আপনার গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে যখন আপনি আয়নার সামনে দাঁড়াবেন,আপনি সম্ভবত আপনার পেটের নাভির তলা থেকে গুপ্ত অঞ্চলের ভিতর অবধি একটি গাঢ় রেখা লক্ষ্য করতে পারেন।এটিকে বলা হয় লিনিয়া নাইগ্রা,অন্যথায় আবার একে গর্ভাবস্থাকালীন রেখা হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
নাম প্রস্তাব অনুসারে,লিনিয়া নাইগ্রা হল একটি গাঢ় রেখা যেটি আপনার গর্ভাবস্থার পঞ্চম মাস থেকে দেখা যায়।এটি আসলে একটি বিবর্ণ ফ্যাকাসে রেখা,যেটি আপনার গর্ভাবস্থার পূর্বে প্রায় অদৃশ্য থাকে এবং হঠাৎ করেই আবার তা দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।এটিকে লিনিয়া আলবা বলা হয়ে থাকে(সাদা রেখা)।গর্ভাবস্থাকালে পেটের উপরের এই রেখাটি সম্পূর্ণ রূপে স্বাভাবিক এবং অক্ষতিকারক।
লিনিয়া নাইগ্রা হল আসলে লিনিয়া আলবার গাঢ় রূপ,যা ইতিমধ্যেই আপনার পেটে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল কিন্তু খুব বেশি স্পষ্ট বা দৃশ্যমান ছিল না।সুতরাং,এই রেখাটি আপনার গর্ভাবস্থায় দেখা দিয়েছে একথা আপনি হয়ত মনে করতেই পারেন। লিনিয়া নাইগ্রাটি আসলে কালো নয়,এটি একটি বাদামী শেডের থেকেও আরও বেশি গাঢ়।এটি আপনার পেটের উপর নাভি থেকে পিউবিক হাড় পর্যন্ত চলনশীল একটি উলম্ব রেখা,কখনও কখনও আবার এটি আপনার পাঁজর থেকেও দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।
লিনিয়া আলবা হল এমন একটি স্থান,যেখানে আপনার পেটের পেশীসমূহের সংযোগকারী কলাগুলি মিলিত হয়।প্রথম দিকে এটি একেবারে ফ্যাকাসে থাকে যা সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায় না।গর্ভাবস্থায় আপনার দেহে হরমোনের কারণে এটি ক্রমশ গাঢ় হয়ে ওঠে।আপনার পেটের উপর এই রেখাটি গাঢ় হয়ে প্রকট হয়ে ওঠে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কারণ ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অতিরিক্ত মেলানিন নিসৃত হয়।আর এই মেলানিনের কারণেই ত্বকের বর্ণ গাঢ় হয়ে ওঠে,সুতরাং গর্ভাবস্থার ক্রম অগ্রগতির সাথে সাথে লিনিয়া নাইগ্রাও স্বাভাবিকভাবেই গাঢ় হয়ে উঠতে থাকে।গর্ভবতীর পেটের উপরের এই গাঢ় রেখাটি প্রায় 1/2-1 সেন্টিমিটার চওড়া হয়ে থাকে।আপনি আবার হয়ত এও লক্ষ্য করতে পারেন যে,যদি আপনার ত্বকে কোনও গাঢ় দাগ বা কোনও ক্ষত চিহ্ন বিদ্যমান থাকে সেগুলিও আপনার দেহস্থ বর্ধিত মেলানিনের কারণে গাঢ় বর্ণে রূপান্তরিত হতে।
কিছু মহিলা সম্ভবত লিনিয়া নাইগ্রার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে ওঠেন কিন্তু এটিকে ভালবাসার বেশ কয়েকটি কারণ আছে।
1.এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়ঃ গর্ভাবস্থায় লিনিয়া নাইগ্রাটি দেখা দেওয়া সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক।এটি কেবলমাত্র আপনার দেহে বর্তমান অতিরিক্ত মেলানিনের উপস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়।আপনি আবার হয়ত এও লক্ষ্য করতে পারেন যে,এই পর্যায়ে আবার আপনার স্তনবৃন্তের চারপাশের ঈষৎ রঞ্জিত স্থানটি বা অ্যারিওলা এবং ক্লিটারিগুলিকে গাঢ় হয়ে উঠতে।এটি চিন্তার কোনও সঙ্কেত নয়,সুতরাং চুপ করে শুধু বসে থাকুন আর এই সুন্দর পর্যায়টি উপভোগ করুন।গর্ভাবস্থাকালীন এই রেখাটি আপনার জীবনের সাথে একটি সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকে।
2.এটি নিজে থেকেই উধাও হয়ে যায়ঃ আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে,সন্তানের জন্মদানের কয়েক মাস পরে গর্ভাবস্থাকালীন এই রেখাটি আপনা থেকেই উধাও হয়ে যাবে।প্রসবের পর,আপনার হরমোনগুলি স্থিতিশীল হতে শুরু করে এবং তার ফলে মেলানিনও স্বাভাবিক হয়ে যায় যা আপনাকে আপনার ত্বকের মূল রঙ ফিরিয়ে দেয়।
3.এটি অক্ষতিকারকঃ এই গর্ভাবস্থাকালীন রেখাটি আপনার শিশুর পক্ষে ক্ষতিকারক নয়।এটি গর্ভাবস্থায় আপনার দেহে একটি প্রাকৃতিক ঘটনার কারণে ঘটে থাকে।এটির ব্যাপারে চিন্তার বিশেষ কিছু নেই এবং এটি হওয়া থেকে প্রতিরোধ করারও কোনও কারণ নেই।লিনিয়া নাইগ্রা প্রতিরোধের জন্য কোনওরকম ক্রীম প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকাই সবচেয়ে ভাল কারণ এটি অন্যান্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে।চিন্তা করার পরিবর্তে বরং আপনি এটিকে আলিঙ্গন করতে পারেন এবং আপনার অভ্যন্তরে একটি জীবনকে প্রতিপালন করার ক্ষমতার ব্যাপারে আপনি নিজে গর্ববোধ করতে পারেন।
4.আপনি এটিকে আবৃত করতে পারেনঃ যদিও লিনিয়া নাইগ্রা অবিশ্যম্ভবী,তবে এমন কিছু উপায় আছে যার দ্বারা এটিকে কিছুটা হ্রাস করা যেতে পারে।যদি সম্ভব হয় আপনি সূর্যালোকটি এড়িয়ে চলুন এবং যখন একান্তই বাড়ির বাইরে বেরোবেন একটা ভাল সান্সস্ক্রীন ব্যবহার করুন।এটি সম্ভবত রেখাটিকে গাঢ় হওয়া থেকে প্রতিরোধ করবে।কিছু গবেষণায় এটি মানা হয় যে,লিনিয়া নাইগ্রা দেহস্থ ফোলিক অ্যাসিডের নিম্ন মাত্রার সাথে সম্পর্কিত।অতএব,আপনি এই ব্যাপারটিকে আরও হালকা করে তুলতে, পালং শাকের মত প্রাকৃতিক উৎস থেকে ভাল পরিমাণে ফোলিক অ্যাসিড গ্রহণের চেষ্টা করুন।
লিনিয়া নাইগ্রাকে প্রতিরোধ করা যায় না তবে আপনি এটির প্রকটতাকে হ্রাস করার চেষ্টা করতে পারেন।পূর্বের উল্লেখানুযায়ী,কিছু সাধারণ নির্দেশিকা যেমন সূর্যারশ্মি পরিহার,সান্সস্ক্রীন প্রয়োগ এবং আপনার পেটকে আবৃত করে রাখা মেলানিনের উৎপাদন হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে,যা সেটিকে আরও গাঢ় হয়ে ওঠা থেকে প্রতিরোধ করে।সেই অর্থে লিনিয়া নাইগ্রার কোনও বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি নেই,আর তাই কোনওরকম টপিক্যাল ক্রীম বা ওষুধ ব্যবহার এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
লিনিয়া নাইগ্রা প্রতিরোধ করার কোনও নির্দিষ্ট প্রতিকার বা উপায় নেই।ডাক্তাররা মায়েদের এটি প্রতিরোধের জন্য কোনওরকম প্রতিকার প্রয়োগ না করারই পরামর্শ দিয়ে থাকেন কারণ এটি শিশুর পক্ষে কেবল ক্ষতিরই কারণ হয়ে উঠবে।এক্ষেত্রে গর্ভাবস্থাকালীন রেখাটিকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে হয়ত কিছু কৌশল বা প্রতিকার দাবী রাখতে পারে কিন্তু লনিয়া নাইগ্রাকে প্রতিরোধ করা কিম্বা সেটিকে উধাও করে দেওয়ার প্রকৃতই কোনও উপায় নেই।
গর্ভাবস্থাকালীন রেখাকে ভিত্তি করে শিশুর লিঙ্গ সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ বাণী সম্পর্কিত বেশ কিছু কল্পকাহিনী রয়েছে,তবে সেগুলি এক চিমটে লবণের সাথে গ্রহণ করা উচিত।যদি পুরানো গল্পকথাটিকেই বিশ্বাস করা হয়,তবে সেক্ষেত্রে লিনিয়া নাইগ্রাটি যদি পিউবিক হাড় থেকে পেটের নিম্বাংশ পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়,তবে সেক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুটি ছেলে হয়ে থাকে।আবার যদি এটি উপরের দিকে পাঁজরের খাঁচা অবধি অবিরত থেকে যায় তবে গর্ভস্থ শিশুটি মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।যদিও এই জ্ঞাত বিষয়টি সম্পূর্ণটাই মজাদার,সর্বদা মনে রাখবেন যে এর সাথে লিঙ্গ সনাক্তকরণের বিষয়টি কখনই সম্পর্কিত নয় এবং এক্ষেত্রে গর্ভে ছেলে কিম্বা মেয়ে থাকার সমান সম্ভাবনাই থাকে।লিঙ্গ নির্ধারণের পরিবর্তে গর্ভস্থ শিশুটি কতটা স্বাস্থ্যকর সেই বিষয়টিই মাথায় রাখুন!
লিনিয়া নাইগ্রাটি সম্পূর্ণরূপে অক্ষতিকারক।এটি কেবল বাহ্যিক কোষগুলিতেই সীমাবদ্ধ এবং কোনওভাবেই এটি আপনার শিশুর সাথে সংযুক্ত নই।তাই আপনার গর্ভে আপনার শিশু সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং সুরক্ষিত।
গর্ভাবস্থাকালীন এই রেখাটি না থাকাটাও সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক কারণ কিছু ক্ষেত্রে যদি দেহস্থ মেলানিন উপাদানটির পরিমাণ কম হয়ে থাকে তবে রেখাটি গাঢ় হয়ে প্রকট ওঠে না।
আপনার সন্তান প্রসব করার পর,শরীর পুনরায় স্বাভাবিকে ফিরে আসতে শুরু করে,যার অর্থ হল আপনার দেহস্থ সকল হরমোনগুলি পুনরায় তাদের নিজের জায়গায় ফিরে আসতে শুরু করে।গর্ভাবস্থাকালীন রেখাটি নিজে থেকেই উধাও হয়ে যায়।যদি তার পরেও সেটি কখনও রয়ে যায়,তবে আপনি আপনার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে কিছু ক্রীম ব্যবহার করতে পারেন যেগুলি এই রেখাটিকে হালকা হতে হয়ত সহায়তা করবে।যাইহোক,তবে গর্ভাবস্থায় এবং সন্তানকে স্তন পান করানোর সময় যেকোনও ধরণের ওভার দ্য কাউন্টার ক্রীম অথবা ওষুধের ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে।
কিন্তু বাস্তবে,এটি কেবল একটি গাঢ় রেখা যেটি গর্ভাবস্থায় কয়েক মাসের জন্য উপস্থিত থাকে এবং সন্তান প্রসবের পর স্বাভাবিকভাবেই অদৃশ্য হয়ে যায়।এটি এমনকি আবার আপনার উদ্বেগের বিষয়গুলির সবচেয়ে নিম্ন তালিকার একটি বিষয় কারণ গর্ভাবস্থায় এটি সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক এবং সুরক্ষিত।