গর্ভাবস্থায় ঘেমে যাওয়া

গর্ভাবস্থায় ঘেমে যাওয়া

একটি মহিলার দেহে অসংখ্য পরিবর্তন আনয়নের দ্বারা গর্ভাবস্থা চিহ্নিত হয়ে থাকে।একদিকে,দেহের অভ্যন্তরে হয়ে যাওয়া বহু পরিবর্তন অনুভূত না হতে পারে।আবার অন্যদিকে,এমন কিছু দৃশ্যত পরিবর্তন হয়ে থাকে যেগুলি গর্ভাবস্থায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানকে বদলে দেয়।অত্যাধিক ঘেমে যাওয়া এরকমই একটি শারীরিক পরিবর্তন যা একজন গর্ভবতী মহিলা সম্ভবত অনুভব করে থাকেন।

ঘেমে যাওয়া কি প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থার লক্ষণ?

ঘেমে যাওয়া হল,ঠিক মেজাজের দোলাচল,ফুলে ওঠা বুক এবং চরম অবসাদের মতই গর্ভাবস্থার একটি লক্ষণ।গর্ভাবস্থায় হাত এবং পায়ের পাতা ঘেমে যাওয়াটা সাধারণ ব্যাপার,যেহেতু হরমোনের মাত্রার ঘন ঘন পরিবর্তন এবং নতুন হরমোনের নিঃসরণ গরমের ঐ ঝলকানিগুলির কারণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ঘেমে ওঠার কারণগুলি

গর্ভাবস্থার সম্পূর্ণ সময়কাল জুড়ে কোনও কোনও গর্ভবতী মহিলা অস্বাভাবিক ঘাম অনুভব করেন।বিশেষ করে রাত্রিবেলায় ঘামের হার বেড়ে যায়।মহিলাদের মধ্যে অত্যাধিক ঘাম হওয়ার কারণগুলি এখানে দেওয়া হলঃ

  1. হরমোনের পরিবর্তনঃ গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনগুলির প্রচুর উত্থানপতন এবং পরিবর্তন হওয়ার ফলে সেগুলি অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার জন্য দায়ী হয়ে ওঠে। শুক্রাণু এবং ডিম্বানুর মিলনের ফলে হরমোনগুলির পরিবর্তনের ফলস্বরূপ হাইপোথ্যালামাসকে বিভ্রান্ত করে তোলে। শরীরের হরমোনগুলির পরিবর্তনের কারণে, হাইপোথ্যালামাস শরীরে তাপ অনুভব করে,এমনকি কিছু না হওয়া সত্ত্বেও এবং শরীরকে শীতল করার জন্য একটি প্রতিচ্ছবি হিসাবে ঘাম প্রকাশ করে।
  1. ওষুধঃ জ্বর,গা গুলানোবমি বমি ভাব অথবা অ্যান্টিডিপ্রেসনের জন্য ওষুধ গ্রহণের কারণে শরীরের মধ্যে তাপমাত্রার পরিবর্তন হতে পারে এবং তার ফলে ঘাম হয়,বিশেষ করে রাত্রি বেলায়।এই ওষুধগুলির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও আবার অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
  1. ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন যা স্ট্রেসের কারণঃ যেসকল ক্রিয়াকলাপগুলি যোগব্যায়ামের মত প্রচুর অঙ্গ সঞ্চালনার সাথে যুক্ত সেগুলি করার ফলে অতিরিক্ত ঘাম হয়ে থাকে।
  1. সংক্রমণ এবং অসুস্থতাঃ গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক ঘাম হওয়ার অন্য কারণটি হতে পারে কোনও সংক্রমণ অথবা অসুস্থতা যাতে গর্ভবতী মহিলাটি ভুগে থাকেন।হজকিনের লিম্ফোমা হল এক ধরণের ক্যান্সার যেটি গর্ভাবস্থায় লসিকা তন্ত্র অঞ্চলের মধ্যে বিকাশ লাভ করে।
  1. থাইরয়েড গ্রন্থিতে হওয়া পরিবর্তনগুলিঃ গর্ভাবস্থা হাইপোথাইরয়েডিজমকে পরিচালনা করতে পারে।এই অবস্থাটিও দেহে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
  1. মশলাদার খাদ্য এবং ক্যাফিন গ্রহণঃ যে সকল খাদ্য উপাদানের মধ্যে মশলা,ক্যাফিন অথবা অতিরিক্ত মিষ্টি থাকে,সেগুলি শরীরে আরও বেশী তাপ উৎপন্ন করার মাধ্যমে দেহের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে তোলে।এই খাবারগুলি দেহের বিপাকীয় হার বৃদ্ধি করে এবং অতিরিক্ত ঘামকে সৃষ্টি করে।

গর্ভাবস্থায় কখন আপনি অত্যধিক ঘাম অনুভব করেন?

হরমোনের পরিবর্তনগুলি ছাড়াও,গর্ভাবস্থায় দেহ বিপুল চাপের মধ্যে থাকে।এই পর্যায়ে নতুন জীবনটিকে বিকশিত এবং সমর্থন করার জন্য আপনার দেহের প্রচেষ্টাটিকে আরও দ্বিগুণ করা প্রয়োজন।দেহের এই অতিরিক্ত প্রচেষ্টার কারণে আরও বেশী তাপ উৎপন্ন হয় এবং যাতে শরীরকে ঠাণ্ডা করতে প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেহ থেকে ঘাম মুক্ত হয়।গর্ভাবস্থায় হঠাৎ প্রচুর ঘাম ঝরার অভিজ্ঞতা হওয়া স্বাভাবিক।

গর্ভাবস্থায় রাত্রিকালীন ঘাম অথবা নকটারনাল হাইপারহাইড্রোসিস সম্পর্কে কি জানা যায়?

গর্ভাবস্থার কারণে রাত্রে ঘুমের মধ্যে আপনার অত্যধিক ঘাম হতে পারে।এই অবস্থাটি নকটারনাল হাইপারহাইড্রোসিস নামে পরিচিত এবং কোনও মহিলার রজোবন্ধের রূপান্তরের বছরগুলিতেও বেশ স্বাভাবিক।

এটির প্রকৃত কারণটিকে নির্ধারণ এবং পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ।রাত্রিকালীন ঘামের কারণ হতে পারে গর্ভাবস্থার ফলস্বরূপ হরমোনগুলির পরিবর্তনের কারণে অথবা চারপাশের গরমের জন্য,যেটি সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক।তবে আবার এটি অন্তর্নিহিত কোনও অসুস্থতা অথবা সংক্রমণের কারণেও হতে পারে যা চিকিৎসা করার প্রয়োজন আছে।

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ঘাম থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে?

যদিও ঘাম হওয়ার জন্য কোনও নিরাময় নেই,নিম্নে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল যার দ্বারা আপনি এর প্রভাবকে হ্রাস করতে এবং অনেকটা ভাল অনুভব করতে পারেনঃ

  • হাইড্রেট থাকার জন্য পর্যাপ্ত জল পান করুন এবং এমন ধরণের খাবার খান যা আপনাকে শীতল রাখবে এবং আপনার দেহের তাপমাত্রা হ্রাস করবে।
  • ভারী ব্যায়াম করা এড়িয়ে চলুন বিশেষ করে যখন খুব বেশী গরম থাকে।শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ব্যামায় করার গুরুত্বকে প্রাধান্য দিন এবং হাঁটার জন্য খুব ভোরবেলায় অথবা সন্ধ্যার সময় বাইরে বের হন।
  • গায়ের উপর খুব বেশী জামাকাপড় চাপানোকে এড়িয়ে চলুন।হালকা রঙের জামাকাপড় পরুন যেগুলি হালকা,নরম উপাদান দিয়ে তৈরী।আপনার পোশাক তৈরীর উপাদানগুলি বায়ু চলাচলের যোগ্য হবে এবং তাপকে আটকে রাখবে না সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করুন।
  • আপনার দেহে ট্যালকম পাউডার প্রয়োগ করুন,বিশেষত সেই সকল অঞ্চলগুলিতে যেখানে ঘষা লাগার প্রবণতা থাকে।ট্যালকম পাউডার ঘামকে শুষে নেবে।
  • দিনের বেলায় সরাসরি সূর্যালোক থেকে দূরে থাকুন,বিশেষ করে গ্রীষ্ম ঋতুতে।শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে সময় কাটালে তা আপনার দেহকে ঠাণ্ডা রাখবে এবং ঘাম হওয়া হ্রাস পাবে।
  • একটি স্নানের তোয়ালের উপর ঘুমান অথবা আপনার শয্যার উপর বিছানার চাদরের অতিরিক্ত স্তর সজ্জিত করুন। এটি অতিরিক্ত ঘাম শুষে নিয়ে আপনাকে শুকনো রাখতে সহায়তা করবে।
  • তেলমশলাযুক্ত খাবার খাওয়া এবং গরম পানীয় পান করা এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলি আপনার দেহে ঘাম হওয়ার মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলবে।অ্যালকোহল গ্রহণ,ক্যাফিনযুক্ত পানীয় পান করা,চকলেট অথবা মিষ্টি খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
  • আপনি নিজেকে বদ্ধ ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখবেন না।ঘরের মধ্যে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশের এবং বায়ু চলাচলের জন্য জানালাগুলিকে উন্মুক্ত রাখুন।ঘাম শুকনো করার জন্য নিজেকে বাতাস করুন।
  • ঘন ঘন স্নান করুন,বিশেষ করে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে।
  • তাজা ফল এবং সবজির প্রাকৃতিক রস পান করুন।সেগুলি প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করবে এবং তার সাথে আবার আপনাকে শীতলও রাখবে।প্যাকেটজাত ফলের রস,যেগুলিতে প্রচুর মিষ্টি অতিরিক্ত যোগ করা থাকে এবং সোডা জাতীয় পানীয় পান করা এড়িয়ে চলুন।
  • ত্বকের উপর খুব বেশী মেকআপ করবেন না অথবা অত্যধিক তেল বা বডি লোশন প্রয়োগ করবেন না।এটিতে বায়ু চলাচল হতে দিন।
  • অ্যান্টিপার্স্পিরেন্টের প্রয়োগও ঘাম হওয়া হ্রাস করতে পারে।
  • লম্বা চুলও ঘাম হওয়ার সাথে যুক্ত হতে পারে।আপনার চুলগুলিকে বিনুনি করে রাখুন যাতে সেগুলি আপনার সারা চোখেমুখে ছড়িয়ে না পড়ে।

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ঘাম থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে?

কখন আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা উচিত?

যদি অস্বাভাবিক ঘাম হওয়ার সাথে অতিরিক্ত জ্বর,ধড়ফড়ানি অথবা দ্রুত হৃদস্পন্দন সংযুক্ত থাকে তবে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে আলোচনা করুন।ভীষণ ভাবে ঘেমে যাওয়া,ক্যান্সার অথবা লিউকেমিয়ার মত গুরুতর অসুখের লক্ষণ হতে পারে।আপনার ভোগ করা যেকোনও ধরনের অস্বস্তিকে আপনার ডাক্তারবাবুকে জানান।আপনার ডাক্তারবাবুই সিদ্ধান্ত নেবেন যে আপনার ঘাম হওয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আপনার কোনও পরীক্ষা করানোর অথবা ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা।

গর্ভাবস্থায় ঘাম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।এটি একটা সময় অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে,তবে এটি এমন একটি জিনিস যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।অস্বাভাবিক ঘেমে যাওয়াকে হ্রাস করতে এবং এটির দ্বারা আপনি অত্যধিক প্রভাবিত হবেন নাএই ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করতে আপনি প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন।