গর্ভাবস্থা

গর্ভাবস্থায় ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি-কারণ এবং প্রতিকারসমূহ

গর্ভবতী মহিলারা সাধারণত তাদের ত্বক কতটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এবং তাদের চুলগুলি আগের তুলনায় কতটা ভাল বলে মনে হচ্ছে এ ধরনের মন্তব্যগুলি পেয়ে থাকেন।শরীরের জৈব রসায়নের বিকাশ শেষ পর্যন্ত মহিলার দেহের অভ্যন্তরে এবং তার পাশাপাশি বাইরেও তার ফলাফলের ক্ষেত্র তৈরী করে।কিন্তু সেগুলির সবগুলিকেই স্বাগত জানানো হয় না।প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থায় চোখের তলায় কালি পড়া হল সেইগুলির মধ্যে এমন একটি বিষয় যা একজন গর্ভবতী মহিলার স্বচিত্রকে নাশ করার প্রবণতা থাকে যেটি আপনার মধ্যে হয়ত থাকতে পারে।নিশ্চিত থাকুন,সেগুলিকে সঠিক ভাবে হ্রাস করার উপায় রয়েছে।

গর্ভাবস্থায় আপনার কি ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পড়তে পারে?

হ্যাঁ,আপনি গর্ভবতী হলে আপনার চোখের তলায় কালি পড়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, যেটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি পরিচিত বিষয়,যাকে সাধারণত মেলাসমা বলা হয়ে থাকে।সাধারণ ব্যক্তির পরিভাষায় গর্ভাবস্থাকালীন মুখোশ বা প্রেগনেন্সি মাস্ক হিসেবে বর্ণিত,এটি সাধারণত হয়ে থাকে যখন ত্বকের মেলানিন মুখের উপরে জমতে শুরু করে একটি মুখোশের আদলে।বেশীরভাগ সময়েই,এই পিগমেন্টেশনটি চোখের তলার অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়ে শেষ হয়,যার ফলে সেখানে ডার্ক সার্কেল গড়ে ওঠে।

গর্ভবতী হওয়ার পর ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পড়ার কারণগুলি কি?

যদিও চোখের তলায় কালি পড়ার প্রাথমিক কারণগুলির মধ্যে একটি হল পিগমেন্টেশন,তবুও এছাড়াও আরও এক গুচ্ছ অন্যান্য কারণও আছে যেগুলি এটির জন্য বেশ ভাল মত দায়ী।

1.হরমোন প্রণোদিত রক্তবাহের প্রসারণ

একজন গর্ভবতী মহিলার দেহে বিভিন্ন হরমোনের মাত্রার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে,যা শরীরের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে শেষ হয়।এর প্রভাবগুলির মধ্যে একটি রক্তবাহের উপর পড়ে এবং সেটি আরও বেশি পরিমাণে রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে। এই কারণেও প্রচুর পরিমাণে রক্ত এই অঞ্চলে একত্রিত হয়ে জমে ওঠে,সেই কারণে অঞ্চলটি ডার্ক সার্কেলের অনুরূপ ঘন লাল হয়ে ওঠে

2.অনুশীলনের অভাব

একজন স্বাস্থ্যকর ব্যক্তির রক্তের রঙ সাধারণত উজ্জ্বল লাল বর্ণের হয়ে থাকে।কারণ ভাল রক্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন বহন করে এটিকে স্বাস্থ্যকর করে তোলে।অলসতা বা ব্যায়াম অনুশীলনের অনুপস্থিতি অথবা অভাবের কারণে অক্সিজেন সংশ্লেষ কমে গেলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে শুরু করে।এই কারণে এর রঙ বদলে নীলচেকাল হওয়ার দিকে যায়, যার ফলে ত্বকের উপর কালচে অঞ্চল গড়ে ওঠে।

3.অপর্যাপ্ত ঘুম

গর্ভবতী হোক কিম্বা না হোক প্রত্যেকেই জর্জরিত হয়ে ওঠে এমন কারণগুলির মধ্যে এটি একটি। চোখের তলায় কালি পড়ার একটি অন্যতম বড় কারণ হল ঘুমের অভাবে ভোগা,যেহেতু এটির কারণে ত্বক পুনরুদ্ধার এবং পুনর্নিমিত হতে যথেষ্ট সময় পায় না।এর ফলে চোখের উপর বেশ ভাল মত চাপ পড়ে যার পরিণতিতে চোখের তলায় কালি পড়ে যায়।

4.প্রদাহ

যখন শরীরের কোনও একটি অঞ্চলে প্রদাহ হয়ে থাকে,তখন প্রথমেই যেটি ঘটে তা হল রক্ত প্রবাহ কমতে শুরু করে।এই কারণে ঐ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে রক্ত থেকে যায়।সমস্ত রক্ত কোষের সম্মিলিত রঙ ঘনলালের অনুরূপ হতে পারে,যা ত্বকের উপর কাল রঙের মত দেখায়।

5.তরল ধরে রাখা

দেহে তরল ধারণ করে রাখা,একটি খুবই সাধারণ সমস্যা যা অনেক গর্ভবতী মহিলার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়।যদিও এটির ফলে সরাসরি ডার্ক সার্কেল নাও হতে পারে,তবে এটি অবশ্যই প্রদাহ হওয়ার পূর্বাভাস।প্রদাহযুক্ত অঞ্চলগুলির কারণে নির্দিষ্ট অঞ্চলে রক্ত ​​স্রোত বৃদ্ধি পায় যার ফলে ডার্ক সার্কেল সৃষ্টি হয়।

গর্ভবতী থাকাকালীন ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পড়ার চিকিৎসার জন্য পরামর্শ

এক গুচ্ছ দ্রুত ঘরোয়া প্রতিকার গর্ভবতী মহিলাদের ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পরার প্রতিকারে বেশ কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।

  • আপনি গর্ভবতী থাকাকালীন বায়ুপূর্ণ পানীয়গুলি পান করা এড়িয়ে চলুন।
  • ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবারগুলিকে বেছে নিন।
  • তাজা দুধের ক্রীম ব্যবহার করুন এবং দ্রুত ফল পেতে সেটিকে চোখের তলায় প্রয়োগ করুন।
  • চোখের নিচে কাঁচা আমণ্ড তেল প্রয়োগ করুন এবং সেটিকে সারারাত ধরে রেখে দিন।
  • পুদিনা পাতাকে থেঁতো করে নিয়ে তার রসটিকে নিঃসৃত করে নিন এবং সেটিকে টমেটোর রসের সাথে মিশ্রিত করুন আপনার মুখমন্ডলের উপর দ্রুত প্রয়োগ করার জন্য।
  • আপনার চোখের নিচে ঠাণ্ডা টি ব্যাগ রাখাও এক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
  • উন্নত মানের গোলাপ জল বিস্ময়কর ভবে কাজ করার জন্য পরিচিত।
  • চাপ হ্রাস করতে ধ্যান এবং ব্যায়াম অনুশীলন করুন।
  • কাঁচা আলুর টুকরোগুলি শসার টুকরোগুলির পরিপূরক হতে পারে
  • ডার্ক সার্কেল বা কাল ছোপ অপসারিত করতে ত্বকের ব্লিচ ব্যবহার করবেন না কারণ এটি আরও ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।

ঘরে প্রস্তুত সহজ ফেস মাস্ক যা আপনি ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারেন ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পড়া থেকে মুক্তি পেতে

ফেস মাস্কগুলি হল সর্বোত্তম প্রতিকার যা একজন গর্ভবতী মহিলা বেছে নিতে পারেন দ্রুত ডার্ক সার্কেল হ্রাস করার জন্য এবং তার সাথে আবার পুনরায় তার ত্বকের ঔজ্জ্বল্য ফিরে পাওয়ার জন্যও।

1. হলুদ এবং চন্দন কাঠের মাস্ক

এই মাস্কটি কেবলমাত্র ত্বকের ট্যানিং হ্রাস করা এবং মুখমন্ডলের ঔজ্জ্বল্য পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্যই একটি দুর্দান্ত প্রতিকার হিসেবে কাজ করে না,এর উপাদানগুলির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলি আবার একটি স্বাস্থ্যকর সংযোজনও বটে।

কীভাবে প্রস্তুত করবেন

Related Post
  • একটি বাটি নিয়ে তার মধ্যে চন্দনকাঠের গুঁড়োর সাথে হলুদ গুঁড়ো মিশ্রিত করুন।
  • এটি মিশ্রিত করার পর এর সাথে কিছুটা মধু যোগ করে সেগুলিকে সঠিক ভাবে নেড়ে নিন যাতে একটি সম্পৃক্ত মসৃণ পেস্ট তৈরী হয়।এর গন্ধও চমৎকার এবং দেহের যেকোনও বাহ্যিক অংশে ব্যবহার করা যেতে পারে।

কীভাবে ব্যবহার করবেন

  • এই পেস্টের থেকে কিছুটা অংশ আপনার আঙুলে তুলে নিন এবার সেটিকে আপনার ত্বকের কালো হয়ে যাওয়া অঞ্চলটির উপর প্রয়োগ করুন।
  • এরপর সেই পেস্টটিকে ত্বকের উপর শুকিয়ে যেতে দিন এবং সেটিকে ত্বকের উপর মোটামুটি 15-20 মিনিটের জন্য রেখে দিন।
  • তারপর মুখ ধুয়ে ফেলুন,আর ত্বককে শুকিয়ে নিন এবং তার উপর কিছুটা ময়েশ্চারাইজার প্রয়োগ করুন।
  • ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালিকে হ্রাস করার জন্য এটি নিয়মিত নিয়ম করে চালিয়ে যান।

2. পেঁপে নির্ভর মাস্ক

পেঁপের উপাদানগুলি ত্বকের পিগমেন্টেশন হ্রাস করার জন্য পরিচিত,যা এটিকে মহিলাদের জন্য একটি দুর্দান্ত মাস্ক হিসেবে গড়ে তুলেছে।

কীভাবে প্রস্তুত করবেন

  • একটি প্লেট অথবা বাটির মধ্যে পাকা পেঁপের কয়েক টুকরো নিন।
  • এরপর এর সাথে কিছুটা মধু এবং অ্যালোভেরার শাঁস যোগ করুন।সেগুলি সব ভাল ভাবে মিশ্রিত করতে থাকুন যতক্ষণ না একটি মিহি পেস্ট গড়ে ওঠে।

কীভাবে ব্যবহার করবেন

  • আপনার আঙুলে করে এর কিছুটা তুলে নিন এবং প্রভাবিত এলাকার উপর সেটিকে প্রয়োগ করুন।
  • এবার এটিকে ত্বকের উপর 15-20 মিনিটের জন্য রেখে দিন কারণ এটি ত্বককে শীতল করে।
  • মুখটি পরিষ্কার জলে ধুয়ে নিয়ে সেটিকে হালকা করে চাপড় মেরে শুকিয়ে নিন।
  • সপ্তাহে তিন বার এর পুনরাবৃত্তি করুন অথবা দ্রুত ফল পেতে আপনি নিয়মিত ভিত্তিতেও এটিকে ব্যবহার করতে পারেন।

3. শসা নির্ভর মাস্ক

শসা এবং লেবুর সমন্বয়,ব্যবহারযোগ্য একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফেস মাস্ক হিসেবে সুপরিচিত।

কীভাবে প্রস্তুত করবেন

  • একটি শসাকে সঠিক ভাবে ঘষে বা কুঁড়ে নিয়ে সেটিকে চিপে নিয়ে তার রসটিকে একটি বাটির মধ্যে নিন।
  • এবার বাটিটির মধ্যে কিছুটা লেবুর রস মিশ্রিত করে সেটিকে ভাল ভাবে একসাথে নেড়ে নিন।

কীভাবে ব্যবহার করবেন

  • কয়েকটি তুলোর টুকরো নিয়ে সেগুলিকে বাটিটির মধ্যে ডুবিয়ে দিন।
  • এবার সেগুলিকে সামাণ্য চিপে নিয়ে চোখের উপর রাখুন এবং সেগুলিকে সেখানে 10-15 মিনিটের জন্য রেখে দিন।
  • পরে সেগুলিকে সরিয়ে দিয়ে মুখটিকে ধুয়ে নিন,প্রত্যহ এটির পুনরাবৃত্তি করুন।

গর্ভাবস্থায় চোখের তলা্য় কালি পড়াকে কি প্রতিরোধ করা যায়?

এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি উপায় আছে যেগুলির দ্বারা আপনি গর্ভাবস্থায় ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পড়ার সম্ভাবনাকে হ্রাস করতে পারেন।

  • প্রত্যহ পর্যাপ্ত জল পানের মাধ্যমে আপনি হাইড্রেট থাকুন এবং ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে রাখুন।
  • চোখগুলিকে উজ্জ্বল করে তোলার জন্য ঠাণ্ডা তোয়ালেকে চোখের উপরে স্থাপন করুন।
  • ঘুমানোর আগে চোখের উপরে ঠাণ্ডা শসা এবং লেবু স্থাপন করুন।
  • নিয়মিত গর্ভাবস্থার উপযোগী ব্যায়াম করুন।

কখন একজন ডাক্তারকে ডাকবেন?

ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলায় কালি পড়া আবার থাইরয়েডের সমস্যা অথবা এমনকি অ্যানিমায়ারও একটি লক্ষণ হতে পারে।এই কারণের জন্যই এটি হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একবার ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করিয়ে নিন।যদি ডার্ক সার্কেলগুলি জ্বালা জ্বালা করতে শুরু করে,ত্বক নমনীয় ও লাল হয়ে ওঠে এবং এমনকি রক্তপাত হতে শুরু হয়,তৎক্ষণাৎ আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

গর্ভাবস্থায় চোখের তলায় কালি পড়া সেই বিষয়গুলির মধ্যে পড়ে না যা একজন মহিলা তার জীবনের সবচেয়ে সেরা পর্যায়ে প্রত্যাশা করে থাকেনযদিও এটি হতে পারে বিভিন্ন চিকিৎসাগত কারণের জন্য,তবে জীবনযাত্রার পছন্দগুলিও এই একই ফল প্রকাশ করতে পারে।সংশ্লিষ্ট যথাযথ ব্যায়াম অনুশীলন এবং নিজেকে উপযুক্তভাবে হাইড্রেট ও আনন্দে রাখার মাধ্যমে প্রায় কোনও রকম সময় ব্যাতীতই এই সকল ডার্ক সার্কেল বা চোখের তলার কালিগুলি বিলীন হয়ে যাবে।

Share
Published by
দেবশ্রী ব্যানার্জী