গর্ভদশা, কোনওরকম সন্দেহ ছাড়াই আপনার জীবনের সবচেয়ে চাপপূর্ণ একটা সময় হয়ে উঠতে পারে।এটি আপনার প্রথমবার হোক বা নাই হোক, হবু মায়েদের দ্বারা সহ্য করা এই সকল চাপের মাত্রাগুলি প্রকৃত অর্থে খুব বেশি হ্রাস পায় না।তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে, এই কঠিন সময়ে যতটা সম্ভব আপনার চাপ মুক্ত থাকার বিষয়টি আবশ্যিকভাবে নিশ্চিত করণীয়।সর্বোপরি, স্ট্রেসফুল অভিজ্ঞতাগুলি বেড়ে ওঠা শিশুর পক্ষে ভাল নয়।
নানা ধরনের চাপ–সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে লাঘব করার সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি হল দীর্ঘ মেয়াদে একটা ভাল ম্যাসাজ করা।যদিও প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই ম্যাসাজগুলি করানো যেতে পারে, তবে এটি মায়েদের ক্ষেত্রেও দুর্দান্তভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
একটা রেগুলার বা নিয়মিত ম্যাসাজের থেকে প্রসব পূর্ববর্তী ম্যাসাজ করাটা খুব বিশেষভাবে আলাদা কিছু হয় না।এই ক্রিয়াটির উদ্দেশ্য হল মাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সাহায্য করা, মাংস– পেশীগুলি থেকে চাপ বা টান দূর করা, ব্যথা–বেদনা হ্রাস করা এবং শরীরে রক্ত প্রবাহের উন্নতি ঘটানো।এর জন্য গর্ভাবস্থায়, প্রকৃতপক্ষে শরীরের যে অংশগুলি অন্তর্ভূক্ত হতে পারে তা হল গর্ভবতী হলে পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত ম্যাসাজ করা।প্রসবপূর্ব ম্যাসাজগুলি নির্ধারিত হয় অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের সাধারণ ব্যথা–বেদনার জায়গাগুলির জন্য এবং গর্ভবতী মহিলাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলিতে কিছুটা অদল বদল এনে তার উপযুক্ত হিসেবে তা স্থির করা হয়।
প্রসবপূর্ব ম্যাসেজগুলি অবশ্যই এই জাতীয় ম্যাসেজগুলিতে শংসাপত্র পাওয়া প্রশিক্ষিত ট্রেনারদের দ্বারা পরিচালনা করা উচিত, কারণ প্রেগনেন্সি ম্যাসেজের জন্য ফোকাস করার ক্ষেত্রে ম্যাসেজের কৌশল এবং ক্ষেত্রগুলির মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।উদাহরণ হিসেবে, গর্ভাবস্থা লিগামেন্টগুলিকে দুর্বল করে দেয় যা সেগুলিকে আরও ভারসাম্যহীন করে তোলে, বিশেষ করে জোর দিলে বা বল প্রয়োগের সময়।কিন্তু প্রশিক্ষিত ট্রেনাররা জানেন যে গর্ভাবস্থার প্রসব যন্ত্রণার দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত জায়গা ঠিক কোনগুলি এবং কোন জায়গাগুলি এড়িয়ে যেতে হবে তারও একটা পরিষ্কার ধারণা তাদের থাকে।
যদিও এটা শুনে অক্ষতিকারক মনে হয়, এবং বাস্তবেই তা, তবুও এ ব্যাপারে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে, আর তা হল– গর্ভদশার শুরুতে একটা প্রসবপূর্ব ম্যাসাজ করানো ভ্রূণের গঠনের পক্ষে ক্ষতিকারক।আর তারই পরিণাম হিসেবে, অনেক ম্যাসাজ সেন্টারগুলোই গর্ভদশার প্রথম ত্রৈমাসিকে থাকা গর্ভবতী মহিলাদের প্রেগনেন্সি ম্যাসাজ করার ক্ষেত্রে অনুমতি দেয় না।তবে এটা দেখা গেছে যে, ম্যাসাজগুলো কোনওভাবেই শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে না।বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা গর্ভাবস্থার পুরো সময়কাল ধরেই এই ম্যাসেজগুলি গ্রহণের পরামর্শ দেন, কারণ এগুলি উপকারী।এগুলি গ্রহণের স্বাভাবিক সময়সূচীটি হল তৃতীয় ত্রৈমাসিক পর্যন্ত প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে এবং তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে ম্যাসেজ নেওয়া।
প্রিন্যাটাল বা প্রসবপূর্ব ম্যাসাজের একাধিক উপকারিতাগুলির থেকে বেশ কিছু নিম্নে তালিকাবদ্ধ করা হলঃ
ম্যাসাজটি সতর্কতার সাথে সম্পন্ন করতে হবে কারণ মা এবং বাচ্চার স্বাস্থ্যের ওপর এর সরাসরি প্রভাব রয়েছে।বাড়িতে অথবা কোনও ক্লিনিকে ম্যাসাজটি করা হচ্ছে কিনা তার ওপর ভিত্তি করে এক্ষেত্রে নোট করার মত অনেকগুলি বিষয় রয়েছে।
বাড়িতে ম্যাসাজ করার ক্ষেত্রেঃ
আপনার নিজের বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যে একটি ম্যাসেজ করার সময়, আপনার কেবল যতটা সম্ভব সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় থাকার কথাটি মনে রাখা দরকার।আপনার অঙ্গমর্দিকা বা মালিশদানকারীর সাথে কথা বলুন এবং যন্ত্রণাপূর্ণ অঞ্চলগুলি এবং যে জায়গাগুলিতে খুব বেশি যত্নের প্রয়োজন নেই সেগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করুন।
ক্লিনিকে ম্যাসাজ করার ক্ষেত্রেঃ
আপনি যদি কোনও সার্টিফায়েড বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদারকে দিয়ে তার ক্লিনিকে ম্যাসাজ করানোর পরিকল্পনা করেন, প্রথমেই প্রয়োজন ঘরটির পরিবেশের সাথে আপনার নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করানো।আপনার প্রশিক্ষকের সাথেও খোলামেলাভাবে কথা বলা দরকার এবং সুষ্ঠুভাবে মালিশটি সম্পন্ন করার জন্য হয়ত আপনাকে সমস্ত জামা–কাপড় ছেড়ে ফেলার কথাও বলা হতে পারে, তাই সেটাও মাথায় রেখে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত রাখবেন।
বিশেষত, আপনার গর্ভাবস্থার শেষের পর্যায়ে, ম্যাসাজ করানোর জন্য আপনার কখনই পিঠের উপর ভর দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা উচিত নয়।এটি আপনার পিঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া যেকোনও রক্তনালীকে সঙ্কুচিত করতে পারে, কাজেই তার ফলে রক্তচাপ কমে যায়।গর্ভাবস্থায় সাধারণত পাশ ফিরে শুয়ে রেখেই মায়েদের প্রসবপূর্ব ম্যাসাজগুলিও করানো হয়ে থাকে, এমনকি সেটা যদি তেল দিয়ে মালিশও হয়।তবে কিছু টেবিলে পেটের জায়গাটিতে একটা গভীর কাট–আউট করা থাকে, যা মাকে মুখ নিচুর দিক করে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে শুয়ে থাকতে সক্ষম করে।
প্রসবপূর্ব ম্যাসাজ করার সময় এড়িয়ে চলা উচিত এমন স্থান খুব বেশি নেই, শুধুমাত্র গোড়ালী এবং হাতের তালুর কয়েকটি জায়গা ছাড়া, যেহেতু সেগুলি জরায়ুতে সংকোচন সৃষ্টি করতে পারে।অতএব, প্রসবপূর্ব ম্যাসাজটি চালু করার পূর্বে একজন প্রশিক্ষিত মালিশদানকারীর পরামর্শ নিয়ে নেওয়াটাই সর্বোত্তম।
বাড়িতে প্রেগনেন্সি ম্যাসাজ
প্রসবপূর্ব অথবা যেকোনও ধরণের একটা ম্যাসাজ আরামদায়কভাবে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে নেওয়ার সবচেয়ে আদর্শ স্থানটি হয়ে থাকে আপনার নিজের বাড়ি।তবে প্রসবপূর্ব ম্যাসেজটি করানোর আগে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়।
ম্যাসাজের জন্য সঠিক কৌশল
1.পিঠঃ পিঠে ব্যথার জন্য ম্যাসাজটি অবশ্যই ঘাড় থেকে শুরু করা উচিত এবং তা দৃঢ় ভাবে নীচের দিক বরবার চালিয়ে আপনার পশ্চাৎদেশ পর্যন্ত করতে হবে।তবে সমস্যা এড়াতে, মেরুদন্ডের ওপর কোনোরকম চাপ দেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে।
2.নিতম্বঃ মেরুদন্ডের মূল হাড়টি হাত মুঠো করে আঙ্গুলের গিঁটগুলি দিয়ে হালকা করে ম্যাসাজ করা দরকার যদিও পশ্চাৎদেশের কাছে লেজের হাড়টি এড়ানো উচিত।
3.পাঃ পায়ের চাপ কমাতে, বৃত্তীয় এবং পার্শ্ববর্তী গতিতে স্ট্রোকগুলিকে পায়ের পাতা থেকে শুরু করে নিতম্ব পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে।
4.হাত এবং পাঃ পেশীর ব্যথাগুলি সাধারণত এখানে সমস্যা নয়, তরল ধারণ– যার ফলে হাত–পা ফুলে যায়, অস্বস্তির প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।ম্যাসেজের ফলে রক্ত সঞ্চালন বাড়া উচিত আর সেটি করা প্রয়োজন বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে শরীরের কেন্দ্রের দিক বরাবর।
5.ঘাড়ঃ ঘাড়ের পেশীর চাপ লাঘব করা যেতে পারে বুড়ো আঙ্গুলগুলির সাহায্যে বিস্তৃতভাবে কাঁধের জায়গাটি মালিশ করার মাধ্যমে।
একটা উপযুক্ত প্রসবপূর্ব ম্যাসাজের একাধিক বিকল্প নেই, কারণ এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করা হলে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলতে পারে।তবে সাধারণভাবে করে থাকা কয়েকটি সাধারণ ম্যাসাজ এর বিকল্প হিসেবে করা যেতে পারে, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করতে পারেন শিয়াটসু টেকনিক অথবা আকুপাঙ্কচার পদ্ধতিটি।আকুপ্রেসার এবং ফুট রিফ্লেক্সোলজি হল এর অন্যান্য বিকল্প যা মায়ের উপরে একই প্রভাব ফেলে।
যদিও বেশ কয়েকটি ম্যাসেজ ক্লিনিকে গর্ভপাতের ভয় থেকে মহিলাদের প্রথম ত্রৈমাসিকের মধ্যে তাদের উপর প্রেগনেন্সি ম্যাসাজগুলি না করানোর রিপোর্ট পাওয়া গেছে, তবে দেখা গেছে যে এই ভয়গুলির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।প্রেগনেন্সি ম্যাসেজগুলি গর্ভাবস্থার পুরো সময়কাল ধরেই নেওয়া যায় একটি আদর্শ শিডিউলের সাথে, যেখানে তৃতীয় ত্রৈমাসিক পর্যন্ত প্রতি 2 সপ্তাহে একবার এবং তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে।
গর্ভবতী মহিলাদের ধারেকাছে সবসময় কোনও লোক নাও থাকতে পারে, তাই তাদের ম্যাসাজের প্রয়োজন বোধ হলে নিজেদের উপরেই নির্ভর করতে হতে পারে।তবে স্ব–মালিশের সাথে জড়িত অনেকগুলি সীমাবদ্ধতা রয়েছে কারণ দেহের এমন কতগুলি স্থান রয়েছে সেখানে আপনার নিজের পক্ষে পৌঁছানো কঠিন।যদিও হাত–পাগুলি ভালভাবেই ম্যাসাজ করা যায় কিন্তু ঘাড়, পিঠের মতো জায়গাগুলোতে সন্তোষজনকভাবে পৌঁছানোটা শক্ত।
একটি আরামদায়ক বেলি ম্যাসাজের জন্য, বিছানার উপর কয়েকটি বালিশের সাহায্য নিয়ে এমনভাবে বসুন যাতে আপনার দেহটি 45 ডিগ্রী কোণে থাকে এবং আপনার পেটের উপর স্ট্রোকের গতিগুলিকে হৃদপিন্ডের দিকে(উপরের দিকে)নিয়ে চলুন।প্রয়োজন হলে লোশন বা তেল ব্যবহার করতে পারেন।আপনি আবার আপনার সবচেয়ে পছন্দের প্রশমণকারী অপরিহার্য তেলটি দিয়ে আপনার মাথাটিকেও ম্যাসাজ করার চেষ্টা করতে পারেন।আপনার কপালটিকে কেবল হালকা বৃত্তীয় গতিতে ঘষে সেটিকে টেনে ভ্রূ–র দিকে প্রসারিত করুন এবং তারপর তা পুনরায় কপালের মাঝ বরাবর ফিরিয়ে আনুন।এই হেড–ম্যাসাজটি এমনকি প্রাক–শয়নকালীন একটি পদ্ধতি হিসেবেও কাজ করে।
ম্যাসাজের পরে, মহিলারা গভীর নিদ্রা যাপন করতে পারেন এবং একটা সার্বিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।এর ফলে রক্ত সংবহন উন্নত হয় ও পেশীর ব্যথাগুলি হ্রাস পাওয়ায় তা বর্ধিত ওজনকে সহ্য করে তার সাথে আরও ভালভাবে মানিয়ে দেহকে বহন করতেও সাহয্য করে আর এভাবেই বর্ধিত সময়ের জন্য সতেজ হয়ে উঠতে সাহায্য করার সাথে পুনরুজ্জীবিত বোধ করায়।
প্রেগনেন্সি ম্যাসাজ কিম্বা প্রসবপূর্ববর্তী ম্যাসাজ আপনাকে আরও ভাল এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করাতে আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করতে পারে।তবে গর্ভাবস্থায় যেকোনও পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরূপ, ম্যাসাজের ক্ষেত্রেও তা সঠিকভাবে সতর্কতার সাথে করা আবশ্যক।এর থেকে আপনি এবং আপনার শিশু উভয়েই যথার্থ উপকারিতাগুলি অর্জনের স্বার্থে একজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিত ব্যক্তির থেকেই ম্যাসাজ নেওয়া নিশ্চিত করুন।গর্ভাবস্থা হল একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল মুহুর্ত, তাই যেকোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।