গর্ভাবস্থাকালে দাঁত ব্যথা – কারণ এবং প্রতিকারসমূহ

গর্ভাবস্থাকালে দাঁত ব্যথা

গর্ভাবস্থা হল একটি বিচিত্র পর্যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রায় সকল মহিলাই মাতৃত্বকে আলিঙ্গন করে নিতে চান।কিন্তু গর্ভাবস্থার এই যাত্রাপথ সকল মহিলার ক্ষেত্রেই খুব একটা সহজ নাও হয়ে উঠতে পারে।গর্ভাবস্থা এটির সাথে নির্দিষ্ট কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে এবং এ জাতীয় একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে দাঁতে ব্যথা।আপনি যদি জানতে চান গর্ভাবস্থায় কেন আপনার দাঁতে ব্যথা হতে পারে তবে নিম্নলিখিত নিবন্ধটিকে সম্পূর্ণ রূপে ঘেঁটে মগজে অভ্যন্তরস্থ করুন।গর্ভাবস্থায় দাঁত ব্যথার বিভিন্ন কারণগুলি এবং আপনার দাঁতের যত্ন নেওয়ার জন্য আপনি কীভাবে সেগুলির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন তা জানুন।

গর্ভাবস্থার কারণে কি দাঁত ব্যথা হতে পারে?

গর্ভাবস্থার কারণে কোনও রকম দাঁতের সমস্যা হতে পারে কিনা এ ব্যাপারে আপনি যদি চিন্তা করতে থাকেন,তবে এই প্রশ্নটির সহজ উত্তরটি হল হ্যাঁ,গর্ভাবস্থার ফলে দাঁত এবং মাড়ির সমস্যা হতে পারে।গর্ভাবস্থায় দাঁতের সমস্যাটি বাড়তে পারে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা,আপনার গর্ভস্থ সন্তানের ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা এবং এই ধরনের অন্যান্য কারণগুলির জন্য।তবে আপনি যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করেন,দাঁতের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখেন এবং নিয়মিত আপনার দন্ত চিকিৎসকের পরিদর্শনের মধ্যে থাকেন,আপনি গর্ভাবস্থায় দাঁতের যেকোনও ধরনের সমস্যা থেকেই দূরে থাকতে পারবেন।

দাঁত যন্ত্রণা কি আপনার অনাগত শিশুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে?

একটি গবেষণায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে,সেক্ষেত্রে একজন গর্ভবতী মহিলার মাড়ির মারাত্মক অসুস্থতার সহিত সরাসরি যোগসূত্র ছিল,যিনি পরবর্তীতে অকাল প্রসব বা নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অপরিণত শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন।আরেকটি গবেষণা করা হয়েছিল 100 জন গর্ভবতী মহিলার উপর,যারা দীর্ঘমেয়াদী দাঁতের রোগে ভুগছিলেন,তাদের মধ্যে 18 জন মহিলার অপরিণত বা অকাল শিশুর জন্ম দেওয়ার নথি পাওয়া গেছে।তবে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং অনতিবিলম্বে দাঁতের চিকিৎসা অপরিণত বা অকাল শিশু প্রসবের ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস করে।

গর্ভাবস্থায় দাঁত ব্যথার কারণগুলি কি?

নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লিখিত হল যেগুলি গর্ভাবস্থায় দাঁত ব্যথার কারণ হতে পারেঃ

  • গর্ভাবস্থায় আপনার দাঁতের সমস্যার একটি কারণ হতে পারে মর্নিং সিকিনেস।যখন পেটের অ্যাসিড আপনার মুখের মধ্যে উঠে আসে,তখন এর ফলে আপনার গর্ভাবস্থায় দাঁতে গহ্বর সৃষ্টি হতে পারে এবং আপনার দাঁত যন্ত্রণা করতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় দেহের হরমোনের ব্যাঘাত ঘটায় তা আপনাকে হয়ত মাড়ির প্রদাহের আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে,যার ফলে পরবর্তীতে দাঁত এবং মাড়ির বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় আপনার ডায়েটে বিভিন্ন পরিবর্তন হতে থাকে।যদি আপনি বেশি পরিমাণে দুগ্ধজাত পণ্য বা মিষ্টিজাত খাবার খেয়ে থাকেন,তবে সেক্ষেত্রে আপনার দাঁতের সমস্যা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • যখন আপনি গর্ভবতী হন আপনার দেহের ক্যালসিয়ামের চাহিদা বেড়ে যায় কারণ এটি একটি ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের ক্যালসিয়াম প্রয়োজনীয়তাগুলির সুবিধার্থে প্রয়োজন হয়।কিন্তু আপনি যদি গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ না করে থাকেন,তবে আপনার দাঁতের এনামেল গঠণকারী খনিজের পরিমাণ হ্রাস পাবে,তার ফলে দাঁত ব্যথা এবং দন্ত ক্ষয় হবে।
  • গর্ভাবস্থার কারণে আপনার দাঁত এবং মাড়ি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে এবং সেই কারণে প্রায়ই আপনার দাঁত হয় মাজাই হয় না অথবা অযথাযথ ভাবে ব্রাশ করেন যা পরবর্তীতে দাঁতের সমস্যার সৃষ্টি করে।

গর্ভাবস্থায় দাঁত যন্ত্রণার চিকিৎসা

যেখানে কিছু মহিলা তাদের সন্তান প্রসব না করা পর্যন্ত তাদের দাঁতের চিকিৎসা হয়ত স্থগিত রাখতে পছন্দ করতে পারেন,অন্যরা তখন আরও জটিলতা বেড়ে ওঠাকে এড়ানোর জন্য এর চিকিৎসা করাতে চাইতে পারেন।এখানে কিছু চিকিৎসার উল্লেখ করা হল যেগুলি আপনার ডাক্তারবাবু হয়ত আপনার জন্য সুপারিশ করতে পারেনঃ

১. এক্স-রে

কখনও কখনও আপনার ডাক্তারবাবুকে দাঁতের ক্ষতের ব্যপ্তিটি নির্ধারণ করতে এক্স-রে ব্যবহার করতে হতে পারে। অনেক মহিলা আশঙ্কা করেন যে এক্স-রে নেওয়া হয়ত তাদের অনাগত সন্তানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আপনার চিকিৎসার জন্য একান্তই প্রয়োজনীয় না হওয়া অবধি আপনার দন্ত চিকিৎসক কোনও এক্স-রে করানোর সুপারিশ হয়ত করবেন না,তবে তিনি যদি তা করে থাকেন তবে আপনাকে হয়ত বলা হবে এমন একটি লেড অ্যাপ্রোন পরার কথা যা আপনার বাচ্চাকে এক্স-রে এর খারাপ প্রভাব থেকে বাঁচাতে পারে।

২. ওষুধ

যখন আপনি আপনার দাঁতের সমস্যার সমাধান করতে আপনার দন্ত চিকিৎসকের কাছে যান তখন তার নজরে এটি নিয়ে আসুন যে আপনি গর্ভবতী,যেহেতু দাঁত ব্যথার জন্য এমন কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলি গর্ভাবস্থায় গ্রহণের ফলে হয়ত শিশুর জন্মগত ত্রুটি এবং আপনার সন্তানের আরও অন্যান্য জটিলতাগুলি সৃষ্টি হতে পারে।যদি আপনার দাঁত এবং মাড়ির কোনওরকম সংক্রমণ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের একটি সম্পূর্ণ কোর্স আপনার সম্পন্ন করা প্রয়োজন হতে পারে।

প্রাকৃতিক প্রতিকারগুলি

গর্ভাবস্থা হয়ত আপনাকে আপনার স্বাস্থ্যের বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্ক করে তুলতে পারে আর যখন দাঁতের সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার বিষয়টি আসে তখন আপনি প্রথমে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকার চেষ্টা করতে চাইতে পারেন।বেশ, সুসংবাদটি হল এখানে আমাদের এমন কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকার রইল যা আপনি গর্ভাবস্থায় দাঁতের ব্যথার জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারেন:

  • দাঁত যন্ত্রণার চিকিৎসার জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি বিকল্প হল লবঙ্গের ব্যবহার।আপনি হয় লবঙ্গটিকে চিবিয়ে নিতে পারেন অথবা ক্ষতিগ্রস্থ দাঁতের উপর লবঙ্গ তেল প্রয়োগ করতে পারেন।
  • গর্ভাবস্থায় দাঁত যন্ত্রণার জন্য আরেকটি কার্যকর প্রতিকার হল কিছু পালং শাকের পাতাকে চিবিয়ে নেওয়া।
  • উষ্ণ কম্প্রেস প্রয়োগ এক্ষেত্রে যন্ত্রণা হ্রাসে সহায়ক হতে পারে।আপনি একটি ওয়াশক্লথকে গরম জলের মধ্যে ভিজিয়ে নেওয়ার পর সেটিকে নিংড়ে নিয়ে যেখানে আপনার দাঁত ব্যথা করছে আপনার মুখমণ্ডলেরে সেই জায়গার উপর সেটিকে প্রয়োগ করতে পারেন।
  • পেয়ারা পাতা ফুটানোর মাধ্যমে প্রস্তুত পাচনের সহিত গার্গেল করা অথবা কিছু কচি পেয়ারা পাতাকে সরাসরি চিবিয়ে নিলেও তা দাঁত ব্যথা নিরাময়ে সহায়তা করে থাকে।
  • রসুনের মধ্যে উপস্থিত অ্যালিসিন দন্ত ক্ষয়কারী ব্যাকটেরিয়া হত্যায় খুবই কার্যকর।সুতরাং এক কোঁয়া রসুন চিবিয়ে খাওয়াও এক্ষেত্রে দাঁত যন্ত্রণা উপশমের সহায়ক হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় দাঁতে ব্যথার ঘরোয়া প্রতিকার

বমি করা কি আপনার দাঁতকে ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলতে পারে?

গর্ভাবস্থায় বার বার বমি করার প্রবণতা অথবা অ্যাসিড রিফ্ল্যাক্স আপনার দাঁতের উপর হয়ত পেটের অ্যাসিডের একটি আবরণ সৃষ্টি করতে পারে।এই অ্যাসিড দাঁতের এনামেলকে ক্ষতিগ্রস্থ করে তোলে যার ফলে দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং গর্ভাবস্থায় বমি হলে তা হয়ত আপনার দাঁতগুলিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলতে পারে।

ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন D কীভাবে বৃদ্ধি করতে হয়?

গর্ভাবস্থায় ক্যালসিয়াম শুধুমাত্র আপনার হাড়ের ভরকেই রক্ষা করে না এটি আবার তার সাথে ভ্রূণের হাড় এবং দাঁত গঠণেও সহায়তা করে।সুতরাং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ এমন কিছু খাবার রয়েছে যেগুলিকে আপনার ডায়েটে অন্তর্ভূক্ত করা উচিতঃ

  • চীজ
  • দই
  • ক্যালসিয়াম-সুরক্ষিত সয়া দুধ

ক্যালসিয়াম আপনার শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কিন্তু দেহে ভিটামিন D এর অভাবে এটি সঠিকভাবে আপনার শরীরের মধ্যে শোষিত হতে পারে না।অতএব ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি আপনার শরীরে যথেষ্ট ভিটামিন D -ও থাকা উচিত।আর সেটি পাওয়ার জন্য আপনি এই খাদ্যগুলিকে আপনার ডায়েটের মধ্যে রাখতে পারেনঃ

  • স্যালমন এবং অন্যান্য চর্বিযুক্ত মাছ
  • ডিম
  • চীজ
  • সুরক্ষিত মার্জারিন

আপনার দাঁত ব্রাশ করার সময় মনে রাখার বিষয়গুলি

গর্ভাবস্থায় কোনও রকম দাঁতের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাকে হ্রাস করতে আপনার দাঁত ব্রাশ করার সময় যে কয়েকটি বিষয় আপনার মনে রাখা উচিত সেগুলি হলঃ

  • আপনার দাঁত ব্রাশ করার গতিটিকে ধীর করার জন্য কিছুটা সময় নিয়ে ব্রাশ করুন।
  • আপনার টুথ পেস্টটির স্বাদ যদি আপনি পছন্দ না করেন তবে অন্যান্য টুথ পেস্টগুলি ব্যবহারের চেষ্টা করুন।
  • স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়ায় আপনি ব্রাশ করুন তবে সতর্ক হন, সবলে যেন ব্রাশ করবেন না।
  • ছোট মাথার ব্রাশগুলি ব্যবহার করুন যেগুলি সাধারণত একটু বড় বাচ্চারা ব্যহার করে থাকে।
  • যদি ব্রাশ করার সময় আপনার বমি হওয়ার মত অনুভূতি হয়,আমরা আপনাকে পরামর্শ দিই যে নিজেকে অন্যমনস্ক করে তুলুন কিছু গান শোনার মাধ্যমে বা আপনার চোখ দুটি বন্ধ করে অন্য কোনও কিছুর প্রতি আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করুন।

আপনার দাঁত ব্রাশ করার সময় মনে রাখার বিষয়গুলি

প্রাক-গর্ভাবস্থায় দন্ত স্বাস্থ্য যত্নের পরামর্শ

যদি আপনি গর্ভবতী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে থাকেন,অন্যান্য সাবধানতাগুলি গ্রহণ করা ছাড়াও,আপনার দাঁতের স্বাস্থ্যের প্রতিও আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করা উচিত যাতে গর্ভাবস্থায় আপনার কোনও রকম দাঁতের সমস্যা না হয়ে থাকে।এখানে কিছু প্রাক-গর্ভাবস্থায় দন্ত স্বাস্থ্য যত্নের পরামর্শ রইল যা হয়ত আপনাকে সাহায্য করতে পারে আপনার মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যবিধির যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রেঃ

  • নিয়মিত ভিত্তিতে আপনার দন্ত পরিদর্শন করাতে দন্ত চিকিৎসকের কাছে যান যাতে কোনও রকম দাঁতের সমস্যার ক্ষেত্রেই যত্ন নেওয়া যেতে পারে।
  • দিনে দু’বার আপনার দাঁত ব্রাশ করুন।
  • আপনি হয়ত এটি পছন্দ নাও করতে পারেন কিন্তু ফ্লস করলে তা এক্ষেত্রে ভীষণ সহায়ক হয়ে ওঠে।সুতরাং প্রতিদিনই আপনার দাঁতগুলি ফ্লস করুন।

প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে সর্বদা ভাল;অতএব,গর্ভাবস্থায়কোনওপ্রকারদাঁতেরসমস্যানাহওয়ারদিকেআপনার প্রচেষ্টাকে সংহত করা উচিত।তবে আপনার মধ্যে যদি কোনও প্রকার দাঁতের সমস্যা বিকাশ পেয়ে থাকে তবে দেরী না করে দ্রুত আপনার দন্ত চিকিৎসকের কাছে যান।