গর্ভাবস্থায় কালো মল

গর্ভাবস্থায় কালো মল

গর্ভাবস্থা শরীরের উপর একটা মারাত্মক ধকল ফেলে, আর সেই কারণে এ ব্যাপারে বেশির ভাগ মহিলাই এই সময় অতিরিক্ত সচেতন হয়ে ওঠেন, অস্বাভাবিক মনে হওয়া কোনওকিছু এবং যেকোনও লক্ষণের সন্ধানে আপনি সর্বদা সতর্ক থাকেন।সেগুলির মধ্যে একটি উপসর্গ হল গর্ভাবস্থায় কালো মল।তবে এটি একটি বিভ্রান্তিকর ভয় হয়ে উঠতে পারে যেহেতু শুধুমাত্র কালো মল কখনও বিপজ্জনক হয় নাকালো মলের সাথে সংযুক্ত অন্যান্য লক্ষণগুলি কোনও অসুস্থতা, সংক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ইঙ্গিত দিতে পারে।কেবল মলটি একাই কোনও অসুস্থতা নয় তবে এটি একটি সঙ্কেত বা উপসর্গ। আপনার কালো মল হওয়ার সময় যে লক্ষণগুলির দিকে লক্ষ্য রাখবেনঃ

  • তলপেটে ব্যথা
  • জ্বর
  • মাথা ঘোরা ও ঝিমঝিম করা
  • মাথা টলা এবং অস্থির বোধ করা
  • বমি বমি ভাব
  • মাথা যন্ত্রণা
  • কিডনিতে ব্যথা করা

গর্ভাবস্থায় কালো মলের সাথে যুক্ত কারণগুলি এবং ঝুঁকিগুলি বেশি ভাল করে বুঝতে, কালো মল হওয়ার কারণগুলি বোঝাটা জরুরি।

গর্ভাবস্থায় কালো মল হওয়ার কারণগুলি

গর্ভাবস্থায় আপনার কালো মল হওয়ার পিছনে অনেকগুলি কারণ থাকতে পারে, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি অলঃ

1.ওষুধ

বিশেষ কয়েক ধরণের ওষুধের কারণে আপনার গর্ভাবস্থাকালে কালো মল হয়ে থাকতে পারে।এটি সাধারণত সেই প্রথম জিনিস যা আপনার অবস্থা নিরীক্ষণ করার সময় ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে থাকেন।কয়েক ধরণের অ্যান্টাসিডগুলি এই কালো মল হওয়ার কারণ হিসেবে পরিচিত।ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধগুলি খুব সহজেই পাওয়া যায় এবং প্রেসক্রিপশন ছাড়া সেগুলি গ্রহণ করলে ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।এটা মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে গর্ভাবস্থায় স্বসিদ্ধান্তে ওষুধ গ্রহণ করা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।আপনার গ্রহণ করা ওষুধের ব্যাপারে আপনার ডাক্তারবাবুকে অবগত করুন যাতে আপনার মলের সাথে ওষুধ সম্পর্কিত কোনও সমস্যা থেকে থাকলে তা নির্ধারণ করে নিরাময়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

2.খাদ্য

এটা সাধারণত বিশ্বাস করা হয় যে, গাঢ় রঙের খাবার খেলে তা মলের বর্ণ গাঢ় করে তোলে।কালো বা নীল বর্ণের খাবারগুলির দিকে লক্ষ্য রাখুন এবং আপনার পুষ্টি গ্রহণে ভারসাম্য আনতে আপনার ডায়েট পরিচালনা করার বিষয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।এই সময় কোনও কৃত্রিম রঙ দ্বারা প্রস্তুত খাবারগুলি গ্রহণ করা থেকে দূরে থাকার পরামর্শই আপনাকে দেওয়া হয়।

3.আয়রণ পরিপূরক

গর্ভাবস্থায় আপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে আয়রণ পরিপূরক গ্রহণের প্রস্তাব দেবেনআর এটি আপনার মলের বর্ণকে কালো করে তোলার কারণ হয়ে ওঠাটা একেবারে স্বাভাবিক।ঋতুস্রাবের সময় প্রচুর রক্তে ক্ষরণ আর গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বেশিরভাগ মহিলা সাধারণত রক্তাল্পতায় ভুগে থাকেন।এই পরিপূরকগুলি যেহেতু সাধারণত ক্ষতি করে না, তাই সেগুলির সাথে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার যেমন পালং শাক, মাংস ইত্যাদি খাওয়া চালিয়ে যান, এছাড়াও আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা রুটিন মাফিক পরীক্ষা করান।

4.রক্ত ক্ষরণ

গর্ভাবস্থায় কালো মল হওয়ার আরও মারাত্মক কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হল রক্তক্ষরণ।এটি মারাত্মক GERD-এর কারণে হয়ে থাকা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তপাতের মতো ছোট বা অন্ত্রের রক্তক্ষরণের মতো মারাত্মক কিছু হতে পারে। প্রকার নির্বিশেষে, এটি ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করা জরুরী।

5.স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা

কালো মল প্রায়ই স্বাস্থ্য জনিত সমস্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে।আপনার মল যদি কালো এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধ যুক্ত হয়ে থাকে, তবে এটি মেলেনা নামক একটি অবস্থা হতে পারে।এর ধরণটি যদি আলকাতরার ন্যায় এবং কালো হয়ে থাকে, এটি ভিতর থেকে রক্ত ক্ষরণের ইঙ্গিত করতে পারে।যদি আপনার গর্ভাদশার তৃতীয় পর্যায়ে মলদ্বার অঞ্চলটি ফুলে যায় এবং কালো মল হতে থাকে, এটি আপনার পায়ুদ্বার ছিঁড়ে যাওয়ার একটি লক্ষণ হতে পারে।আপনার হওয়া কালো মলটি চিকিৎসা জনিত কোনও সমস্যার সাথে সম্পর্কিত কিনা তা বুঝতে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলুন।

ডায়গনোসিস বা রোগ নির্ণয়

চিকিৎসকরা প্রথমে আপনার চিকিৎসা জনিত এবং শারিরীক অবস্থার ইতিহাস জেনে তা বিবেচনা করার পর আপনার কালো মল হওয়ার কারণটিকে নির্ণয় করতে পারেন।যদি তিনি বোঝেন যে আপনার থেকে পাওয়া তথ্যগুলি আপনার কালো মল হওয়ার কারণকে নির্দেশ করতে পারছে না, সেক্ষেত্রে আপনাকে এক্সরে, রক্ত পরীক্ষা এবং স্টুল পরীক্ষা প্রভৃতি করাতে হবে।এটি আপনার কালো মলের কারণকে সনাক্ত করতে সহায়তা করতে পারে।এটি যদি তখনও অসমাধিত হয়ে থাকে, তবে ডাক্তারবাবু আপনাকে এন্ডোস্কোপি নামক একটি পরীক্ষা করার জন্য বলতে পারেন যেখানে কোনও প্রশিক্ষিত পেশাদার আপনার খাদ্যনালীর মধ্য দিয়ে একটি নল প্রবেশ করাবেন যার মধ্যে একটি ক্যামেরা যুক্ত থাকে।এই নলটি আপনার গ্যাস্ট্রোইন্সটেনাইল ট্র্যাক্ট অর্থাৎ পৌষ্টিক নালীর ক্ষুদ্রান্ত্র পর্যন্ত ছবি তুলে আনবে এবং কালো মল হওয়ার কারণ সনাক্ত করার চেষ্টা করবে। আপনার ডাক্তারবাবু আবার এর কারণ হিসেবে কোলন ইনফেকশন এবং কোলন ক্যান্সার দায়ী কিনা তা নির্ধারণের জন্য আপনাকে একটি কোলনোস্কোপি করার কথাও বলতে পারেন

কালো মল এড়াবার কার্যকর উপায়

আপনার গর্ভাবস্থায় কালো মল হওয়া এড়ানোর কয়েকটি কার্যকর উপায়ের উল্লেখ এখানে করা হলঃ

1.ফাইবার বা তন্তু জাতীয় খাদ্য গ্রহণ বাড়ান

গর্ভাবস্থায় হজম জনিত সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির মধ্যে একটি হল উচ্চ ফাইবার এবং মিনারেল সমৃদ্ধ আহার গ্রহণ করা যা আপনার হজম প্রক্রিয়াকে সহজে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা এবং পুষ্টি উপাদানগুলি ভেঙ্গে ফেলাকে নিশ্চিত করে।তবে তার অর্থ কখনও এই নয় যে আপনি আপনার ডায়েট থেকে কার্বোহাইড্রেটকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেবেন।এর খুব সহজ মানে হল, আপনি আপনার ডায়েটে ফাইবার উপাদানের পরিমাণ বাড়াবেন এবং জটিল ও স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেটগুলি গ্রহণ করবেন।একজন পুষ্টি বিশারদের পরামর্শ নিন এবং এমন একটি খাদ্য পরিকল্পনা গড়ে তুলুন যা কেবল আপনার দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী সকল খনিজ, ভিটামিন এবং পুষ্টি উপাদানগুলিই সরবরাহ করবে না তার সাথে আবার আপনার পৌষ্টিক নালীর কার্যক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করার ক্ষেত্রেও সুবিধাজনক হয়ে উঠবে।ফাইবারের পরিমাণ বাড়ালে তা কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে স্বস্তি আনে এবং মলদ্বার চিঁড়ে যাওয়া বা অর্শ এবং তার সাথে রক্ত ক্ষরণও প্রতিরোধ করে

2.ধূমপান ত্যাগ করুন

ধূমপান একটি অত্যন্ত বদ অভ্যাস ও ভীষণভাবে ক্ষতিকারক যা কেবল আপনার ফুসফুসেরই ক্ষতি এবং ক্যান্সারের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে না তার সাথে এটি আবার দেহযন্ত্রের স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটায় যা হজম জনিত সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে, আপনার রক্তচাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এমনকি আভ্যন্তরীণ রক্ত ক্ষরণের কারণ হয়ে উঠতে পারে।চিকিৎসকরা এমনিতেই সাধারণভাবে ধূমপান না করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন তবে বিশেষ করে আপনার গর্ভাবস্থায় এর ঝুঁকি স্বাভাবিকের থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায় এবং আপনার গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যে এবং প্রসবের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়তে পারে।

3.হাইড্রেট থাকুন

আপনার পৌষ্টিক নালীর অবনতি হওয়ার পিছনে থাকা কারণগুলির মধ্যে একটি অন্যতম সাধারণ কারণ হল ডিহাইড্রেশন।একটি স্বাস্থ্যকর হজম প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দেহযন্ত্রের ও বিশষত অন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে জল একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।সুতরাং প্রতিদিন সঠিক পরিমাণে জল পান করা এবং জলের ভাগ বেশি আছে এমন জাতীয় রসাল ফল যেমন তরমুজ, শসা এবং আঙ্গুর অত্যাদি সেবন করার কথা মাথায় রাখবেন।

4.স্বসিদ্ধান্তে ওষুধ খাওয়া এড়িয়ে চলুন

কিছু ওষুধের কারণেও কালো মল হয়ে থাকতে পারে, আর সেই কারণের জন্যই আপনাকে পরামর্শ দেওয়া হয় গর্ভাবস্থাকালে নিজে নিজেই বেছে নিয়ে কোনওরকম ওষুধ না খাওয়ার জন্য।ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধগুলি গ্রহণের পূর্বে একজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে তাঁর পরামর্শ নিন এবং নিশ্চিত করুন যে আপনি নিজে থেকে যে ওষুধগুলি গ্রহণ করেন সেগুলি পরিহার করে চলবেন ডাক্তারের মতানুযায়ী।

5.যোগব্যায়াম

মনে রাখবেন যে আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য যোগব্যায়াম করা আবশ্যক।কিছু হালকা যোগব্যায়াম শুধু আপনার দৈহিক স্বাস্থ্যকেই অটুট রাখে না এটি আবার আপনার হজম শক্তিকে উন্নত করতে সহায়তা করে এবং নিশ্চিত করে মাংসপেশীর সুস্বাস্থ্য।এটি আবার কালো মল হওয়াকে এড়িয়ে চলার সহায়ক হিসেবেও পরিচিত।

কালো মল হওয়া লক্ষ্য করলে আপনি কি করবেন?

সবচেয়ে ভাল হল এ ব্যাপারে আপনি ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন এমনকি যদি এর কারণটি সামাণ্যও হয়ে থাকে, কারণ কোনও রকম বিপদ ঘটে যাওয়ার আগে তার কারণটি নির্ধারণ করে ফেলাটাই সর্বোত্তম।মনে রাখবেন যে, আপনি যখন গর্ভবতী হন, তখন আপনার গর্ভস্থ সন্তানের সুস্বাস্থ্যের এবং মঙ্গলের দায়িত্বটিও আপনিই বহন করেন।আপনার এবং সন্তানের উভয়ের জন্যই যাতে ভবিষ্যতটি বিপদের সম্ভাবনাহীন, সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে তার জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনানুযায়ী ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের সহায়তা নিন।

যদিও গর্ভাবস্থায় কালো মল হওয়া একটা হালকা উদ্বেগের লক্ষণ হতে পারে, তা বলে সেটি সর্বদা বিপদকেই নির্দেশ করে না।ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন, তাঁর দেওয়া পরামর্শ অনুসরণ করুন এবং আপনি এর অন্যান্য উপসর্গ ও লক্ষণগুলির দিকে নজর রাখা নিশ্চিত করুন।খোলাখুলি বিস্তারিত ভাবে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করুন ও তাঁকে সহযোগিতা করুন যাতে তিনি আপনার জন্য সঠিক পদক্ষেপটি গ্রহণ করে আপনাকে আপনার গর্ভাবস্থার যাত্রাপথে সুষ্ঠুভাবে সুস্থতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।