In this Article
গর্ভাবস্থা আপনাকে কেবল আবেগের রোলার কোস্টারে নিয়ে যায় না, পাশাপাশি এটি আপনার দেহে এমন পরিবর্তনগুলিও দেয় যা মোটেও আনন্দদায়ক নয়। যদিও গর্ভাবস্থার ত্বকের উজ্জ্বলতা একটি অনস্বীকার্য পাওনা, তবে এর পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় র্যাশ, স্ট্রেচ মার্কস এবং ত্বকের অন্যান্য সমস্যাগুলির প্যাকেজও এর অবাঞ্ছিত অংশ।
গর্ভাবস্থার র্যাশ কি?
র্যাশ হল ত্বকের এক সমস্যা যা গর্ভাবস্থার লক্ষণগুলির কারণে গর্ভাবস্থায় নিজেকে উপস্থাপন করে। এগুলির সাথে জ্বালা ও চুলকানি উপস্থিত হতে পারে। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ধরণের র্যাশ দেখা দেয় এবং যদি আপনার ত্বকে এর কোনো একটি লক্ষ্য করা যায় তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভাল।
গর্ভাবস্থায় র্যাশের কারণ কি?
গর্ভাবস্থায় র্যাশ হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। কিছু ধরণের র্যাশ কোনো অন্তর্নিহিত কারণের সাথে যুক্ত করা যায় নি, তবে গর্ভাবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট র্যাশ হতে পারে:
১. সংক্রমণ
অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া বা সংক্রমণ যখন আপনার শরীরকে আক্রমণ করে, তখন এটি প্রতিক্রিয়াটির প্রতিরোধ ক্ষমতা হিসাবে হিস্টামিন নামে একটি যৌগ উত্পাদন শুরু করে। এটি ত্বকে র্যাশ বা ফোলা অংশের আকারে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে।
২. হরমোনগুলি লিভারকে প্রভাবিত করে
কোলেস্টেসিসের মতো কিছু সমস্যা শরীরের হরমোনগুলির উচ্চ স্তরের কারণে ঘটে, যা পিত্তথলির স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে এবং চুলকানি ও র্যাশ বাড়ে।
৩. ভ্রূণের কোষ থেকে আক্রমণ
একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, ভ্রূণের কোষগুলি যদি মায়ের ত্বকে আক্রমণ করে, তখন তা চুলকানির সাথে ফোলা ভাব এবং র্যাশ তৈরি করে।
৪. প্রদাহ
অতিরিক্ত ওজনের কারণে আপনার পেট প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে টিস্যুগুলিও প্রসারিত হয় এবং প্রক্রিয়াটিতে টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর ফলে ফুসকুড়ি বা র্যাশ হতে পারে। এটি একাধিক ভ্রূণ বহনকারী গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে খুবই সাধারণ।
গর্ভাবস্থায় র্যাশ কোথায় কোথায় উপস্থিত হয়?
ধরণের উপর নির্ভর করে গর্ভাবস্থায় র্যাশ ত্বক, উরু, হাত এবং স্তন সহ শরীরের যে কোনও জায়গায় উপস্থিত হতে পারে।
র্যাশ কি আপনার শিশুকে প্রভাবিত করতে পারে?
পিইউপিপিপি (প্রিউরিটিক ইউটেক্যারিয়াল পাপুলস এবং প্লাকস অফ প্রেগনেন্সি)-এর মতো বেশিরভাগ র্যাশগুলি আপনার শিশুকে প্রভাবিত করে না। তবে অন্যান্য কিছু র্যাশ বা ত্বকের সংক্রমণ রয়েছে যা সময় মতো চিকিত্সা না করলে জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং কখনও কখনও মারাত্মকও হতে পারে।
গর্ভাবস্থার র্যাশের প্রকারভেদ
গর্ভাবস্থায় কিছু সাধারণ র্যাশ রয়েছে, যা বিভিন্ন ধরণের হতে পারে এবং তাদের তীব্রতার বিভিন্ন ডিগ্রী থাকতে পারে। নিচে তাদের তালিকাভুক্ত করা হল।
১. পিইউপিপিপি
প্রিউরিটিক ইউটেক্যারিয়াল পাপুলস এবং প্লাকস অফ প্রেগনেন্সি (পিইউপিপিপি) হল একটি সাধারণ র্যাশ, বহু গর্ভবতী মহিলা যার অভিজ্ঞতা পান। এটি গড়ে প্রতি ১৫০ জন গর্ভবতী মহিলার মধ্যে একজনকে প্রভাবিত করে বলে পরিচিত এবং ৩৪তম সপ্তাহের মধ্যে নিজেকে উপস্থাপন করে। এটি লাল দাগ বা ছাপ দ্বারা চিহ্নিত হয় অথবা চুলকানির সাথে যুক্ত ফোলা অংশ দ্বারাও চিহ্নিত করা হয়। কিছু গবেষকের মতে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে মায়ের ত্বকে ভ্রূণের কোষ আক্রমণ করার ফলে পিইউপিপিপি হয়। এই অবস্থার কারণে হওয়া র্যাশগুলি সাধারণত পেটের উপরে প্রথমে উপস্থিত হয় এবং উরু, স্তন, হাত ও নিতম্বে ছড়িয়ে পড়ে।
পিইউপিপিপি মা ও শিশুর কোনও ক্ষতি করে না এবং প্রসবের পরে অদৃশ্য হয়ে যায়। টপিকাল মলম ব্যবহার করেও এর চিকিত্সা করা যেতে পারে।
২. গর্ভাবস্থার প্রুরিগো
এই অবস্থাটি গর্ভাবস্থার একজিমা হিসাবেও পরিচিত এবং এটি সাধারণত দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে দেখা দেয়। এই অবস্থায় মহিলারা তাদের দেহের বিভিন্ন অংশে, যেমন – হাত, পা, স্তন ইত্যাদিতে ক্ষুদ্র লাল দাগযুক্ত ছাপ দেখতে পাবে। এই অবস্থাটি এটোপিক ডার্মাটাইটিসের মতো দেখা দিতে পারে, তবে এটি ভেবে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
৩. গর্ভাবস্থার ইন্ট্রাহেপাটিক কোলেস্টেসিস
গর্ভাবস্থার কোলেস্টেসিস তৃতীয় ত্রৈমাসিকে দেখা দেয় এবং প্রায় প্রতি ১০০০টি গর্ভাবস্থার মধ্যে একটিকে প্রভাবিত করে। এই অবস্থাটি গর্ভাবস্থার হরমোনগুলির বৃদ্ধির কারণে ঘটে, যা লিভারের বাইরে পিত্তের প্রবাহকে প্রভাবিত করে। পিত্তের প্রবাহ হ্রাস হওয়ার সাথে সাথে যকৃতের মধ্যে থাকা পিত্তের একটি অংশ রক্ত প্রবাহে লিক হতে পারে। এটি সারা শরীর জুড়ে অবিরাম চুলকানির সংবেদন ঘটায়, তবে হাত এবং পায়েও সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। এই অবস্থার অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ফ্যাকাশে বর্ণের মল, গাঢ় প্রস্রাব, হালকা মাত্রার জন্ডিস এবং ত্বকের বিবর্ণতা (ত্বক এবং চোখগুলি হলুদ দেখাতে পারে)।
কোলেস্টেসিস ভ্রূণের সঙ্কটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে এবং এমনকি অকাল প্রসব বা মৃত শিশু প্রসবেরও কারণ হতে পারে। সুতরাং, শিশুর ফুসফুস যখন কোনো জটিলতা রোধ করার জন্য উন্নত হয়ে যায়, তখনি প্রসব শ্রম প্ররোচিত হলে সবচেয়ে ভাল। আপনার চিকিত্সক এমন ওষুধ লিখে দেবেন যা রক্তে পিত্তের মাত্রা হ্রাস করতে এবং আপনার শিশুর নিয়মিত নিরীক্ষণ করতে সাহায্য করতে পারে, যাতে তাড়াতাড়ি প্রসব শ্রম প্রেরণার প্রয়োজন আছে কিনা তা বোঝা যায়।
৪. পেমফিগয়েড গেসটেশনিস
পেমফিগয়েড গেসটেশনিস একটি অটো-ইমিউন রোগ যা গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে ঘটে তবে এটি দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যেও শুরু হতে পারে। এই অবস্থায়, ইমিউনোগ্লোবিন টাইপ-জি অটোঅ্যান্টিটিবডিগুলি ত্বকের কোষগুলিতে আক্রমণ করে এবং ক্ষতি করে, কারণ তারা ভুলভাবে সেগুলিকে কোনো আক্রমণাত্মক হুমকি হিসাবে উপলব্ধি করে। সমস্যাটি পেটে নাভির চারপাশে লাল ছাপ হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করে এবং হাত, পিঠ এবং নিতম্বের কাছেও ছড়িয়ে পড়ে। অগ্রগতির সাথে সাথে এই চুলকানি ফুসকুড়ি ও ফোস্কা বিকাশ করে, যা তরল ভরা হয় অথবা কেবল ফোলা প্যাচগুলি তৈরি করে।
এটি বেশিরভাগ মহিলার প্রসবের পরে ঠিক হয়ে যায়; তবে কিছু মহিলার ক্ষেত্রে প্রসবের পরে কয়েক মাস ধরে এটি থেকে যেতে পারে। এটি গর্ভস্থ বাচ্চাদের প্রভাবিত করে বলে জানা যায় না, তবে জটিলতার বিরল পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের অকাল জন্ম হতে পারে বা ক্ষণস্থায়ী ফোস্কা দেখা দিতে পারে যা মায়ের অ্যান্টিবডিগুলি শোষিত হওয়ার ফলে হয়, এটি কয়েক মাসের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
৫. ইম্পেটিগো হার্পেটিফর্মিস
যদিও বিরল, তবে এটি একটি মারাত্মক অবস্থা যা কুঁচকির চারপাশে, কনুই ও হাঁটুর কাছাকাছি ফোস্কা আকারে দেখা দেয় এবং গর্ভাবস্থার প্রথম দিকেও এটি ফুসকুড়ি বা র্যাশ সৃষ্টি করে। এই অবস্থার সাথে হওয়া অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া, ডায়রিয়া, জ্বর ও সর্দি, এবং লিম্ফ নোডের সমস্যা। ফোসকাগুলি এক গুচ্ছভাবে তৈরি হয় এবং পুঁজে পূর্ণ হয়। এগুলি শুকিয়ে যায় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই খসে পড়ে যায়। নতুন ফোসকা পুরানোগুলির জায়গায় তৈরি হয়। এই অবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা প্রয়োজন এবং সেই মহিলার নিবিড়ভাবে চিকিত্সার করা প্রয়োজন, কারণ এটির চিকিত্সা না করা হলে ভ্রূণের মৃত্যু এবং এমনকি মায়ের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
৬. গর্ভাবস্থার প্রিউরিটিক ফলিকুলাইটিস
প্রিউরিটিক ফলিকুলাইটিস গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ঘটে। এই অবস্থার ক্ষুদ্র ব্রণ জাতীয় ফুসকুড়ি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং সাধারণত ব্যাকটিরিয়াল ফলিকুলাইটিস ভেবে ভুল করা হয়। এটি শিশু বা মায়ের জন্য কোনও ঝুঁকি সৃষ্টি করে না এবং গর্ভাবস্থার পরে ঠিক হয়ে যায়।
গর্ভাবস্থায় ত্বকের র্যাশের চিকিত্সা
বেশিরভাগ গর্ভাবস্থার র্যাসের চিকিত্সা কর্টিকোস্টেরয়েডের সাময়িক প্রয়োগ দিয়ে করা হয়। প্রিউরিটিক ফলিকুলাইটিসের মতো অবস্থার ক্ষেত্রেও বেনজয়েল পারক্সাইড ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্লোরফেনামিনের মতো অ্যান্টিহিস্টামাইনগুলি চুলকানি উপশমের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। কখনও কখনও, প্রডিনিসনের মতো ওরাল কর্টিকোস্টেরয়েডগুলি নির্ধারিত হতে পারে। ক্র্যাকিং এবং শুষ্কতা রোধে আপনার ত্বকে নরম ও ময়শ্চারাইজ করার জন্য ইমোলেটিনেট প্রয়োগ করার পরামর্শও দেওয়া হতে পারে।
প্রাকৃতিক প্রতিকার
আপনি র্যাশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকারও ব্যবহার করে দেখতে পারেন। এই প্রতিকারগুলির সবগুলির বৈজ্ঞানিক সমর্থন না থাকলেও অনেক মহিলা তাদের উপকারী বলে মনে করেন।
- সবজির রস পান করা শরীরকে ডিটক্স এবং পরিষ্কার করতে সহায়তা করে।
- কোলাজেন পরিপূরকগুলি ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুগুলি মেরামত করতে এবং তাদের শক্তিশালী করতে সহায়তা করতে পারে। আপনার ফলের রসে কয়েক চামচ গ্রাস-ফেড কোলাজেন মিশিয়ে খাওয়া হল এর সেরা উপায়। টপিকাল কোলাজেন ক্রিম লাগানো খুব কার্যকর হয় না, কারণ কোলাজেনের অণুগুলি ত্বকে প্রবেশ করার পক্ষে খুবি বড় আকারের হয়।
- ড্যান্ডেলিয়নএর মূল ও নেটলেট পাতার চা লিভার ও রক্তকে বিশুদ্ধ করতে পারে এবং চুলকানি ও প্রদাহ কম করতে পারে।
- ক্যামোমাইল, চাইনিজ স্কালক্যাপ এবং ক্যালেন্ডুলার মতো অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ভেষজগুলির প্রয়োগ সাময়িকভাবে ত্বকের প্রদাহ হ্রাস করতে সহায়তা করে। এই ভেষজগুলি সহজে প্রয়োগের জন্য লোশন, অ্যালোভেরা বা ডাইন হ্যাজেলে যুক্ত করা যেতে পারে।
- ওটমিল দেওয়া বাথ টাবে শরীরকে ভিজিয়ে রাখা ত্বকে চুলকানির অনুভূতি হ্রাস করতে এবং এটি ময়েশ্চারাইজ করতে সহায়তা করে। আপনি একটি কাপড়ে কিছু ক্যামোমেইল চা এবং ওটমিল বেঁধে রাখতে পারেন, এটি আপনার টাবের মধ্যে ফেলে দিন এবং ২০ মিনিটের জন্য সেই জলে বসে থাকতে পারেন।
- মানসিক চাপ কমাতে ব্যবহৃত অ্যাডাপ্টোজেনগুলিও প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। যেহেতু গর্ভাবস্থায় অ্যাডাপ্টোজেনগুলির ব্যবহার সম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণা করা হয়নি, তাই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখাই ভাল।
- চুলকানি যদি আপনার রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়, তবে আপনি আরাম পেতে এবং কিছুটা ঘুম পেতে সাহায্যের জন্য ক্যামোমাইল এবং ল্যাভেন্ডার ব্যবহার করতে পারেন।
- গর্ভাবস্থায় পিইউপিপিপি র্যাশগুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কালো চেরির রসও একটি দুর্দান্ত উপায়।
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন ধরণের র্যাশ এবং ত্বকের অবস্থার তীব্রতার আলাদা মাত্রা থাকে। অতএব, আপনি এবং আপনার শিশু নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায় হল দাগ বা ছাপের প্রথম লক্ষণটি উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সা করানো।