গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাস- এটি কি নিরাপদ?

গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাস- এটি কি নিরাপদ?

আপনার আহার করা খাদ্য আপনার স্বাস্থ্য নির্ধারণ করেআপনি যাই খান সেটা অপনার শরীরের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর সেটাই আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যদি আপনি একটি সন্তানধারণের প্রচেষ্টা করেনযদি আপনি গর্ভবতী হয়ে থাকেন, আপনার ভালোর জন্যই আপনার ডায়েটে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে আর আপনার মুখের মধ্যে কোনওকিছু প্রবেশ করানোর আগেও সে ব্যাপারে আপনার অবশ্যই দুবার চিন্তা করা প্রয়োজনএ ব্যাপারে, এমন বেশ কিছু খাদ্য আছে যেগুলি গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশে সহায়তা করে, তবে আবার এমন কিছু খাবারও আছে(ভেষজ এবং পরিপূরকগুলিও অন্তর্ভূক্ত)যা আপনার গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে, অতএব, সেগুলি কঠোরভাবে এড়িয়ে চলাই উচিত।আজ আমরা একটা নির্দিষ্ট ভেষজের বিষয়েই আলোচনা করবলেমনগ্র্যাস, যা আবার সিমবোপোগন, সিলকি হেডস, কোচিন গ্র্যাস, মালাবার গ্র্যাস নামেও খ্যাত।গর্ভাবস্থায় এই লেমনগ্র্যাস সেবন করা নিরাপদ নাকি নয় জানতে আরও পড়ুন।

লেমনগ্র্যাস কি?

লেমনগ্র্যাস আবার সিট্রোনেল্লা নামেও অভিহিত।এটি এমন একটি গাছ, যা 2 মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।এটি আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় উদ্ভিদ।লেমনগ্র্যাস একটি ভেষজ হিসেবে রান্নায় ব্যবহৃত হয় এবং এর পাতা ও তেল ওষুধ প্রস্তুতে ব্যবহার করা হয়।

অনেক লোক চায়ের সাথে লেমনগ্র্যাস যুক্ত করে থাকেন।তবে এর মধ্যস্থ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং প্রিজারভেটিভ বা সংরক্ষণ করে রাখার বৈশিষ্ট্যাবলী বজায় থাকার পাশাপাশি আবার এর মধ্যে তাজা লেবুর স্বাদের উপস্থিতি থাকায়, এটি রান্নার মধ্যে একটি উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, কারণ আর মধ্যস্থ সকল বৈশিষ্ট্যাবলীই কোনও খাদ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাস খাওয়াটা কি নিরাপদ?

লেমনগ্র্যাসের মধ্যে সিট্রাল এবং মাইক্রেন নামক দুটি যৌগ উপস্থিত থাকায়, গর্ভাবস্থায় সেটি গ্রহণ করা উচিত নয়, এগুলি গর্ভাবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।উচ্চ মাত্রায় মাইক্রেন সেবন করলে তা ভ্রূণের কঙ্কালতন্ত্রের বিকাশকে বিঘ্নিত করতে পারে এমনকি পরিণামস্বরূপ গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটতে পারে।

লেমনগ্র্যাসের চা অথবা পরিপূরক হিসেবে গাঢ় কিম্বা ঘন আকারে গ্রহণ করলে তা গর্ভাবস্থায় মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।লেমনগ্র্যাস সবসময় অল্প পরিমাণে গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন থাইডিশগুলির মত, যেখানে এটিকে ফোঁড়ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে এটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলাটাই সবচেয়ে ভাল।

গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাস খাওয়াটা কি নিরাপদ?

গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাসের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি

গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাস সেবনের প্রভাব ক্ষরিকারক হতে পারে কিন্তু এর প্রভাবগুলি মানুষের উপর ব্যবহারিক পরীক্ষা করা হয় নি।উচ্চ মাত্রায় লেমনগ্র্যাস সেবন এড়িয়ে চলার পরামর্শটি যৌক্তিক অনুমান এবং তার সাথে আবার ইঁদুরের উপর পরিচালিত গবেষণার উপর ভিত্তি করেই দেওয়া হয়ে থাকে।

ভ্রূণের উপর প্রভাবগুলি

  • লেমনগ্র্যাসের নির্যাস কোষমৃত্যুকে দৃঢ় করে তুলতে এবং দুবর্ল বৃদ্ধির কারণে কোষের সংখ্যাবৃদ্ধিকে বাধাদান করতে পারে।
  • লেমনগ্র্যাস কঙ্কালতন্ত্রের অস্বাভাবিকতাগুলির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
  • এর প্রভাবে মৃত সন্তানের জন্মের মত নির্মম ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে পারে।

মায়ের উপর প্রভাবগুলি

  • লেমনগ্র্যাস ঋতুস্রাব হওয়ানোর ভেষজ ওষুধে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।খুব বেশি পরিমাণে এর ব্যবহারে, ভ্রূণের পর্দা বা ঝিল্লিটি ফেটে যায়, যার ফলস্বরূপ গর্ভপাত ঘটে।
  • লেমনগ্র্যাস রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করে।যদি কোনও মহিলার টাইপ 2 ডায়াবেটিস কিম্বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থেকে থাকে এবং তিনি খুব বেশি লেমনগ্র্যাস গ্রহণ করে থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে তার রক্ত শর্করার মাত্রা হঠাৎ কমে যেতে পারে, যার ফলে তার মধ্যে দেখা দিতে পারে ক্লান্তি, ঝাপসা দৃষ্টি এবং এমনকি আবার মাথা ঝিমঝিম ও ঘুরতেও পারে।
  • গলা ফোলা, ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ এবং বুকে ব্যথার মত কিছু হালকা অ্যালার্জি প্রভাবগুলিকেও লেমনগ্র্যাস বাড়িয়ে তুলতে পারে।

লেমনগ্র্যাস চায়ের বিকল্পগুলি

পূর্বের উল্লেখ মত, লেমনগ্র্যাসের চা ঘনীভূত আকারে গ্রহণ করলে তা গর্ভাবস্থায় গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।সুতরাং আপনি যদি গর্ভবতী হয়ে থাকেন এবং নিয়মিত রুটিনমাফিক লেমনগ্র্যাসের চা পান করেন, তবে এর পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে অন্য ধরণের চা যা গর্ভাবস্থার পক্ষে নিরাপদ, গ্রহণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।এর জন্য আমরা নিম্নলিখিত বিকল্পগুলির প্রস্তাব দিলামঃ

  • আদা চাঃ এটি অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করে, হজম শক্তি বাড়ায় এবং গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে মর্নিং সিকনেশ বা প্রাতঃকালীন অসুস্থতা লাঘব করতে সাহায্য করে।
  • রাস্পবেরি চাঃ এটি লাল রাস্পবেরি গুল্মের পাতা থেকে প্রস্তুত করা হয়।গর্ভাবস্থায় এটি সেবনের প্রস্তাব পরম্পরাগতভাবে দেওয়া হয়ে থাকে।তবে এই বিষয়ের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা সীমাবদ্ধ।ধারণা করা হয় যে, এটি জরায়ুর স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে এবং গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের সময় অকাল এবং বিলম্বিত জন্ম ও অন্যান্য জটিলতা উভয়ই প্রতিরোধ করে।

আপনার ভেষজ চায়ের মধ্যে লেমনগ্র্যাসের বিকল্প স্বাদ প্রতিস্থাপন করতে নিম্নলিখিতগুলি সর্বোত্তম সংযোজন গড়ে তুলবেঃ

  • লেমন জেস্ট বা লেবুর সুস্বাদ বা ফ্লেভারঃ লেমনগ্র্যাসের স্বাদের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং সম্ভবত উপযুক্ত একটি প্রতিস্থাপন হল জেস্ট বা লেবুর স্বাদের ফ্লেভার কিম্বা পাতি লেবু। স্বাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিলিপির জন্য, একটি আরুগুলা পাতার পেস্টের সাথে এক চা চামচ লেবুর স্বাদ মিশ্রণ করুন এবং এটি আপনার চায়ে ব্যবহার করুন।
  • লেবুর রসঃ স্বাদের জন্য আপনি আবার পাতি লেবুর রস অথবা লেবুর রসের কয়েক ফোঁটাও ব্যবহার করতে পারেন।

অন্তঃসত্ত্বাকালে লেমনগ্র্যাস তেল ব্যবহার করাটা কি নিরাপদ?

ত্বকে ম্যাসেজ বা মালিশ করার জন্য অথবা অ্যারোমাথেরাপির জন্য সুগন্ধি হিসাবে লেমনগ্র্যাস তেল ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ নয়, তবে তা ব্যবহার করা এড়িয়ে চলাই ভাল। ম্যাসাজ বা মালিশের জন্য অপরিহার্য তেলগুলি যখন ব্যবহার করা হয় তখন সেগুলি ত্বকে শোষিত হওয়ার মাধ্যমে কাজ করে।যেহেতু অপরিহার্য তেলগুলিতে থাকা অণুগুলি বেশ ছোট হয়, তাই সেক্ষেত্রে ভয় হল এই যে, সেগুলি হয়ত প্লাসেন্টা বা অমরাটিকে অতিক্রম করে শিশুর রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় বা সংবন তন্ত্রে প্রবেশ করতে পারে

তাছাড়াও অপরিহার্য তেলগুলিও আবার ভীষণ ঘনিভূত অবস্থায় থাকে, সুতরাং গর্ভাবস্থায় এগুলি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।আর আপনি যদি লেমনগ্র্যাস তেল একান্তই ব্যবহার করতে চান, তবে সেক্ষেত্রে জল কিম্বা কোনও কেরিয়ার বা সাহায্যকারী হালকা তেলের সাথে মিশিয়ে সেটিকে পাতলা করে নেওয়ার পরামর্শ আপনাকে দেওয়া হয়।আপনি কোনও কেরিয়ার বা সাহায্যকারী হালকা তেলের সাথে 1-2 ফোঁটা লেমনগ্র্যাস তেল মিশিয়ে নিতে পারেন এবং তারপর সেটিকে ম্যাসাজ বা মালিশের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারেন।

অন্তঃসত্ত্বাকালে লেমনগ্র্যাস তেল ব্যবহার করাটা কি নিরাপদ?

লেমনগ্র্যাস তেল ব্যবহার করার ঝুঁকিগুলি

আপনি যদি এই তেলের প্রতি অ্যালার্জি প্রবণ হয়ে থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে এই তেল নিম্নোলিখিত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা বা সমস্যাগুলি সৃষ্টি করতে পারে।এমনকি আপনি যদি এই তেলের প্রতি অ্যালার্জিপ্রবণ নাও হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রেও কিন্তু আপনি নিম্নোলিখিত উপসর্গগুলি লক্ষ্য করতে পারেনঃ

  • ত্বকে বা চামড়ায় জ্বালা করা
  • জ্বলন অনুভূতি
  • র‍্যাশের ক্রমবিকাশ(আমবাত)

মনে রাখার বিষয়গুলি

গর্ভাবস্থায় আপনি যদি লেমনগ্র্যাস (যেকোনও আকারে)ব্যবহারের পরিকল্পনা করে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার মনে রাখা উচিত এমন কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলঃ

  • ব্যথার জন্য লেমনগ্র্যাস তেল ব্যবহার করার আগে, আপনার এটিতে অ্যালার্জির প্রবণতা রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য একটি স্কিন প্যাচ পরীক্ষা করান।
  • লেমনগ্র্যাস তেল কিম্বা অন্য যেকোনও অপরিহার্য তেলগুলি সর্বদা অন্য কোনও কেরিয়ার বা সাহায্যকারী হালকা তেলগুলির সাথে মিশিয়ে পাতলা করে নেওয়া উচিত, অন্যথায় এটি ত্বককে পুড়িয়ে দিতে পারে।
  • আপনার যদি ডায়াবেটিস বা লো ব্লাড সুগার বা নিম্ন রক্ত শর্করা থাকে, সেক্ষেত্রে কখনই যেন লেমনগ্র্যাস চা খাবেন না, কারণ এটি আপনার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে।
  • লিভার এবং কিডনির উপর লেমনগ্র্যাসের প্রভাবগুলি বেশি শক্তিশালী হওয়ার কারণে, লেমনগ্র্যাসের কোনও পণ্য গ্রহণ করার পূর্বে সর্বদা একজন ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।আপনি যদি কিডনি অথবা লিভার সম্পর্কিত কোনও অসুস্থতায় ভোগেন অথবা পূর্বে কখনও ভুগে থাকেন, সেক্ষেত্রে এটি কোনওভাবে ব্যবহার না করাই সর্বোত্তম।

গর্ভাবস্থায় লেমনগ্র্যাস হল একটি সম্ভাব্য ক্ষতিকারক মাধ্যম এবং অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সহজ উপায়টি হল এটিকে পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে চলা।যদি কোনওক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় আপনি এটিকে ব্যবহার করতে চান, তবে সেক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে চলুন।