একটি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোটা মোটেই কোনও সহজ কাজ নয় এবং অধিকাংশ নতুন মায়েরই তাদের ছোট্ট সোনাকে সঠিকভাবে বুকের দুধ পান করানোর প্রক্রিয়াটি শিখতে কিছুটা সময় লাগে।একবার মা এটি রপ্ত করে নিলে, তার শিশুটিও ঠিকভাবে খেতে শিখে যায়, আর স্তন্যপান করানোর এই সময়পর্বটি মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই সামগ্রিকভাবে একটি সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলতে প্রভূত সহায়ক হয়ে ওঠে।যাইহোক, তবে সব মায়ের ক্ষেত্রে কিন্তু স্তন্যপান করানোটা সহজ হয়ে ওঠে না।একজন স্তন্যদানকারী মা হিসেবে আপনি হয়ত আপনার আদরের ছোট্টটিকে বুকের দুধ খাওয়ানোকে আনন্দের সাথে উপভোগ করবেন তবে তার সাথে আবার ক্ষত যুক্ত, ফাটা, চিড়ে যাওয়া কিম্বা রক্ত ক্ষরণ হতে থাকা স্তনবৃন্তের মত কিছু নিরানন্দজনক অভিজ্ঞতাগুলিরও মুখোমুখি হতে পারেন।এগুলি হল এমন কিছু ব্যাপার যেগুলি বেশিরভাগ মায়েরাই তাদের ছোট্ট শিশুর জন্য সহ্য করে নেন।আপনারও যদি এরকম ফেটে যাওয়া, চিড়ে যাওয়া কিম্বা রক্ত ক্ষরিত হতে থাকা স্তনবৃন্ত দেখা দেওয়ার মত সমস্যা সৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে সেগুলি হওয়ার কারণ কি এবং কীভাবেই বা তার চিকিৎসা করা যায় তা জানতে আমাদের লেখনিটি পড়ুন।
আপনি যখন বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করেন, তখন আপনার স্তনবৃন্তে নমনীয়তা উপলব্ধি করাটা বেশ সাধারণ।যদিও জ্বলন এবং দংশন সংবেদন ও তার সাথে জড়িত কিছু ব্যথা–বেদনা থাকাটা সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক, কিন্তু ফেটে বা চিড়ে যাওয়া, রক্ত ক্ষরিত হতে থাকা কিম্বা ক্ষত যুক্ত স্তনবৃন্তের ক্ষেত্রে চিকিৎসাগত মনোনিবেশ করানোর প্রয়োজন হতে পারে।বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলাদের মধ্যে স্তনবৃন্ত ফেটে বা চিড়ে যাওয়া অথবা তা থেকে রক্ত ক্ষরিত হতে থাকা সাধারণত বহুবিধ কারণে হয়ে থাকতে পারে যেগুলি সম্পর্কে আমরা পরবর্তী অংশে আলোচনা করব।
বুকের দুধ খাওয়ানোর শুরুর দিকে, বাচ্চারা সাধারণত স্তন চোষণ করে পান করতে পারে না আর তা তাদেরকে শেখানোটা মায়েদের কাছে যেন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।বাচ্চা যদি মায়ের স্তন ঠিকমত চোষণ না করে সেক্ষেত্রে মায়ের স্তনবৃন্ত ফেটে বা চিড়ে যেতে পারে অথবা তার থেকে রক্তও ক্ষরিত হতে থাকে।বাচ্চা কীভাবে তার মায়ের স্তনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে তা নির্দেশ করে তার ল্যাচিং বা চোষণ করার প্রক্রিয়াটি।বেশিরভাগ মায়েরাই এই সমস্যাটি ভোগ করে থাকেন তাদের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরুর প্রথম কয়েকটি দিন এবং ধীরে ধীরে সঠিকভাবে শিশুরা তা চোষণ করতে শিখে গেলে তা দূর হয়ে যায়।
আপনি যখন বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করেন, মাঝে মাঝেই আপনি আপনার বুকের দুধে রক্ত লক্ষ্য করতে পারেন।তবে, যদি আপনার কোনও ব্যথা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে স্তন্যপান করানোর প্রথম সপ্তাহে আপনার স্তনবৃন্ত থেকে হওয়া এই ক্ষরণটির মধ্যে রক্তপাত হয়ে থাকতে পারে শুধুই আপনার স্তনের মধ্যে বর্ধিত রক্ত প্রবাহের জন্য এবং দুগ্ধ উৎপাদনকারী টিস্যুগুলির বৃদ্ধির কারণে।এটি কোনও চিকিৎসা জনিত হস্তক্ষেপ ছাড়াই কয়েক দিনের মধ্যে সেরে ওঠা উচিত।তবে, যদি প্রতিবার খাওয়ানোর পরেই আপনার স্তনবৃন্তগুলি লাল, সূচালো এবং ক্ষত যুক্ত হয়ে ওঠে(গোলকাকার এবং মসৃণ হওয়ার পরিবর্তে) সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবু কিম্বা একজন স্তন্যদান বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন হতে পারে।
স্তনবৃন্তের সংবেদনশীল ত্বকটি নিম্নলিখিত যেকোনও কিম্বা সবগুলি কারণেই প্রভাবিত হতে পারেঃ
1.ভুল চোষণের দ্বারা স্তন্যপানঃ শিশু যদি ঠিকমত স্তন চোষণ না করে দুধ পান করে সেক্ষেত্রে স্তনের ক্ষত বেড়ে যেতে পারে।খাওয়ানোর জন্য শিশুর স্তন চোষণ প্রক্রিয়াটির পরিবর্তন করলে তা হয়ত এই সমস্যাটির সমাধান করতে পারে।
2.শুষ্ক ত্বক বা একজিমাঃ জামা–কাপড়ের ডিটারজেন্ট, পারফিউমের উত্তেজকগুলি, সাবান, ক্রিম এবং লোশন, এয়ারকন্ডিশন, কুলার ও হিটার ব্যবহারের ফলে শুষ্ক বায়ু– এই সবকিছুই একজিমার কারণ হতে পারে।আর এগুলি স্তনবৃন্তে ক্ষত ও বেদনার সৃষ্টি করতে পারে।
3.ব্রেস্ট পাম্পের ভুল ব্যবহারঃ ব্রেস্ট পাম্পের ভুল ব্যবহার আপনার স্তনের টিস্যু বা কলাতে আঘাতের কারণ হতে পারে এবং তার ফলে স্তনবৃন্ত ফেটে বা চিড়ে যেতে পারে ও তার থেকে আবার রক্তও ক্ষরিত হতে পারে।ফ্ল্যাঞ্জের আকারটি যদি ভুল হয় এবং অস্বস্তিকারক গতিতে পাম্প করা এবং সাকশান সেটিং করা হয়, তবে সেটিও স্তনবৃন্ত ফেটে বা চিড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
4.থ্রাশঃ এটি হল স্তনবৃন্তের ত্বকের ওপর হয়ে থাকা ইস্ট জনিত একটি সংক্রমণ, যেটিও স্তনবৃন্তে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।আর এই সংক্রমণটি আবার আপনার শিশুর মুখের ভিতরেও হতে পারে।
5.শিশুদের মধ্যে টঙ–টাই(বদ্ধ–জিহ্বা):আপনার শিশুর জিহ্বাটি যদি বদ্ধ বা অবরুদ্ধ প্রকৃতির হয়ে থাকে,সে খাওয়ার সময় সমস্যার মুখে পড়বে এবং স্তনবৃন্তগুলিকে তাদের জিহ্বা দ্বারা ঠেলতে থাকবে।এটি বেদনাদায়ক স্তনবৃন্ত এবং অস্বস্তির সৃষ্টি করতে পারে।
যন্ত্রণাবহুল স্তনবৃন্ত থাকা মায়েদের পক্ষে তাদের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।স্তন্যপান করানোর চিকিৎসায় শিশুকে দুধ পান করানো, দেখাশোনা এবং পরিচর্যার কৌশলের মধ্যে কিছু সাধারণ এবং সামান্য সামঞ্জস্য রয়েছে যা আপনাকে স্তনবৃন্তে আঘাত পাওয়া বা বেদনাদায়ক স্তনবৃন্তগুলি এড়াতে সহায়তা করে।আসুন আমরা রক্ত ক্ষরণ হওয়া স্তনবৃন্তগুলির জন্য এমন কিছু চিকিৎসার সন্ধান করি যা কোনও মাকে তার স্তনবৃন্ত ফেটে বা চিড়ে যাওয়া অথবা সেখানে ক্ষত সৃষ্টি হলে তা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করতে পারে।
স্তন পানের জন্য শিশুর চোষণ প্রক্রিয়ার সংশোধন
ফাটা বা চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তের চিকিৎসা শুরু করা হয় শিশুর স্তন চোষণ করার পদ্ধতির সাথে।যদি চোষণের সময় স্তনবৃন্তের সম্মুখভাগটা বাচ্চার মুখের ভিতরে থাকে, তখন বাচ্চার জিভটি সামনের দিকে উঠে আসলেই মা একটা চিমটির ন্যায় ব্যথা বোধ করবে, আর তা মা এবং শিশু উভয়ের মধ্যেই একটা অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
তবে, যদি আপনার শিশুটি তার মুখটি প্রশস্ত করে এবং স্তনের টিস্যুগুলির একটি অংশ জুড়ে চোষণ করে, তবে স্তনবৃন্তগুলি শিশুর মুখের পিছনের দিকে আরামদায়কভাবে অবস্থান করে, যেখানে শক্ত এবং নরম তালু মিলিত হয়, আর চিমটি লাগার কোনও জায়গাই থাকে না।এই অবস্থায় স্তনবৃন্তগুলি আঘাতপ্রাপ্ত হয় না।
ক্রিমের ব্যবহার
ফাটা বা চিড়ে যাওয়া স্তনের জন্য অনেক মায়েরা ল্যানোলিন মলম ব্যবহার করেন।রক্ত ক্ষরণ যুক্ত স্তনবৃন্তগুলির জন্য এই চিকিৎসাটিকে আবার আর্দ্র ক্ষত নিরাময় হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।এটি ব্যথা প্রশমিত করে এবং স্তনের উপরের ক্ষতটি শীঘ্রই নিরাময় করতে সাহায্য করে।
সাবান এবং লোশনগুলি এড়িয়ে চলা
ফাটা বা চিড়ে যাওয়া অথবা ক্ষত যুক্ত স্তনবৃন্তের ওপর কোনওরকম সাবান, লোশন এবং পারফিউম ব্যবহার না করার পরামর্শই সর্বদা দেওয়া হয়ে থাকে।ফেটে বা চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তের সবচেয়ে ভাল চিকিৎসাটি হল পরিষ্কার জল দিয়ে সেটি ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া।
বিঃদ্রঃ আপনি যদি নিপল শিল্ড ব্যবহার করেন তবে সংক্রমণ এড়াতে সেগুলি ভালমত নির্বীজন করে নেওয়া সুনিশ্চিত করুন।
বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় ফাটা বা চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তের মোকাবিলা করার বিভিন্ন উপায় আছে।এই চিকিৎসাটি বেশ কিছু সহজ উপায়ের দ্বারা পরিচালনা করা যেতে পারে।বাচ্চাকে স্তন পান করানো, দেখাশোনা ও পরিচর্যা করার সময় আপনার ফাটা ও চেড়া স্তনবৃন্তের মোকাবিলা করার বেশ কিছু উপায়ের ইঙ্গিত এখানে দেওয়া হল কারণ যন্ত্রণাদায়ক স্তনবৃন্তের সাথে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোটা মায়ের পক্ষে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
স্তন্যদানের পূর্বে
স্তন্যদানের সময়
স্তন্যদানের পরবর্তীতে
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় ফাটা বা চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে আপনি বেশ কয়েরকটি ঘরোয়া প্রতিকার প্রয়োগ করতে পারেন।তার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিকার আমরা ইতিমধ্যেই উপরিল্লিখিত অংশে আলোচনা করে ফেলেছি।এরপর আরও অতিরিক্তভাবে আপনি যেগুলি করতে পারেনঃ
ফাটা–চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তের জন্য কয়েকটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি নিম্নরূপঃ
ফেটে বা চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তগুলি যদিও মায়েদের জন্য ভীষণই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে তথাপি বাচ্চারা সাধারণত সেগুলিকে অবজ্ঞা করে চলে।দুধের মধ্যে সামাণ্য রক্তের উপস্থিতি বাচ্চার ক্ষতি করবে না।আপনি যদি যন্ত্রণাটা সহ্য করতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে আপনার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শই আপনাকে দেওয়া হয়।আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত বাচ্চাকে দক্ষতার সাথে খাওয়ানো শিখতে সহায়তা করা যাতে আপনার স্তনবৃন্তগুলি দ্রুত নিরাময় হয়ে উঠতে পারে যদি সেটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে তবে আপনার বুকের দুধ পাম্প করে বের করে তা ফিডিং বোতলে ভরে সেই বোতলটির সাহায্যে আপনার শিশুকে খাওয়ানোর বিষয়ে বিবেচনা করুন।
যদিও বুকের দুধ পান করানোর সময় স্তনবৃন্ত ফেটে বা চিড়ে যাওয়ার বিষয়টি হল একটি স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনা, তবুও যদি সেটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে এবং আপনার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়, তবে সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করা নিশ্চিত করুন।অবস্থার আরও অবনতির জন্য একদম অপেক্ষা করবেন না।যদি সময়ের মধ্যে আপনার স্তনবৃন্তের ক্ষত নিরাময় হয়ে না ওঠে আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন।
স্তন্যদান হল মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই একটি আনন্দদায়ক অনুভূতির অভিজ্ঞতা। সুতরাং এটিকে উপভোগ করুন, আর যদি ফাটা বা চিড়ে যাওয়া স্তনবৃন্তের মত সমস্যাটি অব্যাহত রয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন চিকিৎসক অথবা স্তন্যদান বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা মারফৎ পরামর্শ গ্রহণ করুন।