হল খুব সাধারণ এবং প্রাকৃতিক একটি ঘটনা।এটির জন্য নানা কারণ থাকতে পারে,সবচেয়ে সহজ থেকে সবচেয়ে বেশী জটিল পর্যন্ত।তবে শিশুদের বাতকর্ম করার অর্থ এই নয় যে শিশুটি অসুস্থ।এর অর্থ কেবল এই যে,আপনার বাচ্চার গ্যাস হয়েছে এবং সে তার পেটে আটকে থাকা গ্যাসগুলিকে বাইরে বের করে দিচ্ছে।
বাবা-মায়েরা প্রায়শই চিন্তায় পড়েন যখন তাদের সন্তান প্রচুর বাতকর্ম করে থাকে।তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে,তাদের সন্তান হয়ত কিছু অসুস্থতা থেকেই বাতকর্ম করছে।তবে এটি বলা হয় যে,গ্যাস বের করে দেওয়া ভাল জিনিস কারণ দেহের অভ্যন্তরে গ্যাস জমে থাকার ফলে শিশুদের পেটে ব্যথা হয় অথবা তারা কোলিক বা উদর যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে।শিশুদের বাতকর্মের কিছু কারণ নিম্নে তালিকাবদ্ধ করা হল।
বাতাস গিলে ফেলা বা অ্যারোফ্যাগিয়া হল পেটে গ্যাস হওয়ার একটি সাধারণ কারণ।শিশুরা খাওয়ার সময়,পান করার সময়,হাসার সময় এবং কাঁদার সময় যে বাতাস গিলে ফেলে,তার ফলে গ্যাস হয়।
যখন খাদ্যের অপাচ্য অংশ ভেঙে যায়,গ্যাস পুঞ্জীভূত হয়।এটি আবার ঘটে স্তন পান করানো মায়েরা যখন তাদের খাদ্যের প্রতি নজর রাখেন না এবং যা খুশি খেয়ে ফেলেন যা গ্যাস উৎপাদনে উৎসাহ যোগায়।
একজন মা হয়ত প্রচুর পরিমাণে ফোরমিল্ক(শিশুকে পান করানোর জন্য মায়ের প্রথম দুধ)উৎপাদন করতে পারেন যদি তাঁর বিপুল পরিমাণ দুধ সরবরাহ হয়ে থাকে।ফরমিল্কে উচ্চ মাত্রায় জলীয় উপাদান এবং ল্যাকটোজ থাকার জন্য এটি বাচ্চাদের মধ্যে পেটে খিঁচুনির কারণ হয়ে ওঠে।তদ্যপোরি,দ্রুত প্রবাহিত দুধ গ্রহণের সময় বাচ্চা প্রচুর পরিমাণে বাতাস গিলে ফেলে যা শিশুকে গ্যাসে পূর্ণ করে তোলে।তাছাড়াও বাচ্চার মধ্যে আবার আরও দুধ পানের প্রবণতা থেকে যায় যখন সে পর্যাপ্ত পরিমাণে সমৃদ্ধ হাইন্ড মিল্ক(শিশু স্তন পান করার সময় সর্বশেষ পান করা দুধ) পায় না।এটি শিশুর ওজন আরও বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে তার পেট ফেঁপে যায়।
তীব্র শব্দ,আলো,স্পর্শ,অপরিচিত অথবা পরিদর্শক ইত্যাদি কারণে যখন সংবেদনশীল শিশুদের মধ্যে চাপ পড়ে,এর ফলস্বরূপ তারা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে।এটি তাদেরকে গ্যাসে পূর্ণ করে তোলে,বদমেজাজী ও ঘ্যানঘ্যানে করে দেয় এবং পরবর্তীতে দিনে অথবা রাতে তাদের ঘুমের সমস্যা হয়।কিছু বাচ্চা যাদের তীব্র মস্তিষ্ক-অন্ত্রের সংযোগ থাকে তাদের উদর বিপর্যয়ের প্রবণতা বেশী হয়।
শিশুদের স্তন দুধ থেকে কঠিন খাদ্যে রূপান্তরিত করার জন্য সময়ের প্রয়োজন।এর কারণ হল বিভিন্ন প্রোবায়োটিকস এবং এনজাইম বা উৎসেচকগুলি যেগুলি হজম শক্তিকে বাড়ায় এবং পুষ্টিকর উপাদানগুলিকে শোষণ করে,সেগুলি গঠিত হতে সময় নেয়।
যখন বাচ্চারা খুব বেশী পরিমাণে খেয়ে ফেলে,তখন এটি তাদের দেহের গ্যাস্ট্রোকলিক রিফ্ল্যাক্সের উপর আরও বেশী প্রভাব ফেলে।এটি তাদের পাচন তন্ত্রে ব্যাঘাত ঘটায় এবং সে যা খায় তা নির্বিশেষে তার পেটের উপর চাপ সৃষ্টি করে।অতিরিক্ত খেয়ে ফেলা আবার শরীরের অপরিহার্য পাচক উৎসাচকগুলির সরবরাহকেও ব্যহত করে যা বিপুল পরিমাণে খাদ্য,অপাচিত প্রোটিন,শ্বেতসার এবং ফ্যাট ভাঙনে সাহায্য করে।কিন্তু অতিরিক্ত খেয়ে ফেলায় তা পুষ্টির প্রক্রিয়াকরণে এবং বর্জ্য পদার্থগুলি অপসারণে দেহকে বাধা প্রদান করে।তার ফলস্বরূপ পেটে গ্যাস উৎপন্ন হয়।
একটি শিশুর মধ্যে ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতাও তার গ্যাসের কারণ হয়ে উঠতে পারে।যখন শিশুর দেহ গ্যালাক্টোজ এবং গ্লুকোজের মত শর্করাগুলির ভাঙনের জন্য পর্যাপ্ত ল্যাকটেজ উৎপাদনে অসমর্থ হয় তখন তার মধ্যে এটি আরও বিকশিত হতে থাকে।সুতরাং,এই না ভাঙ্গা ল্যাকটোজ বৃহদন্ত্রে গমন করে এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে।এটিই গ্যাসে রূপান্তরিত হয়।
যখন শিশু সঠিকভাবে স্তন পানে অসমর্থ হয়,সেই কারণে তখন সে প্রচুর পরিমাণে বাতাস গিলে ফেলতে পারে।এই বায়ু অন্ত্রের মধ্যে বুদবুদ আকারে জমে পেটে অতিরিক্ত গ্যাসের কারণ হয়ে ওঠে।বাচ্চাকে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্যের জন্য,মা খাওয়ানোর সময় স্তনের মধ্যে পরিবর্তন এনে অদলবদল করে খাওয়াতে পারেন অথবা খাওয়ানোর সময় বাচ্চাকে একটি উলম্ব অবস্থানে রাখতে পারেন।
বাচ্চাদের বাতকর্মের মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নেই।শিশুদের অনুন্নত বিকাশশীল পাচন তন্ত্রের জন্য তাদের খাবার ঠিকমত পাচিত না হওয়ার কারণে তাদের পেটে গ্যাস উৎপন্ন হয়।এটা সাধারণত চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা নয়।যদি শিশুদের পাকস্থলীতে প্রদাহ হয় এবং তাদের কান্না ক্রমাগত বাড়তে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে ব্যাথার জন্য।এর সাথে যদি জ্বর,তড়পড়ানি,মুত্রত্যাগে সমস্যা ইত্যাদি যোগ হয় তাহলে সেটি কিছু শারিরীক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।এই লক্ষণগুলি ছাড়াও যদি আপনার বাচ্চা বাতকর্মের সাথে সাথে কোষ্ঠকাঠিণ্য, মলের সাথে রক্ত,একটানা বমি,অথবা জ্বর এবং তার পায়ুর তাপমাত্রা 101 ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তার বেশী হয় তাহলে দ্রুত শিশু-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
যদি আপনার সন্তান সবসময় বাতকর্ম করতে থাকে,এর অর্থ এই হয় যে তার পেটে গ্যাস হয়েছে।এটি সকল বাচ্চার উপরেই কিছু সময়ের জন্য অথবা ভিন্ন সময়ে প্রভাব ফেলে।যাইহোক,এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাধারণ টিপস রয়েছে যেগুলি প্রতিটি মা অনুসরণ করতে পারেন।
আপনার বাচ্চার পেটে ধীরে ধীরে মালিশ করুন ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী বৃত্তীয় গতিতে,পাঁজরের তলায় ডান দিক থেকে বা দিক পর্যন্ত।এটি গ্যাসের বুদবুদগুলিকে পরিপাক নালী বরাবর অগ্রসর করবে।
সমগ্র খাদ্য সমাপনের পর,আপনার বাচ্চার পিঠে ধীরে ধীরে চাপড়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে ঢেকুর তোলানোর প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করুন।পুনরায় স্তন পরিবর্তন করে খাওয়ানোর আগে অথবা বোতলে করে খাওয়ানোর মাঝে,বাচ্চাকে ঢেকুর তোলানোর জন্য ধীরে ধীরে তার পিঠে ঘষে দিন এবং হালকা করে চাপড়াতে থাকুন।শিশুকে ঢেকুর তোলানো তার গ্যাস অপসারণে সাহায্য করবে।
এই কৌশলটি আবার পা দিয়ে সাইকেল চালানো নামে পরিচিত,যা গ্যাস অপসারণে চমৎকার ঘটায়।প্রথমে,আপনার সন্তানকে একটি দৃঢ় পৃষ্ঠতলের উপরে স্থাপন করুন।এরপর,শিশুর পায়ের পাতাগুলিকে ধরুন এবং ধীরে ধীরে সেগুলিকে প্যাডেলের গতিতে পিছনের দিকে এবং সামনের দিকে সঞ্চালন করতে থাকুন।এরপর শিশুটির পাগুলিকে তার বক্ষস্থলের দিকে ভাঁজ করুন।সারাদিন ধরে বেশ কয়েক বার এই কার্যটির পুনরাবৃত্তি করুন কিন্তু মনে রাখবেন তাকে খাওয়ানোর পরক্ষণেই এই কাজটি কখনই করবেন না।
মেঝের উপর আপনার সন্তানকে স্থাপন করুন।তারপর তার পায়ের নিম্নভাগ ধরে রাখুন এরপর সেগুলিকে ঘড়ির কাঁটার গতি অনুযায়ী ঘোরাতে থাকুন বক্ষস্থল থেকে ডান নিতম্ব,হাঁটু,বাম নিতম্ব এবং পুনরায় বক্ষস্থল পর্যন্ত।এরপর পাগুলিকে উলম্বভাবে সামান্য প্রসারিত করুন এবং তার নিম্নাংশটিকে মেঝে থেকে উপরের দিকে তুলে ধরুন।সর্বশেষে,তার হাঁটুগুলিকে ভাঁজ করে তার বক্ষদেশের কাছে নিয়ে এসে প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত করুন।
যদি ‘প্যাডেলিং’ এবং ‘ব্যাঙের ন্যায় পদ সঞ্চালনা’ সাহায্য না করে থাকে,তবে সেক্ষেত্রে আপনি আরো বেশ কিছু ব্যায়াম করানোর চেষ্টা করতে পারেন কৌশলটিকে সম্পন্ন করার জন্য-
আপনার সন্তানের গোড়ালিগুলিকে ধরুন এবং তার পাগুলিকে টানুন।এরপর তার গোড়ালিগুলিকে ধরে রেখে,তার পাগুলিকে তুলে তার নাক পর্যন্ত নিয়ে যান।
গোড়ালিগুলি ধরে তার পাগুলিকে সোজা রেখে প্রসারিত করুন।এরপর সেগুলিকে উপরে তুলে ধরুন,চেষ্টা করুন সেগুলিকে তার কাঁধে স্পর্শ করাতে।আপনি আবার এটিকে কাটাকাটি রূপেও করার চেষ্টা করতে পারেন তার বা পায়ের গোড়ালিকে ডান কাঁধে এবং ডান পায়ের গোড়ালিকে বা কাঁধে স্পর্শ করানোর মাধ্যমে।
প্রথমে,পাগুলিকে টান করুন এবং তারপর দুটি পাকেই নিতম্বের এক পাশে নিয়ে আসুন এবং তারপর সেগুলিকে আবার অন্য পাশে নিয়ে যান।
তবে মনে রাখবেন যে,যখনই কোনও ব্যায়াম আপনার বাচ্চার সাথে প্রয়োগ করবেন সর্বদা সেটি ধীর ভাবে ও নমনীয়তার সাথে করবেন।
গ্যাসের কারণে হওয়া যন্ত্রণাটি আরও তীব্র হয়ে ওঠে যখন বাচ্চা চিত হয়ে শোয়।এটি এড়ানোর জন্য,বেবিওয়্যারিং ব্যবহারের চেষ্টা করুন।গ্যাসকে নিচের দিকে চালনা করার এবং সেটিকে বহিষ্কার করার এটি একটি দুর্দান্ত উপায় এবং এছাড়াও এটির ব্যবহার বাচ্চাকে একটি উলম্ব অবস্থানে ঘুমাতেও সাহায্য করে থাকে।
গ্যাসের যন্ত্রণা উপশমে এবং শিথিল করতে একটি উষ্ণ স্নান বেশ সহায়ক কারণ এটি আবার বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যকেও শিথিল করতে পারে।এটি করানোর জন্য কিছু তোয়ালেকে আপনার হাতের কাছে রাখুন।
উপুড় করে দেওয়া কেবল শিশুর দেহের উপরিভাগকে শক্তিশালী করে তোলার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় এটি আবার তার পেটে আটকে থাকা গ্যাস অপসারণের ক্ষেত্রেও সহায়ক।আপনার যা করা প্রয়োজন তা হল-মেঝের উপর একটা নরম মাদুর বিছিয়ে নিন এবং তার উপর আপনার বাচ্চাকে তার পেটের উপর ভর দিয়ে অন্তত 20 মিনিটের জন্য উপুড় করে রাখুন।
দোলা দেওয়া এবং লোফালুফির মাধ্যমে প্রাণচঞ্চল করে তোলা আপনার সন্তানের অন্ত্র মধ্যস্থ গ্যাস অপসারণে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।তবে মনে রাখবেন যেকোনও সঞ্চালনা ধীরের সহিত করা উচিত।
একটু বেশি বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে,আপনি তাদেরকে প্রোবায়োটিকস দেওয়া বিবেচনা করতে পারেন।এগুলি বাচ্চার পাচন তন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়া রক্ষায় সাহায্য করার মাধ্যমে গ্যাস অপসারণে সাহায্য করে,যা পেট ব্যথার নিরাময় করতে পারে।
প্রতিটি বাচ্চাই পৃথক।যখন একটি কৌশল কোনও একটি শিশুর জন্য উপকারী প্রমাণিত হতে পারে তখন অন্যান্য কৌশলগুলি অন্য শিশুদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।