শিশুর মালিশ – উপকার এবং কৌশল

শিশুর মালিশ – উপকার এবং কৌশল

শিশুর মালিশ আপনার সন্তানকে শান্ত এবং প্রশমিত করার সেরা উপায় । আপনার শিশুর জন্য মালিশের অসাধারণ স্বাস্থ্যকর উপকারিতা আছে । এটি রক্ত সঞ্চালন, ওজন বৃদ্ধি, হজম প্রক্রিয়া এবং আপনার শিশুর দাঁত বেরনোর সময়কার যন্ত্রণার ক্ষেত্রে সহজেই খুব কার্যকর । আপনার ছোট্টটিকে মালিশ করা আপনার ভালোবাসা ও যত্ন প্রকাশ করার একটি চমৎকার উপায় এবং এটি আপনার শিশুর সাথে বন্ধন বিকশিত করতে আপনাকে সহায়তা করে ।

শিশুর মালিশ কি?

শিশুর মালিশ আপনার শিশুর শরীরের আপনার হাতে শরীরের কোমল এবং ছন্দ মিলিয়ে আঘাত করা জড়িত থাকে । মালিশ করার জন্য আপনি তেল, ক্রিম বা ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন, কারণ এটি মালিশের আঘাতকে মসৃণ করতে সাহায্য করে । আপনি আপনার শিশুর বুকে, পেট, পিঠে, হাতে, পায়ে, এবং মাথায় মালিশ করতে পারেন । একটি মালিশের সময় আপনার শিশুকে গান শোনানো বা গুণগুণ করা তাকে শিথিল এবং শান্ত বোধ করতে সাহায্য করে । আপনার শিশুর সহায়কগুলি মালিশ করলে, আপনার শিশুর এবং আপনার মধ্যে অক্সিটোসিন নামেও পরিচিত একটি আনন্দ-অনুভব করার হরমোন মুক্তি পায় । অক্সিটোকিন মুক্তির ফলে ভালভাসা এবং উষ্ণতার অনুভূতি সৃষ্টি হয় ।

শিশুকে মালিশ করার উপকারিতা

শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের স্পর্শ ভালবাসে, এবং এটি আপনার ছোট্টটির সাথে যোগাযোগ করার একটি ভালো উপায় । আপনি এটাও লক্ষ্য করতে পারেন যে, একটি কান্নাকাটি করা বা বিরক্ত শিশুকে আদর করলে, জড়িয়ে ধরলে বা তার পিঠে চাপড় মারলে শান্ত হয়ে যায় । মালিশ হল স্পর্শের একটি ব্যাপ্তি এবং এতে আপনার শিশুর জন্য অনেক উপকারিতা আছে, যেমন:

শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের স্পর্শ ভালবাসে

১) এটা আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো

মালিশ রক্ত সঞ্চালন এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ফাংশন উন্নতিতে সাহায্য করে । এটি আপনার শিশুর শ্বাসের উন্নতির মতো শারীরবৃত্তীয় উপকারিতা সরবরাহ করে ।

২) এটি আপনার শিশুর জন্য শান্তিদায়ক ও আরামদায়ক

স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করার মাধ্যমে, মালিশ আপনার শিশুর পেটের যন্ত্রণায় এবং ঘুমাতে সাহায্য করে । এছাড়াও মালিশ আপনার শিশুর পেশী শিথিল করে এবং ত্বককে পুষ্টি প্রদান করে ।

৩) এটি আপনাকে আপনার শিশুর সাথে বন্ধন তৈরি করতে সাহায্য করে

একসঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানো আপনার ছোট্টটির সঙ্গে বন্ধনের সবচেয়ে কার্যকর একটি উপায় হল মালিশ । এটি আপনার শিশুর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করে ।

৪) এটি আপনাকে আপনার শিশুকে সামলানোতে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে সহায়তা করে

মালিশ আপনার নবজাতক শিশুকে জানতে একটি চমৎকার উপায় এবং আপনি আপনার শিশুকে সামলানোর ক্ষেত্রেও আত্মবিশ্বাসী হন । আপনার বাচ্চার সাথে সময় কাটাতে আপনার শিশুর প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদাগুলি সম্পর্কে পরামর্শ পেতে আপনাকে সহায়তা করে ।

৫) এটি আপনার শিশুকে উপশম দেয়

আপনার শিশুর পেট মালিশ করলে, বিভিন্ন পেট সম্পর্কিত সমস্যা যেমন গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং এমনকি কোলাক্সিকেও হ্রাস করতে সহায়তা করে ।

আপনার শিশুকে একটি মালিশ দেওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়

আপনার শিশুর ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত না হলে বা ঘুম না পেলে আপনার শিশুকে মালিশ দেওয়ার সেরা সময় । আপনি মালিশের জন্য যে কোন সময় বেছে নিতে পারেন, সকালে বা সন্ধ্যা যা খুশি । শিশুকে মালিশ তাকে স্নান করানো, খাওয়ানো এবং ঘুম পাড়ানোর মতো রুটিনের একটি অংশ করে নেওয়াটা কার্যকর উপায় ।

প্রতিদিন একই ভাবে জিনিসগুলি করে মালিশের রুটিন মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয় । এটা করা হয় কারণ, শিশু বারবার হতে থাকা জিনিস ভালবাসে, এবং একটি রুটিন তৈরি করা আআপনার শিশুকে জানতে সাহায্য করে যে, এরপর কি হবে । এই অনুভূতি আপনার শিশুকে সুরক্ষা ও আনন্দের অনুভূতি দেয় ।

আপনার সন্তানের ঘুমের আগে তাকে মালিশ করা একটি ভালো ধারণা । ঘুমনোর আগে মালিশ করা আপনার শিশুকে রাতে ভালো এবং দীর্ঘ ঘুম পেতে সাহায্য করে । যদিও প্রাথমিকভাবে আপনার নবজাতকের শিশুর জন্য একটি প্যাটার্ন বা রুটিন সেট করা কঠিন হতে পারে, আপনার শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে, আপনি আপনার শিশুর জন্য একটি রুটিন সেট করতে সক্ষম হবেন ।

শিশুকে মালিশ করা কখন শুরু করতে হবে, তা নিয়ে অনেক নতুন মায়েরা প্রায়ই চিন্তা করে । আচ্ছা, আপনার নবজাত শিশুর জন্য তেল বা লোশন মালিশ শুরু করার আগে ১০-১৫ দিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয় । প্রিটার্ম বা অকালজাত শিশুর জন্য, কোনও মালিশ শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের অনুমোদন চাইতে পরামর্শ দেওয়া হয় ।

আপনার শিশুকে মালিশ করার আগে আপনাকে কি করতে হবে?

আপনার শিশুর মালিশ করার আগে আপনাকে যা করতে হবে, তার প্রথম কাজ হল মালিশের জন্য সর্বোত্তম জায়গা খুঁজে বের করা । জায়গাটি আপনার এবং আপনার শিশুর উভয় জন্য আরামদায়ক হওয়া উচিত । আপনি আপনার শিশুকে তোয়ালে বা কম্বল দিয়ে রাখতে পারেন । ঘরটি যেন আরামদায়ক এবং উষ্ণ (খুব গরম না ঠান্ডাও না) হয়, নিশ্চিত করুন ।

পোষা প্রাণী বা মোবাইল ফোনের মতো কোনও বিভ্রান্তিকে দূরে রাখা বাঞ্ছনীয় । আপনি শিশুকে মালিশ করার সময় কিছু সঙ্গীত চালাতে পারেন বা গান গাইতে পারেন । মালিশের জন্য আপনি কোনও ভালো বেবি অয়েল বা লোশন নিতে পারেন, কারণ এটি আপনার বাচ্চার ত্বকে মসৃণভাবে চলার জন্য আপনার হাতকে পিছল করতে সহায়তা করে । আপনার শিশুর যদি কিছু চর্মরোগ থাকে, যেমন- অ্যাকজিমা, কোনো মালিশ শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয় ।

যাইহোক, কিছু তেল এবং লোশন যেমন সরিষা তেল, জলজ ক্রিম, অপরিশোধিত চিনাবাদাম তেল, এবং অন্যান্যগুলি, এগুলি শিশুর মালিশের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এই তেলগুলি আপনার শিশুর নরম এবং সূক্ষ্ম চামড়ার ক্ষতি করতে পারে ।

শিশুকে মালিশ করা – ধাপে ধাপে

মালিশের জন্য আপনার শিশুর প্রস্তুতির পরে, আপনি নিম্নলিখিত নবজাতক শিশুর মাথা, মুখ, পিঠ, বুক, পেট, পা এবং পায়ের পাতাগুলির জন্য মালিশের কৌশলগুলি ব্যবহার করতে পারেন ।

শিশুর মালিশের শুরু

১) মাথা

আপনি কিছু তেল নিন এবং আপনার শিশুর মাথায় দিন । আপনার শিশুর মাথার উপর তেল ছড়িয়ে দেওয়ার পর আপনি হালকা করে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন । ফন্টোনেল (আপনার শিশুর মাথার নরম স্থান)-এর দিকে যত্ন নিন এবং এতে চাপ প্রয়োগ করবেন না ।

ফন্টোনেল-এর দিকে যত্ন নিন এবং এতে চাপ প্রয়োগ করবেন না

২) মুখ

আপনার শিশুর মুখের উপর কিছু তেল প্রয়োগ করুন এবং আপনার আঙুল দিয়ে আলতো চাপ দিন । কানের দিকে কপাল থেকে আপনার আঙুল সরান । ভ্রু-এর উপর কোমল চাপ দেওয়ার মাধ্যমে বাইরের দিক থেকে আপনার আঙুলের চাপ দিন । আপনার শিশুর গাল, চিবুক, এবং নাকের উপর মৃদু চাপ প্রয়োগ করুন ।

কানের দিকে কপাল থেকে আপনার আঙুল সরান

৩) পেট ব্যাথার প্রশমন

পেট মালিশ করার পর, আপনার শিশুর হাঁটুকে পেট পর্যন্ত ভাঁজ করুন এবং কোমল চাপ প্রয়োগ করুন । প্রায় ৩০ সেকেন্ডের জন্য এই অবস্থানটি ধরে রাখুন এবং আপনি এটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করতে পারেন । নাভির নীচের দিকে পেটের মালিশ করুন । এটি কোনো গ্যাস বের করে দিতে সাহায্য করে ।

নাভির নীচের দিকে পেটের মালিশ করুন

৪) পিঠ

আপনার শিশুর পেট উপর ভর করে রাখুন । আপনার উভয় হাত দিয়ে, আপনার শিশুর গলা থেকে নিতম্ব পর্যন্ত, আপনার হাত সামনে পিছনে চালনা করার মাধ্যমে মালিশ করুন । আপনার আঙুলের সঙ্গে একটি বৃত্তাকার গতিতে আপনার শিশুর মেরুদণ্ডে মৃদু চাপ প্রয়োগ করুন ।

আপনার আঙুলের সঙ্গে একটি বৃত্তাকার গতিতে চাপ দিন

৫) বুক

আপনি আপনার উভয় হাত আপনার শিশুর বুকের কেন্দ্রে রাখতে পারেন এবং কাঁধের দিকে বাহ্যিক চাপ প্রয়োগ করতে পারেন । আপনি কয়েক বার এই গতির পুনরাবৃত্তি করতে পারেন । আপনি অনুভূমিকভাবে আপনার হাত রাখতে এবং নিচের দিকে চালনা করতে পারেন ।

আপনি আপনার উভয় হাত আপনার শিশুর বুকে মালিশ করুন

৬) পেট

আপনার শিশুর পাঁজরের খাঁচার ভিত্তি থেকে শুরু করে, বৃত্তাকার গতিতে আপনার শিশুর পেট মালিশ করার জন্য আপনার আঙুলগুলি ব্যবহার করুন । একটি ঘড়ির কাঁটার দিকে নাভি পর্যন্ত যান এবং চারপাশে আপনার আঙুলগুলি দিয়ে মালিশ করুন । আপনি আপনার শিশুর পেটের উপর অনুভূমিকভাবে আপনার হাত রাখুন এবং আপনার হাত পাশের দিকে সরানো হতে পারে । নাভির কর্ড সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে না থাকলে এবং সঠিকভাবে সুস্থ না হলে, আপনি শিশুর পেট মালিশ এড়ায়ে যান ।

নাভির কর্ড সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে না থাকলে, আপনি শিশুর পেট মালিশ এড়ায়ে যান

৭) পা এবং পায়ের পাতা

আপনার শিশুর পা নিন এবং উরু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করুন । আপনার শিশুর উরু ধরে রাখুন এবং বিপরীত দিকগুলিতে হাত দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিচে নামিয়ে আনুন ।

থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করুন

আপনার বাচ্চার পায়ের পাতায় যান এবং আপনার বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে মৃদু চাপ প্রয়োগ করুন, যেটি গোড়ালি থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত উপরে উঠে । আপনার শিশুর পুরো পায়ের পাতায় চাপ প্রয়োগ করতে আপনার হাত ব্যবহার করুন । মালিশ করার সময় আপনার শিশুর গোড়ালিগুলির চারপাশে ছোট বৃত্তাকার গতিতে মালিশ করুন এবং আস্তে আস্তে পায়ের প্রতিটি আঙুল টানতে পারেন ।

আপনি উপরে উল্লেখিত শিশুর মালিশের ধাপগুলি অনুসরণ করতে পারেন, তবে নিশ্চিত হোন যে, আপনি আপনার শিশুর শরীরের যে কোনো অংশে বেশি চাপ প্রয়োগ যেন না করেন ।

কিছু টিপস

আপনার শিশুকে মালিশ করার জন্য আপনি অনুসরণ করতে পারেন এমন কিছু টিপস এখানে দেওয়া হল:

আপনার শিশুকে মালিশ করার জন্য কিছু টিপস

১) হালকা ও কোমল চাপ দিন

আপনার শিশু খুব কমনীয় এবং নরম, অতএব মালিশের সময় অত্যধিক বা শক্তিশালী চাপ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকুন । এছাড়াও আপনার শিশুর জনন অঙ্গ এবং কুঁচকি এলাকার কাছাকাছি মালিশ করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয় ।

২) শিশুটি একটি ভাল মেজাজে আছে কিনা নিশ্চিত করুন

শিশু বদমেজাজে থাকলে বা বিরক্ত হলে মালিশ করবেন না । আপনি যদি কোন নির্দিষ্ট শরীরের অংশকে মালিশ করার সময় আপনার শিশুর অস্বস্তি হয়, তবে অই অংশটিকে এড়িয়ে যাওয়ার এবং অন্য অংশে মালিশ করার পরামর্শ দেওয়া হয় । তবে, যদি শিশুকে অসুখী বা অস্বস্তিকর মনে হয়, মালিশ করা বন্ধ করুন ।

৩) আপনার শিশুর সঙ্গে কথা বলুন

মালিশ করার সময়, আপনি আপনার সন্তানের কাছে হাসতে, মুচকি হাসতে বা কথা বলতে পারেন । এমনকি আপনি আপনার শিশুর কাছে গান গাইতে বা গুণগুণ করতে পারেন । আপনার শিশুর সাথে যোগাযোগ করা আপনার শিশুকে আগ্রহী এবং সুখী রাখে ।

৪) একটি রুটিন তৈরি করার চেষ্টা করুন

মালিশের সময় মেনে চলতে এবং বেশি পরিবর্তন না আনতে পরামর্শ দেওয়া হয় । সময়সূচী ধরে রাখা শিশুর নিয়মিত রুটিন পেতে এবং মালিশের সময়টাকে এভাবে আরো আরামদায়ক এবং প্রস্তুত হতে সাহায্য করে ।

৫) অতিরিক্ত তেল মুছে ফেলুন

মালিশ শেষ করার পরে, আপনার বাচ্চার হাতের তালু এবং আঙ্গুলগুলি সুন্দরভাবে মুছে ফেলতে হবে, কারণ বাচ্চারা সাধারণত তাদের আঙুলগুলো মুখের ভিতরে ভরে রাখে । এছাড়া আপনার শিশুর জন্য নিরাপদ একটি তেল বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় ।

শিশুর মালিশ আপনার শিশুর সাথে বন্ধন তৈরি করার সেরা উপায় । যতক্ষণ আপনি চান ততক্ষণ মালিশ চালিয়ে যেতে পারেন । তবে, যদি আপনার শিশুর মালিশ সংক্রান্ত উদ্বেগ বা প্রশ্ন থাকে, তবে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেওয়া হয় ।