কীভাবে শিশুদের ব্রণ ফোঁড়া/ফোঁড়ার চিকিৎসা করবেন

কীভাবে শিশুদের ব্রণ ফোঁড়া/ফোঁড়ার চিকিৎসা করবেন

শিশুর ত্বক সংবেদনশীল এবং তাদের ইমিউন সিস্টেম এখনও পরিণত নয়। তার অর্থ তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়াও যদি আবহাওয়া প্রতিকূল থাকে, শিশুদের সারা শরীরে ছোট ছোট ফুসকুড়ির মতন হয়ে যায়, যাকে ব্রণ বলে।

এই অবস্থায়, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখলে এবং শিশুর ত্বককে ঠান্ডা রাখলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধা দেয়। আপনি আপনার বাচ্চার জন্য ব্যবহৃত স্নানের সাবান, তেল বা লোশন এবং পাউডার জাতীয় পণ্যগুলি পরিবর্তন করার বিষয়েও বিবেচনা করতে পারেন। সময়মতো চিকিৎসা না হলে, ব্রণ বা ফোঁড়াফোঁড়া বেদনাদায়ক হতে পারে এবং সমস্যা গুরুতর হতে পারে।

ব্রণ আসলে কী?

ব্রণ আসলে কী?

একটি লোম বা চুলের গোড়া বা তৈলগ্রন্থির সংক্রমণের কারণে ত্বকের উপর সৃষ্ট একটি কোমল গুটিকে ব্রণ বলে। সংক্রমণ সাধারণত স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। ব্যাকটিরিয়া ত্বকে উপস্থিত থাকতে পারে এবং ত্বকের ছোট ছোট ফাটল দিয়ে দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে, অথবা এটি চুল বেয়ে তার গোঁড়া বা ফলিকলে প্রবেশ করতে পারে। এই সংক্রমণ তারপর একটি ব্রণর আকার নেয়।

শুরুতে সংক্রামিত ত্বক লাল হয়ে যায়, এবং একটি গুটি দেখা দেয়। সময়ের সঙ্গে, গুটি সাদা হয়ে আসে এবং চামড়ার নিচে পূঁজ জমা হতে পারে। পূঁজ জমা হওয়ার ফলে ফোঁড়া খুব বেদনাদায়ক হয়ে উঠতে পারে।

মুখে, পিঠে, ঘাড়ে, কাঁধে, উরুতে এবং নিতমম্বের উপর ফোঁড়া ফুটে উঠতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের জ্বরও থাকতে পারে। সাধারণ ফোঁড়া যেমন গরমের ফোঁড়া ইত্যাদি প্রায়শই ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিরাময় করা যেতে পারে; কিন্তু কোন সন্দেহ থাকলে, পেশাদার চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়াই ভাল।

শিশুর ফোঁড়া কি সংক্রামক হয়?

কিছু ধরনের ফোঁড়া যেমন পূঁজ যুক্ত ফোঁড়া সংক্রামক হতে পারে। এগুলি কেবলমাত্র শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে তাই নয়, সান্নিধ্যে আসা ব্যক্তিদেরও সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। এমনকি গামছা, বিছানার চাদর বা দাঁতের ব্রাশের মাধ্যমেও এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

পূঁজ সম্বলিত ফোঁড়া, চুল বা লোমের গোড়া বা ফলিকল্গুলিতে স্ট্যাফ্ ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা সংক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। পূঁজ সম্বলিত ফোঁড়া ছোট ছোট গুটির আকারে শুরু হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা বড় হয়ে যায় এবং পূঁজ দ্বারা পূর্ণ হয়। একত্রে একাধিক পূঁজ সম্বলিত ফোঁড়াকে কার্বাঙ্কল্ বলা হয়।

যেহেতু শরীরের প্রায় সর্বত্রই লোম বা চুল থাকে এবং এর গোঁড়াতেই সংক্রমণ হয় সেহেতু বাচ্চার শরীরের যেকোনো অংশেই ফোঁড়া দেখা দিতে পারে। যাইহোক, যে স্থানগুলিতে ঘাম এবং নিয়মিত ঘর্ষণ হয়, যেমন  মুখ, ঘাড়, বগল, উরু ইত্যাদি অংশে ফোঁড়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিতম্বে ফোঁড়া এই কারণেই অনেক মায়েদের মনে হয় যে গ্রীষ্ম বা বৃষ্টির সময় সাধারণত ফোঁড়া বেশি হয়।

কতদিন শিশুদের ফোঁড়া স্থায়ী হয়?

যখন ফোঁড়া হয় তখন শিশুর চামড়ায় একটি কোমল গুটি দেখা দেয়। সময়ের সাথে এটি বড় এবং লাল হয়ে ওঠে। এটি দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পূঁজে ভরে ওঠে। যদি একে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়ার উপর ছেড়ে দেওয়া হয় তবে এগুলি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কমে যেতে পারে। যদি দুই সপ্তাহ পরেও ফোঁড়াগুলি অদৃশ্য না হয় বা কমে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা না যায়; তবে চিকিৎসার সহায়তা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

শিশুদের ফোঁড়া হওয়ার কারণ

কিছু চিকিৎসা বিষয়ক পরিস্থিতি শিশুর ফোঁড়া হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। সেগুলি হল:

  • সঠিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির অভাব
  • কম রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা
  • শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব
  • রক্তাল্পতা অথবা লোহার ঘাটতি
  • কঠোর সাবান, ক্রিম বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ত্বকের ক্ষতি  হয়
  • প্রতিকূল আবহাওয়ার অবস্থা যেমন চরম তাপ বা আর্দ্রতা

শিশুদের ফোঁড়ার চিহ্ন এবং উপসর্গ

বাচ্চাদের ফোঁড়ার কিছু লক্ষণ এবং উপসর্গ নিম্নরূপ:

  • ব্রণর চারপাশে প্রভাবিত চামড়া ফুলে যায় ও লাল হয়ে যায়
  • কিছু ক্ষেত্রে শিশুর জ্বর হতে পারে
  • যেখানে প্রথম ফোঁড়া দেখা দেয় সেখানে একাধিক ফোঁড়া তৈরি হতে পারে
  • ফোঁড়ার চারপাশে লসিকা গ্রন্থিগুলি ফুলে উঠতে পার

রোগ নির্ণয়

সংক্রমণ শরীরের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে গেছে কিনা তা নির্ধারণ করতে ডাক্তার বাচ্চার শরীরের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করতে পারে। ফোঁড়া বেরোনোর পিছনে অন্য কোনো অন্তর্নিহিত মেডিকেল কারণ আছে কিনা তা জানতে, ডাক্তার ফোঁড়া থেকে একটি অংশ নিয়েও পরীক্ষা করতে পারে। সব কারণ বিশ্লেষণ করে, ডাক্তার তার নির্ণয় উপস্থাপন করবে।

জটিলতা

সাধারণত শিশুদের ফোঁড়া কোনো জটিলতার কারণ হয় না বা চিকিৎসার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যদি একটি ফোঁড়া চিপে যায় বা ফেটে যায়, তাহলে কিছু দাগ তৈরি হতে পারে। যদি ফোঁড়া খুব বড় হয়ে যায় তবে এটি সেলুলাইট তৈরি করতে পারে। এতে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। যদি ফোঁড়া থেকে কার্বঙ্কল হয়ে যায় এবং সেরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ না দেখায় তাহলে ডাক্তার সার্জারির পরামর্শ দিতে পারে। পুঁজ ফোঁড়া সংক্রামিত হলে অতিরিক্ত যত্ন নিতে পারেন।

বাচ্চাদের বারবার হওয়া ফোঁড়া

মাঝে মাঝে শিশুরা বারবার হওয়া ফোঁড়ার দ্বারা কষ্ট পায়। আপনার সন্তানের অন্যান্য সংক্রমণ সম্পর্কিত বার বার হওয়া কোনো প্যাটার্ন লক্ষ্য না করলে এটি উদ্বেগের কারণ না হতে পারে।

বারবার হওয়া ফোঁড়া সংক্রামক হতে পারে কারণ ত্বকের উপর বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই এক শরীর থেকে অন্য শরীরে স্থানান্তরিত হয়। অতএব, পরিবারের কোনো সদস্য এই সংক্রমণে ভুগছে কিনা এবং শিশুর দেহে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কিনা তা খুঁজে বের করতে হবে।

চিকিৎসা

সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত প্রভাবিত এলাকাটি এন্টিসেপটিক দিয়ে ধোয়া জরুরি। যদি ফোঁড়া ফেটে যায় তবে কিছু তুলো এবং অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করুন। শুকানোর পর, বাচ্চাটি যাতে স্পর্শ করতে না পারে, সে জন্য গজ বা ড্রেসিং দিয়ে ঢেকে দিন। ফোড়াটি টিপে দেওয়ার বা ফাটিয়ে দেওয়ার প্রলোভন প্রতিরোধ করুন, কারণ এর ফলে এটি আশেপাশের এলাকায় দাগ তৈরি করতে পারে এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

যদি ফোঁড়া বড় হয় বা ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে হয়, তবে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক নির্ধারণ করতে পারে। যদি ফোঁড়াটি কমেও যায় তবুও পুরো কোর্সটি সম্পূর্ণ করার কথা মনে রাখবেন নাহলে আবার হতে পারে। আপনি ডাক্তারের সাথে পরামর্শের পর ফোঁড়াতে সংক্রমণ প্রতিরোধী ক্রিম প্রয়োগ করতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে, ডাক্তার অস্ত্রোপচার করে ফোঁড়ার মুখ খুলে দিয়ে পুঁজ বের করে দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পদ্ধতিটি অ্যানেস্থেসিয়ার প্রভাবের অধীনে করা যেতে পারে।

শিশুর মাথার উপর হওয়া ফোঁড়ার এলাকায় এলকোহল ঘষার মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। এটি স্থানটিকে নির্বীজিত করবে এবং সহজ সংক্রমণের কারণে হওয়া ফুসকুড়িগুলি নিরাময় করতে পারে। মাথার উপর একাধিক ফুসকুড়ির ক্ষেত্রে, সম্ভবত সম্ভাব্য কারণ হল তাপ এবং আবহাওয়া। এই অবস্থায়, নারকেল তেল প্রয়োগ করা খুব দরকারী বলে প্রমাণিত হতে পারে কারণ এটির ঠান্ডা করার ক্ষমতা আছে।

ফোঁড়া সারানোর ঘরোয়া প্রতিকার

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, কয়েকদিনের মধ্যেই নিজে থেকেই ফোঁড়াগুলি নিরাময় হয়। তবুও, আপনি নিরাময় প্রক্রিয়াটিকে দ্রুত করতে নিম্নোক্ত ঘরোয়া প্রতিকারগুলিও চেষ্টা করতে পারেন:

1. উষ্ণ কম্প্রেস

ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক পরিত্রাণের জন্য, প্রভাবিত এলাকায় এবং ফোঁড়ার উপর কয়েক মিনিটের জন্য একটি গরম কম্প্রেস স্থাপণ করা যেতে পারে। এই কাজটি দিনে বেশ কয়েক বার পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে। এটি ফোঁড়া থেকে ধীরে ধীরে পুঁজ বের করতে সাহায্য করে যার পরে নিরাময় শুরু হতে পারে।

2. মধু থেরাপি

ফোঁড়াতে মধু প্রয়োগ করা একটি ভাল আইডিয়া হতে পারে যেহেতু মধু একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক।

3. যবের মন্ড কম্প্রেস

আপনি যবের মন্ড দ্বারাও চিকিৎসার চেষ্টা করতে পারেন। একটি পরিষ্কার সুতির কাপড়ে যবের মন্ড মুড়িয়ে এবং গরম দুধে ডুবিয়ে একটি উষ্ণ কম্প্রেস করুন। যবের মন্ড প্রদাহ হ্রাস করে কার্যকরভাবে নিরাময় প্রক্রিয়া দ্রুত করে।

4. পার্সলে পাতা

আপনি পার্সলে পাতার একটি কম্প্রেস ব্যবহার করতে পারেন। পার্সলে পাতাগুলি নরম হয়ে যাওয়া অবধি সেদ্ধ করা যেতে পারে এবং অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন করার পরে, একটি কম্প্রেস প্রস্তুত করা যেতে পারে। ফোড়ার উপর এই কম্প্রেস প্রয়োগ করলে তা খুব শীঘ্রই ফোঁড়া নিরাময় করতে সাহায্য করতে পারে।

5. হলুদ

ফোড়ার উপর হলুদ গুঁড়া দেওয়া উপকারী চিকিৎসা বলে প্রমাণিত হতে পারে, কারণ এর অ্যান্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্য আছে।

6. পেঁয়াজ এবং রসুনের একটি মিশ্রিত রস

যদি ফোঁড়া ফেটে যায়, আপনি এটির উপর পেঁয়াজ এবং রসুন রসের মিশ্রণ দিতে পারেন। এটি শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াই ধ্বংসই করে না রোগ নিরাময় ত্বরাণ্বিত করতে পারে।

শিশুর ফোঁড়া প্রতিরোধ করা

কিছু জিনিস অনুশীলন করা যেতে পারে শিশুর শরীরে ফোঁড়া হওয়া এড়ানোর জন্য। তাদের মধ্যে কিছু হতে পারে

  • শিশুর জন্য সঠিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা।
  • আপনার শিশু স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার পাচ্ছে তা নিশ্চিত করুন।
  • শিশুকে সামলানোর সময় বারবার হাত ধুয়ে নিন।
  • নিয়মিত শিশুর তোয়ালে, বিছানার চাদর, ওয়াশক্লথ পরিবর্তন করুন এবং গরম জল দিয়ে সেগুলি ধুয়ে নিন।
  • ফোঁড়াগুলি আরও ছড়িয়ে পড়া আটকানোর জন্য, এটিকে ড্রেসিং করে রাখুন এবং সময়ে সময়ে এটি পরিবর্তন করুন। সাবধানে এটিকে ফেলে দেওয়ার কথা মাথায় রাখবেন।
  • যদি ফোঁড়া ফেটে গিয়ে পুঁজ বের হয়, তবে এটিকে যথাযথ ভাবে পরিষ্কার করুন এবং নিশ্চিত করুন যে পুঁজটি যেন শিশুর শরীরের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে না যায়।
  • শিশুর শরীরে নতুন ফোঁড়ার কোনো লক্ষণ আছে কিনা তার জন্য লক্ষ্য রাখুন।

আপনি কখন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন?

আপনি ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে পারেন যদি:

  • শিশুর জ্বর হয়।
  • ফোঁড়া আকারে বাড়তে শুরু করে এবং বেদনাদায়ক হয়।
  • দুই সপ্তাহ পরও ফোঁড়া কমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখায় না।
  • আবার ফোঁড়া হয় এবং শরীরের অন্যান্য এলাকায় ছড়াতে থাকে।
  • শিশুর লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে।
  • ফুসকুড়িটি পুঁজ ভরাট হয়ে যায়।

বাচ্চাদের ফুসকুড়ি হওয়া সাধারণত খুব একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নয়। শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা পদ্ধতি সাধারণত এটির যত্ন নেয়। কিন্তু যদি আপনি মনে করেন যে ফোঁড়াগুলি কমছে না এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং হয়ত অন্য কোনো অন্তর্নিহিত চিকিৎসাগত অবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে সর্বদা চিকিৎসার পরামর্শ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।