অষ্টম মাসের গর্ভাবস্থায় ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস (29-32 সপ্তাহ)

অষ্টম মাসের গর্ভাবস্থায় ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস (29-32 সপ্তাহ)

গর্ভাবস্থায় যত্ন নেওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল খাদ্য।এটি শিশুর স্বাস্থ্যের উপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে এবং তার সাথে এটি মায়ের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যেকেও নানা উপায়ে প্রভাবিত করে।শিশুর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খাবার গুলির প্রভাব মাথায় রেখে সেগুলি তৈরী করা প্রয়োজন অত্যন্ত যত্নের সাথে।

চলুন দেখে নেওয়া যাক এমন কিছু খাদ্য উপকরণ যেগুলি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে খাওয়া থেকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং তার পাশাপাশি এমন কিছু খাবার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক যেগুলি নিরাপদে খাওয়া যেতে পারে তৃতীয় ত্রৈমাসিক সময়ে অথবা গর্ভধারণের অষ্টম মাসে।

গর্ভধারণের অষ্টম মাসে কি কি খাবেন?


নিম্নে কিছু খাবারের উল্লেখ করা করা হল যেগুলি এই সময়ের মধ্যে খাওয়া যেতে পারে।

1. মাছ

মাছের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ,যা গর্ভধারণের শেষ মাসের জন্য ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।আয়রণের ঘাটতির ফল হল অ্যানিমিয়া, যা মায়েদের মধ্যে সাধারণ ভাবে অবসাদ অনুভবের কারণ হয়ে উঠতে পারে।এছাড়াও মাছের মধ্যে থাকে আরো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুষ্টি উপাদান যেমন প্রোটিন এবং অনুরূপ আরও কিছু,যেগুলি আট মাসের গর্ভাবস্থার খাদ্য তালিকায় একটা দূর্দান্ত সংযোযোজন ঘটায়।

2. রেড মিট

একজন প্রত্যাশিত মায়ের খাদ্যে রেড মিটের সংযোজন হল একটা দারুণ ব্যাপার যেহেতু এটিও আয়রণে এবং প্রোটিনে সমৃদ্ধ একটি উৎস।এই উভয় প্রকারই হল মায়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ কারণ এগুলি শিশুর বৃদ্ধিতে দ্রুত সহায়তা করে।রেড মিট আবার মায়ের সাধারণ স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটায় যেহেতু এতে মিনারেল বা খনিজ থাকে যা গর্ভাবস্থার সময় আপনাকে ক্লান্ত এবং অসুস্থ হওয়া থেকে দূরে রাখে।

3. কলা

কলা হল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন একটি ফল যার মধ্যে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই রয়েছে খাদ্যের প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারালের মহান উৎস।কলা পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং আয়রণে সমৃদ্ধ যা যেকোনো মহিলার খাদ্য উপকরণের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে।সব থেকে বড় ব্যাপার হল এগুলি আবার পাচন কার্যকে উন্নীত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য উপশম করে এবং ভিন্ন উপায়ে প্রত্যাশিত মায়েদের স্বান্তনা বৃদ্ধি করে।

4. দুগ্ধজাত পণ্য

দুগ্ধজাত পণ্যগুলি শিশুদের গঠনমূলক বছরগুলিতে তাদের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হওয়ার কারণ আছে ,দুধ সহ দুগ্ধজাত পণ্য গুলি হল ক্যালশিয়াম,পটাশিয়াম,প্রোটিনের মতই অন্যান্য ভিটামিন এবং মিনারেলের অসম্পূর্ণ উৎস।গর্ভাবস্থার শেষ মাসে দুগ্ধজাত পণ্যগুলি গ্রহণের ফলে তা শিশুর বৃদ্ধির উপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

5. সবুজ শাক সবজি

তন্তু সমৃদ্ধ খাবার গুলি গর্ভাবস্থার সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু এটি কোষ্ঠকাঠিণ্যের অনুভূতি কমাতে সাহায্য করে,যেটি ঘটে থাকে অতিরিক্ত ওজন এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময় অতিরিক্ত হরমোন ক্ষরণের কারণে।সবুজ শাকসবজিতে রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী তন্তুর পাশাপাশি অন্যান্য খনিজও সংযুক্ত থাকে যেমন আয়রণ,পটাশিয়াম এবং ক্যালশিয়ামও।এগুলি ভারতীয় মায়েদের আট মাসের গর্ভাবস্থার খাদ্য তালিকায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

6. পিনাট মাখন

চূড়ান্ত ত্রৈমাসিকের সময়ে চর্বিও শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়,অন্যথায় যদিও অনেক মানুষই এটিকে কেবল একটা অনুমান বলেই মনে করেন।যখন উচ্চ চর্বি বা ফ্যাট কঠোর ভাবেই বন্ধের কথা বলা হয় তখনও কিছু অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিড গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকে।ওমেগা 3 হল এরকমই অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিডের একটা উদাহরণ এবং ভ্রূণের মস্তিষ্কের উন্নয়ণে এটি ব্যাপকভাবে প্রভাব রাখে।অন্যান্য উৎস গুলির মধ্যে পিনাট বাটার বা মাখনের সাথে সংযোজিত রয়েছে ডিম এবং মাছ।

7. কমলা লেবু

অতিরিক্ত পরিমাণে তন্তু থাকা ছাড়াও কমলা লেবুতে আছে অতিরিক্ত মাত্রায় ভিটামিন C ,যা শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা পুষ্টি।ভিটামিন C অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কারণ এটি ভোজন করা আয়রণের শোষক হিসাবে ব্যবহৃত হয়,সুতরাং এটির অভাবের ফলে মায়েদের মধ্যে অ্যানিমিয়া এবং অবসাদ দেখা দিতে পারে।ভিটামিন C এর অন্যান্য উৎসগুলি হল টমেটো, লেবু এবং বাঁধাকপি।

গর্ভধারণের অষ্টম মাসের খাদ্যতালিকায় যে খাবারগুলি সংযোজন করবেন না

এখানে কিছু খাবারের উল্লেখ করা হল যেগুলি আপনার বা আপনার ভ্রূণের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

1. আনপাস্তুরাইজড দুধ

অনেক ভারতীয় পরিবারেই গরু,অথবা ভেড়ার থেকে সরাসরি নেওয়া আনপাস্তুরাইজড দুধকেই আদর্শ রূপে গণ্য করা হয়।গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময়ে এটির ব্যবহার কঠোর ভাবেই এড়িয়ে চলতে হবে যেহেতু এই দুধগুলি খাওয়া নিরাপদ হিসাবে গণ্য করা হয় না এগুলি যথেষ্ট ভাবে প্রক্রিয়াভুক্ত না হওয়ার কারণে।যেকোনো উপায়েই ছাগলের দুধ এড়িয়ে চলা উচিত যেহেতু এতে ক্ষতিকারক উপাদান টক্সোপ্লাজমোসিস থাকে।

2. কফি

গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ক্যাফিনযুক্ত পদ কঠোরভাবেই নিষিদ্ধ,যেহেতু এটি গ্রহণের পর পানকারীর মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের একটা প্রবণতা আসে।আপনি এটি খাওয়ার পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে জল পান করাকে বেছে নিতে পারেন, সাধারণ সময়েও যেটির প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত।যেকোনো প্রত্যাশিত মায়ের কাছেই কফি হল এমন একটা খাদ্য যেটিকে তাদের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এড়িয়ে চলতেই হবে।

3. মাদক এবং তামাক দ্রব্য

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গর্ভাবস্থার যেকোনো পর্যায়েই মাদক এবং তামাক দ্রব্যকে অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে,বিশেষ করে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময়।এগুলি প্রসবের সময়ে জটিলতার কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং মায়ের অভ্যন্তরে ভ্রূণের বৃদ্ধিও বাঁধাপ্রাপ্ত হয় ও তার উপর খারাপ প্রভাব পারে।

4. ভাজা খাবার

অন্য শ্রেণীভুক্ত খাবার গুলি হল তেলে ভাজা খাবার যেগুলিকেও গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময়ে এড়িয়ে চলা উচিত,সেগুলির পুষ্টির মান অনুযায়ী আপনার খাবারে সামান্য পরিমাণে যোগ করুন।ভাজা খাবার আবার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যারও কারণ হয়ে উঠতে পারে,যার মধ্যে অপ্রকৃত হজম ও গলা বুক জ্বালা অম্বলও সংযুক্ত,যা মারাত্মক ভাবে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে যখন আপনি সন্তান ধারণ করে থাকেন।

5. সার্ক,মার্লিন এবং সোর্ড ফিস বা তলোয়ার মাছ

এই ধরণের মাছগুলিকে গর্ভাবস্থার সময় অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন যেহেতু এগুলির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মিথাইলমার্কারির মত ক্ষতিকর পদার্থগুলি উপস্থিত থাকে।ভ্রূণের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে জটিলতার কারণ হতে পারে এই মিথাইলমার্কারি,সুতরাং নির্বাচন করুন এমন মাছ যেগুলির প্রয়োজনীয় পুষ্টিমূল্য আছে এবং অতিরিক্ত চর্বিযুক্তও নয়।

6. লিভার এবং শুকনো মাংস

শুধু মাত্র তৃতীয় ত্রৈমাসিকেই নয়,সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থার সময় জুড়েই লিভার এবং অন্যান্য মাংস খাওয়া অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত।ছাড়িয়ে রাখা শুকনো মাংস অজাত শিশুর মধ্যে টক্সোপ্লাজমোসিস এবং লিস্টেরিওসিসের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে,সেই কারণেই যেকোনো প্রত্যাশিত মাকেই তাদের গর্ভধারণ চলাকালীন সময়ে এগুলি খাওয়া থেকে কঠোর ভাবে বিরত থাকতে হবে।

7. সফট বা নরম চীজ

যে চীজগুলি একটু পুরানো হয় এবং ছাঁচের জন্য ব্যবহৃত হয়,যেমন ব্রেইএগুলিকে গর্ভাবস্থা চলাকালীন সময়ে এড়িয়ে চলা উচিত।এছাড়াও ড্যানিশ ব্লু এর মত চীজগুলি তে থাকে নীল রঙের শিরা যার মধ্যে প্রায়ই থাকে লিস্টেরিয়া,এগুলিও গর্ভধারণকালীন সময়ে শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।সুতরাং তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময়ে যদি মায়েদের চীজ খাওয়ার ইচ্ছে হয়ে থাকে তবে চেডার চীজের ন্যায় শক্ত চীজ নির্বাচন করুন।

8 মাসের গর্ভবতী মহিলার খাদ্যাভ্যাসের পরামর্শ

  • সেই সকল খাবার গুলিই আপনার খাদ্যতালিকাভুক্ত করুন যেগুলি পুষ্টি গুণে ভরপুর (তাই বলে বেশী পরিমাণে চকোলেট কেক নয়)
  • বেশী করে তরল পান করুন যেহেতু এটি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিহত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ,তার সাথে রক্ত প্রবাহের মাত্রাও বাড়ায় যা মা এবং শিশুর মধ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলগুলিকে সরবরাহ করে।সুতরাং সুনিশ্চিত করুন প্রতিবার খাবার এবং জলখাবার খাওয়ার পর পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা এবং আটবার পান করুন প্রতিবার সামনে একটা জলের বোতল দেখতে পাওয়া মাত্র।
  • পুরোপুরিভাবে সামুদ্রিক খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলবেন না ,যদিও তাতে ক্ষতিকারক পদার্থ যেমন মার্কারি থাকতে পারে,আপনি তার পরেও এমন মাছ নির্বাচন করতে পারেন যেগুলি গর্ভাবস্থাকালীন সময়ে খাওয়া নিরাপদ।যে সব মাছের মধ্যে ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে সেগুলি ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভাবস্থাকালীন একটা খাদ্য তালিকা গড়ে তোলা খুবই কঠিন কাজ যেহেতু এর সাথে মায়ের স্বাস্থ্য এবং শিশুর ভালোভাবে বেড়ে ওঠা জড়িত থাকে।পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন এবং ভ্রূণের সুস্বাস্থ্যের জন্য মাদক, তামাক এবং ড্রাগের মত ক্ষতিকারক পদার্থগুলি থেকে যথেষ্ট দূরে থাকা আবশ্যক।