গর্ভাবস্থার প্রথম মাস – কোন খাবার খেতে এবং এড়িয়ে যেতে হবে

ডিম্বস্ফোটনের সময় রক্তপাত

গর্ভাবস্থায়, শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি এবং বিকাশে পুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভধারণের প্রায় তিন মাস আগে থেকে, ফোলেট সহ প্রারম্ভিক ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত । গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে খাদ্য উন্নয়নশীল ভ্রূণের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই নিবন্ধটি আপনাকে গর্ভধারণের প্রথম মাসে খাবারের তালিকায় কোন কোন খাবার রাখবেন এবং কোনগুলি বাদ দেবেন, তা নির্দেশ করবে ।

গর্ভধারণের প্রথম মাসে যে যে খাবার খাওয়া উচিত

গর্ভাবস্থার পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়ার সময়, আপনি প্রায় আড়াই সপ্তাহ গর্ভবতী । তাই আপনি যদি গর্ভধারণ করতে চান, তবে আপনাকে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া শুরু করতে হবে এবং জাঙ্ক ফুড, তামাক, অ্যালকোহল এবং ড্রাগস এড়াতে হবে । গর্ভাবস্থায় খাবারের তালিকায় প্রথম মাসে প্রচুর ফল এবং সবজি যোগ করা উচিত । সুস্থ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আপনার প্রথম ত্রৈমাসিকে খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত এমন খাবারগুলি এখানে দেওয়া হল:

১) দুগ্ধজাত পণ্য

দুগ্ধজাত পণ্যগুলি (শক্তিবর্ধকগুলি সহ) ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং ফোলিক অ্যাসিডের একটি দুর্দান্ত উৎস । আপনার প্রথম-মাসের গর্ভাবস্থায় খাবারের মধ্যে দই, দুধ, এবং শক্ত চীজ বা পনির অন্তর্ভুক্ত করুন ।

২) ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার

ফোলেট বা ফোলিক অ্যাসিড শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের যথাযথ বিকাশের জন্য অপরিহার্য, যা পরবর্তীতে মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের কোষে বিকশিত হয় । ফোলেট-সমৃদ্ধ খাবার অথবা ফোলিক অ্যাসিডের সম্পূরক আপনার খাবারের তালিকায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ । ফোলেট সমৃদ্ধ খাবারের উদাহরণ হল- গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি যেমন পালং শাক এবং বাঁধাকপি, শতমূলী, লেবুবর্গীয় ফল, বীনস, মটরশুটি, মুসুর ডাল, আভোকাডো, ব্রাসিলস স্প্রাউট (ছোট্ট বাঁধাকপি) এবং ভেন্ডি বা ঢ্যাঁড়শ ।

৩) গোটা শস্যদানা (হোল গ্রেইন)

গোটা শস্যগুলি কার্বোহাইড্রেট, ডায়েটযোগ্য ফাইবার, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স এবং আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও সেলেনিয়ামের মতো খনিজের স্বাস্থ্যকর উৎস । এইগুলি আপনার শিশুর স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য । গোটা শস্যের উদাহরণ হল বার্লি, বাদামী চাল, বাজরা, ডালিয়া, সমগ্র আটারপাওরুটি বা পাস্তা, মিলেট, এবং ওটামিল ।

৪) ডিম এবং হাঁস-মুরগির মাংস

ডিম প্রোটিন, ভিটামিন এ, বি২, বি৫, বি৬, বি১২, ডি, ই ও কে, এবং ফসফরাস, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং জিঙ্কের মতো খনিজগুলির একটি ভাল উৎস । পোল্ট্রি (হাঁস-মুরগির) এছাড়াও প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস । গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে ডিম ও হাঁস-মুরগির মাংস খাওয়া ভ্রূণের সুস্থ বিকাশকে নিশ্চিত করবে ।

৫) ফল

খরমুজ, আভোকাডো, ডালিম, কলা, পেয়ারা, কমলালেবু, মিষ্টি লেবু, স্ট্রবেরি এবং আপেলের মতো ফলগুলি গর্ভজাত শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে ।

৬) সবজি

প্রচুর পরিমাণে রঙিন সবজি খাওয়া নিশ্চিত করে যে, আপনি আপনার ক্রমবর্ধমান শিশুর জন্য অপরিহার্য পুষ্টির বিস্তৃত পরিসর পাবেন । উদাহরণ- ব্রোকোলি, বাঁধাকপি, পালং শাক, গাজর, কুমড়ো, মিষ্টি আলু, টমেটো, ক্যাপসিকাম, ভুট্টা, সজনের ডাঁটা, বেগুন ইত্যাদি ।

৭) বিভিন্ন বীজ ও বাদাম

বীজ এবং বাদামগুলি স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ, ফ্ল্যাভোনিয়েডস, এবং স্বাস্থ্যকর ফাইবারের ফাইবারের চমৎকার উৎস । সুস্থ শিশুর জন্য গর্ভাবস্থায় প্রথম মাসে নিয়মিত এগুলি খেতে ভুলবেন না ।

৮) মাছ

মাছ কম ফ্যাট, উচ্চ মানের প্রোটিনের একটি সেরা উদাহরণ । মাছ এছাড়াও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন বি২, ডি ও ই এবং পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, আয়োডিন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাসের মতো অপরিহার্য খনিজের একটি খুব ভালো উৎস ।

৯) মাংস

মাংসে ভিটামিন বি, প্রোটিন, জিঙ্ক এবং লোহা রয়েছে । গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে আপনার খাদ্যতালিকায় চর্বিহীন মাংস থাকলে এটি আপনার এবং আপনার শিশুর পক্ষে ভালো । যাইহোক, আধসিদ্ধ মাংস এবং শুয়োরের মাংস এড়ানো ভালো ।

গর্ভধারণের প্রথম মাসে যে যে খাবার এড়ানো উচিত

কিছু খাবার রয়েছে যা প্রাথমিক গর্ভধারণের সময় এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ এটি বাড়তে থাকা শিশুর ক্ষতি করতে পারে । গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে থেকে যে খাবারগুলি থেকে দূরে থাকা উচিত, সেগুলি এখানে রয়েছে:

১) নরম চীজ বা পনির

নরম চীজগুলি নির্বীজকৃত দুধ থেকে তৈরি হয় না এবং এতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে । অতএব, গর্ভাবস্থার সময় নরম চীজগুলি এড়িয়ে চলাই উচিত ।

২) প্যাকেট-করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার

প্যাকেট-করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন জ্যুস, মাইক্রোওয়েভ-প্রস্তুত খাবার, কেক এবং বিস্কুট, কনডেন্সড দুধ ইত্যাদি সংযোজন, প্রিজারভেটিভ, উচ্চ মাত্রার চিনি ও সোডিয়াম এবং খালি ক্যালোরি; এগুলি আপনার বা আপনার শিশুর জন্য ভাল নয় । কিছু প্যাকেটযুক্ত খাবারে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে । প্রাকৃতিক বা জৈব উত্পাদনের সঙ্গে তৈরি তাজা, রান্না করা খাবার খাওয়া উচিত ।

৩) সামুদ্রিক খাবার

সীফুড বা সামুদ্রিক খাবারে পারদের উচ্চ স্তর থাকে, যা ভ্রূণের মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং বিকাশের বিলম্বের সাথে যুক্ত । অতএব, প্রাথমিক গর্ভধারণের সময় সীফুড এড়িয়ে চলুন এবং পরিবর্তে আপনার খাদ্যের মধ্যে তাজা জলের মাছ অন্তর্ভুক্ত করুন ।

৪) পেঁপে

কাঁচা এবং আধা-পাকা পেঁপেতে ল্যাটেক্স থাকে, যা গর্ভাশয়ের সংকোচন শুরু করে দেয় এবং অকাল প্রসব, এমনকি গর্ভপাতের কারণ হতে পারে । গর্ভাবস্থার সময় এগুলি এড়িয়ে চলুন । যদিও, পাকা পেঁপেতে বেশ কয়েকটি পুষ্টি ধারণ করে এবং যদি আপনার ডাক্তার আপনাকে এটি খেতে অনুমতি দেয়, তবে আপনি সংযম করে খেতে পারেন ।

৫) আনারস

আনারসে ব্রোমেলাইন নামে একটি পদার্থ রয়েছে, যা সার্ভিক্সকে নরম করে তুলতে পারে । প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় সার্ভিক্স নরম হয়ে যাওয়ার ফলে গর্ভপাত বা অকাল প্রসব হতে পারে । সুতরাং, গর্ভাবস্থায় আনারস এড়ানো ভালো ।

৬) কাঁচা বা আধ-সিদ্ধ মাংস

কাঁচা বা আধ-সিদ্ধ মাংস ব্যাকটেরিয়া, সালমেনেলা, লিস্টারিয়া ইত্যাদি দ্বারা দূষিত হতে পারে, যা গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা গর্ভজাত শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে । শুকরের মাংস এড়ানোও ভালো, কারণ এমনকি সামান্য একটু আধ-সিদ্ধ শুয়োরের মাংসে বৃত্তাকার কৃমি সিস্ট থাকতে পারে, যা মাকে সংক্রামিত করতে পারে এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে ।

৭) জাঙ্ক ফুড

গর্ভাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে জাঙ্ক ফুড খাওয়া ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, এবং মনোযোগ-ঘাটতি হাইপার্টিভিটি ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সাথে যুক্ত । গবেষণায় দেখা গেছে যে, গর্ভাবস্থায় এই ধরণের খাবার শিশুদের মধ্যে স্থূলতার সাথে যুক্ত ।

৮) ক্যাফিন

গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যাফিনের মাত্রা সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত, কারণ এটি স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে এবং অত্যধিক হারে গ্রহণ করা হলে অনিদ্রা, বিরক্তিকরতা এবং স্নায়বিক দুর্বলতা বা ভয় সৃষ্টি করে । এতে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে ।

৯) মাদকজাতীয় পানীয়

অ্যালকোহল ভ্রূণের বিকাশের জন্য খুব খারাপ এবং গুরুতর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে । গর্ভাবস্থায় সম্পূর্ণভাবে মদ্যপান করা উচিত নয় ।

১০) চিনিযুক্ত খাবার

একটি গর্ভবতী মহিলার তার অনাগত সন্তানের বৃদ্ধিকে সমর্থন করতে, শুধুমাত্র অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালোরির প্রয়োজন । প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি খাবার খেলে ওজন বৃদ্ধি এবং গর্ভাবস্থা ডায়াবেটিস হতে পারে ।

প্রথম মাসের গর্ভাবস্থার ডায়েট টিপস

গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে আপনার খাদ্য পরিকল্পনা করার সময় মাথায় রাখতে হবে, এমন কিছু বিষয় এখানে রয়েছে:

  • ফোলিক অ্যাসিড সহ প্রিনেটাল ভিটামিন নিন ।
  • কঠোর ডায়েটিং শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন, কারণ খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে আনা ভ্রূণের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে ।
  • সংযমই চাবিকাঠি- এমনকি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার উপরও সংযম রাখা উচিত । আপনার এবং আপনার শিশুর জন্য কোন কিছুর অতিরিক্ত পরিমানই খারাপ ।
  • আপনার ডায়েটে ফল এবং সবজি অন্তর্ভুক্ত করুন, একই সময়ে জাঙ্ক ফুড বাতিল করুন ।
  • যথেষ্ট জল পান করুন ।

গর্ভাবস্থার প্রথম মাসটি এমন একটি সময়, যখন আপনার শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে । হরমোনের পরিবর্তন মুড সুইং (ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন), ক্লান্তি এবং সকালে অসুস্থতা হতে পারে । স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত সময়ের অন্তরে অল্প করে খাবার খাওয়া, হাইড্রেটেড থাকা, অল্পসল্প ব্যায়াম করা এবং চাপমুক্ত থাকা এই সমস্যাগুলি কমিয়ে দিতে পারে । এটি আপনার শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি এবং বিকাশ নিশ্চিত করবে ।