আপনি গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি উদ্ঘাটিত হওয়ার পরে সবার প্রথম যে বিষয়টি মাথায় আসে তা হল-“পরবর্তী 9 মাসের জন্য– মাসিক বা পিরিয়ডের কোনও ঝুট–ঝামেলা নেই!”গর্ভদশার ক্রম–অগ্রগতির সাথে সাথে আপনার দেহের মধ্যেও সমানে নানা ধরনের ক্রিয়া হতে থাকে, আর এই সমস্ত ধরণের পরিবর্তনগুলি পরবর্তী 37-42 সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে।দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে এই পৃথিবীতে সন্তানের আবির্ভাব ঘটে কিন্তু আপনার শরীরের মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তনগুলি অব্যাহত থেকে যায়।এই সকল পরিবর্তনগুলির মধ্যেই একটি হল আপনার বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি প্রলম্বিত প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ হতে থাকবে– যা লোচিয়া নামে পরিচিত।
প্রসবোত্তর রক্তপাত বা লোচিয়া হল এমন একটি প্রয়োজনীয় নিরাময় প্রক্রিয়া যা প্রসব পরবর্তীতে আপনার শরীরে হওয়া ধকল নিরাময়ে সাহায্য করে।গর্ভের মধ্যে আপনার সন্তানের পরিচর্যা করে থাকা, তাকে পুষ্টি দেওয়া অমরাটি আপনার শিশুর জন্মের পরপরই সাধারণত বেরিয়ে যাবে এবং জরায়ুর আস্তরণ থেকে পৃথক হয়ে যাবে।জরায়ুর সাথে অমরা যুক্ত থাকার জায়গায় কিছু রক্তবাহ খোলা থাকবে।আর জরায়ুর অভ্যন্তরের এই রক্তনালীগুলি থেকে রক্তপাত হতে শুরু হবে।এই রক্তই জন্ম নালিকা দিয়ে যোনিতে যাবে।আর এর সাথে থাকে জরায়ুর আস্তরণের টিস্যু বা কলাগুলি ।
লোচিয়া ডিসচার্য বা স্রাব হল ঠিক মাসিকের মতই, এর একমাত্র পার্থক্য হল এই যে, এটি কিছুটা দীর্ঘতর এবং মারাত্মক প্রকৃতির বা তীব্র হয়ে থাকে।প্রসবের পরে প্রথম 2-3 দিনের জন্য ভারী রক্তপাত হবে এবং এর মধ্যে জমাট বাধা রক্তের ডেলাও থাকতে পারে।এর কয়েকদিন পর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে প্রবাহটি ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।প্রবাহের রঙ গাঢ় লাল থেকে বাদামি এবং অবশেষে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জরায়ু নিরাময়ের পরে হলদেটে–সাদা হয়ে যাবে।
লোচিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে গঠিত হয়ঃ
যদি আপনার যোনি পথের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসব হয়ে থাকে, তবে জন্ম নালিকা মারফৎ আপনার দেহ থেকে লোচিয়া নির্গমন হবে।বেশ কয়েকটি সংকোচন হবে এবং যোনিপথের মধ্য দিয়ে এটি বাইরে বেরিয়া আসবে।আর আপনার যদি সিজারিয়ান বা অস্ত্রপচারের পর্বটি হয়ে থাকে তবে অমরা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হবে। যে কোনও ক্ষেত্রেই, প্রসবের পরবর্তীতে আপনি রক্তপাতের অভিজ্ঞতা পাবেন।
দয়া করে নোট করবেন যে লোচিয়া কিন্তু কোনও পিরিয়ড বা মাসিক নয়।প্রসবের পর আপনার মাসিক বা ঋতুস্রাব ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে। স্তন্যদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে তাদের প্রথম মাসিক শুরু হতে পারে প্রসব পরবর্তী প্রায় 6 মাসে, আর আপনি যদি ফরমূলা খাইয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনি প্রসবের 6 সপ্তাহ পরেই তা দেখতে পাবেন।
স্রাবের বর্ণের ওপর নির্ভর করে লোচিয়াকে তিনটি ধরণ বা পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।যেখানে প্রতিটি পর্যায়ের সময়ের দৈর্ঘ্য পৃথক পৃথক হবে।
এটি ভারী রক্ত প্রবাহের সাথে হয়ে থাকা একটি পর্যায় যা প্রসবের পরে প্রায় 3-4 দিন চলবে। এ সময় রক্ত স্রাবটি গাঢ় লালচে বর্ণের হয়ে থাকে।এটি প্রধাণত গড়ে ওঠে ঘন রক্তের বড় আকারে জমাট বাঁধা অংশ, ভ্রূণের ঝিল্লি, মেকোনিয়াম (নবজাতকের কালো রঙের প্রথম মল), ডেসিডুয়া এবং জরায়ুর স্রাবের সাথে।যেহেতু এই সময় জমাট বাঁধা রক্তের ড্যালাগুলি দেহ থেকে নির্গত করার জন্য জরায়ুটি ব্যাপক সঙ্কুচিত হবে তাই আপনি হয়ত মাসিক ক্র্যাম্পের মতই বেদনাদায়ক খিঁচুনিগুলি অনুভব করতে পারেন।যদি ভারী স্রাব 7 দিনের বেশি স্থায়ী হয় বা আপনার অস্বাভাবিক ভারী রক্তপাত হয় বা বড় আকারের জমাট বাঁধা রক্তের ড্যালা বেরোতে থাকে তবে সেক্ষেত্রে এটি জরায়ুর অভ্যন্তরে অমরার কিছু অংশ থেকে যাওয়ার একটা চিহ্ন হয়ে থাকতে পারে।এর ফলস্বরূপ একটি সংক্রমণ বা রক্তক্ষরণ হয়ে থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আপনার অবিলম্বে চিকিৎসা জনিত মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
রক্তের ঘনত্ব ক্রমশ পাতলা হতে শুরু করবে এবং রক্ত স্রাবের রঙ গাঢ় লাল থেকে বাদামীতে পরিবর্তিত হবে এবং প্রসবের পরে প্রায় 7-10 দিনের মধ্যে তা ধীরে ধীরে হলদেটে হয়ে যাবে।স্রাবটিতে খুব কম সংখ্যক লোহিত রক্ত কণিকা এবং অধিকাংশ শ্বেত রক্তকণিকা, জরায়ুর শ্লেষ্মা এবং প্ল্যাসেন্টা বা অমরা থেকে কিছু তরল থাকবে।এই পর্যায়টি প্রায় তিন থেকে চার সপ্তাহ ধরে চলবে।যদি ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এটি অব্যাহত থাকে, সম্ভাব্য জটিলতাগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি মূল্যায়নের জন্য আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
আরও এক সপ্তাহ বা তারও কিছু পরে, আপনি লক্ষ্য করবেন যে স্রাবটি ক্রমশ সাদাটে হয়ে যাবে এবং স্রাবে রক্তের দাগের পরিমাণ কমে যাবে।এটি প্রায় পনেরো দিন মত চলবে।এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্লেষ্মা, শ্বেত রক্তকণিকা, ডেসিডুয়া এবং এপিথেলিয়াল কোষগুলি নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে।এটি লচিয়ার শেষ পর্যায় এবং জরায়ুর সম্পূর্ণ নিরাময়ের প্রতিনিধিত্ব করে ।এই সর্বশেষ পর্যায়টির পরে লোচিয়ায় হয়ে থাকা রক্ত স্রাবের দাগটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
লোচিয়া হল প্রসবের পরবর্তীতে প্রতিটি মহিলার মধ্যে হয়ে থাকা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।এটি কোনও রোগ বা গর্ভাবস্থার জটিলতা নয়। যেমনটি আগে আলোচনা করা হয়েছিল, ডেলিভারি বা প্রসবের পরে জরায়ু আস্তরণের স্খলনের কারণে এটি ঘটে।প্রসবের পরে দেহের নিরাময় হওয়া প্রয়োজন, এবং জরায়ুটিও তার গর্ভাবস্থার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া দরকার।
যাইহোক, তবে আপনি যদি অস্বাভাবিক পরিমাণে কিম্বা দীর্ঘমেয়াদে লোচিয়ার অভিজ্ঞতাটি পেয়ে থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
লোচিয়া চলাকালীন নিম্নোলিখিত উপসর্গগুলি আপনার দেখা দিতে পারেঃ
গড়ে, লোচিয়া প্রসবের পর থেকে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে থাকে।প্রাথমিক পর্যায়ে গাঢ় ও ভারী প্রবাহ থেকে নিয়মিত ঋতুস্রাব হওয়ার মত হয় যা দাগ দেখা দেওয়ার 1 সপ্তাহ পর থেকে 15 দিন পরে ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।যাই হোক না কেন, প্রসবের ছয় সপ্তাহ পরে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত।
প্রসবের পর লোচিয়া হওয়াটা পুরোপুরি স্বাভাবিক এবং নিরাময় বা আরোগ্যলাভের জন্য এটা হওয়াটাও জরুরী।আপনার কেবল প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখাকে নিশ্চিত করতে হবে এবং এই সময়টি অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন নেওয়া উচিত।
লোচিয়া গাঢ় লাল হবে এবং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ক্রমশ তা বাদামি এবং হলদেটে বর্ণ ধারণ করবে।আপনি আপনার স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপরেই লোচিয়া দেখতে সক্ষম হবেন।সময়ের সাথে এর প্রবাহটি হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে এর দাগগুলিও হ্রাস পেতে থাকবে।আপনি শেষ কয়েকদিন প্যান্টি লাইনারগুলি ব্যবহার করতে পারেন।
আপনি যোনি পথে সাধারণ প্রসব বা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে যেভাবেই শিশুর জন্ম দিন না কেন আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্ত এবং কলাগুলিকে মুক্ত হবে।অস্ত্রপচারের মাধ্যমে প্রসবের পরে হয়ে থাকা রক্তপাতটিও স্বাভাবিক প্রসবের পরে হয়ে থাকা রক্তপাতের মতই একই সময় ধরে এবং পরিমাণেও প্রায় একই হবে।
যদি আপনি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলির কিছু অনুভব করেন তবে আপনাকে অবিলম্বে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।এক্ষেত্রে সম্ভবত আপনি জরায়ুর কোনও সংক্রমণে ভুগতে পারেন, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ হয়ে থাকতে পারে অথবা অমরার কোনও টুকরো থেকে যেতে পারে যেটি আবার জরায়ুর প্রাচীরের সাথে এখনও সংযুক্ত রয়ে যেতে পারে।
প্রসবোত্তর পর্যায়ে লোচিয়া স্বাভাবিক।এটা এমন কোনও রোগ নয় যার জন্য নজর রাখা উচিত, তবে এটি একটি প্রাকৃতিক স্খলন প্রক্রিয়া যা প্রতি গর্ভদশার পরবর্তীতেই হয়ে থাকে।এক্ষেত্রে কয়েকটি করণীয় এবং অকরণীয় বিষয় রয়েছে যেগুলি প্রসবোত্তর নিরাময় প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে।এই প্রক্রিয়াটি একবার সমাপ্ত হয়ে গেলে সেটা পুনরায় কেবলমাত্র তখনই হবে যদি আপনি আবার অন্য আরেকটি প্রসবক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকেন।তাই অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, আপনার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখুন।