার শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ হয়।

আপনার শিশুর সম্পূর্ণ পরিণত হতে সাহায্যকারী পরিচর্যাসমূহ

  • সঠিকভাবে চর্মস্পর্শও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি আপনার বাচ্চার ওজনকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে, তাদের উষ্ণ রাখে, তাদের হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের গভীর নিদ্রা সুনিশ্চিত করে এবং স্তন্যদুগ্ধ পানের সম্ভাবনাও বাড়ায়।
  • মালিশও আপনার শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
  • মনে রাখবেন এই জাতীয় জটিল পরিস্থিতিতে আপনার চিকিৎসকের দ্বারা বাচ্চার নিয়মিতভাবে ওজন পরীক্ষা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলিতে বিন্দুমাত্রও অবহেলা করবেন না।
  • আপনার শিশুকে আদর করুন, তার প্রতি মনোযোগ দিন এবং তাকে খুশি রাখুন।

উপসংহার

অকালে প্রসবিত শিশুরা অতিশয় পলকা ধরনের হয়ে থাকে এবং একটি বিশেষ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তাদের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। শুভ সংবাদ হল তাদের বেঁচে থাকার সাফল্যের হার যথেষ্ট বেশি এবং সঠিকভাবে ওজন বৃদ্ধি এই বেঁচে থাকাটিকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। প্রদত্ত পরামর্শগুলি আপনার প্রিমির ওজন বৃদ্ধিকে নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।