শিশুর নাক ডাকা: কারণ, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিকার

শিশুর নাক ডাকা

আপনার সন্তান যখন ছোট থাকে তখন আনন্দ এবং উদ্বেগের মধ্যে আপনি দুলতে থাকেন। আপনার সন্তানকে একজন অনন্য ব্যক্তি হিসাবে বড় হয়ে উঠতে দেখা একটি আনন্দ। তবে, এটি ক্রমাগত উদ্বেগ নিয়ে আসে যেমন আপনার সন্তান অসুস্থ হলে আপনি সঠিক জিনিস করছেন কিনা তা নিয়ে ভাবা বা আপনার সন্তানের আচরণ স্বাভাবিক আছে কিনা নাকি আপনার চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু আছে। আপনি আপনার শিশুর নাক ডাকা এই সম্ভাব্য উদ্বেগের একটি হতে পারে।

শিশুদের নাক ডাকা কি স্বাভাবিক?

একটি নবজাতককে নাক ডাকতে দেখতে মিষ্টি লাগতে পারে, কিন্তু যদি আপনার শিশু নিয়মিত নাক ডাকে, তাহলে আপনার চিন্তা শুরু হতে পারে। ঘুমের সময় একটি শিশুর নাক ডাকা একটি স্বাভাবিক ঘটনা যেখানে দশটি বাচ্চার মধ্যে প্রায় একটি বাচ্চার এই প্রবণতা থাকে। এটি সাধারণত ঘটে কারণ একটি নবজাতকের বায়ুচলাচলের পথ অপরিণত হয় এবং মিউকাস থাকার ফলে সংকীর্ণ হতে পারে।

শিশুদের নাক ডাকার কারণ কী?

বাচ্চাদের গলার বায়ুপথে কিছু বাধা সৃষ্টির ফলে শ্বাসের সাথে নেওয়া বায়ু গলার টিস্যুকে কাঁপায় ও ফলে শব্দের সৃষ্টি হয়। এই কারণে বাচ্চাদের নাক ডাকে। এর সাধারণ কারণগুলি হল নাক বন্ধ থাকা, পুরোপুরি বিকশিত না হওয়া বায়ুপথ, বা সর্দি লাগা। মাঝে মাঝে, শিশুর গলার পেশী গভীর ঘুমানোর সময় শিথিল হয় এবং উদ্ভূত শব্দটি নাক ডাকার মতো মনে হতে পারে।

বেশিরভাগ শিশু বড় হয়ে উঠলে নাক ডাকা বন্ধ হয়ে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি রোগের একটি লক্ষণ হতে পারে যেমন:

১. শৈশবের অ্যাপনিয়া:সাধারণত এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, এটি ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাসপ্রক্রিয়ায় একটি সাময়িক বিঘ্নকে বোঝায়। শিশুর ঘুমের অ্যাপনিয়া একটি সংশ্লিষ্ট শ্বাসের ব্যাধি।

২. সংক্রামিত টনসিল:যদিও এটি একটি বিরল ঘটনা, যখন শিশুর টনসিলগুলি সংক্রমণের কারণে বেড়ে যায়, তখন নাক ডাকতে পারে। অবস্ট্রাকটিভ অ্যাপনিয়া নামেও পরিচিত, এই রোগে ঘন ঘন স্বাস বা মুখ খুলে শ্বাস নেওয়া, সাথে নাক ডাকা হতে পারে।

৩. নাসামধ্য পর্দার বিচ্যুতি:এই অবস্থায়, নাসামধ্য পর্দা, যা নাকের গহ্বরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে, কেন্দ্র থেকে সরে যায়।

৪. শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ:যখন একটি শিশুর সর্দি লাগার ফলে নাক ভর্তি থাকে, তখন নাকের পথ বন্ধ থাকার কারণে শিশুকে মুখের মাধ্যমে শ্বাস নিতে হতে পারে। এর ফলে নাক ডাকতে পারে।

৫. হাঁপানি:যে বাচ্চাদের নাক ডাকে তাদের অন্যদের থেকে হাঁপানি হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বলে মনে করা হয়। কিছু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শ্বাসযন্ত্রের অ্যালার্জি থেকে এটি হতে পারে।

৬. গলার সমস্যা:মুখের এবং নাকীয় গহ্বরের মধ্যে বিভাজক প্যালেটের অনিয়মিত আন্দোলনের ফলে শিশুদের নাক ডাকতে পারে। সিস্ট হল শিশুদের নাক ডাকার অন্য একটি কারণ।

৭. অপরিণত অবস্থার অ্যাপনিয়া:গর্ভধারণের 34 সপ্তাহের মধ্যে অকালিকভাবে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দেয়, যেখানে শিশুর অপরিণত শ্বাসযন্ত্রের কারণে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি হয়। এটা তারপর স্নাতক এনেছে।

শিশুদের নাক ডাকার কারণ কী?

নাক ডাকা কি কোনো রোগ বা অসুস্থতার একটি চিহ্ন?

বাচ্চাদের নাক ডাকা টনসিল বা অ্যাডিনয়েড বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘুমের অ্যাপনিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। নাক ডাকা আপনার সন্তানের ঘুমের মানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে যার ফলে বৃদ্ধি এবং বিকাশের ক্ষেত্রে আরও সমস্যা হয়। ঘুমের অভাবের ফলে ওজন বৃদ্ধি কম হওয়া, স্থূলতা, রাতে ভয়, এডিএইচডি, চোখের নিচে কালো দাগ, বিছানা ভিজিয়ে ফেলা এবং আরও অনেক কিছু হতে পারে। যদি আপনার শিশুর নাক ডাকা অভ্যাসগত হয়ে যায় এবং কম খাওয়ার পাশাপাশি ওজন বৃদ্ধি কম হয়, তবে এটি সম্ভব যে অন্তর্নিহিত কারণটি হল গলা, ফুসফুসের বা হৃৎপিন্ডের সমস্যা।

নাক ডাকা এবং শব্দযুক্ত শ্বাসের মধ্যে পার্থক্য কী?

মাঝে মাঝে, শব্দযুক্ত শ্বাস, যা স্ট্রাইডর নামেও পরিচিত, নাক ডাকা হিসাবে ভুল করা হয়। এই ক্ষেত্রে, আওয়াজ শিশুর গলা থেকে আসে এবং প্রায়শই ল্যারিঙ্গোম্যালেসিয়ার ফলে এটি হয়, যেটি হল জন্মগত সমস্যা। শব্দটি ল্যারিংক্সে উৎপন্ন হয় যেখানে উপরের ল্যারিংক্সের কার্টিলেজিনাস আস্তরণটি ভেতর দিকে ঢুকে যায় এবং বায়ুপথে ধসে পড়ে।

শিশুদের নাক ডাকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

বাচ্চাদের নাক ডাকা অনেক দিন ধরে চললে, সেটি থেকে এই সমস্যাগুলি হতে পারে:

  • মনোযোগের অভাব এবং খারাপ স্মৃতিশক্তি
  • শিশু বড় হওয়ার সাথে সামাজিক দক্ষতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া
  • উদ্বেগ এবং বিরক্তি
  • জ্ঞানীয় ত্রুটি
  • কম মাত্রার কার্যকলাপ করা এবং দিনের বেলা ঘুমাতে চাওয়া
  •  বিষণ্নতা

শিশুর নাক ডাকার জন্য প্রতিকার

যদি শিশুর নাক ডাকা কোনো চিকিৎসা বা জন্মগত অবস্থার কারণে হয় তবে সেই কারণটির চিকিৎসা করলে আপনার সন্তানের নাক ডাকার নিরাময় করা যাবে। তবে, যদি এটি অন্য কারণে হয় এবং আপনি আপনার শিশুর নাক ডাকা কীভাবে মোকাবিলা করবেন তা নিয়ে ভাবছেন, তবে নিচের কয়েকটি প্রতিকার চেষ্টা করুন:

  • ঘুমের অবস্থানের সামঞ্জস্য করুন: ঘুমের সময় আপনার শিশুর অবস্থান পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন। বাচ্চারা যখন চিত হয়ে বা উপুড় হয়ে ঘুমাতে থাকে তখন অনেক বাচ্চার নাক ডাকার প্রবণতা থাকে। পাশ ফিরে ঘুমালে কিছু বাচ্চাদের নাক ডাকা বন্ধ হয় বলে মনে করা হয়। বলা হয় যে শিশুদের চিত করিয়ে শোওয়ার অবস্থানটিই সেরা, তাই আপনি তার মাথা একপাশে হেলিয়ে দিতে চেষ্টা করতে পারেন এবং দেখতে পারেন যে কোনো কাজ হয় কিনা। আপনি অবশ্যই বার বার মাথা একপাশ থেকে অন্যপাশে হেলিয়ে দেবেন। গদির নিচে একটি বালিশ দিয়ে আপনার শিশুর মাথাটি একটু উঠিয়ে কোণ করে রাখলে সর্দি জমাভাব থেকে আরাম দিতে পারে এবং তাকে আরও ভাল ঘুমাতে সাহায্য করতে পারে।

ঘুমের অবস্থানের সামঞ্জস্য করুন

  • অ্যালার্জি দূর করুন: সর্দি, নাক জমে যাওয়া, এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা যা থেকে নাক ডাকা হতে পারে, প্রতিরোধ করতে আপনার শিশুর ঘরটি অবশ্যই পরিষ্কার এবং ধুলো মুক্ত রাখুন। পুরু কার্পেট বা ভারী পর্দা ব্যবহার করবেন না, এগুলি হল ধুলোর চুম্বক।
  • একটি হিউমিডিফায়ার নিয়ে আসুন:আপনার ঘরের ভেতরের বায়ু যদি শুষ্ক হয় তবে এটি শিশুর অপরিণত বায়ুপথে জ্বালা সৃষ্টি করতে পারে। হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করলে তা শিশুর ঘুমানোর সময় আর্দ্রতা সর্বোত্তম মাত্রায় বজায় রাখতে পারে এবং এইভাবে শ্বাস প্রশ্বাস সহজ করতে পারে যার ফলে নাক ডাকা এবং আওয়াজ করা বন্ধ হয়।
  • একটি নাসাল অ্যাসপিরেটর ব্যবহার করুন:নিয়মিতভাবে বাচ্চাদের নাক অ্যাসপিরেটর দিয়ে পরিষ্কার করলে তা মিউকাস বের করে দিতে পারে এবং নাকের পথকে পরিষ্কার করতে পারে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শের পরে প্রস্তাবিত ডোজ অনুযায়ী একটি স্যালাইন স্প্রে ব্যবহার করুন।
  • শিশুকে স্টীম শ্বাস নিতে দিন:বাচ্চাকে কোলে নিন এবং বাথরুমে দাঁড়িয়ে উষ্ণ সাওয়ার চালু করুন এবং বাষ্প বাড়তে দিন। একবার বাষ্প আপনার শিশুর বায়ুপথে প্রবেশ করলে, এটি নাকের বন্ধভাব কমিয়ে দেবে যা থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাগুলি হচ্ছিল।

এই ঘরোয়া প্রতিকারগুলি ছাড়া, আপনার শিশুর নাক ডাকার জন্য কোনো ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ দেবেন না যদি না তা আপনার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

নাক ডাকার সমস্যার সমাধান করার জন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে এবং এই সময়ে, আপনার বাচ্চার উপর আপনার ঘনিষ্ঠ নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ যাতে নিশ্চিত করা যায় যে তার কোনো বিপদ নেই। আপনি যদি নিম্নলিখিতগুলির মধ্যে কোনোটি লক্ষ্য করেন, তা হলে অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে:

. অনিয়মিত শ্বাস:যে কোনও সময়ে, যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে আপনার শিশুর শ্বাস নাক ডাকার সময় বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি যদি এটি কেবল এক বা দুই সেকেন্ডের জন্যও হয়, তবে আপনাকে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে এবং এমনকি এত অল্প সময়ের জন্যও শ্বাস না নিলে, শিশুর অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলিতে প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে।

২. ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা:যদি নাক ডাকার ফলে আপনার শিশু জেগে উঠতে থাকে এবং তার একটানা ঘুম অসম্ভব হয়ে পড়ে, তবে আপনাকে সাহায্য চাইতে হবে। ঘুমের বঞ্চনা আপনার সন্তানের বৃদ্ধির এবং বিকাশের ক্ষেত্রে বিস্তৃত প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।

৩. অত্যধিক আওয়াজ করা এবং নাক ডাকা:আপনার বাচ্চা যদি প্রতিবার ঘুমানোর সময় আওয়াজ করে ও নাক ডাকে এবং এটি দিন এবং সপ্তাহ ব্যাপী চলতে থাকে, তবে এটি উদ্বেগের ব্যাপার।

৪. উগ্র বা অত্যন্ত জোরালো আওয়াজ করা এবং নাক ডাকা:আপনার সন্তানের আওয়াজ করা এবং নাক ডাকা আপনার কানে বেদনাদায়ক হলে, কিছু গরবর আছে। একটি ছোট শিশুর উচ্চ গ্রামে নাক ডাকা স্বাভাবিক নয়।

আপনার সন্তানের ঘুমের প্যাটার্নগুলির উপর আপনাকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখতে হবে এবং একটি ডায়রিতে নোট করতে হবে যে কখন নাক ডাকা সবচেয়ে বেশি হয়, কত ঘন ঘন এটি হয়, এবং এটি কতটা জোরে এটা হয়। কয়েক দিন ধরে এটি করলে, তা আপনাকে একটি প্যাটার্ন দেখতে সহায়তা করবে এবং একজন ডাক্তারকে দেখাতে হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। এছাড়াও, এই তথ্যটি আপনার ডাক্তারকে একটি নির্ণয়ে পৌঁছাতে এবং চিকিৎসার সর্বোত্তম পদ্ধতির পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।

দাবি পরিত্যাগ বিবৃতি: এই তথ্য শুধুই একটি নির্দেশিকা এবং একজন যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাদারের থেকে চিকিৎসা পরামর্শের একটি বিকল্প নয়।