গর্ভাবস্থা হল মহিলাদের একটি অতীব দুর্বলতার সময়।গর্ভবতী মহিলাদের সর্বদাই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগুলি গ্রহণ করতে এবং তেল মশলাযুক্ত ভাজাভুজি খাদ্যগুলিকে পুরোপুরি ত্যাগ করার কথাই বলা হয় তাদের গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির জন্য।যদি আপনি গর্ভবতী হয়ে থাকেন,আপনাকেও এই একই কথা বলা হবে এবং আপনি অবশ্যই অবাক হয়ে যাবেন এই ভেবে যে কীভাবেই বা আপনি সম্পূর্ণরূপে সেই সকল খাদ্যগুলি খাওয়া ছেড়ে দিতে পারেন যেগুলি আপনার একান্ত পছন্দের!এটি বেশ শক্ত মনে হতে পারে কফি,পিৎজা,পাস্তার মত লোভনীয় খাবারগুলিকে একেবারে ত্যাগ করা,তাই নয় কি?কিন্তু আপনি এটি করতে পারেন,আমাদের বিশ্বাস করুন!বেশিরভাগ খাদ্য যেগুলি অন্য সময়ে খাওয়ার জন্য নিরাপদ,সেগুলির সবগুলিই আবার গর্ভাবস্থায় নিরাপদ নাও হতে পারে।অতএব,সেই সকল খাদ্যগুলি সম্পর্কে আপনার জেনে নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেগুলি গর্ভাবস্থায় আপনার পরিহার করে চলা উচিত।
যে সকল ভারতীয় খাদ্যগুলি গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক হতে পারে
গর্ভাবস্থায় আপনি আপনার মুখের ভিতরে যাই ঢোকান না কেন তার সবটাই আপনার গর্ভস্থ সন্তানের সাথেও ভাগ হয়ে যাবে। সুতরাং খাবারের ব্যাপারে আপনার স্বাস্থ্যকর পছন্দগুলিকে বেছে নেওয়া খুবই জরুরি।আপনার জন্য যেটি ভাল সেটি আবার আপনার গর্ভের অভ্যন্তরে বেড়ে ওঠা আপনার ছোট্টটির জন্য পুরোপুরি ভাল নাও হতে পারে।তাই গর্ভাবস্থায় বুদ্ধিমানের মত বিচক্ষণতার সাথে আপনার খাদ্য পছন্দ করুন এবং পরিহার করুন, আর এভাবেই আপনার গর্ভস্থ ছোট্টটিকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখুন।
1. কাঁচা পেঁপে
আপনি নিশ্চই ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন যে গর্ভাবস্থায় পেঁপে খাওয়া বর্জন করা উচিত,কিন্তু আপনি কি জানেন কেন সেটা?কাঁচা পেঁপে অথবা পেকে না যাওয়া পেঁপে কিম্বা আংশিক পাকা পেঁপে গর্ভাবস্থায় খাওয়া নিরাপদ নয়।কাঁচা পেঁপের মধ্যে রয়েছে উচ্চ ঘনত্বে ল্যাটেক্স,যেটি বিশেষভাবে ক্ষতিকারক কারণ এটির থেকে জরায়ুর সংকচন হতে পারে,যা আবার এমনকি গর্ভপাতও ঘটাতে পারে।এছাড়াও এর মধ্যে থাকে প্যাপাইন এবং পেপসিন,যা ভ্রূণের বিকাশে প্রভাব ফেলে এবং পরিণতিতে নানা জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়।
2. তুলসী পাতা
আজ্ঞে হ্যাঁ,তুলসী পাতাও গর্ভাবস্থায় খাওয়া নিরাপদ নয়।সর্দি-কাশি হলে আমরা প্রায়ই তুলসী পাতা খেয়ে থাকি।কিন্তু তুলসী পাতার মধ্যে আছে মার্কারী,যা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকারক এবং সংকোচনের প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে।
3. ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা এবং অ্যালোভেরার রস
ত্বকের সমস্যার নিরাময়কারী হিসেবে পরিচিত অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী প্রকৃতপক্ষে গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।অ্যালোভেরা কেবলমাত্র জরায়ুতে প্রভাব ফেলে সংকোচনের মাত্রাকেই বৃদ্ধি করে না,এটি আবার দেহের মধ্যে শর্করার মাত্রাও হ্রাস করে।এর পাশাপাশি এটি ভ্রূণের জন্যও উপকারী নয়।একই সাথে আবার এই অ্যালোভেরা বমি করা এবং ডায়রিয়ার মত কিছু প্রতিক্রিয়াগুলিকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে,যার কারণে দেহের ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রার ভারসাম্যও বিঘ্নিত হতে পারে।
4. হিং
হিন্দি এবং বাংলায় হিং নামে পরিচিত বস্তুটি হল ভারতীয় রন্ধনশালায় ব্যবহৃত একটি অত্যন্ত পরিচিত সাধারণ উপকরণ। আমারা এটিকে কারি,ডাল এবং অনেক সবজিতেই ব্যবহার করে থাকি।এটি যে নিঃসন্দেহে যেকোনও রেসিপির স্বাদকে বাড়িয়ে তোলে তা বলাই বাহুল্য।কিন্তু এটিকে গর্ভাবস্থায় খাওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয় না।হিং দেহের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং এনার্জি বা শক্তি সরবরাহের জন্য তাপমাত্রাকে আরও উন্নীত করে।আর সেটি ভ্রূণের জন্য আদর্শ নয় কারণ ভ্রূণের বিকাশের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার তাপমাত্রারই প্রয়োজন হয়।সুতরাং,গর্ভাবস্থায় এটি এড়িয়ে চলাই সবচেয়ে ভাল।
5. মেথি বীজ
বাংলা এবং হিন্দিতে মেথি দানা হিসেবে পরিচিত এই উপাদানটি মহিলাদের স্তন দুধ উৎপাদনে উদ্দীপিত করার কারণে সন্তান প্রসবের পরবর্তীতে এটি নতুন মায়েদের ডায়েটের একটি মূল অঙ্গ হয়ে ওঠে।তবে যদি গর্ভাবস্থায় এই মেথি দানাগুলি গ্রহণ করা হয়,তবে সেক্ষেত্রে এগুলি মা এবং সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্যের উপরেই বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।মেথি দানার মধ্যে রয়েছে ফাইটোইস্ট্রোজেন,যা শরীরে প্রবেশ করে মহিলাদের মাসিক চক্রকে প্ররোচিত করার পাশাপাশি হরমোনগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করে।এটি গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে সঙ্কোচন আরম্ভ করতে পারে এবং পরবর্তীতে তা গর্ভপাতের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
6. আনারস
কিছু মহিলার মধ্যে আবার আনারস খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় তাদের নির্ধারিত তারিখ এগিয়ে আসার সাথে সাথে,সেটা ততদিনই ঠিক আছে যতদিন পর্যন্ত আপনার ডাক্তারবাবু এটা খাবার ব্যাপারে আপনাকে অনুমতি দিয়ে থাকেন।তবে গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে আনারস খাওয়া?একেবারে দৃঢ়ভাবেই “না”।আনারসের মধ্যে আছে ব্রোমেলাইন উৎসেচকটি,যেটি সার্ভিক্সকে নমনীয় করে তোলে এবং প্রসব শ্রমকে প্ররোচিত করতে সহায়তা করে।সুতরাং এটি হয়ত অযাচিত সংকোচনের দিকে পরিচালিত করতে পারে এবং পরিণতিতে গর্ভপাতও ঘটতে পারে।
7. কাঁচা ডিম
ডিম অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি বহুমুখীখাদ্য বিশেষ আর স্বাদে নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।কিন্তু আপনি কি তার আস্বাদ গর্ভাবস্থায় গ্রহণ করতে পারেন?হ্যাঁ,আপনি তা পারেন কিন্তু সবরকম ভাবে নয়!আপনি যদি চান তো সেদ্ধ ডিম খেতেই পারেন,আপনার গর্ভাবস্থাকালের ডায়েটে এগুলি অন্তর্ভূক্ত করা নিরাপদ।কিন্তু আপনার সেগুলি কখনই কাঁচা অবস্থায় খাওয়া উচিত নয়।কাঁচা ডিম খাবারের বিভিন্ন প্রস্তুতিগুলির মধ্যেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে যেমন মেয়োনিজ,পুডিং,মাফিনস ইত্যাদির মত বিভিন্ন ডেজার্টের মধ্যে এবং নানা ধরণের শসের মধ্যে।কাঁচা ডিমের মধ্যে সালমোনেল্লা ভাইরাসের উপস্থিতির মত ঝুঁকির উচ্চ সম্ভাবনা থাকে,যা গর্ভাবস্থার একাধিক জটিলতা সৃষ্টির কারণ হিসেবে পরিচিত।সুতরাং আপনার সেগুলিকে কাঁচা অবস্থায় খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
8. নোনতা খাবার
নোনতা এবং মশলাদার ঝাল ঝাল মুখরোচক খাবারগুলি ওহ!জিভে জল আনা স্বাদ তাই না?আপনার হয়ত সেগুলি খাওয়ার তীব্র বাসনা মনে জেগে উঠতে পারে এবং আপনার ক্ষুধা এবং স্বাদকোরকগুলিকে পরিতৃপ্ত করার জন্য আপনি উদগ্রীব হয়ে উঠতে পারেন,কিন্তু গর্ভাবস্থায় এই সকল উচ্চ লবণযুক্ত খাদ্যগুলিকে এড়িয়ে চলার জন্যই আপনাকে উচ্চ মাত্রায় সুপারিশ করা হয়।এগুলির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে আপনার সবচেয়ে পছন্দের সিঙ্গারা,পকোড়া এবং এমনকি আবার সাধারণ আলুর চিপসগুলিও।উচ্চ মাত্রায় লবণ আপনার দেহে বেশি পরিমাণে জল ধারণ করে রাখতে পারে এবং তা প্রচুর সমস্যার কারণ হতে পারে।সুতরাং এগুলিকেও এড়িয়ে চলুন।
9. স্ট্রীট ফুড বা রাস্তার খাবার
হ্যাঁ,আমরা জানি এটি আপনার জন্য এক টুকরো দুঃখের সংবাদ, কিন্তু আপনি যদি আপনার গর্ভস্থ সন্তানটিকে সুরক্ষিত এবং সুস্থ রাখতে চান,রাস্তায় বিক্রি হওয়া খাদ্যগুলি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন।সাময়িক কিছু সময়ের জন্য সুস্বাদু চাট এবং চাইনীজ খাবারগুলির কথা ভুলে যান।হ্যাঁ এই সকল খাবারগুলির জন্য আপনার প্রবল ইচ্ছে হবে ঠিকই,বিশেষ করে সেটি আরও বাড়বে গর্ভাবস্থায়,কিন্তু সেক্ষেত্রেও নিজেকে সংযত রাখুন কারণ রাস্তার বিক্রেতারা সাধারণত খাবারগুলি প্রস্তুত করার সময় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সঠিক মানের রান্না করার পদ্ধতিটি মেনে চলে না।সুতরাং গর্ভাবস্থায় রাস্তার খাবার খেলে তা হয়ত আপনাকে এবং আপনার সন্তানকে বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।আপনার পেট ফেঁপে যেতে অথবা বদহজম হতে পারে,যা ভীষণ অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে।স্ট্রীট ফুডগুলিও ভীষণ মশলাদার হয়ে থাকে আর সেই কারণেও আবার আপনার এগুলি খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।তেল মশলাদার খাদ্যগুলি গ্রহণ করার ফলে তা হৃদয় জ্বলন বা গ্যাস-গলা-বুক জ্বালা অম্বল এবং আপনার পেটের মধ্যে একটা জ্বলন অনুভূতি সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে।তাই যতটা সম্ভব এগুলি পরিহার করে চলুন।
10. সীফুড
সুশী হয়ত আপনার অন্যতম একটি প্রিয় খাদ্য হয়ে থাকতে পারে,কিন্তু গর্ভাবস্থাকালে আপনার প্রিয় খাদ্য তালিকা থেকে সেটিকে বাদ দিন।যেকোনোও ধরণের কাঁচা মাংস,বিশেষত মাছ খাওয়া ভীষণভাবে অস্বাস্থ্যকর কারণ কাঁচা মাংসের মধ্যে হয়ত বিভিন্ন পরজীবী এবং অন্যান্য জীবাণুগুলি থাকতে পারে।রান্না করা তেল মশলাযুক্ত মাছের কারী অথবা চুপচুপে তেলে কড়া করে মাছ ভাজা খাওয়াও এড়িয়ে চলা উচিত।হ্যাঁ,যদিও এ কথা ঠিক যে মাছের মধ্যেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিকর উপাদান আছে যেগুলি একজন মহিলার তার গর্ভাবস্থায় প্রয়োজন কিন্তু তবুও এটি খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।আসলে সমস্যাটা মাছের সাথে নয়,প্রকৃত সমস্যা হল জলের সাথে।জলে প্রচুর পরিমাণে দূষিত পদার্থ থাকে,যার মধ্যে মার্কারিও অন্তর্ভূক্ত,আর সেই জলেই মাছ থাকে এবং তা গ্রহণ করে।যা অনিবার্যভাবেই মাছের সাথে আপনার দেহেও প্রবেশ করতে পারে এবং তা একাধিক সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে।কয়েকটি বিশেষ ধরণের মাছ যেমন চিংড়ি,স্যালমন এবং ক্যাটফিশ এগুলিকে সাধারণত গর্ভবতী মহিলাদের খাওয়ার পক্ষে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিন্তু এগুলিকে আপনার ডায়েটের অংশ করে তোলার আগে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে এ ব্যাপারে অবশ্যই আলোচনা করে নিশ্চিত হয়ে নিন।
11. মৌরি দানা
মৌরি দানার মধ্যে ফাইটোইস্ট্রোজেনের সন্ধান পাওয়া যায় যা মহিলাদের দেহে প্রাপ্ত ইস্ট্রোজেনের মত কাজ করে এবং জরায়ুর সংকচনকে উদ্দীপ্ত করার জন্য পরিচিত।মৌরি দানাগুলি ঠিক মেথি দানাগুলির মতই,মহিলাদের সন্তান প্রসবের পরবর্তীতে দেওয়া হয়ে থাকে যেহেতু সেগুলি স্তন দুধের উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে এবং জরায়ুকে পরিষ্কার রাখে।এগুলিকে গর্ভাবস্থায় খুব সামাণ্য পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে তাও আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়ার পরেই।তবে একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থা বজায় রাখার জন্য সবচেয়ে ভাল হল সেগুলিকে বর্জন করা।
আপনার বাসনার সবকিছু খেতে না পারাটা আপনাকে অনিবার্যভাবেই দুঃখী করে তুলবে,কিন্তু মনে রাখুন আপনি এটি করছেন আপনার নিজের এবং আপনার সন্তানের জন্য।এগুলি হল এমন কিছু ভারতীয় খাদ্য যেগুলি আপনার গর্ভাবস্থায় ভক্ষণ করা উচিত নয়,তবে এরকম আরও অনেক অন্যান্য খাদ্য আছে,যেগুলি গর্ভাবস্থায় খাওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয় আর সেগুলি বেশ সুস্বাদুও বটে।সুতরাং সেগুলির আস্বাদ গ্রহণ করুন!সর্বদা স্বাস্থ্যকর থাকার ব্যাপারে দৃষ্টি রাখুন এবং আপনার সন্তানকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করুন আর তার সাথেই আপনি নিশ্চিতভাবে হয়ে উঠবেন সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর ফুটফুটে একটি শিশুর জননী।