In this Article
নবজাতকের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাবা–মা এর সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেই কারণে শিশুর স্বাস্থ্যের সকল লক্ষণগুলি বাবা–মায়েদের ভালো ভাবে লক্ষ্য করা দরকার।জন্মের প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই শিশুদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোনের বিকাশ ঘটে, সুতরাং তাদের এই বৃদ্ধি ব্যাহত না হওয়া নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। স্লিপ অ্যাপনিয়া– এই গুরুতর ব্যাধির সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন অপরিহার্য, যেহেতু এটির জন্য প্রয়োজন সতর্কতা অবলম্বন এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কি?
ঘুমের সময় শ্বাস প্রশ্বাসে বাধার সৃষ্টি হওয়াকেই স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়।এটি সম্ভাব্য ক্ষতিকারক অবস্থা, যখন সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হয় তখন সেটি গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।ছোটো শিশুদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে ঘটে ধীর হৃদ স্পন্দন এবং তাদের বৃদ্ধির মান নিম্ন হতে পারে।শ্বাসকার্যে আংশিক ভাবে বাধা পাওয়া হাইপোপনিয়াস নামে পরিচিত যেহেতু শ্বাস–প্রশ্বাসে একটি সম্পূর্ণ বিরতি অ্যাপনিয়া রূপেই অভিহিত।স্লিপ অ্যাপনিয়াকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
1.প্রতিরোধক ঘুম অ্যাপনিয়া (অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া)
এই ধরণের অ্যাপনিয়া ঘটে যখন উপরের বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বন্ধ গলার পিছনে নরম কলা গুলি ঠিকভাবে কাজ করে না।
2.মধ্য ঘুম অ্যাপনিয়া (সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া)
মধ্য অ্যাপনিয়া ঘটে হৃদযন্ত্র এবং মস্তিষ্কের সমস্যার কারণে,যেখানে শরীর শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয়। সেখানে মস্তিষ্কের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না,কিন্তু এটি শ্বাসকার্যের জন্য পেশী গুলিকে সংকেত পাঠাতে ব্যর্থ হয়।
3.মিশ্র অ্যাপনিয়া (মিক্সড অ্যাপনিয়া)
প্রস্তাবিত নামানুযায়ী, এটি হল মধ্য এবং প্রতিরোধক অ্যাপনিয়ার সমন্বয়।এটি এমন এক ধরণের অ্যাপনিয়া যা সাধারণত সবচেয়ে বেশী দেখতে পাওয়া যায় একদম ছোটো অপরিণত শিশুদের মধ্যে।
এটির কারণগুলি কি কি?
ঘুম বা স্লিপ অ্যাপনিয়া নানান কারণের জন্য হয়ে থাকে।স্লিপ অ্যাপনিয়ার কিছু কারণ গুলি হল নিম্নরূপ।
- ঘুমের সময় পেশীগুলি শক্তিহীন হয়ে পড়ে।আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের পেশী গুলির শক্তিও কার্যহীন হয়,কিন্তু প্রতিরোধকারী স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্তই পেশীগুলি শিথীল হয়ে থাকে,সেই কারণেই বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে যায় যার ফলে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।টনসিলের বেড়ে যাওয়া এবং এডিনয়েডসগুলিও অ্যাবস্ট্র্যাকটিভ অ্যাপনিয়ার কারণ।
- অ্যাপনিয়ার পারিবারিক ইতিহাস
- অতিরিক্ত ওজন
- ডাউন সিন্ড্রোম
- সেরিব্রাল পালসি
- মুখের ভিতরে বিকৃতি,চোয়াল এবং গলার গঠন
- তুলনামূলক লম্বা গলা
- বৃহত্তর জিহ্বা যা ফিরে আসতে পারে এবং ঘুমানোর সময় বায়ু চলাচল আটকে দেয়।
শিশুদের স্লিপ অ্যাপনিয়ার আরো অন্যান্য অনেকগুলি কারণ আছে।
- মস্তিষ্কের রক্ত ক্ষরণ
- শ্বাসযন্ত্রের রোগ
- পরিপাকতন্ত্র জনিত সমস্যা যেমন রিফ্লাক্স
- সংক্রমণ
- হৃদরোগ
- দেহের রাসায়নিকের অসামঞ্জস্যতা যেমন দেহে ক্যালসিয়াম ও গ্লুকোজের অস্বাভাবিক পরিমাণ
- ক্ষতিকারক এবং বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রকাশ
কোন শিশুদের মধ্যে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি দেখা যায়?
যেকোনো শিশুরই স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে, কিন্তু অপরিণত শিশুদের মধ্যে এটি আরো বেশী সাধারণ একটি ব্যাপার। অকাল জন্মের ব্যবধান দীর্ঘ হলে তা অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি উচ্চ মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়।গর্ভাবস্থায় 37 সপ্তাহের আগে শিশুর জন্ম হলে সেই শর্তটিকে অপরিণতির (প্রিম্যাচিউরিটির) অ্যাপনিয়া বলা হয়।শিশুর জন্ম 37 সপ্তাহ বা তার পরে হলে,তাকে বলে শৈশবের (ইনফ্যান্সি) অ্যাপনিয়া।প্রতিবেদন অনুযায়ী, 84% এর কাছাকাছি কম ওজনের শিশু যাদের 1 কিলোগ্রামেরও কম ওজন তাদের অ্যাপনিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে।এই ঝুঁকিই কমে 25% এ দাঁড়ায় সেইসকল শিশুদের মধ্যে যাদের জন্মের সময় ওজন প্রায় 2.5 কিলোগ্রাম মত হয়।
ডাউন সিন্ড্রোম এবং কিছু জন্মগত শর্ত উপরের দিকের বায়ু চলাচলের উপরে প্রভাব ফেলতে পারে,যা স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণ হতে পারে।ডাউন সিন্ড্রোম সহ বেশীরভাগ শিশুই সাধারণত স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভোগে।
জটিলতা
স্লিপ অ্যাপনিয়া হল একটি গুরুতর স্বাস্থ্যবস্থা,বিশেষ করে অপরিণত শিশুদের ক্ষেত্রে।কিছু বিরল ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে।এই অবস্থায় যেহেতু শিশু শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দেয়, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়।এটিও হৃদস্পন্দনের হার কমিয়ে দিতে পারে এবং অসাড়তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
শিশুদের স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ গুলি
অ্যাপনিয়ার কোনও রকম লক্ষণ প্রকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য পিতামাতাদের সর্বদা সচেতন থাকা প্রয়োজন।তাদের অতিরিক্ত সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন যখন এই অ্যাপনিয়া অপরিণত বা কম ওজনের শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।আমেরিকান একাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিন অনুযায়ী শ্বাসকার্যে 15 সেকেন্ড পর্যন্ত বিরাম হওয়া সাধারণ ব্যাপার এবং এটিকে বলা হয় পিরিয়ডিক ব্রেথিং বা থেমে থেমে শ্বাস নেওয়া।এই পিরিয়ডিক ব্রেথিং কিন্তু অ্যাপনিয়ার কোনও সংকেত নয়।যাইহোক, শ্বাসকার্যে বিরতির সময়সীমা বেড়ে যাওয়া হল একটি বিপজ্জনক সংকেত।
এখানে শিশুদের স্লিপ অ্যাপনিয়ার কিছু লক্ষণ আলোচিত হল যেগুলি সম্পর্কে পিতা মাতাদের সাবধান হওয়া উচিত।
ত্বক নীলাভ বর্ণে রূপান্তর—শিশুদের কপাল এবং দেহ নীলচে রঙে রূপান্তরিত হওয়া নির্দেশ করে যে,তার শরীরে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে।কিছু সময় মনে রাখা প্রয়োজন, বাচ্চাদের মুখের এবং পায়ের পাতার আশেপাশের অংশ নীলাভ বর্ণে রূপান্তরিত হয় যদি তাদের ঠান্ডা লেগে থাকে অথবা কাঁদতে থাকে।
গ্যাসপিং বা হাঁ করে দীর্ঘ শ্বাস নেওয়া—দীর্ঘ সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে থাকার পরে এটি ঘটে থাকে।অপরিণত শিশুদের শ্বসন তন্ত্রের অসম্পূর্ণতার কারণে, মস্তিষ্ক পেশীগুলিকে শ্বাসকার্যের সংকেত পাঠাতে ব্যর্থ হয়।এটি সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া বা কেন্দ্রীয় ঘুম অ্যাপনিয়ার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
নিস্তেজ হয়ে যাওয়া—অ্যাপনিয়ায় নিস্তেজ পেশীগুলি গুরুতর প্রভাব ফেলে।পেশী গুলি নিস্তেজ হয়ে পড়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অস্বাভাবিক হ্রাস পাওয়ার কারণে।
ধীর হৃদ স্পন্দন—অ্যাপনিয়া হওয়া শিশুদের হৃদ স্পন্দনের হার ধীর গতিতে হয়,এই অবস্থাকে বলে ব্রাডিকার্ডিয়া যা হঠাৎ অচেতনতা ঘটাতে পারে।
কীভাবে এই রোগ নির্ণয় করা হয়?
ঘুমের অস্বাভাবিকতার উপর সন্দেহ করে, শিশুকে ঘুম বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বাচ্চার ডাক্তারবাবু তাকে শিশু ফুসফুস বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর আগে কয়েকটি পরীক্ষা করাবেন।সেগুলির মধ্যে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ,হৃদ স্পন্দনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ এবং শ্বাসকার্যের পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য।
অ্যাপনিয়া রোগটি নির্ণয়ের জন্য অন্য আরেকটি যে পরীক্ষা করা হয় তা হল পলিসোনোগ্রাম।বাচ্চা যখন ঘুমায় সেই সময়ে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের জন্য এই পরীক্ষাটি করানোর প্রয়োজন হয়,এবং এটি প্রযুক্তিবিদ–দের দ্বারা ঘুমের ল্যাবে পরিচালনা করা হয়।এই পর্যবেক্ষণটি করা হয় মস্তিষ্কের তরঙ্গ,হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসকার্যের নিদর্শনগুলিকে ধরে রাখতে,শ্বাসকার্যের সমস্যা প্রকাশ করার জন্য।এটি একটি যন্ত্রণাবিহীন পদ্ধতি।
চিকিৎসা
অ্যাপনিয়ার তীব্রতার উপর নির্ভর করে,ডাক্তারবাবু শিশুদের ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।যদি টনসিল প্রসারিত হয় এবং অ্যাডিনয়েডস বা গলরসগ্রন্থি দেখা দেয় তবে সে ক্ষেত্রে একজন ENT (কান,নাক,গলা) বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করে পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। আবার অবস্ট্রাকটিভ অ্যাপনিয়ার কিছু ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্য একটি অনবরত পজেটিভ এয়ার ওয়ে প্রেসার মেশিন (ইতিবাচক বায়ু চলাচলের চাপ মেশিন) ব্যবহার করা হয়।যেসব শিশুদের শ্বাসকার্যে প্রভাব ফেলা বিভিন্ন সমস্যাগুলির জন্য ফুসফুসীয়–শ্বাসযন্ত্র পর্যবেক্ষনের প্রয়োজন সে সব ক্ষেত্রেও শিশুর স্লিপ অ্যাপনিয়া পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়।
বেশীরভাগ বাচ্চার ক্ষেত্রে তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে শিশু স্লিপ অ্যাপনিয়া কমে যায়,কিন্তু অপরিণত শিশুদের ক্ষেত্রে এই অ্যাপনিয়া অনেক দীর্ঘ সময় ধরে চলে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য—স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে এমন শিশুর বাবা–মায়েদের CPR (কার্ডিও পালমোনারী রেজুসিয়েশন) কে কীভাবে সঞ্চালন করা যায় তা শেখা উচিত।এই বিষয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন এবং শিখে নিন যাতে আপনি জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারেন।
কখন ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন?
অপরিণত ও কম ওজনের মত সমস্যাযুক্ত শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের পিতা–মাতার অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। যখন 15 সেকেন্ডের বেশী সময় ধরে শ্বাসকার্যে বাধার সৃষ্টি হয়,এবং মৃদু ডাকেও সাড়া না দেয়, তবে অবিলম্বে ডাক্তার ডাকুন।
যদিও স্লিপ অ্যাপনিয়া একটি গুরুতর অবস্থা,পিতা মাতারা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাদের নব জাতকের এই পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করে চিকিৎসায় আরোগ্য লাভে সহায়ক হয়।সঠিক নির্দেশিকা এবং চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য সতর্ক দৃষ্টি এবং উপযুক্ত পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক।