পিতা-মাতার দায়িত্ব কেবলমাত্র একটি শিশুর শারীরিক বিকাশের যত্ন নেওয়া নয় – এটি শিশুর মানসিক বৃদ্ধি উন্নত করার ক্ষেত্রে সূক্ষ্মভাবে যত্ন নেওয়াকেও বোঝায়। পিতামাতারা, যুক্তিযুক্তভাবে, তাদের সন্তানের চরিত্র গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন এবং বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে জীবনে সে কিরকম মানুষ হয়ে উঠবে তার উপর সর্বাধিক প্রভাব ফেলেন।
কিছু লোক যুক্তি দেয় যে বাচ্চারা নিজেরাই নৈতিকতা শেখে, বা প্রি-স্কুলার শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ এবং ধারণা শেখার পক্ষে বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু এটি ভুল; অল্প বয়সেই বাচ্চাদের মূল্যবোধ শেখানো ভাল, যাতে তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে সেগুলি তাদের ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে যায়।
আসুন এমন দশটি নৈতিক মূল্যবোধ দেখে নেওয়া যাক যা প্রত্যেক পিতা-মাতাদের তাদের বাচ্চাদেরকে শেখাতে হবে।
শিশুরা আশেপাশের লোকদের কাছ থেকে শেখে, তাই আপনার বাচ্চাদের ভাল মূল্যবোধ শেখানোর জন্য আপনাকে প্রথমে সেগুলিকে আপনার নিজের জীবনে মডেল করতে হবে। আপনি মৌখিকভাবে অসংখ্য মূল্যবোধ ব্যাখ্যা করতে পারেন, তবে আপনার বাচ্চা কেবলমাত্র সেগুলিই বেছে নেবে যেগুলি আপনি আপনার নিজের আচরণের মাধ্যমে দেখাবেন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা গল্পের মতো হয় এবং সমস্ত বাচ্চারা গল্প শুনতে পছন্দ করে। আপনার নিজের জীবন থেকে গল্প বাচ্চার সাথে শেয়ার করুন, যেখানে নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলার ফলে আপনার জীবনে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং এইভাবে আপনার শিশু আরও ভালভাবে বুঝতে বাধ্য।
এমন একটি সিস্টেম নিয়ে আসুন, যেখানে আপনি আপনার সন্তানকে তার জীবনে এই মূল্যবোধগুলি ব্যবহার করার জন্য পুরস্কৃত করবেন। প্রশংসা এবং পুরষ্কার হ’ল ইতিবাচক শক্তিবৃদ্ধি যা শিশুদের গঠনে অবিশ্বাস্যভাবে ভাল কাজ করে।
এই নৈতিক মূল্যবোধগুলি কীভাবে প্রতিদিনের জীবনে কাজ করে তা সম্পর্কে আপনার শিশুর সাথে প্রতি দিনই কথোপকথন করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি খবরের কাগজের একটি নিবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন এবং আপনার সন্তানকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে সে এই একই পরিস্থিতিতে কী করত।
টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট থেকে কোনভাবেই রেহাই পাওয়া যায় না, তবে আপনার শিশু যা দেখছে তা আপনি অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। নিশ্চিত হয়ে নিন যে শো-টি ভাল মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রচার করে এবং তার বয়সের জন্য উপযুক্ত হয়।
অনেক বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের কেবল বড়দের শ্রদ্ধা করতে শেখান, এটি ঠিক নয়। বয়স বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলেই শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য। শ্রদ্ধা একটি অপরিহার্য নৈতিক মূল্যবোধ যা আপনার শিশুকে অল্প বয়সেই অবশ্যই জেনে রাখতে হবে, কারণ এটি অপরিচিত এবং প্রবীণদের সাথে তার আচরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে সমস্ত বাচ্চারা অল্প বয়স থেকেই তাদের সমবয়সী এবং প্রবীণদের সম্মান জানায় তারা ভবিষ্যতে এ থেকে উপকৃত হবে। এমনকি ভবিষ্যতে কঠিন সময় এলেও, আপনার শিশুটি অন্যের সাথে আরও বেশি অনুনয়ী হয়ে কথা বলবে।
পরিবার বাচ্চাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি তাদের জীবনকে আকার দেয় এবং তাদের লালনপালন করে প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলে। অতএব, আপনার বাচ্চাদেরকে পরিবার সম্পর্কে একটি ধারণা প্রদান করা এবং পরিবার কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে তাদের সহায়তা করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি করুন এবং আপনার বাচ্চারা ভালো ও খারাপ সময়ে তাদের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রেখে বেড়ে উঠবে।
বাচ্চাদের জেনে রাখা জরুরী যে সবকিছু তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে না। অল্প বয়স থেকেই তাদের শেখান যে যখন খুব প্রয়োজন হয়, তখন তাদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হতে পারে। আপনার বাচ্চাকে অবশ্যই মানিয়ে নিতে এবং আপোষ করতে শেখানো উচিত, কেবল যদি তার নিজের জীবন এখানে ঝুঁকিতে না পড়ে। মানিয়ে নেওয়া নীতিগতভাবে খুব ভালো শোনালেও, একটি সূক্ষ্ম রেখা রয়েছে যেখানে এটি আপোষ করাকে পেরিয়ে যায়। আপোষের কারণে যদি শিশুটি হারতেই থাকে তবে এটি কেবল ক্ষতিকারকই নয়, পরিচিতি লাভের পথেও বাধা হয়ে ওঠে।
আপনার শিশুকে অবশ্যই অল্প বয়স থেকে অন্যকে সহায়তা করতে শেখানো উচিত, এমনকি সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকেও। আপনার বাচ্চাকে শেখাতে হবে যে কেন অন্যকে সহায়তা করা এত গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনি যখন কাউকে সাহায্য করেন তখন কীভাবে আপনি সর্বদা এটি ফিরে পান। সমাজের কার্যকরী অংশ হওয়ার জন্য, আপনার শিশুটির অন্যের প্রয়োজনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার সন্তানকে গড়ে তোলা উচিত, কেবল তার নিজের ধর্মকে শ্রদ্ধা করার জন্য নয়, বরং এটা তাকে বুঝতে হবে যে প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। অল্প বয়স থেকেই আপনার বাচ্চাদের শিখিয়ে দিন যে ধর্ম বা উৎসব উদযাপন নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই সমান।
নৈতিক দিক নির্ণয় এবং ন্যায়বিচারের অনুভূতি হ’ল এমন গুরুত্বপূর্ণ দুটি মূলবোধ যা কোনও সন্তানের অল্প বয়স থেকেই থাকা উচিত। আপনার বাচ্চারা যখনই কোনও অন্যায় কাজ দেখে তখন তাদের সেটির বিষয়ে কথা বলতে সর্বদা উৎসাহিত করতে হবে যাতে তাদের নিজেদের বা অন্যের উপকার হয়।
অল্প বয়স থেকেই সততাকে বাচ্চাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সততা সর্বদা সর্বোত্তম নীতি, এবং আপনার বাচ্চাকে সে যে-কোনও ভুলই করুক না কেন সত্য বলতে উৎসাহিত করতে হবে।
আপনার সন্তানকে বোঝান যে কাউকে আঘাত করা কেবল একটি শারীরিক সমস্যা নয়- কোনও আঘাতের কারণে মানসিক এবং আবেগগত প্রভাবও পড়তে পারে। আপনার বাচ্চাদের কীভাবে ক্ষমা চাইতে হবে তা শেখাতে ভুলবেন না, এবং যদি তারা শারীরিকভাবে বা কথাবার্তার মাধ্যমে কাউকে আঘাত করে তবে তাদের তখনই ক্ষমা চাইতে উৎসাহিত করুন।
চুরি করা অন্যায়, এটি করার পিছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন- এটি বাচ্চাদের জন্য একটি ভাল মূল্যবোধ। আপনার শিশুকে শিখিয়ে দিন যে চুরি একটি ভুল কাজ, শুধু আইনগতভাবেই নয়, নৈতিকভাবেও, কারণ চুরির অর্থ হল যে সে অন্য কোনও ব্যক্তির জিনিস গ্রহণ করছে।
যে কোন মানুষের কাছে থাকা সবচেয়ে বড় অস্ত্রটিই হ’ল শিক্ষা এবং কেউ জীবনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে এটি। শিক্ষার প্রতি ভালবাসা অবশ্যই বাচ্চাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে, একেবারে প্রিস্কুলের সময় থেকে এবং আপনার সন্তানকে জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা উচিত।
নৈতিক মূল্যবোধগুলি শুরু থেকেই শিশুদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে এবং কোনও বয়সই শুরু করার জন্য খুব তাড়াতাড়ি নয়। এগুলি আপনার সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশাল ভূমিকা পালন করে এবং আপনার শিশু কীভাবে তার জীবনকে রূপ দেয় তার উপর সবচেয়ে বড় প্রভাব রয়েছে।