চিকিৎসা বিজ্ঞানের এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগের ব্যাপক উন্নতির ফলে ডাক্তার বাবুদের গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের খুঁটিনাটি বিষয়ে নিরীক্ষণ করা এবং গর্ভস্থ শিশু ও তার মায়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন হলে সেইমত হস্তক্ষেপ করা সম্ভবপর হয়ে উঠেছে।গর্ভস্থ শিশুর এই পর্যবেক্ষণ,প্রসব এবং শিশুর জন্মদান প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণকেই বলা হয় ভ্রূণ নিরীক্ষণ।
শ্রম বেদনা এবং প্রসবের সময় আপনার ডাক্তারবাবু সর্তকতার সাথে ছোট্ট হৃদপিণ্ডটির অবস্থান এবং আপনার সংকোচনের প্রতি এটির প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করার জন্য শিশুটির হৃদস্পন্দন নিরীক্ষণ করবেন।এই নিরীক্ষণ প্রসবের আগেও করা হয়ে থাকে আপনার নিয়মিত চেক আপ পর্বে অথবা আপনি যদি আপনার পেটের মধ্যে শিশুটির পদাঘাতের পুণরাবৃত্তির হারের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেন সেক্ষেত্রে।ভ্রূণ নিরীক্ষণের মাধ্যমে অনিয়মিত হৃদস্পন্দের হার ধরা পরে যা ভবিষ্যতে শিশুটি কোন ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মূখীন হতে পারে কিনা তা বুঝতে সাহায্য করে।এটা হল গর্ভস্থ শিশুটির হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করার সব থেকে নির্ভরযোগ্য উপায় এবং সেটা ডাক্তারবাবুকে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থার সমস্ত সময় জুড়ে হৃদপিন্ডের নিরীক্ষণ করার থেকেও প্রসব কালীন সময়ে সেই কার্যটি করা ডাক্তারদের কাছে খুবই কঠিণ কাজ হয়ে দাঁড়ায়।আপনার প্রসবকালীন সংকোচনের সময়ে শিশুটির হৃদস্পন্দনের হার ট্র্যাক করতে ডাক্তারবাবুকে এই পদ্ধতিটি সাহায্য করে থাকে।আপনার বাচ্চাটি ভাল আছে নাকি কোনও সমস্যার মুখে রয়েছে তা জানার জন্য এইটি হল সবথেকে নির্ভরযোগ্য একটি প্রক্রিয়া। প্রসবকালীন সময়ে ভ্রূণের নিরীক্ষণ এর উদ্দেশ্য হল ঐ সময়ে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকাকে নিশ্চিত করা।এটি আপনাকে এবং আপনার ডাক্তারবাবুকে আশ্বাসিত করে যে যদি অন্য কোনও সমস্যা না থাকে বা বাকি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে স্বভাবিক প্রসব করানো যেতে পারে।
ভ্রূণ নিরীক্ষণের প্রাথমিক লক্ষণ হল শিশুটি হাইপোক্সিক(সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত)কিনা তা সনাক্ত করা,যা দিয়ে শিশুটির স্বাস্থ্যের অন্যান্য বিষয়গুলি বিবেচনা করা যায়।যদি এর ফলাফলগুলি ইতিবাচক হয়ে থাকে তাহলে ডাক্তারবাবু অস্ত্রপচারের দ্বারা অথবা ইন্সট্রুমেন্টাল ভ্যাজাইন্যাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
যদি ঠিকমত যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় তাহলে ভ্রূণ নিরীক্ষণ বাড়িতেই করা যেতে পারে।এটা সাধারণত তখনই করা হয় যখন মা কে বাড়িতে থাকতে কিম্বা খুব কম চলাচল করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
তিনটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে শিশুর হৃদস্পন্দন নিরীক্ষণ করা হয় যা নির্ভর করে কোন সময়ে সেগুলো করা হচ্ছে তার প্রয়োজনের উপর।এই অন্তঃস্ত্বাকালীন অবস্থায় ভ্রূণ নিরীক্ষণের পদ্ধতিগুলি বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ এই উভয় প্রকার নিরীক্ষণে বিভক্ত এবং সেগুলি হল নিম্নরূপঃ
আপনি যদি একজন অন্তঃসত্ত্বা মা হয়ে থাকেন,তবে আপনার অবশ্যই ইতিমধ্যে শিশুর জন্মপূর্ববর্তীকালীন ডাক্তার পরিদর্শনকালে এই পদ্ধতিটির অভিজ্ঞতা হয়েছে।গর্ভাবস্থার প্রথম পর্যায়ের সময় সবিরাম অ্যাসকুলেশন বা কানের সাহায্যে হৃদ পরীক্ষায় একজন নার্স অথবা ডাক্তার প্রতি 15-30 মিনিটে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করেন এবং তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে এর পুনরাবৃত্তিটি প্রতি 5 মিনিটের ব্যবধানে বাড়িয়ে তোলেন।
ডাক্তার আপনার সংকোচনের মাঝে শিশুর হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করে রাখেন, এটি প্রতি মিনিটে 110 থেকে 160 বীটের মধ্যে নেমে আসে কিনা তা বিচার করার জন্য। এটি আবার আপনার সংকচনে শিশুর সহনশীল ক্ষমতার একটি ধারণা পেতে ডাক্তারবাবুকে সহায়তা করে। ।
যদিও দুটিই ভ্রূণের বাহ্যিক নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া,তবে নিরীক্ষণ করার পুনরাবৃত্তিতে সেগুলির তফাৎ থাকে।সবিরাম অ্যাসক্লুটেশশন(কানের সাহায্যে হৃদপরীক্ষা)প্রক্রিয়াটিতে পূর্বনির্ধারিত বিরতি বা সময়সীমাতে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন রেকর্ড করা হয়,যেমন এর নামানুসারেই বোঝা যায় যে এই প্রক্রিয়াটির দ্বারা শ্রম অথবা প্রসবের সম্পূর্ণ সময়সীমা জুড়েই অবিরাম নিরীক্ষণ করা হয়।
যখন অবিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণে ভ্রূণের হার্ট ট্রেসিং (হৃদস্পন্দন)এর খবরাখবর এবং তথ্য প্রদর্শনের জন্য ট্রান্সডুসার এবং মনিটর ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে ডাক্তার দ্বারা পর্যালোচনা করা হয়,তখন সবিরাম অ্যাসক্লুটেশশন প্রক্রিয়াটিতে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন পরিমাপের জন্য ডপলার ট্রান্সডুসার নামে একটি ডিভাইস ব্যবহার করা হয়।
সবিরাম ভ্রুণ নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াটি সেই সকল মহিলাদের উপরেই পরিচালনা করা হয়ে থাকে যারা কম ঝুঁকিপুর্ণ গর্ভাবস্থায় আছেন বলে বিবেচনা করা হয়।যখন ডাক্তারবাবু প্রসবের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলি আঁচ করেন তখন তিনি অবিচ্ছিন্ন নিরীক্ষণটি পরিচালিত করেন যাতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সকল ভ্রূণের হৃদস্পন্দনের ধরণগুলির মধ্যে যেগুলি স্বাভাবিক(বিভাগ-।)বা অস্বাভবিক(বিভাগ-II) পরিসরের মধ্যে পড়ে না সেগুলিকেই দ্বিতীয় শ্রেণীর ভ্রূণের হৃদপিন্ডের বর্ণন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।এই বর্ণনগুলি তখন বিরলদৃষ্ট হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।আপনার ডাক্তারবাবু যদি এ জাতীয় প্যাটার্নটি আপনার জন্য নিয়ে আসেন,তবে তিনি হয়ত কর্ডের সংকোচন হ্রাস করতে এবং অমরায় রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করার জন্য আপনার অবস্থানের পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারেন।
আপনার ডাক্তারবাবু আপনার সমগ্র প্রসব সময় জুড়ে আপনার সন্তানের হৃদস্পন্দনের মূল্যায়ন করবেন এবং সেক্ষেত্রে কোনওরকম সমস্যাকে নির্দেশ করতে পারে এমন সংকেতের দিকে তার কড়া নজর জারি রাখবেন।তিনি আপনার সন্তানের হৃদস্পন্দনের বেসলাইন নিরীক্ষণ করবেন তা স্বাভাবিক আছে কিনা তা জানতে এবং যদি কোনও পরিবর্তন আসে তা মূল্যায়ন করবেন।
যদি কোনও ক্ষেত্রে আপনার সন্তানের হৃদস্পন্দনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় তবে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বে আপনার ডাক্তারবাবু হয়ত আরও কয়েকটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেবেন।মাথায় রাখবেন যে একটা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন কিন্তু সবসময়ে বাচ্চার সাথে কোনওরকম ভুলভ্রান্তি হওয়াকেই ইঙ্গিত করে না,আর ডাক্তার কতৃক নির্ধারিত পরীক্ষাগুলি অনুসরণ করলে তা প্রকৃত সমস্যাটিকে নির্ধারিত করবে।
আপনার শিশুটি যদি নড়াচড়া করে তবে তার হৃদস্পন্দন সেই সময় বেড়ে যাবে এবং এটি হল স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।আপনি যোগ-ব্যায়ামাদি করার সময় আপনার হৃদস্পন্দন যেমন বেড়ে যায় এটি ঠিক তারই দর্পনস্বরূপ।এটি কেবল একটি অপরিবর্তিনীয় দ্রুত হৃদস্পন্দন যা ডাক্তারবাবুর বিবেচনার বিষয় হতে পারে।
একটি সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে,আপনার ডাক্তারবাবু হয়ত আপনার অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য অথবা আপনাকে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য কতকগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।একটি আন্তঃ-শিরা পদ্ধতির মাধ্যমে আপনাকে প্রয়োজনীয় তরল সরবরাহ করাও এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল হতে পারে।যদি এই সকল পদক্ষেপগুলি প্রত্যাশিত ফলাফল না দিয়ে থাকে,তবে আপনার ডাক্তারবাবু হয়ত অস্ত্রপচার পদ্ধতি ব্যবহার করে অথবা শিশুটিকে বাইরে বের করার জন্য ফরসেপ বা সাঁড়াশী প্রক্রিয়া কিম্বা ভ্যাকুয়াম প্রয়োগ করে বাচ্চা প্রসবের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ভ্রূণের নিরীক্ষণ হল জন্মের পূর্বে শিশুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। নিরীক্ষণের কয়েকটি স্তর নিয়মিত ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়ে থাকে,এবং এমনকি যদি আপনার ডাক্তারবাবু এক্ষেত্রে অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণের জন্য সুপারিশ করেও থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার কোনও কারণ নেই।আপনি যদি এ ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে থাকেন তবে নিশ্চিতভাবে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে এ বিষয়ে কথা বলুন এবং আপনার সন্তানের সুরক্ষার স্বার্থে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করুন।