সন্তানের জন্মের পরে আতুর অবস্থায় ভারতীয় অভ্যাস বা অনুশীলনগুলি

সন্তানের জন্মের পরে আতুর অবস্থায় ভারতীয় অভ্যাস বা অনুশীলনগুলি

সফলভাবে একটি সুস্থ সন্তানের জন্মদান করা মায়ের পাশাপাশি শিশুর জন্যও বেশ বড় একটি লক্ষ্য অর্জন।প্রসবের সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি মা ও সন্তান উভয়ের উপরেই একটি উপশুল্কের চাপ সৃষ্টি করে,আর সেই কারণেই এটি তাদের দেহের উপরেও চরম করের বোঝা আরোপ করে।সন্তান প্রসবের সময় দেহস্থ সকল শক্তি সেটিতেই কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ে আর তার জন্যই এই পর্যায়ে একজন মা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন।আবার অপরদিকে,সদ্যজাত শিশুটিও এই পৃথিবীকে সদ্য অনুভব করায় এবং তার জীবনে এই পৃথিবীর সকল রূপ রস গন্ধের প্রতিটি প্রথম মুহূর্তকে চ্যালেঞ্জের সাথে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সেও এই পর্বে বেশ উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকে।তাই তাদেরকে একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশের মধ্যে রাখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রসবোত্তর বন্দিদশা বা আতুর ঘরের ব্যাপারটি আসলে কি?

প্রসবোত্তরকালে আতুর ঘরে থাকার সময় সন্তান প্রসবের পর সকল প্রয়োজনীয় দিকগুলির কথা বিবেচনা করা হয় এবং মা ও সন্তানকে এমন এক জায়গায় রাখা হয় যা উভয়ের জন্যই উপকারী।প্রসবোত্তর বন্দিদশাটি তখনই প্রবর্তিত করা যেতে পারে যদি সেক্ষেত্রে মা এবং সন্তানের সাহায্যার্থে পরিবার এবং আত্মীয় পরিজনবর্গরা তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একটি ভালমত সমর্থন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।প্রসব পরবর্তীকালে আতুর ঘরে থাকার বিষয়টি কার্যকর হয় তখনই যেখানে একজন সদ্য হয়ে ওঠা মাকে তার স্বাস্থ্যের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ না করা পর্যন্ত এবং নীরোগ,স্বাস্থ্যবতী ও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠা না পর্যন্ত বাড়ির মধ্যেই বন্দি অবস্থায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।পরিবারের সদস্যরা নানা কাজে নব মাকে সাহায্য করে তার যন্ত নিতে ব্যস্ত থাকেন এবং শিশুর পরিচর্যা ও যত্নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সমর্থনের যোগান তরুণ মাকে দিয়ে থাকেন।

সন্তানের জন্মের পর এই বন্দিদশার সময়কাল কত দিন পর্যন্ত হতে পারে?

এই বন্দিদশার সময়কাল সাধারণত নির্ভর করে মা এবং সন্তান নিরাময় প্রক্রিয়ার সাথে কতটা ভালভাবে সামাল দিয়ে ওঠে তার উপর।কখনও কখনও অস্ত্রপচারের মাধ্যমে প্রসব করানো হলে সেইক্ষেত্রে এই সময়কাল কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।আবার এই সময়কালটি আরও প্রলম্বিত হয়ে উঠতে পারে যদি প্রসবের সময় দুজনের মধ্যে কেউ কিছু জটিলতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগে।একজন মাকে তার নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে, সাধারণভাবে মোটামুটি 40 দিন ব্যাপী সময়সীমাকে স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা হয়।

কিছু ক্ষেত্রে আবার মায়েরা প্রসবের পরবর্তী বিশেষ এই ধরণের আতুর ঘরে থাকার উপর বিশ্বাস করেন না এবং যেই মুহূর্তে তারা ভালবোধ করেন সেই মুহুর্তেই তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন।এটি সাধারণ ঘটে থাকে কর্মরতা প্রচুর মায়েদের ক্ষেত্রে,যদি তাদের পর্যাপ্ত ছুটি না থাকে অথবা তারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজের জগতে ফিরতে চান।

প্রসব পরবর্তী আতুর অবস্থায় ভারতে কোন কোন অভ্যাসগুলি অনুশীলন করা হয়?

সদ্য হয়ে ওঠা মায়েদের জন্য এই সকল পরম্পরাগত অভ্যাসগুলি সারা দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ভিন্ন হয়ে থাকে।শারীরিক নিরাময় এবং মা ও শিশু উভয়েরই হারানো শক্তি পুনরায় ফিরিয়ে আনার উপর মূল লক্ষ্য রাখা হয়,একটি বিশেষ ডায়েট মেনে চলা এক্ষেত্রে একইসাথে সাহায্য করে এবং দুগ্ধ ক্ষরণকে উদ্দীপিত করে আর তার সাথেই আবার বিশেষ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করাও শরীরের উপর পড়া অবাঞ্ছিত যেকোনও চাপ এড়াতে সাহায্য করে।

প্রসবোত্তর ম্যাসাজ বা মালিশ

মায়ের শরীর নানা ধকলের মধ্য দিয়ে বেশ বিস্তৃত সময় পেরিয়ে আসে এবং যাতে তিনি পুনরায় সার্বিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন তার জন্য প্রয়োজন সব দিক থেকে সহযোগিতা।

  • বেশিরভাগ পরিবারে,পরম্পরাগতভাবে চলে আসা, হয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে সুপরিচিত একজন অঙ্গমর্দিকা অথবা কোনও পেশাদার ম্যাসাজ থেরাপিস্টকে তাদের পরিবারের নবমায়ের জন্য নিয়োগ করার ঝোঁক থাকে,যিনি প্রসবোত্তর মালিশের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত কৌশলগুলি প্রয়োগ করেন।

প্রসবোত্তর ম্যাসাজ বা মালিশ

কিছু স্বাস্থ্যসম্মত তেল এবং হালকা গরম জলের সাথে একজন নতুন মায়ের সারা দেহ যথাযথভাবে মালিশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।এগুলি সারা দেহে রক্ত সঞ্চালনকে উদ্দীপিত করে,আবার এই মালিশের দ্বারা বাইরে থেকে প্রয়োগ করা চাপ পেটের এবং দেহের যেকোনও জায়গার প্রসারিত চিহ্ন বা বলিরেখাগুলি দূর করতেও সহায়তা করে।

  • সাধারণত দেহের পিছনের অংশ অর্থাৎ পিঠ,কোমড়,থাই এবং নিতম্ব অঞ্চলের দিকেই এই মালিশের মনোযোগটিকে বেশি মাত্রায় দেওয়া হয়।কারণ এগুলি হল সেই সকল প্রধান জায়গা,যেগুলিতে গর্ভাবস্থাকালে এবং প্রসবের সময় প্রচুর রূপান্তর হয় এবং চাপ সহ্য করে।
  • যে সকল মহিলাদের অস্ত্রপচারের মাধ্যমে প্রসব করানো হয়ে থাকে,সারা শরীরে মালিশ বা ম্যাসাজ তাদের জন্য সবক্ষেত্রে আদর্শ নাও হয়ে উঠতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুর দ্বারা নির্ধারিত কিছু অতিরিক্ত সাবধানতাও অবলম্বন করতে হতে পারে।

বেবি ম্যাসাজ বা শিশুদের মালিশ

মায়ের পাশাপাশি শিশুর জন্যও মালিশের প্রয়োজন।এটি খুবই জরুরি কারণ মায়ের গর্ভের বাইরে এই পৃথিবীতে এটিই তার প্রথম আবির্ভাব এবং এই বিশ্বের সকল প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য তার দেহের ক্রম বিকাশ শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে শক্তির প্রয়োজন,যা এই মালিশের মাধ্যমে তার পেশীগুলিকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

  • যদিও প্রসবের পর মায়েরা নিজেরাই তাদের সন্তানদের মালিশ করা শুরু করতে পারেন কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেরা কিছুটা সুস্থ হয়ে ভালবোধ করার পরেই সেটি সাধারণত করা স্থির করেন।ততদিন পর্যন্ত স্থানীয় কোনও দাইমা বা পরিবারের কোনও সদস্যও শিশুকে মালিশ করার দায়িত্বটি গ্রহণ করতে পারেন।
  • শিশুদের মালিশ করার সাধারণ উদ্দেশ্যটি হল তাদের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা এবং তাদের অস্থিগুলিকে স্বাস্থ্যকর রাখা।প্রয়োজনীয় কিছু শিশু মালিশকারী তেল ব্যবহার করে সেগুলিকে ভাল করে মালিশের দ্বারা তার দেহে প্রবিষ্ট করানোর মাধ্যমে তার হাতপায়ের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করে তুলে আপনার ছোট্টটিকে বেশ কিছুটা আরাম দেওয়া যেতে পারে যা আবার তাকে ভালভাবে ঘুম পাড়াতেও সাহায্য করে।
  • শিশুদের মালিশ প্রতিদিন তাদের স্নান করানোর আগে দীর্ঘ সময় ধরে করানো হয়।সাধারণত দেখা যায় যখন তাদের ম্যাসাজ করা হয় তখন আপনার সন্তান কাঁদতে পারে,খেয়াল রাখবেন যেন তাদের নমনীয়তার সাথে মালিশ করা হয়।
  • পরম্পরাগত ধাত্রী মায়েরা শিশুরদের যে চিরাচরিত পদ্ধতিতে মালিশ দিয়ে থাকেন তা অনেক সময় বেশ কষ্টকর বলে মনে হতে পারে।বেশির ভাগ ধাত্রীরাই খুব অভিজ্ঞ হন,যাইহোক তবে আবার এরকম কিছু ঘটনাও দেখা গেছে যে প্রচুর পরিমাণে মালিশ করার ফলে শিশুদের শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে।

প্রসব পরবর্তীকালে আঁতুর অবস্থায় ভারতীয় খাদ্যের তালিকা

প্রসব পরবর্তীকালে মায়ের খাদ্য তালিকাটি পর্যাপ্ত পুষ্টিপূর্ণ হবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।এই সময়ে কয়েকটি খাদ্য অবশ্যই ডায়েটে তলিকাভূক্ত করতে হবে যা মাকে তার সদ্য মাতৃত্বের এই অভিনব পর্যায়ে সাহায্য করবে।

  • মৌরি দানার সাথে সাথে জিরা দানাও প্রসব পরবর্তী পর্যায়ে খুব উপকারী। কয়েকটি মৌরি দানা গ্রহণ আপনার পাচনতন্ত্রের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে, অনাক্রম্যতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলার পাশাপাশি আবার মাতৃদুগ্ধ ক্ষরণ বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে।জিরা জল দিনে দুবার করে পান করলে ওই একই উপকারগুলি পাওয়া যায় এবং তা যেকোনো ধরনের সংক্রামণকে দূরে রাখে।
  • প্রসব পরবর্তী পর্যায়ে সাধারণত একজন মায়ের জন্য অন্যতম একটি সহজপাচ্য খাদ্য হল খিচুড়ি।এটি খাওয়া সুবিধাজনক এবং তার পাশাপাশি এটি হজম করাও বেশ সহজ কারণ এটি আংশিক শক্ত ও আংশিক তরলের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘনত্বে নানা ধরণের সবজি সহযোগে প্রস্তুত করা হয় যা প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুলি সরবরাহ করে থাকে।
  • গর্ভাবস্থার মতই প্রসবের পরবর্তীতেও শিশু পুষ্টির জন্য মায়ের উপরেই নির্ভর করে থাকে মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে।অতএব,মায়ের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত সবজি,বিশেষ করে সবুজ শাকপাতা অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন,যা শিশুকে পুষ্টি সরবরাহ করে তার মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে।
  • এই সময় হাইড্রেট থাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।এই সময়ে দেহে একটা বড় অনুপাতে তরলের প্রয়োজন হয় কারণ এই পর্বে প্রচুর পরিমাণ দেহস্থ জল দুধ উৎপাদনে ব্যয় হয়।আবার এর সাথেই মাঝে মধ্যে ডাবের জলে চুমুকের পাশাপাশি গরম দুধ এবং স্যুপ পান করাও মায়ের পক্ষে বেশ আরামদায়ক হয়ে উঠতে পারে।
  • নব মায়েদের জন্য লাড্ডু হল অপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য পদ।সাধারণত গণ্ড লাড্ডুগুলির মধ্যে মেথি দেওয়া থাকে যা শিশুর বৃদ্ধির অনুকূল হওয়ার পাশাপাশি দ্রুত নিরাময়েও সহায়তা করে।এরকম বিভিন্ন ধরণের আরও অন্যান্য লাড্ডুগুলি দেহের ব্যথা বেদনাগুলি হ্রাস করতেও সাহায্য করে।

প্রসব পরবর্তীকালে আঁতুর অবস্থায় ভারতীয় খাদ্যের তালিকা

  • মায়ের খাদ্য তালিকায় মৌরি অন্তর্ভূক্ত করুন,এটি করা যেতে পারে তার জন্য প্রস্তুত পরোটার মধ্যে এটি ব্যবহারের মাধ্যমে।আবার এমনকি জলের মধ্যে মৌরি ফুটিয়ে সেটি পান করলেও তা মায়ের জরায়ুকে নিজে থেকেই পরিষ্কার হতে এবং হারানো শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে।
  • অনেক পরিবারেই এই পর্যায়ে নতুন মাকে পচুর পরিমাণে ঘি খাওয়ানোর চল আছে।আদর্শগতভাবে,এটি সংযমের সাথে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত,যা দেহে প্রচুর পুষ্টি সরবরাহ করে এবং মায়ের অন্ত্রের গতিবিধিকে উদ্দীপিত করে।

আতুর অবস্থায় মাতৃত্বের নিয়ম কানুন

বেশিরভাগ পরিবারের মধ্যেই নতুন মায়ের উপর বেশ কিছু রীতি নীতি,নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকে,যেগুলি হয় পারম্পরিকভাবে কিম্বা চিকিৎসাগত প্রয়োজনে মেনে চলতে হয়।

  • চুল ধোয়ার সময় ধুনার ধোঁয়ার ব্যবহার করা
  • একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যৌন সহবাস থেকে বিরত থাকা
  • হালকা সাজসজ্জা করা এবং সারা দেহ ঢেকে রাখা
  • গৃহস্থলীর কাজগুলি থেকে দূরে থাকা
  • অর্থহীন টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলি ও কম্পিউটারের ব্যবহার এড়িয়ে চলা

প্রসবোত্তর বন্দিদশা বা আতুর অবস্থায় থাকার ধারণাটির উদ্ভব মূলত সন্তান জন্মদানের পর মায়ের আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে তাকে নানাভাবে সাহায্যের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করার জন্য।বর্তমানে হয়ত এই প্রক্রিয়ার পরম্পরাগত দৃষ্টিভঙ্গীগুলির কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা এবং নিজে হাতে করে আপনার সন্তানের যত্ন নেওয়াকে উপভোগ করার বিষয়টিকে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এর অন্যান্য শর্তাবলীর বেশিরভাগগুলিই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।